অনলাইন ডেস্ক
উপমহাদেশের চিরবৈরী দুই পক্ষ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টি যখন অনিষ্পন্ন, তখন সেখানে নীরবে ঢুকেছে তৃতীয় আরেক পক্ষ চীন। ৬৫ বছর ধরে এই সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু ও এর শাখা নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে কাজ করেছে। এই চুক্তি সিন্ধু নদ অববাহিকায় পানিপ্রবাহের প্রাণ, যা চীন থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হাজারো বিবাদ সত্ত্বেও উভয় পক্ষই এই চুক্তিকে সম্মান করেছে। এই চুক্তি ঐতিহাসিকভাবে দুই দেশের মধ্যকার এক অনন্য নজির হিসেবে প্রশংসা পেয়ে এসেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই চুক্তির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সংঘাতের আশঙ্কা বজায় ছিল।
কারণ, চুক্তিটি যখন স্বাক্ষরিত হয়, তখন এর প্রণেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এখন এই নদীগুলোর পানির প্রধান উৎস হিমালয়ের হিমবাহ, যেগুলো এখন ব্যাপকভাবে গলছে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে পানি সরবরাহ বজায় রাখার বিষয়টি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে কাশ্মীর নিয়ে চলমান উত্তেজনা, যেখানে সিন্ধু অববাহিকার বেশির ভাগ অংশ অবস্থিত, দুই দেশের সহযোগিতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। এই সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারত পাকিস্তানে হামলা চালায়, যা চার দিনের এক স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধের সূচনা করে। এই সময়ে নয়াদিল্লি একতরফাভাবে সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি বাতিল করে।
তবে পেহেলগাম হামলার আগে থেকেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছিল। ২০১৬ সাল থেকে এই চুক্তি আন্তর্জাতিক সালিসকারীদের হাতে। এই চুক্তির প্রেক্ষাপটে গত ২৭ জুন পারমানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন পাকিস্তানের পক্ষে এক রায় দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, চুক্তিটি স্থগিত রাখায় ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মামলার এখতিয়ার রয়েছে। আরও বলা হয়েছে, এই চুক্তি কোনো পক্ষকে একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল বা স্থগিত করার অনুমতি দেয় না।
চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে তর্কবিতর্কের মধ্যে পাকিস্তান কূটনৈতিক ও কৌশলগত সমর্থনের জন্য চীনের দিকে ঝুঁকেছে। এপ্রিলে সন্ত্রাসী হামলার পর সংঘটিত সংঘর্ষের সময় পাকিস্তানের প্রতি চীনের এই সমর্থন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে সময় পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চীনের তৈরি যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেছিল। এ ছাড়া ভারত চুক্তি স্থগিত করার পর জবাবে চীন ও পাকিস্তান এই নদী ব্যবস্থায় একটি বড় বাঁধ প্রকল্পের নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত করেছে। এই বাঁধ পাকিস্তানের কিছু অংশে পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।
এখন প্রশ্ন হলো, ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে চীন কেন জড়িয়ে যাচ্ছে? এর একটা উত্তর হতে পারে, এটি চীন-পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে গড়ে ওঠা শক্তিশালী সম্পর্কের প্রতিফলন। কিন্তু চীনের সম্পৃক্ততা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কারণ, এই বিরোধে চীন কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নয়; বরং এই অঞ্চলে নিজের প্রভাব বাড়ানোর এবং প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা ভারতকে মোকাবিলা করার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা চীনের।
চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক অনেক দিন ধরে উত্তেজনাপূর্ণ। ১৯৬২ সালে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল এবং এখনো মাঝেমধ্যে সীমান্তে সংঘর্ষ হয়। তাই নয়াদিল্লির আশঙ্কা, চীন নিজ এলাকা থেকে যেসব নদী ভারতের দিকে গেছে, সেগুলোর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ভারত-চীনের মধ্যকার সম্পর্কের বাস্তবতা বিবেচনায় সিন্ধু জল চুক্তিতে চীনা হস্তক্ষেপ এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। সর্বশেষ যুদ্ধের আগপর্যন্ত এই চুক্তি প্রতিবেশী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে একটি সফল দ্বিপক্ষীয় চুক্তির উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতো। ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির প্রথম শর্তানুযায়ী, ভারতকে তিনটি পূর্বাঞ্চলীয় নদীর নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়। সেগুলো হলো, রবি, বিয়াস ও সতলুজ। এই তিন নদীর বার্ষিক গড় প্রবাহ ৪০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনমিটার। অন্যদিকে পাকিস্তান পশ্চিমাঞ্চলীয় তিনটি নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাবের নিয়ন্ত্রণ পায়। এই নদীগুলো থেকে পাকিস্তানকে প্রায় ১৬৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয়।
ভারতে এই তুলনামূলক কম পানি প্রাপ্তি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক ভারতীয় মনে করেন, চুক্তির শর্তানুযায়ী পাকিস্তানকে বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ভারত প্রাথমিকভাবে সিন্ধু নদের পানির ২৫ শতাংশ ব্যবহারের দাবি করেছিল।
আবার পাকিস্তানের জন্যও সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তির শর্তগুলো বেদনাদায়ক। কারণ, এই চুক্তি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় অমীমাংসিত ভূমির বিরোধকে স্থায়ী রূপ দেয়। বিশেষ করে নদীগুলোর বিভাজন কাশ্মীরের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত হয়েছে। তিনটি প্রধান নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব ভারতের শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর অঞ্চলে প্রবেশ করে। কাশ্মীর অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা পাকিস্তানের পানির নিরাপত্তাহীনতাকে আরও স্পষ্ট করে।
পাকিস্তানের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ সিন্ধু অববাহিকায় বসবাস করে, যেখানে ভারতের মাত্র ১৪ শতাংশ জনগণ এই অববাহিকায় বসবাস করে। তাই পাকিস্তানের এই সতর্কবার্তা নিছক হুমকি নয় যে ভারত যদি পানি সরবরাহ বন্ধ করে, তাহলে সেটা যুদ্ধ প্রচেষ্টার শামিল হবে।
এই হুমকি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন নদীগুলোতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষাকেও ব্যাখ্যা করে। পাকিস্তানের মোট বিদ্যুতের এক-পঞ্চমাংশ আসে জলবিদ্যুৎ থেকে এবং প্রায় ২১টি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত। এ ছাড়া যেহেতু পাকিস্তানের অর্থনীতি কৃষির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল এবং কৃষিজমির জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তির ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের নেতাদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে।
এই অবস্থার কারণে ইসলামাবাদ তার পাওনা পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে চীনের সঙ্গে সহযোগিতায় আগ্রহী হয়েছে। চীন পাকিস্তানকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, যেমন ডায়ামার ভাসা বাঁধ ও কোহালা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বহু উদ্যোগে চীন বিনিয়োগ করেছে। এই প্রকল্পগুলো পাকিস্তানের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং দুই দেশের আন্তসীমান্ত পানি সম্পর্কের একটি মূল দিক হয়ে উঠেছে।
ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে নানা ইস্যুতে কাজ করার আগ্রহের কারণে চীন এখন ক্রমেই সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তিতে নিজেকে অংশীদার হিসেবে দেখতে পাচ্ছে। চীনা সংবাদমাধ্যমে ভারতের ভূমিকাকে আক্রমণাত্মক হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে ‘পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের’ আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, সিন্ধু নদের উৎস চীনের পশ্চিম তিব্বত অঞ্চলে অবস্থিত।
চীনের এই অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে তাদের বড় কৌশলগত ভূমিকার অংশ। পেহেলগাম হামলার পর চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই পাকিস্তানের প্রতি চীনের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি পাকিস্তানকে ‘লৌহদৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ’ রাষ্ট্র আখ্যা দেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘সব সময় টিকে থাকা কৌশলগত অংশীদারত্ব’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
ভারতের পক্ষ থেকে চুক্তি স্থগিত করার জবাবে চীন ঘোষণা করে, তারা পাকিস্তানের সিন্ধুর একটি উপনদীতে মোহমান্দ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দ্রুততর করবে। পাকিস্তানের জলবিদ্যুৎ খাতে চীনা বিনিয়োগ দুই দেশের জন্যই শক্তিশালী জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করছে।
উদাহরণস্বরূপ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর প্রকল্পের আওতায় সিন্ধু ক্যাসকেড হাইড্রো পাওয়ার প্রকল্প প্রায় ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে গিলগিট-বালটিস্তানে, যা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের এলাকা। এ থেকে বোঝা যায়, পরিস্থিতি কতটা সংবেদনশীল।
চীন যে পাকিস্তানের পাশে রয়েছে, তার পেছনে মূলত অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে চায় তারা। কিন্তু এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়ছে। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে মিলে কাজ করা সিন্ধু অববাহিকার পানিবণ্টন চুক্তির স্থিতিশীলতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি ভারতের চীন সীমান্তবর্তী রাজ্য অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, পশ্চিম তিব্বতে চীনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো একেকটি ‘পানিবোমা’ হয়ে আছে।
এই উত্তেজনা প্রশমনের জন্য এবং সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তিকে পুনরায় সচল করার স্বার্থে ভারত, চীন এবং পাকিস্তানের কূটনৈতিক আলাপ ও সংলাপে বসা প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার চলমান পানিসংকট মোকাবিলায় এমন উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।
[লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার ওয়াটার রিসোর্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা সহযোগী পিন্টু কুমার মাহলা। দ্য কনভারসেশনে প্রকাশিত নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান।]
উপমহাদেশের চিরবৈরী দুই পক্ষ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়টি যখন অনিষ্পন্ন, তখন সেখানে নীরবে ঢুকেছে তৃতীয় আরেক পক্ষ চীন। ৬৫ বছর ধরে এই সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু ও এর শাখা নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে কাজ করেছে। এই চুক্তি সিন্ধু নদ অববাহিকায় পানিপ্রবাহের প্রাণ, যা চীন থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হাজারো বিবাদ সত্ত্বেও উভয় পক্ষই এই চুক্তিকে সম্মান করেছে। এই চুক্তি ঐতিহাসিকভাবে দুই দেশের মধ্যকার এক অনন্য নজির হিসেবে প্রশংসা পেয়ে এসেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই চুক্তির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সংঘাতের আশঙ্কা বজায় ছিল।
কারণ, চুক্তিটি যখন স্বাক্ষরিত হয়, তখন এর প্রণেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এখন এই নদীগুলোর পানির প্রধান উৎস হিমালয়ের হিমবাহ, যেগুলো এখন ব্যাপকভাবে গলছে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে পানি সরবরাহ বজায় রাখার বিষয়টি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে কাশ্মীর নিয়ে চলমান উত্তেজনা, যেখানে সিন্ধু অববাহিকার বেশির ভাগ অংশ অবস্থিত, দুই দেশের সহযোগিতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। এই সন্ত্রাসী হামলার জবাবে ভারত পাকিস্তানে হামলা চালায়, যা চার দিনের এক স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধের সূচনা করে। এই সময়ে নয়াদিল্লি একতরফাভাবে সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি বাতিল করে।
তবে পেহেলগাম হামলার আগে থেকেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছিল। ২০১৬ সাল থেকে এই চুক্তি আন্তর্জাতিক সালিসকারীদের হাতে। এই চুক্তির প্রেক্ষাপটে গত ২৭ জুন পারমানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন পাকিস্তানের পক্ষে এক রায় দিয়েছেন। আদালত বলেছেন, চুক্তিটি স্থগিত রাখায় ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মামলার এখতিয়ার রয়েছে। আরও বলা হয়েছে, এই চুক্তি কোনো পক্ষকে একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল বা স্থগিত করার অনুমতি দেয় না।
চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে তর্কবিতর্কের মধ্যে পাকিস্তান কূটনৈতিক ও কৌশলগত সমর্থনের জন্য চীনের দিকে ঝুঁকেছে। এপ্রিলে সন্ত্রাসী হামলার পর সংঘটিত সংঘর্ষের সময় পাকিস্তানের প্রতি চীনের এই সমর্থন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে সময় পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চীনের তৈরি যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেছিল। এ ছাড়া ভারত চুক্তি স্থগিত করার পর জবাবে চীন ও পাকিস্তান এই নদী ব্যবস্থায় একটি বড় বাঁধ প্রকল্পের নির্মাণকাজ ত্বরান্বিত করেছে। এই বাঁধ পাকিস্তানের কিছু অংশে পানি সরবরাহ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।
এখন প্রশ্ন হলো, ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে চীন কেন জড়িয়ে যাচ্ছে? এর একটা উত্তর হতে পারে, এটি চীন-পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে গড়ে ওঠা শক্তিশালী সম্পর্কের প্রতিফলন। কিন্তু চীনের সম্পৃক্ততা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কারণ, এই বিরোধে চীন কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নয়; বরং এই অঞ্চলে নিজের প্রভাব বাড়ানোর এবং প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা ভারতকে মোকাবিলা করার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা চীনের।
চীন ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক অনেক দিন ধরে উত্তেজনাপূর্ণ। ১৯৬২ সালে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল এবং এখনো মাঝেমধ্যে সীমান্তে সংঘর্ষ হয়। তাই নয়াদিল্লির আশঙ্কা, চীন নিজ এলাকা থেকে যেসব নদী ভারতের দিকে গেছে, সেগুলোর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে পারে। ভারত-চীনের মধ্যকার সম্পর্কের বাস্তবতা বিবেচনায় সিন্ধু জল চুক্তিতে চীনা হস্তক্ষেপ এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। সর্বশেষ যুদ্ধের আগপর্যন্ত এই চুক্তি প্রতিবেশী দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের মধ্যে একটি সফল দ্বিপক্ষীয় চুক্তির উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতো। ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির প্রথম শর্তানুযায়ী, ভারতকে তিনটি পূর্বাঞ্চলীয় নদীর নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়। সেগুলো হলো, রবি, বিয়াস ও সতলুজ। এই তিন নদীর বার্ষিক গড় প্রবাহ ৪০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনমিটার। অন্যদিকে পাকিস্তান পশ্চিমাঞ্চলীয় তিনটি নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাবের নিয়ন্ত্রণ পায়। এই নদীগুলো থেকে পাকিস্তানকে প্রায় ১৬৭ দশমিক ২ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ব্যবহারের অধিকার দেওয়া হয়।
ভারতে এই তুলনামূলক কম পানি প্রাপ্তি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক ভারতীয় মনে করেন, চুক্তির শর্তানুযায়ী পাকিস্তানকে বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ভারত প্রাথমিকভাবে সিন্ধু নদের পানির ২৫ শতাংশ ব্যবহারের দাবি করেছিল।
আবার পাকিস্তানের জন্যও সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তির শর্তগুলো বেদনাদায়ক। কারণ, এই চুক্তি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সময় অমীমাংসিত ভূমির বিরোধকে স্থায়ী রূপ দেয়। বিশেষ করে নদীগুলোর বিভাজন কাশ্মীরের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত হয়েছে। তিনটি প্রধান নদী সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাব ভারতের শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর অঞ্চলে প্রবেশ করে। কাশ্মীর অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা পাকিস্তানের পানির নিরাপত্তাহীনতাকে আরও স্পষ্ট করে।
পাকিস্তানের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ সিন্ধু অববাহিকায় বসবাস করে, যেখানে ভারতের মাত্র ১৪ শতাংশ জনগণ এই অববাহিকায় বসবাস করে। তাই পাকিস্তানের এই সতর্কবার্তা নিছক হুমকি নয় যে ভারত যদি পানি সরবরাহ বন্ধ করে, তাহলে সেটা যুদ্ধ প্রচেষ্টার শামিল হবে।
এই হুমকি পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন নদীগুলোতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষাকেও ব্যাখ্যা করে। পাকিস্তানের মোট বিদ্যুতের এক-পঞ্চমাংশ আসে জলবিদ্যুৎ থেকে এবং প্রায় ২১টি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত। এ ছাড়া যেহেতু পাকিস্তানের অর্থনীতি কৃষির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল এবং কৃষিজমির জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তির ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের নেতাদের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে।
এই অবস্থার কারণে ইসলামাবাদ তার পাওনা পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে চীনের সঙ্গে সহযোগিতায় আগ্রহী হয়েছে। চীন পাকিস্তানকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, যেমন ডায়ামার ভাসা বাঁধ ও কোহালা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বহু উদ্যোগে চীন বিনিয়োগ করেছে। এই প্রকল্পগুলো পাকিস্তানের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং দুই দেশের আন্তসীমান্ত পানি সম্পর্কের একটি মূল দিক হয়ে উঠেছে।
ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে নানা ইস্যুতে কাজ করার আগ্রহের কারণে চীন এখন ক্রমেই সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তিতে নিজেকে অংশীদার হিসেবে দেখতে পাচ্ছে। চীনা সংবাদমাধ্যমে ভারতের ভূমিকাকে আক্রমণাত্মক হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এতে ‘পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের’ আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, সিন্ধু নদের উৎস চীনের পশ্চিম তিব্বত অঞ্চলে অবস্থিত।
চীনের এই অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে তাদের বড় কৌশলগত ভূমিকার অংশ। পেহেলগাম হামলার পর চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই পাকিস্তানের প্রতি চীনের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি পাকিস্তানকে ‘লৌহদৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ’ রাষ্ট্র আখ্যা দেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ‘সব সময় টিকে থাকা কৌশলগত অংশীদারত্ব’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
ভারতের পক্ষ থেকে চুক্তি স্থগিত করার জবাবে চীন ঘোষণা করে, তারা পাকিস্তানের সিন্ধুর একটি উপনদীতে মোহমান্দ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ দ্রুততর করবে। পাকিস্তানের জলবিদ্যুৎ খাতে চীনা বিনিয়োগ দুই দেশের জন্যই শক্তিশালী জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করছে।
উদাহরণস্বরূপ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর প্রকল্পের আওতায় সিন্ধু ক্যাসকেড হাইড্রো পাওয়ার প্রকল্প প্রায় ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে গিলগিট-বালটিস্তানে, যা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের এলাকা। এ থেকে বোঝা যায়, পরিস্থিতি কতটা সংবেদনশীল।
চীন যে পাকিস্তানের পাশে রয়েছে, তার পেছনে মূলত অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে চায় তারা। কিন্তু এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়ছে। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে মিলে কাজ করা সিন্ধু অববাহিকার পানিবণ্টন চুক্তির স্থিতিশীলতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি ভারতের চীন সীমান্তবর্তী রাজ্য অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, পশ্চিম তিব্বতে চীনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো একেকটি ‘পানিবোমা’ হয়ে আছে।
এই উত্তেজনা প্রশমনের জন্য এবং সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তিকে পুনরায় সচল করার স্বার্থে ভারত, চীন এবং পাকিস্তানের কূটনৈতিক আলাপ ও সংলাপে বসা প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার চলমান পানিসংকট মোকাবিলায় এমন উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।
[লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার ওয়াটার রিসোর্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা সহযোগী পিন্টু কুমার মাহলা। দ্য কনভারসেশনে প্রকাশিত নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান।]
তুরস্কে গণতন্ত্র আজ ভয়াবহ হুমকির মুখে। চলতি মাসের (জুলাই) শুরুতেই বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির (সিএইচপি) অন্তত ১৭ জন মেয়রকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তাঁদের সবাই দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
৯ মিনিট আগেযেকোনো পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিমাত্রই জানেন মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করা মানে হচ্ছে, প্রচুর মানসিক শক্তি খরচ করা। কিন্তু, নিবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের পূর্ণ সহায়তা পাওয়া যায়, তাহলে এই মানসিক চাপ অনেকটাই কমে আসে।
৭ ঘণ্টা আগেরাতের আকাশে যখন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্যাট্রিয়ট সক্রিয় হয়, তখন সারা শহর কেঁপে ওঠে গর্জনে। সেই শব্দ অনেকটা দ্রুতগতির হিপ-হপ মিউজিকের মতো। আকাশে বিস্ফোরণের আলোর ঝলকানি, তারপর মুহূর্তের মধ্যে ভয়ংকর বিস্ফোরণ। বিষয়টি ভাবতে ভালো লাগে। ব্যয়বহুল এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা রুশ
২ দিন আগেগত সপ্তাহে, ওয়ার্নার ব্রাদার্স পিকচার্স সুপারম্যান চলচ্চিত্র সিরিজের একটি নতুন রিবুট মুক্তি দিয়েছে। এই সিনেমাটি বক্স অফিসে বেশ সাড়া ফেলেছে, আয়ের হিসাবে এখন শীর্ষে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উদ্বোধনী সপ্তাহান্তে আনুমানিক ১২২ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
২ দিন আগে