Ajker Patrika

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে চীনের শক্তিশালী ৫টি মন্ত্র

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৮: ০৮
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের দুই বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ এখন একেবারে স্পষ্ট। চীনা পণ্যে ২৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, আর পাল্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে ১২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে বেইজিং। এতে ভোক্তা, ব্যবসা এবং বাজারে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এমনকি বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কাও তীব্র হচ্ছে।

এই বিষয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের সরকার বারবার সংলাপের প্রস্তুতির কথা বললেও, একই সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছে—প্রয়োজনে তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির বিপরীতে এই লড়াই চালিয়ে যেতে বেইজিংয়ের অন্তত পাঁচটি শক্তিশালী দিক রয়েছে। বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এমন পাঁচটি দিকের কথা উল্লেখ করেছে বিবিসি।

চাপ নিতে পারে চীন

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ায় চীন তুলনামূলকভাবে বেশি চাপ নিতে পারে। দেশটির ভেতরেই ১০০ কোটিরও বেশি মানুষের বিশাল অভ্যন্তরীণ বাজার রয়েছে, যা রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিকে কিছুটা সাপোর্ট দিতে পারে। তবে চীনারা এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যয় করছেন না। দেশটির সরকার ইতিমধ্যে সাবসিডি, রিটায়ারিদের জন্য ভ্রমণ সুবিধা ইত্যাদি দিয়ে ভোক্তাবাজারে গতি আনতে চেষ্টা করছে।

এদিকে চীনের নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক নয় বলে স্বল্পমেয়াদি জনমতের চাপ তাদের ওপর কম। ফলে তারা তুলনামূলকভাবে বেশি ধৈর্য ধারণ করতে পারে। যদিও চীনের তরুণ সমাজ বর্তমানে বেকারত্ব ও আবাসন সংকট নিয়ে অসন্তুষ্ট, তবুও সরকার জাতীয়তাবাদী আবেগ কাজে লাগিয়ে জনসমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা করছে। সি চিনপিং এখনো আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলছেন, ‘আকাশ ভেঙে পড়বে না।’

ভবিষ্যতের বিনিয়োগে এগিয়ে চীন

বহুদিন ধরেই চীনকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের কারখানা। তবে এমন পরিচিতি পেলেও এখন তারা আরও উন্নত প্রযুক্তির পথে হাঁটছে। সি চিনপিংয়ের নেতৃত্বে দেশটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, চিপ, নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো খাতে বিশাল বিনিয়োগ করেছে।

চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডি এখন টেসলাকে হারিয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ ছাড়া মার্কিন চ্যাটজিপিটি-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে চীনা চ্যাট বট ‘ডিপসিক’ ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে সরবরাহ চেইন সরাতে চাইলেও, চীনের মতো দক্ষ শ্রমশক্তি ও পরিকাঠামো খুঁজে পাওয়া কঠিন। ফলে চীনের সরবরাহ ব্যবস্থা এখনো অপরিবর্তনীয় অবস্থানে রয়েছে।

ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ থেকে পাওয়া শিক্ষা

প্রথম মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রথমবারের মতো শুল্ক আরোপ করলে চীন বুঝতে পেরেছিল—একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ার সময় এসেছে। এরপরই তারা বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়ন শুরু করে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় করে।

এদিকে আগে যেখানে আমেরিকান কৃষকেরা ৪০ শতাংশ সয়াবিন সরবরাহ করতেন, এখন সেটি ২০ শতাংশে নেমেছে। চীন স্থানীয় উৎপাদন বাড়িয়েছে এবং ব্রাজিল থেকে রেকর্ড পরিমাণ সয়াবিন আমদানি করেছে।

২০২৩ সালে চীন ছিল ৬০টি দেশের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার—যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় যা দ্বিগুণ। তাই যুক্তরাষ্ট্র এখন আর একচ্ছত্র বাজার নয়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেশটির বাজার চীনের জন্য এখন আর অপরিহার্য নয়।

ট্রাম্পের দৌড় কতটুকু—চীন জানে

চলতি এপ্রিলের শুরুর দিকে ট্রাম্প কঠিন ভঙ্গিতে শুল্ক ঘোষণা করলেও আমেরিকান বন্ড মার্কেট ধস নামার পর তিনি ৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিত করেন। তাই চীনারা এখন জেনে গেছে যে, আমেরিকান ট্রেজারি বন্ড মার্কেট ট্রাম্পের একটি দুর্বলতা।

বর্তমানে চীন প্রায় ৭০০ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন সরকারি বন্ড ধরে রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বন্ড বিক্রি করলে চীন নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ইউয়ানের ওপর চাপ পড়বে। তারপরও এটি একটি দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

চীনের হাতে দুর্লভ খনিজ

চীনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ‘রেয়ার আর্থস’ বা দুর্লভ খনিজের নিয়ন্ত্রণ। এই খনিজ উপাদানগুলো উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রপাতি যেমন—ইভি, উইন্ড টারবাইন, এআই চিপ, জেট ইঞ্জিন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের খনিজের বৈশ্বিক উৎপাদনের ৬১ শতাংশ এবং পরিশোধনের ৯২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে চীন।

২০২৪ সালে দেশটি ৭টি দুর্লভ খনিজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়, যার মধ্যে রয়েছে এআই চিপ তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদানও। একই বছর তারা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ‘অ্যান্টিমোনি’ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। এর ফলে বিশ্ববাজারে এটিরে দামের উল্লম্ফন ঘটে। এই পরিস্থিতি প্রতিরক্ষা শিল্প থেকে শুরু করে প্রযুক্তি খাত পর্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

চীনের হাতে থাকা এই পাঁচটি ‘কার্ড’ প্রমাণ করে, তারা শুধু প্রতিরোধ করছে না—তারা প্রস্তুতও। যুক্তরাষ্ট্র চাইলেও সহজে চীনকে কোণঠাসা করতে পারবে না। উল্টো বিশ্ব এখন দেখছে শক্তির এক অনিশ্চিত দ্বৈরথ, যেখানে প্রতিটি চাল হতে পারে বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য এক নতুন মোড়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত