Ajker Patrika

নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন যে আফ্রিকান, ছিল নিজস্ব মুদ্রাও

অনলাইন ডেস্ক
যুক্তরাষ্ট্রের স্ব-ঘোষিত সম্রাট জোশুয়া নর্টন। ছবি: ওকল্যান্ড জাদুঘর
যুক্তরাষ্ট্রের স্ব-ঘোষিত সম্রাট জোশুয়া নর্টন। ছবি: ওকল্যান্ড জাদুঘর

সময়টা ১৮৫৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের সকাল। এক সুসজ্জিত ব্যক্তি সান ফ্রান্সিসকোর ‘দ্য সান ফ্রান্সিসকো ইভনিং বুলেটিনের’ কার্যালয়ে প্রবেশ করে একটি ঘোষণাপত্র জমা দেন, যেখানে নিজেকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের সম্রাট’ বলে ঘোষণা করেন। ওই ব্যক্তি ছিলেন জোশুয়া নর্টন। দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্মগ্রহণ করলেও নর্টন সান ফ্রান্সিসকোর বাসিন্দা ছিলেন। বেশ কয়েকবার ব্যবসায়িক ব্যর্থতা ও আর্থিক বিপর্যয়ের পর তিনি নিজেকে নতুনভাবে সমাজের সামনে তুলে ধরেন এবং ‘যুক্তরাষ্ট্রের সম্রাট, প্রথম নর্টন’ উপাধি গ্রহণ করেন।

নর্টন ১৮১৮ সালে দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের ডেপটফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮২০ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে তিনি পরিবারের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যান। তাঁর বাবা ছিলেন এক সাধারণ সফল কৃষক ও ব্যবসায়ী। ২৭ বছর বয়সে নর্টন যুক্তরাষ্ট্র চলে আসেন এবং ১৮৪৯ সালে ‘ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ড রাশ’ চলাকালে সান ফ্রান্সিসকোয় পৌঁছান। সেখানে তিনি একজন ব্যবসায়ী ও রিয়েল এস্টেট দালাল হিসেবে অল্প সময়েই সফল হন এবং সান ফ্রান্সিসকোর ধনী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জীবনযাপন করেন। তবে, ১৮৫২ সালে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ। সে সময় নিম্নমানের চালে শহর প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ আইনি লড়াই ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ও তাঁর বিরুদ্ধে যাওয়ার পর এবং নর্টন ১৮৫৬ সালে নিজকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন এবং সবকিছু হারান।

কিছু সময়ের জন্য নর্টন জনজীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। কিন্তু ১৮৫৯ সালে তিনি নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে পুনরায় আবির্ভূত হন। তাঁর এই দাবি সম্পূর্ণ প্রতীকী ছিল এবং এর কোনো আইনি ভিত্তি ছিল না। তবুও সান ফ্রান্সিসকোবাসী তাদের নতুন ‘সম্রাটকে’ ব্যাপক হাস্যরস ও আন্তরিকতার সঙ্গেই গ্রহণ করে। নীল রঙের ইউনিফর্ম, কাঁধে পিতলের প্রতীক এবং বীভার হ্যাট পরা নর্টন মানবাধিকার থেকে শুরু করে অবকাঠামো পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে ৪০০ টিরও বেশি ঘোষণা জারি করেন।

এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল হাস্যকর—যেমন আইস স্কেটিং রিঙ্কে তাঁকে স্কেট দিতে অস্বীকার করায় তাঁর ক্ষোভ। আবার কিছু ছিল লক্ষণীয়ভাবে প্রগতিশীল। তিনি আফ্রিকান আমেরিকান, আদিবাসী আমেরিকান, নারী এবং বিশেষ করে চীনা অভিবাসীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলতেন। কারণ, সে সময় এসব জনগোষ্ঠীর লোকজন ক্যালিফোর্নিয়ায় ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হতেন। নর্টন আইনের চোখে তাদের সমান অধিকার দাবি করেন এবং বর্ণবাদী সহিংসতার নিন্দা করেন।

নর্টনের নামে ব্যাংক নোট জারির ঘোষণা। ছবি: সংগৃহীত
নর্টনের নামে ব্যাংক নোট জারির ঘোষণা। ছবি: সংগৃহীত

তাঁর সবচেয়ে স্থায়ী উত্তরাধিকার সম্ভবত সান ফ্রান্সিসকো ও ওকল্যান্ডের মধ্যে একটি সেতু নির্মাণে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। ১৮৭২ সালে তিনটি পৃথক ঘোষণায় নর্টন একটি রেলওয়ে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ওকল্যান্ড পয়েন্ট থেকে গোট আইল্যান্ডের (বর্তমান ইয়েরবা বুয়েনা আইল্যান্ড) মাধ্যমে টেলিগ্রাফ হিল পর্যন্ত একটি সাসপেনশন সেতুর পক্ষে মত দেন। এই ধারণাটি শেষ পর্যন্ত বাস্তব রূপ পায় ১৯৩৬ সালে সান ফ্রান্সিসকো-ওকল্যান্ড বে ব্রিজ নির্মাণের মাধ্যমে। এই সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে নর্টনের প্রস্তাবিত পথ প্রায় হুবহু অনুসরণ করা হয়েছিল।

কোনো আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও নর্টন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। দোকানদাররা তাঁর জারি করা ‘প্রমিসরি নোট’ গ্রহণ করত, ব্যাংকগুলো তাঁর নামাঙ্কিত মুদ্রা তৈরি করত এবং স্থানীয়রা তাঁকে বিনা মূল্যে খাবার ও থাকার জায়গা দিত। তিনি সান ফ্রান্সিসকোর প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক দৃশ্যের এক প্রিয় খেয়ালি ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

নর্টনের ঘোষণাগুলো প্রায়শই সংবাদপত্রে ছাপা হলেও সবগুলি আসল ছিল না। কিছু সম্পাদক প্রচার সংখ্যা বাড়াতে বা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গ করতে নকল ঘোষণা তৈরি করতেন। নর্টন এটি জানতেন এবং প্রায়শই নকল ঘোষণার নিন্দা করতেন। এমনকি ১৮৭০ সালে তিনি ‘দ্য প্যাসিফিক আপিল’ নামে আফ্রিকান আমেরিকান নাগরিক অধিকার বিষয়ক সংবাদমাধ্যমকে তাঁর সরকারি মুখপত্র হিসেবে ঘোষণা করেন।

জোশুয়া নর্টনের সাম্রাজ্য প্রায় ২০ বছর স্থায়ী ছিল। ১৮৮০ সালের ৮ই জানুয়ারি ৬১ বছর বয়সে সান ফ্রান্সিসকোর একটি রাস্তায় পড়ে গিয়ে তিনি মারা যান। যদিও তিনি প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় মারা যান, তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। আনুমানিক ১০ হাজার মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিল এবং তাকে একটি রোজউড কফিনে করে সমাহিত করা হয়। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই তাঁর স্মৃতিকে সম্মান জানান।

সম্রাট নর্টনের গল্প আজও। মার্ক টোয়েন এবং রবার্ট লুই স্টিভেনসনের মতো সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বরা তাঁকে তাদের সাহিত্যে অমর করে রেখেছেন। বেশ কয়েকটি সংগঠন তখন থেকে তাঁকে তাদের পৃষ্ঠপোষক সাধু হিসেবে ঘোষণা করে। বে ব্রিজের একটি অংশের নাম তার নামে করার জন্য স্থানীয় প্রচেষ্টা এখনো চলছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত