Ajker Patrika

প্রেম অথবা রহস্যগল্প

জাকির তালুকদার
আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২২: ০৮
Thumbnail image

এক ঘণ্টা আগেও জানতাম না অচেনা যুবতী আর আমি একই রাতে, একই সময়ে একই স্বপ্ন দেখেছি।

বেশির ভাগ স্বপ্ন মানুষ আর মনে রাখতে পারে না ঘুম ভেঙে গেলে। আর কিছু স্বপ্ন ঘুম ভাঙিয়ে মানুষকে জাগিয়ে রাখে পরের কয়েকটি দিন এবং রাত পর্যন্ত। তার মানে আর সবকিছুর মতো স্বপ্নের গুরুত্বেও অনেক তারতম্য আছে।

ফোনটা এল যখন আমি বিছানা না ছেড়ে স্বপ্নটার কথাই ভাবছি। স্ক্রিনে কোনো নাম বা নম্বর নেই। খুব অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয়। অনেক ভিআইপি বা গোয়েন্দা সংস্থার লোকের ফোন নম্বর ওঠে না স্ক্রিনে। তাই খুব বেশি অবাক না হলেও একটু সতর্ক হয়েই রিসিভ করতে হয়। কণ্ঠে যেন ঘুমের আমেজ না বোঝা যায়। মোটামুটি স্বাভাবিক কণ্ঠ, তবে সর্দি-লাগলে যেমন ভারী শোনায়, শেষের অক্ষরটির উচ্চারণ অস্পষ্ট হয়ে যায়, ঠিক সে রকম মনে হলো।

হ্যালো বলল না, কোনো সম্ভাষণ করল না, আমি রিসিভ বাটন চাপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বলল—মেয়েটির ফোন নম্বর বলছি শুনুন।

বললাম—একটু হোল্ড করুন। কাগজ-কলম নিয়ে আসি। লিখে রাখতে হবে। নইলে এগারোটা ডিজিট মনে রাখতে পারব না।

উত্তর এল—ভুলবেন না।

মানে? আপনি কি আমাকে নম্বরটি টেক্সট করে পাঠাবেন?

তারও দরকার নেই।

নম্বরটা বলা হলো আমাকে। তারপর সেই কণ্ঠ খুব আকুতি মিশিয়ে বলল—মনে রাখবেন আজ সূর্যাস্তের মধ্যেই আপনাদের দুজনকে করতে হবে কাজটি। নইলে কিন্তু সমূহ বিপদ! কোনো দ্বিধা রাখবেন না, প্লিজ। মনে কোনো সন্দেহ রাখবেন না। পৃথিবীর অস্তিত্ব নির্ভর করছে আপনাদের ওপর।

তারপর মোবাইল নীরব।

তবে একটু পরেই মেয়েটির ফোন।

আমার নাম জাহরা।

জানি।

তার মানে আপনিও রাতে সেই একই স্বপ্ন দেখেছেন?

একই স্বপ্ন কি না, জানি না। তবে একটি স্বপ্ন দেখেছি।

বুঝেছি। একই স্বপ্ন দেখেছি আমরা।

কীভাবে বুঝলেন?

উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন আসে—আমার মোবাইল নম্বরটি বলুন তো?

আমি একমুহূর্ত না থেমে এগারোটি ডিজিট বলে যাই। নিজেই অবাক হই স্মৃতি আমার এত ঝকঝকে হলো কেমন করে! একবার শুনেই মুখস্থ হয়ে গেছে নম্বর!

মেয়েটি বলে—আর কোনো সন্দেহ নেই। আমি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ব পনেরো মিনিটের মধ্যে। বলুন কোথায় দেখা হবে আমাদের?

আমি বলি—দাঁড়ান, দাঁড়ান! স্বপ্নটা তো নিছক স্বপ্নই হতে পারে।

তা পারে। কিন্তু যদি সত্যি হয়ে থাকে? তাহলে কাজটা না করলে যে পৃথিবী বাঁচবে না! এত বড় রিস্ক আমরা নেব?

এবার সত্যিই আমার ভেতরটা কেঁপে ওঠে। তবু বলি—কিন্তু পৃথিবীতে আট শ কোটি মানুষ থাকতে আমাদের দুজনকেই কেন বেছে নেওয়া হলো? কী আছে আমাদের মধ্যে?

সেগুলো পরে ভাবা যাবে। আপনি বেরিয়ে আসুন।

আমি ঈষৎ বিরক্তি প্রকাশ করি—আপনি কিন্তু আমাকে জোর করছেন!

জাহরা এ কথায় পাল্টা বিরক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায় না। বলে, আমাকে ফোনে সেই কণ্ঠ এটা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বলেছে, আপনি নিজে থেকে আমাকে ফোন না-ও করতে পারেন। কারণ মেয়েদের কাছে ছোট হতে আপনার খুব অনিচ্ছা বলেই আপনি এখন পর্যন্ত প্রেমহীন। আপনি আগ বাড়িয়ে কোনো মেয়েকে ফোন করবেন না হয়তো। সে কারণেই উদ্যোগী আমাকেই হতে হয়েছে।

একটু চুপ থেকে বলি—আমি বেরোচ্ছি। আপনিই বলুন কোথায় দেখা হবে আমাদের?

পাবলিক লাইব্রেরির গেটে আসুন।

দেখার সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারলাম জাহরাকে। জাহরাও আমাকে। কে যে চেনাল কে জানে! আমার চেহারা নিতান্তই সাধারণ। ভিড়ের মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়ার মতো নয়। আর জাহরাকেও আমি আগে কোনো দিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। উদ্বিগ্ন সুন্দর জাহরা। তবু চিনলাম।

জাহরা কাছে এসে দাঁড়াল। সোজাসুজি চলে এল কাজের কথায়—কোথায় যাব আমরা?

এবার তার দুই গালে একটু লালিমা। উদ্বেগের সঙ্গে লজ্জার মিশেল—কোথায় গিয়ে কাজটা...মানে ওইটা...মানে...কাজটা করব আমরা?

আমি তো জানি না।

আপনার বাসায়?

কথা যত এগোচ্ছে জাহরা তত লাল হয়ে উঠছে লজ্জায়।

সম্ভব না। মা আছে, রিটায়ার্ড বাবা প্রায় সব সময় বাসাতেই থাকেন, বড় ভাইয়ের বউ-ছেলে-মেয়ে আছে। আপনার বাসার কী অবস্থা?

জাহরা বলে—একই।

আমি একটু শব্দ করে হাসি—আমাদের কোনো ‘লিটনের ফ্ল্যাট’ নেই।

সে-ও হেসে ফেলে—আমরা ব্যাকডেটেড। তবু আমাদের ওপরই কেন যে পড়ল এই কাজের ভার! চলেন আমরা বরং পার্ক, উদ্যানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি। কোথাও না কোথাও সুযোগ পেয়ে যাব।

কাজ। মানে পরস্পরকে চুম্বন করা। মাত্র একবার। স্বপ্নে দেখেছি পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে আমাদের দুজনকে মাত্র একবার পরস্পরকে নিবিড় চুম্বন করতে হবে। এমন চুম্বন যখন দুজন পৃথিবী ভুলে যাবে। আমাকে কেন বেছে নেওয়া হলো? কারণ আমি আজ পর্যন্ত কোনো নারীর ঠোঁটে চুম্বন করিনি। জাহরাকেও সেই একই কারণে বেছে নেওয়া হয়েছে। এটি আমাদের দুজনেরই গোপন আফসোসের জায়গা। অন্তত আমার। কিন্তু সেটিই হলো আজ আমাদের যোগ্যতা।

আমি বলি—দাঁড়ান। জায়গা খুঁজে পেলেও আমি কিন্তু প্রেমহীন চুম্বন করতে রাজি নই। আমাদের মধ্যে প্রেম তৈরি হয়নি। এত তাড়াতাড়ি তা তৈরির সুযোগও নেই।

জাহরা একটু ঝাঁজালো কণ্ঠে বলে—সে সমস্যা তো আমারও। প্রেমহীন চুম্বন চাই না, স্পর্শ চাই না বলেই তো আমার ঠোঁট এখনো ভার্জিন।

চলেন, জায়গা খুঁজি। যদি এই সময়ের মধ্যে মনে প্রেমের অনুভূতি না তৈরি হয়, তাহলে কাজটা না করেই ফিরে যাব যে যার ঘরে।

আমরা পার্ক বা উদ্যানে নির্জন জায়গার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ি। রিকশায়, সিএনজিতে, হেঁটে ঘুরতে থাকি শহরের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়, দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়, আমরা একটি পবিত্র চুম্বনের জন্য কোনো নির্জন স্থান পাই না। তখন আমাদের উদ্বেগ বাড়তে থাকে। পেটে হয়তো খিধে। কিন্তু আমরা নিজেদের হাতের বোতলের পানিতে মাঝে মাঝে চুমুক দেওয়া ছাড়া অন্য খাবারের জন্য সময় নষ্ট করিনি। কোনো জায়গা না পেয়ে আমরা গুগল সার্চ দিই। শহরের আর কোনো পার্ক বা উদ্যান বাকি আছে কি না, খুঁজি। না নেই। তখন আমাদের দুজনের দিশেহারা অবস্থা। জাহরার চোখ-মুখ হতাশায় আচ্ছন্ন। আমি মরিয়া হয়ে একটা সিএনজি ডাকি। উঠে বসে বলি, সোজা উত্তরে যেতে। সিএনজি চলে আর আমরা বারবার সূর্যের দিকে তাকাই। সূর্য যখন প্রায় পশ্চিমের কাছাকাছি, তখন আমরা শহর ছাড়িয়ে চলে এসেছি শহরতলিতে। হঠাৎ রাস্তা থেকে একটু দূরে একটা নিঃসঙ্গ ঘর চোখে পড়ে আমার। দূর থেকেও বোঝা যায় ঘরটি জীর্ণ। আমি প্রায় চিৎকার করে সিএনজিকে থামতে বলি। মিটারে কত টাকা উঠেছে জিজ্ঞেস না করে এক হাজার টাকার নোট ড্রাইভারের হাতে গুঁজে দিয়ে জাহরাকে বলি—তাড়াতাড়ি নামেন।

তার হাত ধরে প্রায় ছুটতে থাকি নিঃসঙ্গ ঘরটির দিকে। মনের মধ্যে শঙ্কা। ওখানেও যদি মানুষ থাকে!

ধাক্কা দিতেই নড়বড়ে দরজা খুলে যায়। মনের মধ্যে স্বস্তির বাতাস অনুভব করি। ঘরে কোনো লোক নেই। ভেতরে পা রাখতে গিয়ে জাহরার হাতের টানে থমকে যাই আমি। একটু বিরক্ত হয়েই বলি—কী হলো?

জাহরা ঘরের মেঝের দিকে আঙুল নির্দেশ করে—মেঝেতে অন্তত আট-দশটি সাপ।

এখন!

সূর্যের দিকে তাকাই। অল্পক্ষণের মধ্যেই ডুবে যাবে। আমাদের আর কোনো সুযোগ নেই। কী যে হয়, আমি জাহরাকে হাত ধরে টানি—চলো ঘরের মধ্যে চলো! যা হয় হবে। সাপ কামড়ালে কামড়াবে। কিন্তু আমরা কাজটা এখানেই শেষ করব। আমরা মরলেও পৃথিবীটা বাঁচবে।

জাহরা আমার চোখের দিকে তাকায়। বলে—আমাকে জড়িয়ে ধরো।

আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে সাপগুলোর পাশে পা রাখি। অবাক হয়ে দেখি ওরা আমাদের দেখে ফণা তুলে তেড়ে না এসে সড়াৎ সড়াৎ করে পাশ কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে দরজা দিয়ে বাইরে।

জাহরা আছড়ে পড়ে আমার বুকে—ওগো, প্রেমের এমন শক্তি আগে কোনো দিন ভাবিনি।

আমাদের দুই জোড়া ঠোঁট তখন পরস্পরের মধ্যে হারিয়ে গেছে।

পৃথিবী বাঁচবে। বেঁচে থাকবে। কেননা প্রেম অন্তরিক্ষ থেকে নেমে এসেছে মানব-মানবীর বুকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত