Ajker Patrika

রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে আনারস পাকিয়ে অমৌসুমে বাজারজাত, স্বাস্থ্যঝুঁকি 

আনোয়ার সাদাৎ ইমরান, টাঙ্গাইল
Thumbnail image

মো. খোরশেদ আলম একটি কীটনাশক কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার। পাঁচ বছর ধরে টাঙ্গাইলের মধুপুরে কর্মরত থাকলেও পাঁচটি আনারসও কিনে বাসায় নেননি তিনি। চোখের সামনে দফায় দফায় মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ দেখে আনারস খাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন ওই কর্মকর্তা। খোরশেদ আলমের ভাষায়, ‘মধুপুরের আনারস খাওয়া মানে আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়া। পরিবারের বিপদ ডেকে আনা।’ 

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশন সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান মো. আবু জুবাইর বলেন, ‘মধুপুরে আনারস নিয়ে কয়েকবার গবেষণা করা হয়েছে। এতে বিষাক্ত দ্রব্য ব্যবহারের বিষয়টি ধরা পড়েছে। ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করা আনারস নিয়মিত খেলে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। গর্ভবতী মা ও গর্ভের সন্তানের বিপদ ডেকে আনবে। প্রতিবন্ধী সন্তান হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।’ 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মধুপুরের ইদিলপুর গ্রামে ১৯৪২ সালে প্রথম আনারস চাষ শুরু হয়। বর্তমানে ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টরে আনারস আবাদ হচ্ছে। মধুপুরে হানিকুইন, জায়ান্ট কিউ ও জল ডুগি জাতের আনারস আবাদ হলেও এমডি-২ জাতের ভিনদেশি আনারস পরীক্ষামূলকভাবে চাষ হচ্ছে। এই আনারস মধুপুর থেকে প্রতিদিন ট্রাকযোগে সারা দেশে বিপণন হয়। 

গাজীপুর কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে জানা গেছে, মধুপুরে সুস্বাদু আনারসে ১৯৯৭ সালে প্রথম হরমোন প্রয়োগ করে অমৌসুমে আনারস উৎপাদন শুরু করেন এই ইনস্টিটিউটের কৃষি বিজ্ঞানী মো. নাজিম উদ্দিন। ধীরে ধীরে এর প্রয়োগ ও ব্যবহার বাড়তে বাড়তে লাগামহীন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় দুই শতাধিক প্রতিনিধি কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করিয়ে স্বল্প সময়ে আনারস বাজারজাতের উপযোগী করছে। কৃষকেরা আনারস বিপণন করার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে অন্তত পাঁচবার মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগের ফলে ভেষজগুণ সম্পন্ন আনারস মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদানে পরিণত হচ্ছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধুপুরের এক কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘যেখানে প্রতি ১৬ লিটারে ৫০ মিলি রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করার কথা। সেখানে ১৬ লিটার পানিতে দুই তিন বোতল মানে ২০০-৩০০ মিলি মিশিয়ে আনারসে প্রয়োগ করছেন চাষিরা।’ 

জানা যায়, আনারসের চারা সতেজ ফলবতী হওয়ার উপযোগী হলেই ধারাবাহিকভাবে রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ শুরু হয়। আনারসের চারায় সিঁদুর রঙের আনারস বেরিয়ে এলে বড় করার জন্য দফায় দফায় চলে কোম্পানি ভেদে ভিন্ন নামের রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার। এতে অল্প সময়ের মধ্যে আনারসের আকার বড় হয়ে ওঠে। এ ছাড়া হরমোন প্রয়োগ করা আনারস স্বাভাবিকভাবে পাকে না। তাই কৃষকেরা ইচ্ছামতো বাজারদর উঠানামার ওপর নির্ভর করে সাধারণ ডোজের কয়েকগুণ বেশি রাসায়নিক দ্রব্য প্রয়োগ করে আনারস পাকিয়ে থাকেন। 

মধুপুর উপজেলা কৃষি কার্যালয় জানায়, বর্তমানে মধুপুর উপজেলার ২৬টি পাইকারি ও ১৬২টি খুচরা রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান আছে। দেশি-বিদেশি ৭০টি কোম্পানি ওই ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে আনারসে প্রয়োগের জন্য রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রি করে। 
 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মধুপুর উপজেলা পেস্টিসাইড অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক সদস্য জানান, বছরে অন্তত ৭২ কোটি টাকার রাসায়নিক দ্রব্য বিক্রি হয় মধুপুরে। 

মধুপুরের লাউফুলা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, চাষি ফজলুর রহমানসহ দুই শ্রমিক মিলে আনারস বাগানে রাসায়নিক দ্রব্য ছিটাচ্ছেন। রাসায়নিক দ্রব্য যাতে রোদের তাপে শুকিয়ে না যায় এ জন্য কলার পাতা দিয়ে আনারসগুলো ঢেকে দিয়েছেন। সেই পাতা সরিয়ে রাসায়নিক দ্রব্য ছিটানোর পর আবারও ঢেকে দিচ্ছেন। অমৌসুমের ক্যালেন্ডার জাতের আনারসে এখনই রাসায়নিক দ্রব্য ছিটাচ্ছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে ফজলুর বলেন, ‘ক্যালেন্ডার না, জল ডুগি আনারসে একটি কোম্পানির রাসায়নিক দ্রব্য ছিটাচ্ছি। বড় হওয়ার ওষুধ দেওনে জল ডুগি আনারসই একটু বেশি বড় হইছে। তাই পাকানোর ওষুধ দিতাছি।’ 

উপজেলার ইদিলপুর আনারস চাষি সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, ‘আনারস সাধারণত বর্ষা মৌসুমের ফসল। বর্ষা মৌসুমে পরিবহন, বিপণন সমস্যার পাশাপাশি ভোক্তাও কম থাকে। তাই পাঁচ-ছয়বার মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে মৌসুমের আগেই আনারস বাজারে তুলছে কতিপয় কৃষক। এতে আনারসের স্বাদ, গন্ধ, ঐতিহ্য সবই নষ্ট হচ্ছে। মধুপুরে ফল গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করলে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হতো।’ 

মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল বলেন, ‘আনারসের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করার জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করেছি। কৃষক, ব্যবসায়ী, সুধিমহলকে নিয়ে একাধিক সভা করছি। আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত