Ajker Patrika

যে জীবন কাটে স্বীকৃতিহীন শ্রমে

অর্চি হক, রাঙামাটি থেকে ফিরে
ফলে-ফসলে পাহাড় ভরে ওঠে যাঁদের হাতে, তাঁরাই থেকে যান পর্দার আড়ালে, স্বীকৃতিহীন। ছবি: আজকের পত্রিকা
ফলে-ফসলে পাহাড় ভরে ওঠে যাঁদের হাতে, তাঁরাই থেকে যান পর্দার আড়ালে, স্বীকৃতিহীন। ছবি: আজকের পত্রিকা

‘দিনে কত ঘণ্টা খাটি, তার কোনো হিসাব নাই। বিয়ের আগে বাবার জমিতে কাজ করেছি, বিয়ের পরে করছি স্বামীর জমিতে। কাজের নামও নাই, দামও নাই।’

ভাঙা ভাঙা বাংলায় চাকমা উচ্চারণে পুণ্যদেবী চাকমা যা বললেন, তাকে চলতি বাংলায় এভাবেই লেখা যায়। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার সাবেক্ষ্যং ইউনিয়নের কাপ্তাই লেক ঘেঁষা পশ্চিম দেওয়ান পাড়ায় বসবাস তাঁর। বয়স ষাটের কাছাকাছি। ছোটবেলায় বাবার জমিতে যখন কাজ শুরু করেন, তখন বয়স কত ছিল মনে করতে পারেন না তিনি। তবে খানিকটা ভেবে হাতের কড় গুনে হিসাব করে যা জানালেন, তাতে এটুকু বোঝা গেল, জীবনের অন্তত ৪০টি বছর কৃষিকাজ করেই কেটেছে তাঁর।

পুণ্যদেবী চাকমার সংসারে আছে ছয় সন্তান—পাঁচ মেয়ে, এক ছেলে। প্রতিদিন ভোরে ঘর ছেড়ে চাষের কাজে নেমে পড়েন তিনি। শুকনা মৌসুমে কাপ্তাই লেকের পানি কমে জেগে ওঠা জমিতে ধানের আবাদ করেন। বর্ষায় যখন লেকের পানি বাড়তে শুরু করে, চাষের জমি তলিয়ে যায়, তখন পুণ্যদেবী ছুটে যান অন্যের ফল ও সবজি বাগানে বা মসলার খেতে দিনমজুরি করতে। এ সময় স্বামীও সঙ্গে থাকেন। স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি কাজ করলেও পারিশ্রমিকের ফারাকটা বিস্ময়কর। ‘আমার স্বামী দিনে ৫০০ টাকা পায়, আমি পাই ৩০০। অথচ কাজ একই’—বলেন পুণ্যদেবী। কৃষি তাঁর জীবিকা, কিন্তু নিজের নামে নেই কোনো জমি। তাই কৃষিঋণ বা কৃষি সহায়তা সরঞ্জাম—কিছুই পান না তিনি। এসব বিষয়েও কিছু জানেন না!

শুধু পুণ্যদেবী চাকমা নন, হাজারো পাহাড়ি নারীর গল্পটা এমনই। ফলে-ফসলে পাহাড় যাঁদের হাতে ভরে ওঠে, তাঁরাই থেকে যান পর্দার আড়ালে—স্বীকৃতিহীন। রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সামাজিক চর্চায় তাঁরা আজও ‘কৃষক’ নন, বরং সহযোগী বা সাধারণ গৃহবধূমাত্র।

বছর ত্রিশের হিশা চাকমা দিনে অন্তত আট ঘণ্টা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। কিন্তু ফসল বিক্রির টাকা তাঁর নিজের হাতে আসে না। কারণ, জমিটা তাঁর বাবার। দুই ভাই রয়েছে হিশার। নিজেদের সিদ্ধান্তে, নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী কৃষি বা অন্য কাজ করে উপার্জন করেন ভাইয়েরা। কিন্তু হিশার সেই সুযোগ নেই। কারণ, তিনি নারী। তাঁর গণ্ডি যেন বাবার জমিটুকু পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তবে সেখানেও কাগজে-কলমে নেই তাঁর নাম!

বছর পঁয়ত্রিশের রেনী চাকমাও চাষাবাদ করেন। তাঁর স্বামী বেসরকারি একটি স্কুলের শিক্ষক। কিন্তু তিনি নিয়মিত বেতন পান না। রেনীর চাষাবাদের আয়েই চলে সংসার। অথচ সামাজিকভাবে এই নারীর পরিচয়—গৃহবধূ।

রাঙামাটির কাপ্তাই লেক ঘেঁষা গ্রামগুলোতে নারীদের জীবন সরাসরি জড়িয়ে আছে লেকের পানির ওঠানামার সঙ্গে। যখন লেকের পানি কমে যায়, তখন জেগে ওঠা উর্বর জমিতে তাঁরা ধান চাষ করেন। বর্ষাকালে, যখন লেক ফুলে-ফেঁপে ওঠে, জমি চলে যায় জলের নিচে, তখন সংসার চালাতে তাঁরা বাধ্য

ফলে-ফসলে পাহাড় ভরে ওঠে যাঁদের হাতে, তাঁরাই থেকে যান পর্দার আড়ালে, স্বীকৃতিহীন। ছবি: আজকের পত্রিকা
ফলে-ফসলে পাহাড় ভরে ওঠে যাঁদের হাতে, তাঁরাই থেকে যান পর্দার আড়ালে, স্বীকৃতিহীন। ছবি: আজকের পত্রিকা

হন অন্যের জমিতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতে। তাতে একই ধরনের কাজ করেও নারী ও পুরুষের মজুরিতে রয়েছে বিশাল ফারাক। সেখানে পুরুষ কৃষিশ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা, আর নারীদের ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কখনো অনাবৃষ্টি, কখনো অতিবৃষ্টি—দুটোই ভোগাচ্ছে পাহাড়ি নারীদের। শুকিয়ে যাচ্ছে ঝিরিগুলো। সুপেয় পানির জন্যও ভুগতে হচ্ছে এই নারীদের। নানিয়ারচরের পঞ্চাশোর্ধ্ব মায়াদেবী বলেন, পানি নিয়ে এখানে কাড়াকাড়ি অবস্থা। প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে

১০-১২ কলস পানি আনতে হয়। প্রতিদিন এত

পানি বহন করার ফলে মেরুদণ্ড, হাঁটু ও কোমরে আজকাল প্রচণ্ড ব্যথা হয় বলে জানান তিনি।

রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক আমিনুর ইসলাম জানিয়েছেন, কৃষিকাজে জড়িত পাহাড়ি নারীরা ঋণ নিতে চান না খুব একটা। এ ছাড়া সরকার ও রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের তহবিল থেকে কৃষি সম্প্রসারণে যেসব প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা কর্মসূচি থাকে, সেখানেও নারীদের অংশগ্রহণ কম।

ফলে-ফসলে পাহাড় ভরে ওঠে যাঁদের হাতে, তাঁরাই থেকে যান পর্দার আড়ালে, স্বীকৃতিহীন। ছবি: আজকের পত্রিকা
ফলে-ফসলে পাহাড় ভরে ওঠে যাঁদের হাতে, তাঁরাই থেকে যান পর্দার আড়ালে, স্বীকৃতিহীন। ছবি: আজকের পত্রিকা

মহালছড়ির কৃষিজীবী নারী ডলি মারমা বলেন, ‘আমরা ব্যাংকে বা সরকারি অফিসে যেতে ভয় পাই। গেলেও বিভিন্ন কাগজপত্র চায়, এগুলো জটিল। আমরা এগুলো জানি-বুঝি কম।’

কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৫ সালে কৃষকদের কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেওয়ার কার্যক্রম নেওয়া হয়েছিল। কৃষক পরিবারের প্রধানকে এই কার্ড দেওয়ায় খুব কম নারীই সেই কার্ড পেয়েছিলেন। ২০২৩ সালে স্মার্ট কৃষি কার্ড প্রদানের উদ্যোগ নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। এর আওতায় দেশের ২ কোটি ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৩২১টি কৃষক পরিবারকে ‘কৃষক স্মার্ট কার্ড’ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। পাহাড়ের নারীরা জানান, জমির মালিকানাসহ সব নথিপত্র সাধারণত পুরুষের নামে হয়। তাই নারীরা এই কার্ড পাবেন না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইফুল আলম বলেন, ‘যিনি কৃষিকাজ করেন, কৃষি কার্ড, কৃষিঋণসহ যাবতীয় প্রণোদনা তাঁরই পাওয়া উচিত। অনেক সময় দেখা যায়, পরিবারের নারী সদস্য কৃষিকাজ করেন, আর পুরুষ অন্য পেশায় জড়িত। অথচ কৃষি কার্ড হয় পুরুষের নামে। পাহাড়েও এমনটা হয়ে থাকে। নতুন প্রকল্পের আওতায় আমরা চেষ্টা করব, পরিবারে যিনি কৃষিকাজ করেন, যাচাই-বাছাই করে তাঁকেই যেন কৃষি কার্ড দেওয়া হয়।’

সুইডিশ দূতাবাসের অর্থায়নে রাঙামাটিসহ দেশের পার্বত্য, চর, হাওর ও উপকূলীয় ১৩টি জেলায় কমিউনিটিভিত্তিক জলবায়ু-সহনশীলতা ও নারীর ক্ষমতায়ন কর্মসূচি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘আমাদের দেশে নারীদের কৃষক হিসেবে গণ্যই করা হয় না। পাহাড়েও কৃষিকাজে নারীর কোনো স্বীকৃতি নেই; পাশাপাশি যাতায়াতের প্রতিবন্ধকতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও তাঁদের নানা রকম প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।’ পাহাড়ে নারীদের কৃষিকাজে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পলিসি সাপোর্ট প্রয়োজন। পাশাপাশি তাঁদের জন্য প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি উপকরণ, সুপেয় পানি এবং শিশুদের ডে কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা করা দরকার বলে মনে করেন শাহীন আনাম।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

২১ বছর বয়সেই ব্যবসায় বাজিমাত, দুই বছরে বিক্রি আড়াই কোটির বেশি

নিহতের ফোনের ভিডিওতে মিলল ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ চিত্র: বিবিসির অনুসন্ধান

ইন্টারনেট ছাড়াই চলবে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী

বেশি চিন্তা তৈরি পোশাকে, কারখানা বন্ধের শঙ্কা

জুলাইয়ে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন হাসিনা, ফাঁস হওয়া অডিও বিশ্লেষণ করে জানাল বিবিসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত