Ajker Patrika

গাজার বস্তি থেকে নাসায়, মঙ্গলে পাঠানো হেলিকপ্টারটি তাঁর হাতেই তৈরি

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image

গত কয়েক দিন ধরেই পৃথিবীর বাইরে পাঠানো প্রথম হেলিকপ্টারটি মঙ্গলগ্রহে বিধ্বস্ত হওয়ার খবর নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। মঙ্গলগ্রহে প্রায় চার বছর কাজ করার পর গত ১৮ জানুয়ারি গ্রহের একটি অঞ্চলে ইনজেনুইটি নামে স্বয়ংক্রিয় হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়।

বিশ্বের প্রথম এই মহাকাশ হেলিকপ্টার তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ফিলিস্তিনের গাজা! ইসরায়েলি দখলদারদের হাতে অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় বেড়ে ওঠা একজনের মাথা থেকেই বেরিয়েছে এই অসাধারণ প্রকৌশল জ্ঞান। তিনি ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন প্রকৌশলী লোয়ে আর বাসিউনি। রোবোটিক এ হেলিকপ্টার তৈরির শুরু থেকেই টিমের প্রধান ইলেকট্রিক্যাল প্রকৌশলী হিসেবে যুক্ত আছেন তিনি। 

আল বাসিউনির জন্ম জার্মানিতে। ১৯৮৪ সালে পরিবারের সঙ্গে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার উত্তর–পূর্বাঞ্চলের শহর বেইত হানুনের পৈতৃক ভিটায় ফেরেন। 

অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিংকে তিনি বলেন, ‘শৈশবে পশ্চিম জার্মানি থেকে এসে আমি সবাইকে ইসরায়েলি বাহিনীর কবল থেকে পালাতে দেখেছি। আমি এ পরিস্থিতি দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম।’ 

শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করে আল বাসিউনি বলেন, ‘স্কুল বলতে আমাদের ছিল চারদিকে খোলা এক ছাউনি। এর নিচেই আমরা পড়াশোনা করেছি।’ 

শৈশব থেকেই প্রকৌশলের প্রতি অন্যরকম আকর্ষণ বোধ করতেন আল বাসিউনি। বিশ্বের দীর্ঘতম সংঘাতের এক এলাকায় বেড়ে ওঠার পরও তিনি ঘরে টেলিভিশন, অ্যানটেনা ও রেডিও সারাতে পছন্দ করতেন। 

হেলিকপ্টার ইনজেনুইটির প্রোটোটাইপ দেখাচ্ছেন আল বাসিউনি। ছবি: নাসাতিনি বলেন, ‘আমি যখন ছোট ছিলাম তখনই খামারের পানির পাম্প ইঞ্জিন সারিয়েছিলাম। প্রকৌশল সব সময় আমার কাছে দারুণ লাগত।’ 

হাইস্কুল পর্যন্ত গাজায় লেখাপড়া করেছেন আল বাসিউনি। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। যুক্তরাষ্ট্র আসার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় তাঁর ফেরা হয়েছে মাত্র একবার। 

২০১২ সালে যখন বিভিন্ন অটোমোটিভ কোম্পানির ব্যবসায় ধস নামে তখন আল বাসিউনি চালকবিহীন উড়োজাহাজ (ইউএভি), বিশেষ করে বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজ তৈরির কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমি লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি কোম্পানির প্রধান পাওয়ার ইলেকট্রনিকের প্রকৌশলী ছিলাম। তখনই আমরা নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি (জেপিএল) থেকে হেলিকপ্টার তৈরির প্রস্তাব পাই এবং চুক্তিবদ্ধ হই।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমি এ হেলিকপ্টার তৈরিতে শুরু থেকে যুক্ত ছিলাম। আমি ২০১৯ সালে এর ডিজাইন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত কাজ করেছি।’ 

নাসার মঙ্গলযান পারসিভারেন্স রোভার ‘ইনজেনুইটি’ নামের ক্ষুদ্র হেলিকপ্টারটি মঙ্গলে বহন করে নিয়ে যায়। ২০২১ সালের ১৯ এপ্রিল হেলিকপ্টারটি প্রথম মঙ্গলের আকাশে ওড়ে। এরই মাধ্যমে হেলিকপ্টারটি পৃথিবীর বাইরে কোনো গ্রহে প্রথম নিয়ন্ত্রিত ফ্লাইটের সক্ষমতা প্রদর্শন করে। 

৩০ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে এ হেলিকপ্টারটি পাঠানো হয়েছিল। তবে অবাক করে দিয়ে হেলিকপ্টারটি প্রায় চার বছর টিকে ছিল। 

আর বাসিউনি বর্তমানে জেফ বেজোসের মালিকানাধীন মহাকাশযান প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ব্লু অরিজিনের জ্যেষ্ঠ অ্যাভিওনিক্স ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। 

গাজায় বহু জলপাই ও কমলা গাছের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন আল বাসিউনি। বাবার সঙ্গে খেতে–খামারে কাজ করতে করতে তাঁর মধ্যে প্রকৌশলের প্রতি আলাদা এক আকর্ষণ তৈরি হয়। বেড়ে ওঠার সময়টা তিনি কাজ করেছেন বিভিন্ন দোকানে, করেছেন ব্যবসা, তৈরি করতেন ঘড়ি, আবার মনে মনে পুষতেন ছবি তোলার শখও। তবে তাঁর বাবা চাইতেন প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা না করতে পারলে তিনি যেন উদ্যোক্তা হন। 

মাত্র ৩০ দিনের জন্য পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের কথা থাকলেও তিন বছর টিকে গিয়েছিল ইনজেনুইটি। ছবি: নাসাগাজায় হাইস্কুলে পড়াশোনা শেষে যুক্তরাষ্ট্রে এসে অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন আল বাসিউনি। প্রথমে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার পর অর্থাভাবে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। উচ্চ টিউশন ফির কারণে তিনি চলে আসেন কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। কেনটাকিতে স্কুল ফি পরিশোধ করতে তাঁকে পিৎজা ও স্যান্ডউইচের দোকানে কাজ করতে হয়েছে। 

কেনটাকিতে সেমিস্টার প্রতি ৭ হাজার ৮০০ ডলার খরচ করতে হয়েছে। সপ্তাহে ৮০ ঘণ্টা করে কাজ করেও যখন এ ব্যয় বহন করতে পারছিলেন না তখন ২০০১ সালে এক বছরের জন্য পড়াশোনা ছুটে যায় আল বাসিউনির। দুই বছর পর লুইসভিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন আল বাসিউনি। 

২০১৩ সালে জেপিএল নাসার সঙ্গে হেলিকপ্টার তৈরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর তিনি ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পে কাজ করে গেছেন। আল বাসিউনি নাসার সঙ্গে কাজ করছেন, এ বিষয়ে শুরুতে তাঁর পরিবারও জানত না। অনেকে ভাবেন, ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে তাঁকে এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সুযোগের পেছনে তাঁর পরিচয় নয় বরং রয়েছে কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত