শুল্কযুদ্ধের হুংকার দিয়ে শুরু করলেও মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় ট্রাম্পকে পিছু হটতে হলো। শেয়ার ও বন্ডবাজারের অস্থিরতা, ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষতি ও বৈশ্বিক আর্থিক বাজারে ধস তাঁকে নীতিগত ইউ-টার্ন নিতে বাধ্য করেছে।
হুসাইন আহমদ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি একেবারে আক্রমণাত্মক ও একপেশে। আগ্রাসীভাবে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নহ কয়েক ডজন দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বাগে আনার একপ্রকার নির্বিচার চেষ্টা করলেন তিনি। ১০ শতাংশ ভিত্তি শুল্কসহ ৭৮টি দেশের উপর শুল্ক আরোপ করলেন। এটাকে শুল্কের চেয়ে ‘বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর হাতিয়ার’ বলা ভালো। এই আক্রমণের শিকার বাংলাদেশও। তবে ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অন্য দেশগুলো শুল্ক হার কমানোর জন্য দেনদরবার শুরু করলেও চীন পাল্টা আঘাত হেনেছে। এর ফলে শুল্কহার বাড়ানোর পাল্টাপাল্টি যুদ্ধ চলছে।
বুধবার তৃতীয় দফায় বাড়িয়ে চীনের উপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার আগে চীন দ্বিতীয় দফায় বাড়িয়ে মার্কিন পণ্যে ৮৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। সর্বশেষ মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির জবাব এখনও দেয়নি চীন। কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ করে ট্রাম্প তাঁর অবস্থানে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছেন। চীনের উপর শুল্ক আরো বাড়ালেও বাকি দেশগুলোর শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, শুল্ক নিয়ে সমঝোতার জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের ফোনে কথা বলার ঘোষণা দিয়েছেন।
অথচ তিনি আগে বড় হুংকার দিয়ে আসছিলেন, কোনোভাবেই এই শুল্ক আরোপ থেকে তিনি সরবেন না। তার দাবি, চীন ও ইইউসহ দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক ঠকিয়ে আসছে। তাঁরা অনেক শুল্ক আরোপ করে বলে বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি থাকে। তাই তাঁর শুল্ক আরোপ ন্যায্য। কিন্তু বড় সপ্তাহখানেকের শুল্কযুদ্ধ থেকে পিছু হটলেন ট্রাম্প। তিনি জানালেন, আলোচনার সুযোগ দিতে সাময়িকভাবে শুল্ক আরোপ স্থগিত রাখা হচ্ছে। আর চীনের ওপর শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা আসলে প্রতীকী পদক্ষেপ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র-চীন মধ্যে বর্তমানে শুল্কহার এতটাই বেশি যে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য কার্যত স্থবির।
ট্রাম্পের এই ঘোষণাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বড় নীতিগত ‘ইউ-টার্ন’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্টসহ হোয়াইট হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, পরিস্থিতির চাপে পড়ে পিছু হটতে হয়েছে। কী সেই পরিস্থিতি যা ট্রাম্পকে সপ্তাহে ইউ টার্ন নিতে বাধ্য করল?
ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ মূলত খোলামেলা আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ। চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতকে টার্গেট করেছিলেন তিনি। মূল উদ্দেশ্য ছিল ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে বিদেশি পণ্যকে মার্কিন বাজারে কম প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা এবং বিদেশি সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে বাণিজ্য চুক্তি করতে বাধ্য করা। তবে কদিন না পেরোতেই শুল্ক আরোপের উদ্যোগের নেতিবাচক প্রভাব মার্কিন অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুল্কযুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন শেয়ারবাজার ও বন্ডবাজারে ব্যাপক অস্থিরতা এই সিদ্ধান্তের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে। শেয়ারবাজারে পতনকে পাত্তা না দিয়ে আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, নিয়োগকারীদের ক্ষতি নিয়ে চিন্তিত নন। তবে মঙ্গলবার বন্ড বাজারে ধস পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক করে তোলে। বাস্তবে এটাই তার পলিসি পরিবর্তনের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে মার্কিন বন্ড বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার পর ট্রাম্প বুঝতে পারেন, তার নীতি হয়তো আর বাজারের উপকারে আসছে না।
সাধারণত, শেয়ারবাজারে দরপতন হলে বন্ড বাজারে বিনিয়োগ বাড়ে, অর্থাৎ বন্ড বিক্রি বাড়ে। কিন্তু এবার আতঙ্কে বন্ড বিক্রির হিড়িকে উভয় বাজারেই দরপতন ঘটে। কিছু হেজ ফান্ড বড় অঙ্কের মার্কিন সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শেয়ারবাজারে পতনের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শুল্কযুদ্ধের বিরূপ প্রভাব নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। এর ক্ষতিকর বড় প্রভাব পড়ে মার্কিন ব্যবসায়িক মহলের ওপর।
বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। শুল্কের কারণে আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছিলেন ব্যবসায়ীরা। এতে গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছিল। হেজ ফান্ড ব্যবসায়ী বিল অকম্যার এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। শুল্কযুদ্ধ থামাতে তিনি সরাসরি ট্রাম্পের কাছে আবেদন জানান। কারণ, এর কারণে অনেকেরই ছোট ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়।
ট্রাম্প শুল্কযুদ্ধ থেকে পিছু হঠার আগে তাঁর ডানহাত খ্যাত টেক জায়ান্ট টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্কের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের সামনে সরাসরি পাল্টা শুল্কের বিরোধিতা করেন মাস্ক। তিনি শুল্কযুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে অবস্থান নেন। তার মতে, শুল্কযুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি, গাড়ি ও অন্যান্য শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মাস্কের মতো আরো ব্যবসায়ীরা শুল্কযুদ্ধে অর্থনীতির সংকট ট্রাম্পকে বুঝানোর চেষ্টা করেন।
কারণ এরইমধ্যে শুল্কযুদ্ধের জেরে বিশ্বজুড়ে আর্থিক বাজারে ধস নামতে শুরু করে। মার্কিন শেয়ারবাজারে ধস নামে, ব্যাপক দরপতন হয়। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দিনে আর্থিক বাজারে গত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৯ ট্রিলিয়ন ডলার।
এদিকে বুধবার ১০ বছর মেয়াদি মার্কিন সরকারি বন্ডের মুনাফার হার একলাফে বেড়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ফেব্রুয়ারির পর সর্বোচ্চ। কয়েক দিন আগেও এই হার ছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। একদিকে বন্ডের চাহিদা কমে পড়েছে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা বেশি মুনাফার জন্য় বন্ড বিক্রি করে দিচ্ছেন। মুনাফার হার বাড়ার মানে হলো, সরকারকে এখন ঋণ নেওয়ার জন্য বেশি মুনাফা দিতে হচ্ছে; যা বিশ্ববাজারে মার্কিন অর্থনীতির আস্থার সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, মার্কিন বন্ড বিক্রির হিড়িকের পেছনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাত থাকতে পারে, যার মধ্যে চীনারা উল্লেখযোগ্য। কারণ তাদের হাতে এখনো ৭৫৯ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন বন্ড রয়েছে।
ডয়চে ব্যাংকের জর্জ সারাভেলোস বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধের পরবর্তী ধাপ হবে এমন আর্থিক যুদ্ধ; যার কেন্দ্রে থাকবে চীনের হাতে থাকা মার্কিন সম্পদ। তিনি সতর্ক করে বলেন, এ যুদ্ধে কেউ জয়ী হবে না। বরং হারবে পুরো বৈশ্বিক অর্থনীতি।
এই পরিস্থিতিতে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করতে হত। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার মতো সংকট তৈরি হোক, তা চায়নি ট্রাম্প প্রশাসন। তাহলে সরকারের উপর বড় অনাস্থা তৈরি হত। ফলে কৌশলগতভাবে পিছু হটে আলোচনার জন্য সময় নিল ট্রাম্প প্রশাসন। এটাই ট্রাম্পের হঠাৎ ইউ-টার্নের সবচেয়ে সম্ভাব্য কারণ বলে মনে হচ্ছে, যদিও তিনি বা তার দল কখনো তা স্বীকার করবে না। তবে এই সিদ্ধান্ত যেমন আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছে, তেমনি আলোচনায় ট্রাম্পের অবস্থানকেও দুর্বল করে দিয়েছে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ এখনো বহাল। স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম ও গাড়ি শিল্পের ওপর শুল্কও এখনো প্রত্যাহার হয়নি। তবুও এই সাময়িক স্বস্তি একদিনেই বিশ্ববাজারকে রেকর্ড চাঙা করেছে। শুল্ক স্থগিত করার পর বুধবার শেয়ারবাজারে ঐতিহাসিক উল্লম্ফন হয়।
ডাও জোন্স মার্কেট ডেটার তথ্যমতে, একদিনের রেকর্ড ভেঙে গতকাল বুধবার মার্কিন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধনে একলাফে ৪.৮ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ হয়। যেখানে আগের চারদিন মিলে ৯ ট্রিলিয়ন ডলার হারিয়েছিল। নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ৮.৯ শতাংশ বেড়ে যায়। নাসডাক কম্পোজিট সূচক ১২ শতাংশ বাড়ে। আর ডাও জোন্স সূচক ২,৭৫৬ পয়েন্ট বা ৭.২ শতাংশ বাড়ে।
শুল্কযুদ্ধ থেকে ট্রাম্পের পিছু হটার পেছনে যে অর্থনৈতিক চাপ ছিল, তা স্পষ্ট। মার্কিন বাজারের অস্থিরতা, ক্ষুদ্র ব্যবসার দুরবস্থা ও শেয়ারবাজারের পতনের সম্মিলিত প্রভাব ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রেখেছে। শুল্কনীতি থেকে পিছু হটা ট্রাম্পের কৌশলের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। তবে চীনসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ এখনও অজানা বলে শুল্কযুদ্ধের পুরোপুরি সমাপ্তি ঘটছে না। তবুও বাণিজ্যিক অস্থিরতা এড়াতে এই যুদ্ধবিরতি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি একেবারে আক্রমণাত্মক ও একপেশে। আগ্রাসীভাবে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নহ কয়েক ডজন দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বাগে আনার একপ্রকার নির্বিচার চেষ্টা করলেন তিনি। ১০ শতাংশ ভিত্তি শুল্কসহ ৭৮টি দেশের উপর শুল্ক আরোপ করলেন। এটাকে শুল্কের চেয়ে ‘বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর হাতিয়ার’ বলা ভালো। এই আক্রমণের শিকার বাংলাদেশও। তবে ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অন্য দেশগুলো শুল্ক হার কমানোর জন্য দেনদরবার শুরু করলেও চীন পাল্টা আঘাত হেনেছে। এর ফলে শুল্কহার বাড়ানোর পাল্টাপাল্টি যুদ্ধ চলছে।
বুধবার তৃতীয় দফায় বাড়িয়ে চীনের উপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার আগে চীন দ্বিতীয় দফায় বাড়িয়ে মার্কিন পণ্যে ৮৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। সর্বশেষ মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির জবাব এখনও দেয়নি চীন। কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ করে ট্রাম্প তাঁর অবস্থানে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছেন। চীনের উপর শুল্ক আরো বাড়ালেও বাকি দেশগুলোর শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, শুল্ক নিয়ে সমঝোতার জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের ফোনে কথা বলার ঘোষণা দিয়েছেন।
অথচ তিনি আগে বড় হুংকার দিয়ে আসছিলেন, কোনোভাবেই এই শুল্ক আরোপ থেকে তিনি সরবেন না। তার দাবি, চীন ও ইইউসহ দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক ঠকিয়ে আসছে। তাঁরা অনেক শুল্ক আরোপ করে বলে বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি থাকে। তাই তাঁর শুল্ক আরোপ ন্যায্য। কিন্তু বড় সপ্তাহখানেকের শুল্কযুদ্ধ থেকে পিছু হটলেন ট্রাম্প। তিনি জানালেন, আলোচনার সুযোগ দিতে সাময়িকভাবে শুল্ক আরোপ স্থগিত রাখা হচ্ছে। আর চীনের ওপর শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা আসলে প্রতীকী পদক্ষেপ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র-চীন মধ্যে বর্তমানে শুল্কহার এতটাই বেশি যে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য কার্যত স্থবির।
ট্রাম্পের এই ঘোষণাকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বড় নীতিগত ‘ইউ-টার্ন’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্টসহ হোয়াইট হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, পরিস্থিতির চাপে পড়ে পিছু হটতে হয়েছে। কী সেই পরিস্থিতি যা ট্রাম্পকে সপ্তাহে ইউ টার্ন নিতে বাধ্য করল?
ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ মূলত খোলামেলা আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ। চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতকে টার্গেট করেছিলেন তিনি। মূল উদ্দেশ্য ছিল ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে বিদেশি পণ্যকে মার্কিন বাজারে কম প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা এবং বিদেশি সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে বাণিজ্য চুক্তি করতে বাধ্য করা। তবে কদিন না পেরোতেই শুল্ক আরোপের উদ্যোগের নেতিবাচক প্রভাব মার্কিন অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুল্কযুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন শেয়ারবাজার ও বন্ডবাজারে ব্যাপক অস্থিরতা এই সিদ্ধান্তের পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে। শেয়ারবাজারে পতনকে পাত্তা না দিয়ে আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, নিয়োগকারীদের ক্ষতি নিয়ে চিন্তিত নন। তবে মঙ্গলবার বন্ড বাজারে ধস পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক করে তোলে। বাস্তবে এটাই তার পলিসি পরিবর্তনের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে মার্কিন বন্ড বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার পর ট্রাম্প বুঝতে পারেন, তার নীতি হয়তো আর বাজারের উপকারে আসছে না।
সাধারণত, শেয়ারবাজারে দরপতন হলে বন্ড বাজারে বিনিয়োগ বাড়ে, অর্থাৎ বন্ড বিক্রি বাড়ে। কিন্তু এবার আতঙ্কে বন্ড বিক্রির হিড়িকে উভয় বাজারেই দরপতন ঘটে। কিছু হেজ ফান্ড বড় অঙ্কের মার্কিন সম্পদ বিক্রি করে দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শেয়ারবাজারে পতনের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শুল্কযুদ্ধের বিরূপ প্রভাব নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। এর ক্ষতিকর বড় প্রভাব পড়ে মার্কিন ব্যবসায়িক মহলের ওপর।
বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। শুল্কের কারণে আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছিলেন ব্যবসায়ীরা। এতে গ্রাহকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছিল। হেজ ফান্ড ব্যবসায়ী বিল অকম্যার এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। শুল্কযুদ্ধ থামাতে তিনি সরাসরি ট্রাম্পের কাছে আবেদন জানান। কারণ, এর কারণে অনেকেরই ছোট ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হয়।
ট্রাম্প শুল্কযুদ্ধ থেকে পিছু হঠার আগে তাঁর ডানহাত খ্যাত টেক জায়ান্ট টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্কের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্পের সামনে সরাসরি পাল্টা শুল্কের বিরোধিতা করেন মাস্ক। তিনি শুল্কযুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে অবস্থান নেন। তার মতে, শুল্কযুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি, গাড়ি ও অন্যান্য শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মাস্কের মতো আরো ব্যবসায়ীরা শুল্কযুদ্ধে অর্থনীতির সংকট ট্রাম্পকে বুঝানোর চেষ্টা করেন।
কারণ এরইমধ্যে শুল্কযুদ্ধের জেরে বিশ্বজুড়ে আর্থিক বাজারে ধস নামতে শুরু করে। মার্কিন শেয়ারবাজারে ধস নামে, ব্যাপক দরপতন হয়। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দিনে আর্থিক বাজারে গত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৯ ট্রিলিয়ন ডলার।
এদিকে বুধবার ১০ বছর মেয়াদি মার্কিন সরকারি বন্ডের মুনাফার হার একলাফে বেড়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ফেব্রুয়ারির পর সর্বোচ্চ। কয়েক দিন আগেও এই হার ছিল ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। একদিকে বন্ডের চাহিদা কমে পড়েছে, অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা বেশি মুনাফার জন্য় বন্ড বিক্রি করে দিচ্ছেন। মুনাফার হার বাড়ার মানে হলো, সরকারকে এখন ঋণ নেওয়ার জন্য বেশি মুনাফা দিতে হচ্ছে; যা বিশ্ববাজারে মার্কিন অর্থনীতির আস্থার সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, মার্কিন বন্ড বিক্রির হিড়িকের পেছনে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাত থাকতে পারে, যার মধ্যে চীনারা উল্লেখযোগ্য। কারণ তাদের হাতে এখনো ৭৫৯ বিলিয়ন ডলারের মার্কিন বন্ড রয়েছে।
ডয়চে ব্যাংকের জর্জ সারাভেলোস বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধের পরবর্তী ধাপ হবে এমন আর্থিক যুদ্ধ; যার কেন্দ্রে থাকবে চীনের হাতে থাকা মার্কিন সম্পদ। তিনি সতর্ক করে বলেন, এ যুদ্ধে কেউ জয়ী হবে না। বরং হারবে পুরো বৈশ্বিক অর্থনীতি।
এই পরিস্থিতিতে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করতে হত। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার মতো সংকট তৈরি হোক, তা চায়নি ট্রাম্প প্রশাসন। তাহলে সরকারের উপর বড় অনাস্থা তৈরি হত। ফলে কৌশলগতভাবে পিছু হটে আলোচনার জন্য সময় নিল ট্রাম্প প্রশাসন। এটাই ট্রাম্পের হঠাৎ ইউ-টার্নের সবচেয়ে সম্ভাব্য কারণ বলে মনে হচ্ছে, যদিও তিনি বা তার দল কখনো তা স্বীকার করবে না। তবে এই সিদ্ধান্ত যেমন আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছে, তেমনি আলোচনায় ট্রাম্পের অবস্থানকেও দুর্বল করে দিয়েছে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধ এখনো বহাল। স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম ও গাড়ি শিল্পের ওপর শুল্কও এখনো প্রত্যাহার হয়নি। তবুও এই সাময়িক স্বস্তি একদিনেই বিশ্ববাজারকে রেকর্ড চাঙা করেছে। শুল্ক স্থগিত করার পর বুধবার শেয়ারবাজারে ঐতিহাসিক উল্লম্ফন হয়।
ডাও জোন্স মার্কেট ডেটার তথ্যমতে, একদিনের রেকর্ড ভেঙে গতকাল বুধবার মার্কিন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধনে একলাফে ৪.৮ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ হয়। যেখানে আগের চারদিন মিলে ৯ ট্রিলিয়ন ডলার হারিয়েছিল। নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ৮.৯ শতাংশ বেড়ে যায়। নাসডাক কম্পোজিট সূচক ১২ শতাংশ বাড়ে। আর ডাও জোন্স সূচক ২,৭৫৬ পয়েন্ট বা ৭.২ শতাংশ বাড়ে।
শুল্কযুদ্ধ থেকে ট্রাম্পের পিছু হটার পেছনে যে অর্থনৈতিক চাপ ছিল, তা স্পষ্ট। মার্কিন বাজারের অস্থিরতা, ক্ষুদ্র ব্যবসার দুরবস্থা ও শেয়ারবাজারের পতনের সম্মিলিত প্রভাব ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে বড় ভূমিকা রেখেছে। শুল্কনীতি থেকে পিছু হটা ট্রাম্পের কৌশলের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। তবে চীনসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ এখনও অজানা বলে শুল্কযুদ্ধের পুরোপুরি সমাপ্তি ঘটছে না। তবুও বাণিজ্যিক অস্থিরতা এড়াতে এই যুদ্ধবিরতি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক
আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ ক্যাম্পেইন এগিয়ে নিতে বিশ্বের দেশগুলোর ওপর বিশাল শুল্ক আরোপ করেছিলেন। যদিও পরে সেই শুল্ক তিনি ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন। কিন্তু চীনের ওপর তিনি শুল্ক বাড়িয়েই চলেছেন। জবাবে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় কাছাকাছি পরিমাণে
১ দিন আগেমার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একসময় অনেকগুলো দেশের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিলেন। তবে এই যুদ্ধে এখন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র প্রতিপক্ষ বলা যায় চীনকেই। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে। গতকাল বুধবার ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, চীন ছাড়া অন্য কোনো দেশের পণ্যের ওপর তিনি...
৪ দিন আগেগোপন চুক্তির আওতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যান্য মিত্রশক্তি—যেমন ইতালি ও রাশিয়াও তুরস্কের কিছু অংশের ওপর নিজেদের দাবি জানিয়েছিল। রুশদের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা ছিল ইস্তাম্বুল শাসন করা এবং একসময়ের বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের মহান রাজধানীতে অর্থোডক্স চার্চের প্রাধান্য পুনরুদ্ধার করা।
৪ দিন আগেবাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো ছোট দেশগুলোকে অর্থনৈতিক সমন্বয়ে জোর দিতে দেখা যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সমন্বয় বলতে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের প্রভাব মোকাবিলায় অর্থনীতিতে পরিবর্তন বা সমন্বয় আনার চেষ্টাকে বোঝানো হচ্ছে।
৬ দিন আগে