Ajker Patrika

ট্রাম্পের শুল্কের আঘাত মোকাবিলায় আসিয়ানের দ্বারস্থ চীন

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১৬: ০৮
বেইজিংয়ের গ্রেট হলে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং (ডানে) ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম (বামে)। ছবি: এএফপি
বেইজিংয়ের গ্রেট হলে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং (ডানে) ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম (বামে)। ছবি: এএফপি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এলোমেলো ও লাগামহীন শুল্কারোপের কারণে বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির বাজার খ্যাত আসিয়ানের দেশগুলো বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে। ট্রাম্পের শুল্কের খড়্গ নেমে এসেছে চীনের ওপরও। এই অবস্থায় চীন ও আসিয়ান পরস্পরের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প নিয়েছে। আর তাই পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আসিয়ান সদস্য ভিয়েতনাম সফরে গেছেন তিনি। এরপর যাবেন জোটের আরেক সদস্য ও বর্তমান চেয়ার মালয়েশিয়াতেও।

হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটনের এলোমেলো শুল্ক বৃদ্ধির কারণে প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, রপ্তানিকারকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির কারণে পুরো বিশ্বব্যবস্থাই ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ঠিক তখনই মালয়েশিয়া আগামীকাল মঙ্গলবার চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।

২০১৩ সালের পর মালয়েশিয়ায় এটাই হবে সি’র প্রথম সফর। তিনি তিন দিন থাকবেন মালয়েশিয়ায়। এই সময় তিনি দেশটির রাজা সুলতান ইব্রাহিম ইস্কান্দার ও প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এই সফরে আগামী বুধবার দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

টানা ১৬ বছর ধরে চীন মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। গত বছর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে আমেরিকার বিশাল বাজার এখনো মালয়েশিয়ার পণ্যের প্রধান ক্রেতা। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র মালয়েশিয়া থেকে ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য কিনেছে, যার বেশির ভাগই উচ্চ-টেক চিপ তৈরির গুরুত্বপূর্ণ সেমিকন্ডাক্টর।

তবে ট্রাম্পের তরফ থেকে মালয়েশিয়ার পণ্যের ওপর ২৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ দেশটির গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। যদিও আপাতত সেমিকন্ডাক্টরের ওপর শুল্ক স্থগিত করা হয়েছে। ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য শুল্ক স্থগিত করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সি’র এই সফর মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলোকে সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে চীনের বাজারে আরও ভালো সুযোগ খুঁজতে সাহায্য করবে।

লোওয়ি ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রোগ্রামের গবেষণা ফেলো আব্দুল রহমান ইয়াকুব বলেন, ‘চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক উদ্বেগ অভিন্ন। কারণ ট্রাম্পের শুল্ক তাদের লক্ষ্যবস্তু করেছে। ফলে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

ট্রাম্পের বিশৃঙ্খল শুল্ক নীতির কারণে চীনই এখন বিশ্বব্যাপী মুক্ত বাণিজ্যের রক্ষকের ভূমিকায়। যুক্তরাষ্ট্র যখন বাজার বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চীনের উৎপাদন ক্ষমতার জন্য ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে উঠছে। ফলে এই অঞ্চলে চীনের অতিরিক্ত পণ্য ডাম্পিংয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ইউনিভার্সিটি মালায়ার কৌশলগত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার রয় অ্যান্থনি রজার্স বলেন, মালয়েশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শুল্ক আলোচনা চালিয়ে গেলেও সি চিনপিংয়ের এই সফর ‘দুই দেশের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে।’

অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সি চিনপিংয়ের সপ্তাহব্যাপী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরের লক্ষ্য হলো ওয়াশিংটনের কৌশলকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি চীনের আহ্বানের পক্ষে সমর্থন তৈরি করা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধান অর্থনীতির দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে, বিশ্বের এই দুই প্রভাবশালী দেশের মধ্যে কোনো পক্ষ নিতে তারা রাজি হয়নি।

তবে এই অঞ্চলের সরকারগুলো ট্রাম্পের অস্থিরতা ও পরিবর্তনশীলতা কারণে এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নিয়ন্ত্রণ দাবি করার কারণে সৃষ্টি নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন। আসিয়ান জোটের বর্তমান চেয়ারপারসন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম সোমবার দৃঢ় সুরে বলেন, এই অঞ্চলের ৬৬ কোটি মানুষ ও ৩ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতির ‘অভ্যন্তরীণ শক্তি’ আসিয়ানকে উপলব্ধি করতে হবে।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আসিয়ান বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি এবং এটি সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চল। যদি আমরা এই দুটি শক্তির ওপর ভরসা রাখি, তাহলে কোনো পরাশক্তি আমাদের উপেক্ষা বা প্রান্তে ঠেলে দিতে পারবে না।’

তবে আসিয়ান এখনো শুল্কের বিষয়ে কোনো অভিন্ন অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি। এর প্রধান অর্থনীতির দেশগুলো শাস্তিমূলক শুল্কের মেঘ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হোয়াইট হাউসের সঙ্গে দ্রুত আলোচনা করতে চাইছে।

বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলো সতর্ক করে দিয়েছে যে, মার্কিন শুল্ক মালয়েশিয়ার বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম থেকে শুরু করে কাঠের আসবাবপত্র এবং রাবার গ্লাভস পর্যন্ত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানির চাহিদা মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেবে, যার ফলে বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি এবং কয়েক হাজার কর্মসংস্থান হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের মেয়াদে সি চিনপিংয়ের সর্বশেষ কুয়ালালামপুর সফর বেশ কিছু বড় চুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—১ দশমিক ২ বিলিয়ন রিঙ্গিতের চারটি চীনা নকশার নৌজাহাজ এবং সি চিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অধীনে ৫০ বিলিয়ন রিঙ্গিতের ইস্টার্ন কোস্ট রেল লিংক প্রকল্পের অধিগ্রহণ।

মালয়েশিয়া ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ১৯৭৪ সালে স্থাপিত হয়। সে সময় মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী আবদুল রাজাক হুসেন বেইজিং সফর করেন। মালয়েশিয়ার সঙ্গে অংশীদারত্বের প্রাথমিক বছরগুলোতে চীন অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা লাভ করেছিল। মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী উল্লেখযোগ্য চীনা বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠী (বর্তমানে প্রায় ৭.৪ মিলিয়ন বা মালয়েশিয়ার ৩ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার ২২ শতাংশ) নিয়মিতভাবে তহবিল সংগ্রহ করে চীনকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে সাহায্য করত।

তবে ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য (ডব্লিউটিও) সংস্থায় যোগদানের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয় এবং মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সরবরাহ ব্যবস্থা অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, কারণ চীনা কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত উৎপাদন ডাম্প করে স্থানীয় ব্যবসাগুলোকে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ধ্বংস করে দিয়েছে।

সি চিনপিংয়ের সফর উপলক্ষে মালয়েশিয়ার জাতীয় সম্প্রচার কেন্দ্র রেডিও টেলিভিশন মালয়েশিয়া দিনে দুবার মালয় ভাষায় একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করেছে। এই অনুষ্ঠানে চীনা নেতার ব্যবহৃত ক্ল্যাসিক চীনা প্রবাদগুলো তুলে ধরা হচ্ছে, যা মালয়েশীয়দের তার প্রশাসনিক দর্শন বুঝতে ‘একটি নতুন জানালা’ হিসেবে কাজ করবে।

সি’র সফরকালে নির্দিষ্ট সময়ে প্রধান মহাসড়কগুলো জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাঁর সফরের কর্মসূচিতে বুধবার সুলতান ইব্রাহিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মধ্যাহ্নভোজ (সুলতান ইব্রাহিম এর আগে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বেইজিং সফরে সি চিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন), এরপর আনোয়ারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও নৈশভোজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

আসিয়ান চেয়ার হিসেবে আনোয়ার ইব্রাহিমের সি’র কাছে জোটের স্বার্থ তুলে ধরার কথা আছে। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আসিয়ানের চীন ও মার্কিন বাজারের ওপর নির্ভরতা কমানো উচিত। ইউনিভার্সিটি মালয়ার রজার্স বলেন, ‘আমি মনে করি মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এই অঞ্চলের নিজস্ব সক্ষমতা থাকা উচিত।’

রজার্স আরও বলেন, ‘আসিয়ানের উচিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি করা।’ মালয়েশিয়া জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আঞ্চলিক বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য পূর্ব এশিয়া অর্থনৈতিক ককাসকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

আসিয়ানের সম্মিলিত প্রভাবের একটি নিদর্শন হিসেবে শুক্রবার মালয়েশিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইউরোপীয় মুক্ত বাণিজ্য সংস্থা (আইসল্যান্ড, লিকটেনস্টেইন, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড) এর সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ঘোষণা করেছে। লোয়ি ইনস্টিটিউটের আব্দুল রহমান ইয়াকুব বলেন, ‘ট্রাম্পের ঝড় মোকাবিলায় জোটের চীনের সঙ্গে গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রয়োজন হলেও, মালয়েশিয়া ও আসিয়ানের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার অবস্থানে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম।’

মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিস্তৃত ঐতিহাসিক দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক আঞ্চলিক দাবি রয়েছে। প্রতি বছর অন্তত ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এই সমুদ্রপথ দিয়ে যায়।

আব্দুল রহমান বলেন, ‘মার্কিন শুল্কের শিকার দেশগুলো দীর্ঘ মেয়াদে তাদের রপ্তানি বাজার বহুমুখী করবে। এর অর্থ এই নয় যে, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোকে তাদের নিরপেক্ষতা বা জোটনিরপেক্ষতা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে। বরং, এই দেশগুলো বিকল্প অর্থনৈতিক অংশীদার ও বাজার খুঁজে নেবে। উদাহরণস্বরূপ, মালয়েশিয়া আফ্রিকা ও জিসিসির (গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল) দিকে নতুন বাজার হিসেবে নজর দিতে পারে।’

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহ-সম্পাদক আব্দুর রহমান

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত