Ajker Patrika

লাতিনের পুনরুত্থান, নাকি এবারও ইউরোপীয় হাসি

নাজিম আল শমষের, ঢাকা
আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১৪: ২৭
লাতিনের পুনরুত্থান, নাকি এবারও ইউরোপীয় হাসি

প্রায় ৩০০ বছর পুরো দক্ষিণ আমেরিকাকে শাসন করার পর ইউরোপীয়দের দাপট কমতে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। এই অঞ্চলের অধিকাংশ দেশে স্প্যানিশদের দাপট থাকলেও পর্তুগিজ ও ফরাসিদের প্রভাবও ছিল উল্লেখযোগ্য।

ইউরোপীয়দের অধীনে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ছিল শোষিত দাসদের মতো। সম্পদে ভরা একের পর এক জনপদ বিরান করেছে ইউরোপিয়ানরা। রোগ-জরা আর ঘানি টানা এসব মানুষের জীবনে বিনোদন হয়ে এল ফুটবল নামের গোলক চর্মের এক খেলা। এই এক জায়গায় শোষিত থেকে শাসক হয়ে ওঠার স্বাদ পেল লাতিন অঞ্চলের মানুষ। খেলা থেকে ফুটবল হয়ে গেল গ্লানি মোছার ধর্ম। ইউরোপিয়ানদের শারীরিক শক্তির জবাবে লাতিনদের পায়ে জন্ম নিল চোখ জুড়ানো ‘ড্রিবলিং ফুটবল’।

স্প্যানিশ-পর্তুগিজদের হাত ধরে দক্ষিণ আমেরিকায় ফুটবলের আবির্ভাব। আর এই লাতিনদের ভয়ংকর সুন্দর ফুটবলে ইউরোপিয়ানরা লম্বা সময় পেরে ওঠেনি। ১৯৩০, প্রথম বিশ্বকাপেই লাতিনদের দাপট। বিশ্বকাপটা গেছে লাতিনদের প্রতিনিধি উরুগুয়ের ঘরে। পরের আসর থেকেই দলের সংখ্যা বাড়তে থাকে ইউরোপের। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে ‘মেধা পাচার’ও। ইউরোপে পাড়ি জমানো শুরু লাতিন ফুটবল প্রতিভাদের। নিজেদের তৈরি করা ফুটবলারদের এভাবে পাচার হতে দেখে ২০ বছরের নির্বাসনে চলে যায় লাতিন সৌন্দর্যের অন্যতম ধারক আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টিনা না থাকায় বিশ্বকাপে লাতিন সুভাস ছড়ানোর দায়িত্বটা এককভাবে ছিল ব্রাজিলের কাঁধে।

ফুটবল বিশ্বকাপ সম্পর্কিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তবে বিশ্বকাপে ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে লাতিনদের আসল দ্বৈরথের শুরু ১৯৮৬ বিশ্বকাপ থেকে। আগের চার ফাইনালে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার কাছে পাত্তা পায়নি ইউরোপিয়ানরা। ১৯৫৮ সালে সুইডেন বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো হয় লাতিন-ইউরোপ ফাইনাল। সেবার স্বাগতিক সুইডেনকে কাঁদিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। কিন্তু বিনোদনের বাইরে ফুটবল যে হতে পারে বঞ্চনার জবাব, হতে পারে যুদ্ধে হারের যন্ত্রণার প্রলেপ, সেটাই ’৮৬ বিশ্বকাপে দেখিয়েছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে আর্জেন্টিনা পেয়েছিল যুদ্ধজয়ের প্রশান্তিও। পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে জেতে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। চার বছর পর সেই হারের শোধ নেয় জার্মানি। লাতিনদের বিপক্ষে ফাইনালে প্রথম জয়ের স্বাদ পায় ইউরোপীয় কোনো দেশ। আর সেই ফাইনালের পর থেকেই ফুটবলে কমতে থাকে লাতিনদের দাপট।  বিশ্বকাপে সাফল্যের ঝান্ডা বেশি ওড়ায় ইউরোপীয় দলগুলোই।

এই কাতার বিশ্বকাপ বাদে ফাইনালে ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে লাতিনদের লড়াই হয়েছে ১০বার। বিশ্বকাপে ব্রাজিল যে ৫ শিরোপা জিতেছে, প্রতিটিই ইউরোপিয়ানদের হারিয়ে। আর্জেন্টিনার দুই শিরোপাও তা-ই—একটি নেদারল্যান্ডস, আরেকটি পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে। দুই ফাইনালে আর্জেন্টিনার কান্নার কারণও এক ইউরোপীয় দল—জার্মানি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জিততে দেয়নি আরেক ইউরোপের দল ফ্রান্স।

ফাইনালে ইউরোপীয়দের সঙ্গে দ্বৈরথে পরিসংখ্যান যদিও হেলে লাতিনদের দিকে, কিন্তু এসব জয়ের বেশির ভাগই এসেছে গত শতাব্দীতে। এই শতাব্দীতে বিশ্বায়নের প্রভাবে ইউরোপিয়ান ফুটবল যতটুকু এগিয়েছে, ততটুকুই খেই হারিয়েছে লাতিনদের চিরন্তন সৌন্দর্য। এই শতাব্দীতে শুধু ব্রাজিলই পেরেছে লাতিনদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে, সেটিও একবার। ২০০৬ থেকে ২০১৮ বিশ্বকাপ পর্যন্ত ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে কাঁদিয়েছে ইউরোপের কোনো না কোনো দল। জার্মানি-ইতালির পাশাপাশি ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেনের উত্থানে যখন শিরোপার দাবিদার বেড়েছে ইউরোপে, সেখানে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সঙ্গে আর কোনো পরাশক্তি তৈরি হয়নি লাতিনে। এখানে দুবারের বিশ্বজয়ী উরুগুয়ের সাফল্য বলার মতো নয়।  

গত দুই যুগে বিশ্ব ফুটবলে ফ্রান্সের উত্থান এগিয়ে রেখেছে ইউরোপকে। মিশেল প্লাতিনিরা স্বপ্ন দেখালেও তা বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। নব্বইয়ের দশকে জিদানদের হাত ধরে ফরাসিদের দাপটের শুরু। এই শতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি ফাইনাল খেলার অনন্য কীর্তি তাদের। গত ২৪ বছরে তিন ফাইনাল খেলে দুবার শিরোপা জিতেছে ফ্রান্স, যেখানে আর্জেন্টিনা জিতেছে পাঁচ ফাইনালের দুটিতে। তবে গত আট বছরে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় ফাইনাল খেলা ইঙ্গিত দিচ্ছে—বিশ্বায়ন থেকে শিখছে তারাও।

ইউরোপিয়ানদের বিভিন্ন লিগে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার সুবিধাও কাজে লাগাচ্ছে আর্জেন্টিনা। লাতিন সৌন্দর্যের সঙ্গে ইউরোপিয়ান প্রেসিং ফুটবলের মিশেল অনেকটা ধ্রুপদি সংগীতের সঙ্গে হেভি মেটাল মিউজিকের মিশ্রণের মতো। ফ্রান্সের গতিময় ফুটবলে আবারও কি ইউরোপিয়ানরা এগিয়ে যাবে, নাকি লাতিনদের ২০ বছরের বিশ্বকাপ খরা কাটবে আর্জেন্টিনার হাত ধরে, সেই ফয়সালা হবে আগামীকালই।

ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে লাতিনদের লড়াই
লাতিনদের বিশ্বকাপ: ৭টি
ইউরোপের বিশ্বকাপ: ৩টি

বিশ্বকাপ ফুটবল সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত