রেজওয়ান তানিম
এই তো দিন তিনেক আগে বেশ কয়েকটি দৈনিকে মোটামুটি গুরুত্ব দিয়েই ছাপা হয় সংবাদটি। বিষয়টা আকস্মিক বলে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারে না। পত্রিকা অফিসে ফোন করে নিশ্চিত হতে চায়, সত্যি ঘটনাটা ঘটেছে কি না।
নিশ্চিত করে জানবার পর সকলেই শোক প্রকাশ করতে থাকে।
পত্রিকায় সকালে এলেও রাত তিনটার দিকে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে টিভিতে প্রথম সংবাদটা আসে। সংবাদটা হলো ‘নন্দিত লেখক রাশেদ আহমেদুল হকের মহাপ্রয়াণ’। দ্রুতই খবরটা বাকি চ্যানেলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।
সর্বসাধারণে না হলেও সচেতন পাঠকের কাছে নাম পৌঁছেছে অনেককাল আগেই। লেখার ভিন্নতর বয়ানভঙ্গির জন্য সমালোচকদেরও মুগ্ধ করেছেন তিনি। অগুনতি মানুষ না হলেও তাঁর পাঠকেরা স্বাভাবিকভাবেই শোকার্ত হয়।
চিরকুমার লোকটির প্রয়াণে ফেসবুকে প্রচুর স্ট্যাটাস দেখা যায়। কেউ কেউ তাঁর স্মরণে কাঁদেন, বলেন, ‘আহা এমন নির্বিবাদী লোক এ যুগে বিরল, কখনো খ্যাতির পেছনে দৌড়াননি।’
বিতর্কিত সমালোচকেরা স্বভাবসুলভ উপায়ে এই সময়টাও নিজেকে জাহির করতে কাজে লাগালেন। ফেসবুকে গুনে গুনে চারটা শব্দের স্ট্যাটাস দিলেন, যাতে রাশেদ আহমেদুল হক–এই তিন শব্দের সঙ্গে ছিল একটি ইংরেজি শব্দ ‘অ্যাভারেজ’। অনেকেই তাঁকে খারিজ করলেও একটি পত্রিকায় আব্দুল মোনেম প্রশংসা করে লেখেন, ‘লেখায় নিজের আত্মা মিশিয়েছেন বলেই তা এত জীবন্ত, জলের মতো বহমান।’
রাশেদ আহমেদুল হক যখন মারা যান, তখন পুরো ঘর ছিল ফাঁকা। আর ফাঁকা বলেই বিষয়টা রহস্যের জন্ম দেয়। কেউ ভাবে হার্টফেল, কেউবা স্ট্রোক আবার যারা ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাসী, গুজব রটায় আত্মহত্যার। সাধারণ মানুষ থেকে পাঠক বা সমালোচক, সকল পক্ষই তাই পোস্টমর্টেমের ফলাফল জানার অপেক্ষায় থাকে।
অথচ সেই রাতে কেউ যদি ও বাড়িতে উপস্থিত থাকত, তবে লোকটা বেঁচেও যেতে পারত। উপস্থিত ব্যক্তিটি দেখতে পেত বিছানায় শুয়ে লেখক প্রচণ্ড মাথাব্যথায় কাতর।
এমন সময় শুনতে পাচ্ছেন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। বাইরের দরজায় এ যুগে বেল না বাজিয়ে কেই-বা এমন করে, ভাবেননি রাশেদ সাহেব। শুরুতে কানে লাগা মৃদু ধ্বনি ক্রমে বাড়তে থাকে। সহকারী আব্দুল নোমানকে বার দু-তিন ডাক দেবার পরেও সাড়া মেলে না। শেষে মনে পড়ে ছুটিতে আছে সে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর কাছে এখন আছে জহরপুরে।
দরজার শব্দ বাড়তে থাকে আর গলা চড়ে রাশেদ সাহেবের। রহিমার মা, রহিমার মা ডাকে সাড়া মেলে না যথারীতি। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে থাকা লেখকের মনে থাকে না, সন্ধ্যের পর রহিমার মা ঘরে ফিরে যায়।
মিনিট দশেক পর বহু কষ্টে উঠে দরজার দিকে আগান। খুলে দিলে দেখতে পান, কালো টি-শার্ট আর নেভি ব্লু জিনস প্যান্ট পরা অস্থিরমুখো একটা লোকের পায়চারি।
দেখামাত্র যেন সমস্ত পীড়া চলে যায় আর হেসে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি এলে?’
লোকটা রাশেদ সাহেবের উচ্ছ্বাসকে প্রশ্রয় দেয় না। তাকে চিন্তিত দেখায়। মুখে সামান্য হাসির ভাব এনে ঘরে ঢোকে, ধরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় রাশেদ সাহেবকে।
ভ্রু কুঁচকানো অবস্থায় কপালে হাত রাখে।
জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে লেখকের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন আর সামান্য বাকি থাকা নিজের শেষ লেখাটি লিখছেন মৃত্যুপূর্ব সময়ে, পাগলাটে এক ঘোরগ্রস্ততায়। বিড়বিড় করে আওড়ানো পুরোনো কথকতা থামবার নয়। সবটা জুড়ে লোকটা, চলতে থাকে আটত্রিশ বছর আগের স্মৃতিচারণা।
সেদিনও ছিল বৃষ্টিমুখর, ঠিক আজকের আষাঢ় রাতটা যেমন। ঝকঝকে রোদ, আলো ওঠা দিন অথচ একটু পরেই কালো আকাশ—সবাইকে আশ্চর্য করে ঝরতে শুরু করল বৃষ্টি। কয়েক ঘণ্টা ধরে ঝরা বেয়নেট বৃষ্টির ফোঁটাগুলোয় সব যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। এমন আলসে দিনে পাশবারান্দায় বসে রাশেদ সাহেবের অবসরের গান গাওয়া, ব্যাপারটা মন্দ নয়।
একটু পরে সে এল। কালো রঙের চেক শার্ট, সঙ্গে বেলবটম প্যান্ট; নিতান্ত সাদামাটা পোশাক তার। রাশেদ আহমেদুল তখন লেখালেখি শুরু করেছেন কেবল। লোকটাকে দেখে বললেন—
আপনি কে? আপনাকে আগে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।
লোকটা উত্তর না দিয়ে হাসল। উল্টো পাশে রাখা বেতের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে।
রাশেদ উত্তর না পেয়ে বেশ বিরক্ত হলেন। লোকটাকে ঢুকতে দিল কে, সেটা ভেবেও বিরক্তবোধ করছিলেন। তখন তিনি গলায় রাগের ভাব তুলে বললেন—কথা বলছেন না কেন? কে আপনি, কী চান এখানে?
তখন লোকটা হাসল, বেশ এক আমুদে হাসি। তারপর বলল—চিনতে পারছেন না? আপনিই তো আমাকে ডেকে আনলেন। কী নিয়ে যেন আলাপ করবেন বলেছিলেন।
রাশেদ একটু যেন থমকে গেলেন। এরপর বিস্ময় নিয়ে বললেন—আপনিই কি সে?
লোকটা মাথা নাড়ল। রাশেদ প্রশ্ন করতে মুখ খোলার আগেই তাঁকে ইশারায় থামিয়ে দিল লোকটি। রাশেদ তখনো তরুণ, দেশের নামকরা কথাশিল্পী নন। তবে ঠিক বুঝতে পারছেন না, লেখায় নিয়মিত হবেন কি না।
এই পোড়া দেশে লেখক হবার চেয়ে কুকুরজন্মও যে ঢের সুখের, সে কথা তো শরৎবাবু বহু আগেই বলে গেছেন। তবুও কি এই অজানায় ঝাঁপ দেয়া ঠিক হবে?
রাশেদের না করা প্রশ্নকে ‘জানি’ বলে থামিয়ে দেবার পর, উত্তর না দিয়ে লোকটা গল্প শুরু করল। বিষয় অতি সাধারণ, বৃষ্টিতে ভিজবার গল্প। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। ঝমঝম বৃষ্টিতে লোকটার কথারা ছিল যেন শনশন হাওয়া, যাকে বলে মাতাল বাতাস। অনেক কথার শেষে যাবার আগে সে বলে গেল—
তুমি না জানলেও, মন ঠিকই জানে কী চায় সে। প্রশ্ন করো না মনের কাছে, ঝাঁপ দেবে কি না অতল আগুনে। নিজের কবর নিজেই খুঁড়লে, খারাপ কী? সবাইকেই তো সেখানে যেতে হবে, তুমি না হয় নিজেই তার ব্যবস্থা করলে।
দরজা বন্ধ করে ফিরে এলেন রাশেদ। জানলা দিয়ে দেখছেন ওর চলে যাওয়া। মিনিট দশেক পর দরজায় আওয়াজ। সে ফিরে এসেছে আবার। রাশেদের হাতে একটা কলম তুলে দিয়ে বলল, তোমার জন্যে, ভুলে গিয়েছিলাম দিতে। ভালো থেকো। কোনো সমস্যা হলে ডেকো, চলে আসব যত দ্রুত পারি।
কলমটা এত বছরেও হাতছাড়া হয়নি রাশেদের, বিড়বিড় করে বলতে থাকেন লোকটাকে। কী এক অদ্ভুত গর্বে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর মুখ। লোকটা ওর মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করে, যদিও তাতে তেমন কাজ হয় না। ব্যথাটা বাড়তে থাকলে হাত বাড়িয়ে লোকটাকে স্পর্শ করতে চান রাশেদ আহমেদুল হক। কিন্তু তা আর হয় না। মৃত্যুপথযাত্রী রাশেদের মতো লোকটাও বুঝতে পারে, সময় শেষ, ডাক এসেছে ওপারের। কিছুক্ষণ পর বিছানায় এলিয়ে পড়ে নিথর হাতটা।
চোখের পাপড়িগুলো কিছু একটা বেরিয়ে যাবার অযাচিত বেদনা কী করে যেন অনুভব করে। আর প্রায় সাথে সাথেই দুজনে লিপ্ত হয় জীবনের শেষ আলিঙ্গনে, যা থেকে জেগে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।
মৃত্যুর আগে রাশেদ আহমেদুল টের পান লোকটার চলে যাওয়া। ‘সে’ চলেছে অনন্তের পথে। কিছুক্ষণ আগে পার্থিব সবকিছু থেকে বিদায় নেয়া রাশেদের মনে হয়তো লোকটার সেই কালো শার্ট আর বেলবটম প্যান্টে আটত্রিশ বছর আগের অবয়বে হাজির হওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। মৃত্যু নিকটে বলেই হয়তো ছায়াহীন অবয়বটির মানুষ হওয়া নিয়েও তার মনে কোনো প্রশ্ন ছিল না।
কিন্তু প্রথম দিনের উজ্জ্বল স্মৃতি, মেঘমেদুর বর্ষাদিনের অমন সুখময় দিনেও ঝুমবৃষ্টিতে বর্ষাতি ছাড়া ঘরে ঢুকে পড়া লোকটার গায়ে বৃষ্টির ছাঁট না থাকা কেন রাশেদ আহমেদুল হকের মতো লেখকের মনে প্রশ্ন জাগায় না—সেটা এখনো আমাদের মতো পাঠকদের জন্য বিস্ময়ের বৈকি!
এই তো দিন তিনেক আগে বেশ কয়েকটি দৈনিকে মোটামুটি গুরুত্ব দিয়েই ছাপা হয় সংবাদটি। বিষয়টা আকস্মিক বলে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারে না। পত্রিকা অফিসে ফোন করে নিশ্চিত হতে চায়, সত্যি ঘটনাটা ঘটেছে কি না।
নিশ্চিত করে জানবার পর সকলেই শোক প্রকাশ করতে থাকে।
পত্রিকায় সকালে এলেও রাত তিনটার দিকে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে টিভিতে প্রথম সংবাদটা আসে। সংবাদটা হলো ‘নন্দিত লেখক রাশেদ আহমেদুল হকের মহাপ্রয়াণ’। দ্রুতই খবরটা বাকি চ্যানেলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।
সর্বসাধারণে না হলেও সচেতন পাঠকের কাছে নাম পৌঁছেছে অনেককাল আগেই। লেখার ভিন্নতর বয়ানভঙ্গির জন্য সমালোচকদেরও মুগ্ধ করেছেন তিনি। অগুনতি মানুষ না হলেও তাঁর পাঠকেরা স্বাভাবিকভাবেই শোকার্ত হয়।
চিরকুমার লোকটির প্রয়াণে ফেসবুকে প্রচুর স্ট্যাটাস দেখা যায়। কেউ কেউ তাঁর স্মরণে কাঁদেন, বলেন, ‘আহা এমন নির্বিবাদী লোক এ যুগে বিরল, কখনো খ্যাতির পেছনে দৌড়াননি।’
বিতর্কিত সমালোচকেরা স্বভাবসুলভ উপায়ে এই সময়টাও নিজেকে জাহির করতে কাজে লাগালেন। ফেসবুকে গুনে গুনে চারটা শব্দের স্ট্যাটাস দিলেন, যাতে রাশেদ আহমেদুল হক–এই তিন শব্দের সঙ্গে ছিল একটি ইংরেজি শব্দ ‘অ্যাভারেজ’। অনেকেই তাঁকে খারিজ করলেও একটি পত্রিকায় আব্দুল মোনেম প্রশংসা করে লেখেন, ‘লেখায় নিজের আত্মা মিশিয়েছেন বলেই তা এত জীবন্ত, জলের মতো বহমান।’
রাশেদ আহমেদুল হক যখন মারা যান, তখন পুরো ঘর ছিল ফাঁকা। আর ফাঁকা বলেই বিষয়টা রহস্যের জন্ম দেয়। কেউ ভাবে হার্টফেল, কেউবা স্ট্রোক আবার যারা ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাসী, গুজব রটায় আত্মহত্যার। সাধারণ মানুষ থেকে পাঠক বা সমালোচক, সকল পক্ষই তাই পোস্টমর্টেমের ফলাফল জানার অপেক্ষায় থাকে।
অথচ সেই রাতে কেউ যদি ও বাড়িতে উপস্থিত থাকত, তবে লোকটা বেঁচেও যেতে পারত। উপস্থিত ব্যক্তিটি দেখতে পেত বিছানায় শুয়ে লেখক প্রচণ্ড মাথাব্যথায় কাতর।
এমন সময় শুনতে পাচ্ছেন দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। বাইরের দরজায় এ যুগে বেল না বাজিয়ে কেই-বা এমন করে, ভাবেননি রাশেদ সাহেব। শুরুতে কানে লাগা মৃদু ধ্বনি ক্রমে বাড়তে থাকে। সহকারী আব্দুল নোমানকে বার দু-তিন ডাক দেবার পরেও সাড়া মেলে না। শেষে মনে পড়ে ছুটিতে আছে সে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর কাছে এখন আছে জহরপুরে।
দরজার শব্দ বাড়তে থাকে আর গলা চড়ে রাশেদ সাহেবের। রহিমার মা, রহিমার মা ডাকে সাড়া মেলে না যথারীতি। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে থাকা লেখকের মনে থাকে না, সন্ধ্যের পর রহিমার মা ঘরে ফিরে যায়।
মিনিট দশেক পর বহু কষ্টে উঠে দরজার দিকে আগান। খুলে দিলে দেখতে পান, কালো টি-শার্ট আর নেভি ব্লু জিনস প্যান্ট পরা অস্থিরমুখো একটা লোকের পায়চারি।
দেখামাত্র যেন সমস্ত পীড়া চলে যায় আর হেসে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি এলে?’
লোকটা রাশেদ সাহেবের উচ্ছ্বাসকে প্রশ্রয় দেয় না। তাকে চিন্তিত দেখায়। মুখে সামান্য হাসির ভাব এনে ঘরে ঢোকে, ধরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় রাশেদ সাহেবকে।
ভ্রু কুঁচকানো অবস্থায় কপালে হাত রাখে।
জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে লেখকের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন আর সামান্য বাকি থাকা নিজের শেষ লেখাটি লিখছেন মৃত্যুপূর্ব সময়ে, পাগলাটে এক ঘোরগ্রস্ততায়। বিড়বিড় করে আওড়ানো পুরোনো কথকতা থামবার নয়। সবটা জুড়ে লোকটা, চলতে থাকে আটত্রিশ বছর আগের স্মৃতিচারণা।
সেদিনও ছিল বৃষ্টিমুখর, ঠিক আজকের আষাঢ় রাতটা যেমন। ঝকঝকে রোদ, আলো ওঠা দিন অথচ একটু পরেই কালো আকাশ—সবাইকে আশ্চর্য করে ঝরতে শুরু করল বৃষ্টি। কয়েক ঘণ্টা ধরে ঝরা বেয়নেট বৃষ্টির ফোঁটাগুলোয় সব যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। এমন আলসে দিনে পাশবারান্দায় বসে রাশেদ সাহেবের অবসরের গান গাওয়া, ব্যাপারটা মন্দ নয়।
একটু পরে সে এল। কালো রঙের চেক শার্ট, সঙ্গে বেলবটম প্যান্ট; নিতান্ত সাদামাটা পোশাক তার। রাশেদ আহমেদুল তখন লেখালেখি শুরু করেছেন কেবল। লোকটাকে দেখে বললেন—
আপনি কে? আপনাকে আগে কখনো দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।
লোকটা উত্তর না দিয়ে হাসল। উল্টো পাশে রাখা বেতের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাশেদের দিকে।
রাশেদ উত্তর না পেয়ে বেশ বিরক্ত হলেন। লোকটাকে ঢুকতে দিল কে, সেটা ভেবেও বিরক্তবোধ করছিলেন। তখন তিনি গলায় রাগের ভাব তুলে বললেন—কথা বলছেন না কেন? কে আপনি, কী চান এখানে?
তখন লোকটা হাসল, বেশ এক আমুদে হাসি। তারপর বলল—চিনতে পারছেন না? আপনিই তো আমাকে ডেকে আনলেন। কী নিয়ে যেন আলাপ করবেন বলেছিলেন।
রাশেদ একটু যেন থমকে গেলেন। এরপর বিস্ময় নিয়ে বললেন—আপনিই কি সে?
লোকটা মাথা নাড়ল। রাশেদ প্রশ্ন করতে মুখ খোলার আগেই তাঁকে ইশারায় থামিয়ে দিল লোকটি। রাশেদ তখনো তরুণ, দেশের নামকরা কথাশিল্পী নন। তবে ঠিক বুঝতে পারছেন না, লেখায় নিয়মিত হবেন কি না।
এই পোড়া দেশে লেখক হবার চেয়ে কুকুরজন্মও যে ঢের সুখের, সে কথা তো শরৎবাবু বহু আগেই বলে গেছেন। তবুও কি এই অজানায় ঝাঁপ দেয়া ঠিক হবে?
রাশেদের না করা প্রশ্নকে ‘জানি’ বলে থামিয়ে দেবার পর, উত্তর না দিয়ে লোকটা গল্প শুরু করল। বিষয় অতি সাধারণ, বৃষ্টিতে ভিজবার গল্প। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। ঝমঝম বৃষ্টিতে লোকটার কথারা ছিল যেন শনশন হাওয়া, যাকে বলে মাতাল বাতাস। অনেক কথার শেষে যাবার আগে সে বলে গেল—
তুমি না জানলেও, মন ঠিকই জানে কী চায় সে। প্রশ্ন করো না মনের কাছে, ঝাঁপ দেবে কি না অতল আগুনে। নিজের কবর নিজেই খুঁড়লে, খারাপ কী? সবাইকেই তো সেখানে যেতে হবে, তুমি না হয় নিজেই তার ব্যবস্থা করলে।
দরজা বন্ধ করে ফিরে এলেন রাশেদ। জানলা দিয়ে দেখছেন ওর চলে যাওয়া। মিনিট দশেক পর দরজায় আওয়াজ। সে ফিরে এসেছে আবার। রাশেদের হাতে একটা কলম তুলে দিয়ে বলল, তোমার জন্যে, ভুলে গিয়েছিলাম দিতে। ভালো থেকো। কোনো সমস্যা হলে ডেকো, চলে আসব যত দ্রুত পারি।
কলমটা এত বছরেও হাতছাড়া হয়নি রাশেদের, বিড়বিড় করে বলতে থাকেন লোকটাকে। কী এক অদ্ভুত গর্বে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর মুখ। লোকটা ওর মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করে, যদিও তাতে তেমন কাজ হয় না। ব্যথাটা বাড়তে থাকলে হাত বাড়িয়ে লোকটাকে স্পর্শ করতে চান রাশেদ আহমেদুল হক। কিন্তু তা আর হয় না। মৃত্যুপথযাত্রী রাশেদের মতো লোকটাও বুঝতে পারে, সময় শেষ, ডাক এসেছে ওপারের। কিছুক্ষণ পর বিছানায় এলিয়ে পড়ে নিথর হাতটা।
চোখের পাপড়িগুলো কিছু একটা বেরিয়ে যাবার অযাচিত বেদনা কী করে যেন অনুভব করে। আর প্রায় সাথে সাথেই দুজনে লিপ্ত হয় জীবনের শেষ আলিঙ্গনে, যা থেকে জেগে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।
মৃত্যুর আগে রাশেদ আহমেদুল টের পান লোকটার চলে যাওয়া। ‘সে’ চলেছে অনন্তের পথে। কিছুক্ষণ আগে পার্থিব সবকিছু থেকে বিদায় নেয়া রাশেদের মনে হয়তো লোকটার সেই কালো শার্ট আর বেলবটম প্যান্টে আটত্রিশ বছর আগের অবয়বে হাজির হওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। মৃত্যু নিকটে বলেই হয়তো ছায়াহীন অবয়বটির মানুষ হওয়া নিয়েও তার মনে কোনো প্রশ্ন ছিল না।
কিন্তু প্রথম দিনের উজ্জ্বল স্মৃতি, মেঘমেদুর বর্ষাদিনের অমন সুখময় দিনেও ঝুমবৃষ্টিতে বর্ষাতি ছাড়া ঘরে ঢুকে পড়া লোকটার গায়ে বৃষ্টির ছাঁট না থাকা কেন রাশেদ আহমেদুল হকের মতো লেখকের মনে প্রশ্ন জাগায় না—সেটা এখনো আমাদের মতো পাঠকদের জন্য বিস্ময়ের বৈকি!
নোবেলজয়ী পেরুভিয়ান সাহিত্যিক মারিও বার্গাস যোসা শুধু কথাসাহিত্যের জন্যই নন, মানবিকতা ও বিশ্ব রাজনীতির প্রতি গভীর মনোযোগের জন্যও পরিচিত। বাংলাদেশে এসিড হামলার শিকার নারীদের নিয়ে তাঁর লেখা হৃদয়বিদারক প্রবন্ধ ‘Weaker sex’ প্রমাণ করে, কীভাবে যোসার কলম ছুঁয়ে গিয়েছিল বাংলার পীড়িত নারীদের কান্না ও সংগ্রাম।
৬ দিন আগেনোবেলজয়ী পেরুভিয়ান সাহিত্যিক মারিও বার্গাস যোসা মারা গেছেন। স্থানীয় সময় গতকাল রোববার পেরুর রাজধানী লিমায় তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। তাঁর ছেলে আলভারো বার্গাস যোসা মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।
৬ দিন আগেমৃত্তিকাবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলমগীর হাইয়ের প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। শনিবার (১২ এপ্রিল) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা, ৫ নম্বর গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়।
৭ দিন আগেজর্জ দুহামেল ১৮৮৪ সালের ৩০ জুন প্যারিসের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার আর্থিকভাবে খুব একটা সচ্ছল ছিল না। তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। সব মিলিয়ে তাঁর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি খুব একটা সুখকর নয়; যা তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লে নতেয়্যাখ দু হ্যাভখ (Le Notaire du Havre) এ ফুটে ওঠে।
৭ দিন আগে