Ajker Patrika

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও অবহেলা

সম্পাদকীয়
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও অবহেলা

পৃথিবীতে গণহত্যা কিংবা জেনোসাইড কম হয়নি। যত যুদ্ধের যত গণকবর রয়েছে, সেগুলো বর্বরতার সাক্ষ্য দেয়, ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টে নিহত মানুষের গণকবর যেমন সাক্ষ্য দেয়, রুয়ান্ডার নিয়াবারোঙ্গো নদীও সাক্ষ্য দেয়, তার বুক দিয়ে ভেসে গেছে রক্তস্নাত মানুষের লাশ। তবে বর্বরতার চরম মাত্রা মনে হয় পাকিস্তানিরাই ছাড়িয়ে গিয়েছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাদের জেনোসাইডের শিকার লাখ লাখ বাঙালির পৈশাচিকভাবে বিকৃত নিথর দেহগুলো পড়ে থাকত যেখানে-সেখানে। এসব জেনে আজও নিশ্চয় আমাদের গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। অথচ আমরা সেই সব শহীদকে যথাযথ সম্মান দিতে পারি না। এ নিয়ে শুধু আমাদের আক্ষেপ আর ক্ষোভ যথেষ্ট কি?

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটটি শেষ হালনাগাদ হয়েছে ২০১৮ সালে, ছয় বছর আগে। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে মোট বধ্যভূমির সংখ্যা ২৮১। তবু আমরা এখনো নিশ্চিত নই, একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতার ফলে পূর্ব পাকিস্তান তথা আমাদের বাংলাদেশে আসলে কত বধ্যভূমি রয়েছে। বুধবার আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মাগুরা জেলায় চারটি বধ্যভূমি রয়েছে—সদর, শ্রীপুর, মহম্মদপুর ও শালিখা। অথচ সেগুলোর মধ্যে শুধু সদর ও শালিখার নাম পাওয়া যায় ওই ওয়েবসাইটের তালিকায়। শতাধিক বধ্যভূমি ও গণকবর বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এসব এলাকায় এবং খুব দুঃখজনক কিন্তু সত্যি যে সরকারি উদ্যোগে এসব বধ্যভূমির কোনো রক্ষণাবেক্ষণ নেই। কোথাও উঠেছে দালানকোঠা, কোথাও রয়েছে ময়লার ভাগাড়, এমনকি কোথাও শৌচাগার!

মহান মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য বলিদানের সাক্ষী মাগুরা জেলা। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বধ্যভূমি ও গণকবর সেই অন্ধকার অতীতের চিহ্ন। আর এই স্মৃতিচিহ্নগুলো আজ অবহেলার শিকার। সরকারি উদ্যোগ না থাকায় স্মৃতিচিহ্নগুলো বিলীন হওয়ার পথে। কোথাও কোনো স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ নেই। অথচ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এসব বধ্যভূমির সাক্ষ্য দিচ্ছেন। এটা কেবল একটি জেলা বা তার শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নয়, সমগ্র দেশের জন্যই লজ্জার, অপমানের! অবহেলার তো বটেই।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। তরুণদের তথা নতুন প্রজন্মের মাঝে এই চেতনা সঞ্চারের জন্য স্মৃতিচিহ্নগুলোকে সংরক্ষণ করা জরুরি। তাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে হলে এই স্থানগুলোতে স্মৃতিসৌধ না হোক, অন্তত স্মৃতিফলক তো থাকা উচিত।

যদিও জেলা প্রশাসক মো. অহিদুল ইসলাম পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ কিছু করার। শুধু আশ্বাস দিলে হবে না, আমরা বিশ্বাস করতে চাই, তিনি কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে ইতিহাসের শিকড় রক্ষায় সহায়তা করবেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও নিরাশ করবে না বলে প্রত্যাশা। এ ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অবশ্যই তৎপর হতে হবে।

আগামী প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাগ্রত রাখতে হলে বধ্যভূমিগুলো শনাক্ত ও সংরক্ষণ করা অত্যাবশ্যকীয়। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানা যাবে, সম্ভব হবে একাত্তরের চেতনাকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত