Ajker Patrika

রক্তাক্ত ৪ আগস্ট: গুলিতে ঝরে যায় সাত তরুণের প্রাণ

ফেনী প্রতিনিধি
ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, সরওয়ার জাহান মাসুদ, মো. সবুজ, ছাইদুল ইসলাম শাহী ও জাকির হোসেন শাকিব, ওয়াকিল আহম্মদ শিহাব ও মাহবুবুল হাসান মাসুম (ওপরের সারি, বাম থেকে)। ছবি: সংগৃহীত
ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, সরওয়ার জাহান মাসুদ, মো. সবুজ, ছাইদুল ইসলাম শাহী ও জাকির হোসেন শাকিব, ওয়াকিল আহম্মদ শিহাব ও মাহবুবুল হাসান মাসুম (ওপরের সারি, বাম থেকে)। ছবি: সংগৃহীত

৪ আগস্ট ২০২৪, শ্রাবণের শেষ বিকেল। ফেনীর মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করছিল হাজারো ছাত্র-জনতা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে জড়ো হয়েছিল তারা। হাতে ছিল লাল-সবুজের পতাকা, চোখে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্লাইওভার এলাকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। হঠাৎ গুলির শব্দে গর্জে ওঠে পুরো এলাকা। মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হয় রাজপথের নীরবতা। গুলিতে লুটিয়ে পড়েন ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ, সরওয়ার জাহান মাসুদ, মো. সবুজ, ছাইদুল ইসলাম শাহী, জাকির হোসেন শাকিব ও ওয়াকিল আহম্মদ শিহাব। গুলিবিদ্ধ হন শিক্ষার্থী মাহবুবুল হাসান মাসুম। পরে ৭ আগস্ট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মহিপাল এলাকায় সব স্তব্ধ হয়ে যায়। বাতাসে বারুদের গন্ধ, রাস্তায় রক্ত আর পড়ে থাকা জুতা-স্যান্ডেল হয়ে ওঠে নৃশংসতার নীরব সাক্ষী।

শহীদ ইসতিয়াক আহমেদ শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার বলেন, ‘ও মাথায় আমার ওড়না পেঁচিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিল। এক বছরের মাথায়ও আমরা তার মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছি না। মেয়েটা (শ্রাবণের বোন) ভাইয়ের শোকে কারও সঙ্গে কথাও বলে না।’

শহীদ শাহীর মা রাহেনা বেগম বলেন, ‘শাহী বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ২৫ টাকা চেয়েছিল। বলেছিল শহর থেকে ফেরার ভাড়া লাগবে। কিন্তু আর ফেরেনি।’

ওয়াকিল আহম্মদ শিহাবের মা মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘চুল কাটবে বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল। হয়তো বুঝেছিল, এবারই শেষ দেখা। বুকের মধ্যে তিনটা গুলি লেগে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল আমার সন্তান।’

মাহবুবুল হাসান মাসুমের ভাই মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘মামলায় কোনো অগ্রগতি নেই। যারা জামিনে বের হয়ে আসে, তাদের অনেকে প্রভাবশালীদের সহায়তায় বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে।’

আহত ব্যক্তিদের একজন নূর হোসেন। ফেনী ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। নূর বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা পাইনি। উল্টো হামলার মুখে পড়তে হয়।’

ঘটনার দিন ফেনী শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিষেধ করা হয়েছিল। ফেনী জেনারেল হাসপাতালে প্রথমে নেওয়া হয় শ্রাবণের লাশ। একে একে আসতে থাকে অন্যদের দেহও। হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।

মহিপালের হামলা ও হত্যার ঘটনায় মোট ২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা। এসব মামলায় ২ হাজার ১৯৯ জনের নাম রয়েছে এজাহারে। আরও ৪ হাজার অজ্ঞাতনামা আসামির কথা উল্লেখ রয়েছে। একমাত্র মাসুম হত্যা মামলায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফেনীর দুই সাবেক সংসদ সদস্য।

পুলিশ বলছে, ১৬৪ ধারায় ১১ জন আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অনেকে এখনো পলাতক। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তাঁদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

৪ আগস্টে ফেনীর মহিপালে গুলির দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, এক যুবক মহিপাল প্লাজার সামনে রিকশা থেকে নেমে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর আশপাশে অনেকের হাতে তখন দেশীয় অস্ত্র ও বন্দুক ছিল। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা পিছু হটলেও গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি।

সেদিন সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে অনেক সাংবাদিকও লাঞ্ছিত হয়েছেন। মোটরসাইকেল থামিয়ে তাঁদের মারধর করা হয়, ছিনিয়ে নেওয়া হয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল ফোন। সেদিন অন্তত ১০ সাংবাদিককে একটি ব্যাংক ভবনে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ফেনী জেলা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মুহাইমিন তাজিম বলেন, ‘শহীদদের রক্তের ওপর এ সরকার গঠিত। অথচ হত্যার বিচার হয়নি। আমরা দাবি করছি, বিচার দ্রুত সম্পন্ন হোক।’

ফেনীর পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনায় ২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৪ আগস্টে ফেনীর মহিপালে নিহত মাহবুবুল হাসান মাসুম হত্যার ঘটনায় ২২১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এমপি নিজাম হাজারীকে নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, তদন্তে যাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাঁরাই চার্জশিটে রয়েছেন। এখানে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় আনা হয়নি। অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাঁরা বিদেশে আছেন, তাঁদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ফেনীতে হতাহতের সংখ্যা অন্য জেলার তুলনায় বেশি ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহায়তা দিতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি।’

জেলা প্রশাসকের দাবি, এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫ কোটি টাকার সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইউটিউবে ১০০০ ভিউতে আয় কত

বাকৃবির ৫৭ শিক্ষকসহ ১৫৪ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা

বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারে সরকার, ভয়ে কলকাতায় দিলীপ কুমারের আত্মহত্যা

স্ত্রী রাজি নন, সাবেক সেনাপ্রধান হারুনের মরদেহের ময়নাতদন্ত হবে না: পুলিশ

সাবেক সেনাপ্রধান হারুন ছিলেন চট্টগ্রাম ক্লাবের গেস্ট হাউসে, দরজা ভেঙে বিছানায় মিলল তাঁর লাশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত