Ajker Patrika

কসাই

জাহীদ রেজা নূর
Thumbnail image

তোলিয়ার চেহারাটা আজও ভুলিনি। ও ছিল কসাই।কসাই না বলে মাংসবিক্রেতা বললেই বুঝি ভালো হয়। আমাদের কুবান বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে, তারই এক কোনে ‘আগ্রোপ্রোম’ নামে একটি মাছ-মাংস-সবজির দোকান ছিল। এই দোকানের আলুর স্বাদ আমি কোনো দিন ভুলব না। কোন যৌথ খামার থেকে এই আলু আসত, জানি না, কিন্তু যেভাবেই তা রান্না করতাম বা ভাজতাম, তাতে আলুর স্বাদটা হতো মনের মতো। আলুও যে আলাদাভাবে সুস্বাদু হতে পারে, সেটা আগ্রোপ্র্রোমের আলু খেয়েই প্রথম বুঝেছি। এর আগে আলু নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। 

আরও একটা কথা, ‘নতুন আলু’ যে স্বাদে-গন্ধে পুরোনো আলুর চেয়ে একেবারেই আলাদা, সেটাও সোভিয়েত জীবন শুরু হওয়ার পর বুঝতে শুরু করেছিলাম। 

ক্লাসের পর যখন একা লাগত, তখনই বের হয়ে পড়তাম। কখনো ট্রামে, কখনো ট্রলিবাসে, কখনো বাসে করে চলে যেতাম বহু দূর। সে অভিজ্ঞতার কথাও বলব ধীরে ধীরে। আজ বলব সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যখন দেশগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তার পরের কথা। সোভিয়েত যুগের নিশ্চিন্ত নির্ভরতা তত দিনে হারিয়ে গেছে। রুশ দেশের মানুষেরা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে কত ধানে কত চাল। দুর্নীতি বেড়ে গেছে, তৈরি হয়েছে মাফিয়ার দল, বাইরের দেশ থেকে পণ্য আসছে, তা বিক্রি হচ্ছে খোলা বাজারে। তার বেশির ভাগই কালো বাজার। মানুষের হাতে টাকা নেই। আবার একদল মানুষ টাকার পাহাড়ে বসে আছে। এ রকম এক অরাজক অবস্থায় আমরা দিন কাটাচ্ছিলাম। এখন যে ঘটনার কথা বলব, সেটা মনে হয় ১৯৯৪–৯৫ সালের দিকের ঘটনা। 

আগ্রোপ্রোম দোকানটায় বিদেশিরা খুব একটা যেত না। রাশান বা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের লোকেরাই যেত। আমি সেখান থেকে কখনো কখনো বাজার করতাম। 

সেই দোকানে মাংস বিক্রি করত তোলিয়া। আমার চেয়ে বয়সে বড়। আনাতোলিকে আদর করে তোলিয়া নামে ডাকা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের রীতি অনুসারে সবাইকে লাইনে দাঁড়াতে হতো। একের পর এক ক্রেতা নিজেদের পছন্দমতো মাংসের টুকরো বেছে নিতেন। 

একদিন তোলিয়া জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নাম কী?’ 
বললাম। 
‘কোন দেশ থেকে এসেছ, কিউবা? ইন্ডিয়া?’ 
‘না। বাংলাদেশ।’ 
‘এটা কোথায়?’ 
‘ইন্ডিয়ার পাশেই।’ 
‘ইন্ডিয়ায় তো গরু খায় না!’ 
‘কেউ কেউ খায়। ওই দেশে অনেকগুলো ধর্মের মানুষ থাকে। কেউ গরু খায়, কেউ খায় না। আমরা বাংলাদেশে গরু খাই।’ 
‘ভালো ভালো!’ 
আমি আমার মনের মতো মাংস কিনে ফিরে এলাম। 

এর পর থেকে ঘটতে থাকল এক অদ্ভুত ঘটনা। আমি যখনই আগ্রোপ্রামে যেতাম, লাইনে দাঁড়াতাম, তোলিয়া আড়চোখে আমাকে দেখত। কিন্তু কোনো কথা বলত না। আমি যখন একটু একটু করে লাইনের এক নম্বরে আসতাম, তখন ও আমাকে দাঁড়াতে বলে একটা মাংসের ট্রে নিয়ে চলে যেত ভিতরে। সেখান থেকে কুড়ালে মাংস কাটার শব্দ শোনা যেত। তারপর এমন মাংস নিয়ে আসত, যাতে হাড়ের চেয়ে মাংসের পরিমাণ অনেক বেশি। 

প্রথম দিকে কেউ সেটা খেয়াল করত না। কিছু হিংসুটে বুড়ি সব দেশেই থাকে। ওরা সবখানেই একটা গন্ডগোল বাধিয়ে দেয়। সে রকমই এক বুড়ির চোখে পড়ল, আমার পালা আসতেই তোলিয়া চলে যায় ভিতরে, সেখান থেকে ভালো ভালো মাংস নিয়ে আসে। তা থেকেই বেছে আমাকে দেয়। 

সেই বুড়ি ছিল আমার ঠিক পেছনে। বিড়বিড় করে বলছিল, ‘এইবার কসাই ভিতরে গিয়ে ভালো মাংস নিয়ে আসবে। এই বিদেশি ছেলেটার জন্য আলাদা আয়োজন।’ 

বুড়ির বিড়বিড়ানি তোলিয়ার কানে গেল। সে বলল, ‘হ্যাঁ, ওর জন্য আমি ট্রে নিয়ে মাংস আনতে যাব।’ 

‘ওরা তো এ দেশে এসে দেশটা ছারখার করে দিল। আমরা এ দেশের নাগরিকেরাই খেতে পাই না, আর এরা এসে আমাদের খাওয়ায় ভাগ বসাচ্ছে!’ 
‘ওরা তো উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। ওরা পড়াশোনা করছে। দেশে ফিরে প্রত্যেকেই বিজ্ঞানী হবে।’ 
‘ওদের বিজ্ঞানী হওয়ার নিকুচি করি। নিজের দেশে গিয়ে বিজ্ঞানী হোক। আমাদের দেশটাকে জ্বালাচ্ছে কেন?’ 
তোলিয়া বলল, ‘আমি ট্রেতে করে মাংস নিয়ে এলে কি সব মাংস ও নিয়ে যাবে? ওটার ভাগ আপনি পাবেন না?’ 

এবার কথাটা বুঝতে পারে বুড়ি। আসলে আমার জন্য মাংস কেটে আনলে তার ভাগ্যেও জুটবে কম হাড়ওয়ালা মাংস। কিন্তু তাতেও তিনি দমলেন না। এবার লড়াইটা চালালেন অন্যভাবে, ‘ও এখান থেকেই মাংস নিক। কিংবা একটু অপেক্ষা করুক। তুমি আমার জন্য ট্রে ভরে নিয়ে এস। আগে আমি নেব, তারপর ও নেবে।’ 

তোলিয়া বলল, ‘এটা আমার দোকান। আমি যেভাবে চাইব, সেভাবেই হবে। আপনি মাংস নিলে নেবেন, না হলে লাইন থেকে সরে দাঁড়ান। অযথা এখানকার পরিবেশ নষ্ট করবেন না!’ 

তোলিয়ার সঙ্গে তর্ক করে পারবে না বলে বুড়ি এবার আমাকেই গালাগাল দিতে লাগল। আমাদের কারণেই নাকি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙেছে, আমাদের পালতে গিয়েই সোভিয়েতরাজের খাজাঞ্চিখানা উজাড় হয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। 

তখন খুব মেজাজ খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এখন ভাবি, সে সময় বুড়িরা হঠাৎ করে দারিদ্র্যের যে অকুল দরিয়ায় পড়েছিল, তাতে পৃথিবীর সবকিছুর প্রতিই তাদের রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক।

১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে দেশে ফেরার আগপর্যন্ত তোলিয়া আমার জন্য ওর নিয়মটাই বহাল রেখেছিল। এসব ছোট ছোট ভালোবাসার গল্পগুলোই আনন্দ দেয়। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত