Ajker Patrika

বিবিসির প্রতিবেদন /ট্রাম্প কী করেছেন, এ নিয়ে কেন এত আলোচনা

অনলাইন ডেস্ক
সব আমদানি পণ্যে বিভিন্ন মাত্রায় শুল্ক আরোপ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত
সব আমদানি পণ্যে বিভিন্ন মাত্রায় শুল্ক আরোপ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী আমদানি পণ্যের ওপর ব্যাপক শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। দিনটিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘মুক্তির দিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, এই নীতি যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও সমৃদ্ধ করবে। তবে অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করেছেন, এর ফলে পণ্যের দাম বাড়তে পারে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা আরও তীব্র হবে।

শুল্ক হলো এক ধরনের কর, যা অন্য দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর আরোপ করা হয়। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই কর পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া পণ্যের মূল্যের একটি অংশ থেকেও ক্রেতারা কর দিয়ে থাকেন।

ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে আমদানির ওপর ১০ শতাংশ ‘বেসলাইন’ শুল্ক কার্যকর হবে। এটি যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে ৬০টি দেশকে আরও বেশি শুল্ক দিতে হবে, যা সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর জন্য শুল্কহার হবে ২০ শতাংশ। এই শুল্ক কয়েক দিনের মধ্যে কার্যকর হবে।

এর পাশাপাশি ট্রাম্প স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম ও বিদেশি তৈরি গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বজায় রেখেছেন।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, ট্রাম্প কেন শুল্ক আরোপ করলেন। দু-একটি দেশ হলে একটা কথা ছিল, কিন্তু তিনি প্রায় ৬০টি দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন। এর কারণ, ১৯৮০-এর দশক থেকে ট্রাম্প শুল্ককে মার্কিন অর্থনীতির জন্য সহায়ক হিসেবে দেখছেন। তিনি মনে করেন, এতে মার্কিন জনগণ দেশীয় পণ্য কেনায় উৎসাহিত হবে, আমদানির ওপর কর আদায় বাড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস পাবে।

হোয়াইট হাউসের মতে, অন্য দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈষম্যমূলক বাণিজ্যনীতি অনুসরণ করছে। ট্রাম্প বলেছেন, ‘বিগত কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশকে লুট, ধ্বংস ও শোষণ করা হয়েছে। আমাদের বন্ধু ও শত্রু উভয়েই এই কাজ করেছে।’

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প একটি বড় ঝুঁকি নিচ্ছেন।

বিবিসির উত্তর আমেরিকা প্রতিনিধি অ্যান্থনি জারচার মনে করেন, যদি এটি সফল হয়, তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো বদলে যেতে পারে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা ক্ষুব্ধ হতে পারে এবং বিশ্বজুড়ে মন্দার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

বিবিসির অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক ফয়সাল ইসলাম বলেছেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে ১৯৩০-এর দশকের চেয়েও বড় পরিবর্তন আনতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের দাম বাড়বে?

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিগুলো দাম বাড়াতে বাধ্য হবে। এ ছাড়া পণ্যের সরবরাহ কমলে বাজারে দামের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি হতে পারে।

বিবিসির উপ-অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক দর্শিনী ডেভিড বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের বেশি দাম মেনে নিয়েও বিদেশি পণ্য কিনতে হবে, না হলে ট্রাম্পের প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে না।

ইতিহাস বলছে, এ ধরনের শুল্কের ফলে ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারণ, তাঁরা পছন্দের সুযোগ পান কম এবং বেশি দাম দিতে হয়। এ ছাড়া শুল্ক বৃদ্ধির ফলে যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি, বাড়ি নির্মাণের কাঠ, বিয়ার, হুইস্কি, টাকিলা, অ্যাভোকাডোর মতো পণ্যের দাম বাড়তে পারে।

বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া

ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। বিভিন্ন দেশের নেতারা ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, এটি বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে ট্রাম্পের শুল্কের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশেষত জার্মানির গাড়ি শিল্প, ইতালির বিলাসবহুল পণ্য ও ফ্রান্সের ওয়াইন উৎপাদকদের সুরক্ষার জন্য এসব দেশ যেকোনো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।

চীন জানিয়েছে, তারাও ‘প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা’ নেবে, যা মার্কিন কোম্পানিগুলোর জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার বলেছেন, ‘এই শুল্ক আমাদের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তবে আমরা শান্ত ও ঠান্ডা মাথায় প্রতিক্রিয়া জানাব।’

কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেছেন, কানাডার শ্রমিকদের সুরক্ষিত রাখতে এবং অর্থনীতি শক্তিশালী করতে তারাও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেবে।

যুক্তরাজ্যে প্রভাব

যুক্তরাজ্যের জন্য ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। আপাতদৃষ্টিতে অন্যান্য দেশের তুলনায় এটি কম মনে হলেও অর্থনীতিতে নানা প্রভাব ফেলতে পারে, যেমন এই শুল্ক কার্যকর হলে ডলারের মান বাড়তে পারে, যা যুক্তরাজ্যের জন্য আমদানি ব্যয় বাড়াবে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হলে ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যে সস্তায় পণ্য আসতে পারে। দাম বাড়লে কর্মীরা বেতন বৃদ্ধির দাবি জানাতে পারেন। যদি কোম্পানির লাভ কমে যায়, তাহলে ছাঁটাই বেড়ে যাবে।

সুদের হার দীর্ঘদিন বেশি থাকতে পারে। বর্তমানে সুদের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থনীতিবিদেরা আশা করেছিলেন, এ বছর দুই দফা সুদের হার কমানো হবে। তবে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেলে সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত পিছিয়ে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও বৈশ্বিক বাণিজ্যে প্রভাব

আইএমএফের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কেন রগফ জানিয়েছেন, ট্রাম্পের ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

অবশ্য ট্রাম্প নিজেও এই মন্দার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি।

বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির বিশাল অংশ মার্কিন ভোক্তাদের ব্যয়ে নির্ভরশীল। কিন্তু শুল্ক বৃদ্ধির ফলে তারা কম খরচ করলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এশিয়ায় এই শুল্কের ধাক্কা আরও ভয়াবহ হতে পারে। বিবিসির অর্থনীতিবিষয়ক সম্পাদক ফয়সাল ইসলাম বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই শুল্ক হাজার হাজার কোম্পানি, কারখানা এবং কিছু দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত