Ajker Patrika

এআই কি আমাদের নির্বোধ বানাচ্ছে

অনলাইন ডেস্ক
প্রতীকী ছবি। ছবি: পিক্সাবে
প্রতীকী ছবি। ছবি: পিক্সাবে

যেকোনো পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিমাত্রই জানেন মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লেখার চেষ্টা করা মানে হচ্ছে, প্রচুর মানসিক শক্তি খরচ করা। কিন্তু, নিবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের পূর্ণ সহায়তা পাওয়া যায়, তাহলে এই মানসিক চাপ অনেকটাই কমে আসে। তবে সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) গবেষকেরা এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, এই সহায়তারও একটা চড়া মূল্য আছে।

গবেষণায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের একটা অংশ চ্যাটজিপিটির সহায়তায় এবং আরেকটা অংশ চ্যাটজিপিটি ছাড়া প্রবন্ধ লিখেছেন। এ সময় তাদের মস্তিষ্কের কার্যক্রম ইলেকট্রোএনসেফালোগ্রাম (ইইজি) যন্ত্র দিয়ে মাপা হয়। দেখা যায়, যারা চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছেন, তাদের মস্তিষ্কের সৃষ্টিশীলতা এবং মনোযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশগুলোতে কার্যক্রম অনেকটাই কম ছিল। শুধু তাই নয়, তারা নিজেদের লেখা থেকে একটি নির্ভুল উদ্ধৃতিও দিতে পারছিলেন না।

এই গবেষণাটি একটি বড় প্রশ্ন তুলেছে—এআই ব্যবহারে মিলছে সাময়িক সুবিধা, কিন্তু তার বিনিময়ে কী আমরা ভবিষ্যতে কোনো বড় মূল্য দিতে যাচ্ছি?

এমআইটির এই গবেষণাটি আরও দুটি আলোচিত গবেষণার সঙ্গে মিল রেখে তৈরি হয়েছে। এর একটি করেছে মাইক্রোসফট রিসার্চ। সেখানে ৩১৯ জন জ্ঞানভিত্তিক পেশাজীবীর ওপর জরিপ চালানো হয়। যারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করেন। তারা ৯০০ টির বেশি কাজের উদাহরণ দিয়েছেন—দীর্ঘ প্রতিবেদন সংক্ষেপ করা থেকে শুরু করে বিপণন কৌশল তৈরি পর্যন্ত।

নিজেদের মূল্যায়নে তারা বলেছেন, এর মধ্যে মাত্র ৫৫৫টি কাজই ছিল চিন্তাভাবনা করার মতো, যেখানে এআইয়ের আউটপুট যাচাই করা কিংবা ভুল হলে নতুন প্রম্পট দেওয়া দরকার হতো। বাকিগুলো ছিল মূলত মাথা খাটানোর দরকার নেই—এমন ধরনের। বেশির ভাগই বলেছেন, চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি বা মাইক্রোসফট কোপাইলট ব্যবহারে তাদের কাজের মানসিক চাপ কমেছে।

আরেকটি গবেষণা করেছেন মাইকেল গারলিচ। তিনি সুইজারল্যান্ডের এসবিএস বিজনেস স্কুলের এক অধ্যাপক। তিনি ব্রিটেনের ৬৬৬ জন মানুষের ওপর সমীক্ষা চালান। তারা এআই কতটা ব্যবহার করেন, কতটা বিশ্বাস করেন—জানার পর তাদের ক্রিটিক্যাল থিংকিং বা বিশ্লেষণ ক্ষমতা যাচাই করা হয়। যাঁরা বেশি এআই ব্যবহার করেন, তাঁদের স্কোর সবার নিচে। গারলিচ বলেন, গবেষণাটি প্রকাশের পর বহু স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের ভাষ্য ছিল, ‘গবেষণায় যা উঠে এসেছে, তার প্রতিফলন তাঁরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিদিনই দেখছেন।’

তবে দীর্ঘ মেয়াদে এআই মানুষের মস্তিষ্ক দুর্বল করে দেবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়। গবেষকেরা বলছেন, আরও গবেষণা দরকার। গারলিচের গবেষণায় যেমন বলা হয়েছে যে, হতে পারে যারা বিশ্লেষণ ক্ষমতায় এগিয়ে, তারাই হয়তো এআইয়ের ওপর কম নির্ভর করেন। আর এমআইটির গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন মাত্র ৫৪ জন এবং তা ছিল নির্দিষ্ট একটিমাত্র কাজের ওপর ভিত্তি করে। ফলে, ভবিষ্যতে এ ধরনের বিস্তারিত গবেষণার সুযোগ আছে।

আসলে এআই মানুষের মানসিক বোঝা হালকা করতেই তৈরি। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে সক্রেটিসও নাকি লেখাকে স্মৃতি শক্তি নয়, বরং মনে করিয়ে দেওয়ার একটা উপায় হিসেবে খাটো করে দেখেছিলেন। ক্যালকুলেটর বিল হিসাব করা থেকে ক্যাশিয়ারকে বাঁচায়। গুগল ম্যাপ দিয়ে রাস্তা চেনা যায়—তবু কি মানুষ কম সক্ষম হয়ে গেছে?

‘কগনিটিভ অফলোডিং’—মানে কঠিন কাজ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া; শব্দবন্ধটি তৈরি করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলুর মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইভান রিসকো ও তাঁর সহকর্মী স্যাম গিলবার্ট। রিসকো বলছেন, জেনারেটিভ এআই অন্য সব প্রযুক্তির চেয়ে অনেক বেশি চিন্তার কাজ সরিয়ে নিচ্ছে। একটু হিসাব কষা আর পুরো চিন্তা-প্রক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়া এক কথা নয়। একবার যদি কেউ ‘অফলোডিং’-এর অভ্যাস গড়ে তোলে, সেটি ছাড়াও কঠিন হয়।

এটিকে ডাকা হয় ‘কগনিটিভ মাইজারলিনেস’ নামে—অর্থাৎ, যত কম চিন্তা করে সমস্যা সমাধান করা যায়, মানুষ ততটাই তৃপ্ত থাকে। গবেষক গারলিচ বলছেন, এ থেকে তৈরি হতে পারে এক ধরনের ‘ফিডব্যাক লুপ।’ এআই ব্যবহার বাড়লে চিন্তার ক্ষমতা কমে, আর কম চিন্তায় অভ্যস্ত হওয়ায় এআই-নির্ভরতা আরও বেড়ে যায়। একজন অংশগ্রহণকারী বলেছিলেন, ‘আমি এত বেশি এআই ব্যবহার করি যে, এখন কিছু সমস্যা নিজের চেষ্টায় কীভাবে সমাধান করব—তাও জানি না।’

এআই নিয়ে বড় বড় কোম্পানিগুলো উচ্ছ্বসিত। কারণ, তারা মনে করছে এটি উৎপাদনশীলতা বাড়াবে। কিন্তু নেপথ্যে আছে বড় শঙ্কা। নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক বারবারা লারসন বলেন, ‘দীর্ঘ মেয়াদে বিশ্লেষণ ক্ষমতা কমে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতার সক্ষমতা নষ্ট হতে পারে।’

টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় ৪৬০ জন অংশগ্রহণকারীকে কিছু সাধারণ বিষয়ের অস্বাভাবিক ব্যবহার খুঁজে বের করতে বলা হয়—যেমন টায়ার বা ট্রাউজার। যাঁরা এআইয়ের আইডিয়া দেখে কাজ করেছেন, তাঁদের উত্তরের বৈচিত্র্য ও সৃজনশীলতা কম ছিল। এক উদাহরণ—চ্যাটবট বলেছে, ট্রাউজারে খড় ভরে ভয় দেখানোর কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। অথচ একজন মানুষ প্রস্তাব করেছেন, পকেটে বাদাম ভরে সেটিকে পাখির খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হোক!

তবে উপায়ও আছে। অধ্যাপক লারসন বলেন, এআইকে সহকারী হিসেবে ব্যবহার করতে হবে—যেমন একজন উৎসাহী কিন্তু অতটা বুদ্ধিমান নয় এমন সহকারী হিসেবে। গারলিচের পরামর্শ, একবারে চূড়ান্ত ফল চাওয়া নয় বরং একেক ধাপে প্রম্পট করা হোক। যেমন ‘আমি কোথায় ঘুরতে যাব?’ না বলে আগে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে, ‘সেখানে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয় কোথায়?’

মাইক্রোসফটের গবেষকেরা এমন এআই তৈরি করছেন, যেগুলো ব্যবহারকারীর চিন্তায় হস্তক্ষেপ করবে—মাঝেমধ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দেবে, যাতে ব্যবহারকারী আরও ভাবেন। এমোরি ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চ্যাটবটগুলো যেন প্রশ্ন করে, উত্তর না দিয়ে বরং ব্যবহারকারীকেই ভাবতে শেখায়—এটাই হোক ভবিষ্যৎ। সক্রেটিস হয়তো এতে খুশিই হতেন।

তবে এসব ধারণা বাস্তবে কতটা কাজ করবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। এমনকি প্রোগ্রামিং শেখানোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বেশি বেশি ‘প্রোভোকেশন’ দিলে দুর্বল শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স আরও খারাপ হয়ে যায়।

আরও সরল একটি উপায় হতে পারে, ব্যবহারকারীর ওপর কিছু বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেওয়া। যেমন, নিজের মতো করে চিন্তা না করলে বা কিছুক্ষণ অপেক্ষা না করলে, এআই ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। মাইক্রোসফটের গবেষক জানা বুসিনকা বলেন, এতে ফল ভালো হয় ঠিকই, কিন্তু ব্যবহারকারীরা এসব পছন্দ করেন না।

এআই নিষিদ্ধ করলেও মানুষ সেটা ব্যবহার করতে চাইবে, এটি পরিষ্কার। অলিভার ওয়াইম্যান নামের একটি প্রতিষ্ঠানের করা এক জরিপে দেখা গেছে, ১৬টি দেশের ৪৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন, কর্মস্থলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তাঁরা জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করবেন।

এখনো অনেক কাজেই মানুষের মস্তিষ্কই সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাবতে হবে, এআইয়ের সুবিধা আর এর মস্তিষ্কঘাতী প্রভাবের মধ্যে কোনটি বড়। যদি একসময় প্রমাণ হয়—এআই মানুষকে বোকা বানিয়ে দিচ্ছে, তখন কি মানুষ সেটার তোয়াক্কা করবে?

দ্য ইকোনমিস্ট থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনবিআরে আন্দোলন: শাস্তি পেতে পারেন তিন শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী

প্রধান প্রকৌশলীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ, ইইডিতে তোলপাড়

সাবেক আইজির রাজসাক্ষী হওয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পুলিশে

গোপালগঞ্জে হামলার ঘটনায় ফেসবুকে সরব ইসলামপুরের পলাতক আওয়ামী নেতারা

সরকারি চাকরির নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়া হবে না

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত