আবদুল হাই

আমার বয়স আশি পেরিয়েছে আরও বছর পাঁচেক আগে। আমি বলি, ত্রিকাল দেখেছি। এক কালে পাগড়ি পরা ইংরেজ সাহেবদের ঘোড়ায় চড়ে যেতে দেখেছি। পাকিস্তানি শাসকদের গোঁজামিল বুঝেছি। আর এই বাংলাদেশ নামের একটা বেদনাঘন স্বাধীন দেশকে দেখছি— প্রতিদিন বদলে যেতে, ভেঙে পড়তে, আবার দাঁড়াতে, আবার হোঁচট খেতে।
আমি এক সময়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিছু জায়গা-জমি আছে। নিজে কৃষিকাজও করেছি। মাসিক বেতন পঁচিশ টাকা দিয়ে শিক্ষকতার শুরু। সেই টাকায় সংসার, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, ঈদ আনন্দ—সবই চালিয়ে নিয়েছি। গায়ে হাওয়া দিতো অভাবের গন্ধ, তবু বুক ভরে শ্বাস নিতাম। আজকের মতো কষ্ট লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতাম না। বরং গর্ব ছিল— আমি সৎ, আমি শিক্ষক, আমি মানুষ গড়ার কারিগর।
ঈদের কথা মনে পড়ে খুব। সেকালের ঈদ...
ঈদ মানেই ছিল অন্তরের খুশি। আগে থেকেই প্রস্তুতি হতো, কিন্তু সেটা বাহারি নয়। সব বাড়িতে কোরবানি হতো না। গরু কোরবানি হতো খুব কম। অনেকে ভাগে গরু কোরবানি দিত, ছাগল কোরবানি হতো বেশি। আবার কারও বাড়িতে শুধু সাদা ভাত আর ডিমের কারি। কিন্তু সে নিয়েও কারও আফসোস ছিল না। বরং যার বাড়িতে কোরবানি হতো না, তার বাড়ির শিশুরাও আনন্দে ভেসে যেত। পাড়া-পড়শিরা বলতো, ‘আজ তোমার ছেলেকে আমাদের বাড়িতে পাঠিও, দেলোয়ার ভাইয়ের কোরবানি হবে তো, ওরাও খাবে।’
যারা কোরবানি দিতেন, তাঁদের মাংস ভাগ হতো তিন ভাগে— গরিব আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী, নিজের ঘর। সেই তিন ভাগেই তৃপ্তি ছিল। কোরবানির আগে আল্লাহর নামে পশুর মাথায় হাত রেখে বলতাম, ‘হে আল্লাহ, মন থেকে দিচ্ছি’। কে কোন ব্র্যান্ডের ছুরি দিল, কে কত টাকায় গরু কিনল, এসব বিষয় ছিলই না। দেখানোর জন্য নয়, দানের জন্যই কোরবানি ছিল। একবার আমার এক ছাত্র বলেছিল, ‘স্যার, আমার বাবা বলেছেন, কোরবানি করলে পাপ কাটে না, মন পরিষ্কার রাখতে হয়।’ আমি বলেছিলাম, ‘তোমার বাবার কথাই সত্য।’
আজকাল...
যখন রাস্তায় এক গাদা গরু, হরিণের মতো দামি ছাগল, ব্যানার লাগানো ‘কোরবানি স্পনসর্ড বাই...’ দেখি, তখন বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়। ঈদ কি এতটা প্রতিযোগিতার বিষয়? হিন্দি ছবির ডায়লগে যেমন বলে— ‘দুনিয়াদারি হি সব কুছ হ্যায়’। এই দুনিয়াদারিতেই ঈদের রুহ, কোরবানির মহিমা সব চাপা পড়ে গেছে।
মানি ইজ নো প্রবলেম—এই বাতিক কবে ধরলো আমাদের?
যদ্দূর মনে পড়ে, সত্তর দশকের শেষ ও আশির দশকের শুরুর দিক থেকে। তখন বিদেশে যারা কাজ করতেন, তাদের রেমিট্যান্সে বাড়ি, গরু, কোরবানি, জামা-কাপড়—সব পাল্টাতে লাগলো। তারপর রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতার খেলা খেলতে খেলতে সমাজটাকে এমন একটা অবস্থায় এনে ফেললো, যেখানে ‘কে কতোটা বেশি দেখাতে পারে’— এই হলো মূল সূচক।
রাজনীতি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠলো ঠিক তখনই, যখন সমাজের নেতৃত্ব চলে গেল টাকার মালিকদের হাতে। আগে নেতা মানে ছিল, যে গ্রামের মানুষের সেবায় এগিয়ে আসে। এখন নেতা মানে, যার ৫০টা গরু, বিশাল ব্যানার, বড় মাইকে ঈদের বাণী।
আমার প্রশ্ন: মানুষ কি অন্তরের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে? সেই মায়া, সেই হাসি, সেই একবেলার মাংস ভাগাভাগি, সেই ‘আমার বাড়িতে খেতে এসো’ ডাক— সব কি কেবল স্মৃতি হয়ে যাবে?
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সম্ভবত মোবাইল ফোন ঢুকছে দেশে। বিদেশফেরত লোকদের হাতে অনেক টাকা। গ্রামের মানুষ ভাবলো—ওরা উন্নত। ওদের মতো হতে হবে। ঈদের গরুর মাপ তখন ধীরে ধীরে মানুষের মাপের চেয়ে বড় হয়ে উঠলো।
আমার ছোট ছেলে তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। ঈদের সময় বললো, ‘আমরা এতো ছোট গরু কোরবানি দিই কেন? মজনুদের বাড়িতে দেখি বিশাল ষাঁড় আসছে।’ আমি চুপ করে ছিলাম। বললাম না, কারণ বললেই হয়তো আমার আয়ের সীমাবদ্ধতা বোঝা যাবে। আমার মনে কষ্ট হলো না, হলো ভয়। এই ছেলেটি যদি বড় হয়ে শুধু দেখার জন্য কোরবানি দেয়, তাহলে আমি কী শেখাতে পেরেছি?
এই সময় থেকেই মিডিয়ার প্রভাব বাড়লো। টিভিতে ঈদের গরুর মেলা, ঢাকায় কে কতো বড় গরু আনলো, ‘রাজাবাবু’, ‘সুলতান’, ‘বাহুবলী’ নামের ষাঁড় নিয়ে হৈচৈ। গ্রামের হাটেও তার প্রভাব পড়লো। মানুষ গরু না দেখে নাম দেখে কিনতে লাগলো। একজনকে বলতে শুনেছি, ‘এইটা সেই “বম্বে বাবু” না?’
এই হুজুগ তৈরি করলো কারা?
ব্যবসায়ী আর রাজনীতিকেরা। ঈদের বাজার মানেই এখন কোটি টাকার খেলা। গরু মানেই প্যাকেজ—সার্ভিসিং, ডেলিভারি, ফেসবুক লাইভ, পোস্টার। ঈদের নামাজ পড়ে যখন দেখি পাশের লোক জামার হাতা উঁচু করে তার ব্র্যান্ড দেখাচ্ছে, মনে হয় নামাজের দোয়া পড়ার সময় ভুলে যাচ্ছে, কিন্তু স্টাইল ঠিকঠাক আছে।
রাজনীতি তো পরে আসলো। আগে রাজনীতি ছিল ত্যাগের জায়গা। এখন সেটা হচ্ছে সম্পদের প্রদর্শন। আগে যে নেতা মাঠে নামতো গরিবের ঈদের কাপড় জোগাড় করতে, এখন সে হাটে যায় ছবি তুলতে। ব্যানারে লেখে, ‘মাননীয় নেতার পক্ষ থেকে ঈদের শুভেচ্ছা’। নেতার পক্ষ থেকে মানে কী? উনি নিজে কোরবানি দিচ্ছেন না?
এইসব দেখে কষ্ট পাই, কিন্তু বেশি কষ্ট হয় নিজের সন্তানদের চোখে দেখি যখন তাদের ঈদের আনন্দে মাংসের চেয়ে মোবাইল ক্যামেরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা ঈদ বলে না, বলে—‘কন্টেন্ট’।
প্রশ্ন করি নিজেকে—কোথায় সেই অন্তরের সৌন্দর্য? মানুষ এখন এতটাই বাহ্যিক রঙে বিভোর যে একবেলার শান্তি, এক টুকরো হাসিমুখ, এক মুঠো মাংসের ভাগ—এগুলো আর মূল্য রাখে না। অথচ আমি জানি, আল্লাহ তাকওয়া দেখেন, পশু নয়।
আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত। তারা চেষ্টা করে আমাকে ভালো রাখার। ঈদের সময় পাকা মাংস আসে আমার বাসায়, ফ্রিজ ভর্তি থাকে। কিন্তু আমি বসে থাকি জানালার পাশে। অপেক্ষা করি যদি কেউ বলে— ‘চাচা, খাইতে আসেন।’ আজকাল কেউ বলে না। শহর বদলে দিয়েছে সম্পর্কের প্রকৃতি। দানের চেয়ে দৃষ্টির খোঁজ বেশি।
স্মৃতির এক কোণে আটকে আছি, যেখানে কোরবানির পর গরুর চামড়ায় পানি ঢেলে রাখতাম যেন শুকিয়ে না যায়, যেন মাদ্রাসার হুজুর এসে নিতে পারেন। আজ সেটা নিয়ে মারামারি হয়, কে নেবে, কোথায় দেবে। আল্লাহর নামে কোরবানি হয়, কিন্তু তা নিয়ে হিংসা, ঝগড়া— এ কেমন ত্যাগ?
আমার বিশ্বাস ছিল, ঈদ মানুষকে এক করে। এখন মনে হয়, ঈদ মানুষকে আলাদা করে দিচ্ছে— কে কতোটা পারছে, কে কতোটা দেখাতে পারছে।
তবু আশায় থাকি। নতুন প্রজন্ম আসুক আবার অন্তরের রঙ নিয়ে। প্যাকেজ ঈদ না, প্রাণের ঈদ ফিরে আসুক। কে কত বড় গরু দিল, তা নিয়ে নয়— কে কাকে ভালোবাসলো, কে কার পাশে দাঁড়ালো, সেই গল্প হোক ঈদের গল্প। ঈদ তো শেষ পর্যন্ত কোরবানির নাম, আত্মত্যাগের নাম। যদি তা ভুলে যাই, তাহলে সবকিছুই শুধু আয়োজন হয়ে যাবে— আনন্দ নয়।
আমি জানি, আমি বুড়ো। আমার কথার ওজন নেই। কিন্তু আমি ইতিহাসের একজন সাক্ষী। বলার অধিকার আমার আছে। তাই বলি—যারা ঈদের ভেতরের সৌন্দর্য ভুলে যাচ্ছো, তারা ভবিষ্যৎ হারিয়ে ফেলবে। ঈদের আনন্দ তখন আর থাকবে না, শুধু থাকবে শোরগোল।
আসুন, অন্তরের ঈদ ফিরিয়ে আনি!
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক

আমার বয়স আশি পেরিয়েছে আরও বছর পাঁচেক আগে। আমি বলি, ত্রিকাল দেখেছি। এক কালে পাগড়ি পরা ইংরেজ সাহেবদের ঘোড়ায় চড়ে যেতে দেখেছি। পাকিস্তানি শাসকদের গোঁজামিল বুঝেছি। আর এই বাংলাদেশ নামের একটা বেদনাঘন স্বাধীন দেশকে দেখছি— প্রতিদিন বদলে যেতে, ভেঙে পড়তে, আবার দাঁড়াতে, আবার হোঁচট খেতে।
আমি এক সময়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিছু জায়গা-জমি আছে। নিজে কৃষিকাজও করেছি। মাসিক বেতন পঁচিশ টাকা দিয়ে শিক্ষকতার শুরু। সেই টাকায় সংসার, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, ঈদ আনন্দ—সবই চালিয়ে নিয়েছি। গায়ে হাওয়া দিতো অভাবের গন্ধ, তবু বুক ভরে শ্বাস নিতাম। আজকের মতো কষ্ট লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতাম না। বরং গর্ব ছিল— আমি সৎ, আমি শিক্ষক, আমি মানুষ গড়ার কারিগর।
ঈদের কথা মনে পড়ে খুব। সেকালের ঈদ...
ঈদ মানেই ছিল অন্তরের খুশি। আগে থেকেই প্রস্তুতি হতো, কিন্তু সেটা বাহারি নয়। সব বাড়িতে কোরবানি হতো না। গরু কোরবানি হতো খুব কম। অনেকে ভাগে গরু কোরবানি দিত, ছাগল কোরবানি হতো বেশি। আবার কারও বাড়িতে শুধু সাদা ভাত আর ডিমের কারি। কিন্তু সে নিয়েও কারও আফসোস ছিল না। বরং যার বাড়িতে কোরবানি হতো না, তার বাড়ির শিশুরাও আনন্দে ভেসে যেত। পাড়া-পড়শিরা বলতো, ‘আজ তোমার ছেলেকে আমাদের বাড়িতে পাঠিও, দেলোয়ার ভাইয়ের কোরবানি হবে তো, ওরাও খাবে।’
যারা কোরবানি দিতেন, তাঁদের মাংস ভাগ হতো তিন ভাগে— গরিব আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী, নিজের ঘর। সেই তিন ভাগেই তৃপ্তি ছিল। কোরবানির আগে আল্লাহর নামে পশুর মাথায় হাত রেখে বলতাম, ‘হে আল্লাহ, মন থেকে দিচ্ছি’। কে কোন ব্র্যান্ডের ছুরি দিল, কে কত টাকায় গরু কিনল, এসব বিষয় ছিলই না। দেখানোর জন্য নয়, দানের জন্যই কোরবানি ছিল। একবার আমার এক ছাত্র বলেছিল, ‘স্যার, আমার বাবা বলেছেন, কোরবানি করলে পাপ কাটে না, মন পরিষ্কার রাখতে হয়।’ আমি বলেছিলাম, ‘তোমার বাবার কথাই সত্য।’
আজকাল...
যখন রাস্তায় এক গাদা গরু, হরিণের মতো দামি ছাগল, ব্যানার লাগানো ‘কোরবানি স্পনসর্ড বাই...’ দেখি, তখন বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়। ঈদ কি এতটা প্রতিযোগিতার বিষয়? হিন্দি ছবির ডায়লগে যেমন বলে— ‘দুনিয়াদারি হি সব কুছ হ্যায়’। এই দুনিয়াদারিতেই ঈদের রুহ, কোরবানির মহিমা সব চাপা পড়ে গেছে।
মানি ইজ নো প্রবলেম—এই বাতিক কবে ধরলো আমাদের?
যদ্দূর মনে পড়ে, সত্তর দশকের শেষ ও আশির দশকের শুরুর দিক থেকে। তখন বিদেশে যারা কাজ করতেন, তাদের রেমিট্যান্সে বাড়ি, গরু, কোরবানি, জামা-কাপড়—সব পাল্টাতে লাগলো। তারপর রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতার খেলা খেলতে খেলতে সমাজটাকে এমন একটা অবস্থায় এনে ফেললো, যেখানে ‘কে কতোটা বেশি দেখাতে পারে’— এই হলো মূল সূচক।
রাজনীতি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠলো ঠিক তখনই, যখন সমাজের নেতৃত্ব চলে গেল টাকার মালিকদের হাতে। আগে নেতা মানে ছিল, যে গ্রামের মানুষের সেবায় এগিয়ে আসে। এখন নেতা মানে, যার ৫০টা গরু, বিশাল ব্যানার, বড় মাইকে ঈদের বাণী।
আমার প্রশ্ন: মানুষ কি অন্তরের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে? সেই মায়া, সেই হাসি, সেই একবেলার মাংস ভাগাভাগি, সেই ‘আমার বাড়িতে খেতে এসো’ ডাক— সব কি কেবল স্মৃতি হয়ে যাবে?
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সম্ভবত মোবাইল ফোন ঢুকছে দেশে। বিদেশফেরত লোকদের হাতে অনেক টাকা। গ্রামের মানুষ ভাবলো—ওরা উন্নত। ওদের মতো হতে হবে। ঈদের গরুর মাপ তখন ধীরে ধীরে মানুষের মাপের চেয়ে বড় হয়ে উঠলো।
আমার ছোট ছেলে তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। ঈদের সময় বললো, ‘আমরা এতো ছোট গরু কোরবানি দিই কেন? মজনুদের বাড়িতে দেখি বিশাল ষাঁড় আসছে।’ আমি চুপ করে ছিলাম। বললাম না, কারণ বললেই হয়তো আমার আয়ের সীমাবদ্ধতা বোঝা যাবে। আমার মনে কষ্ট হলো না, হলো ভয়। এই ছেলেটি যদি বড় হয়ে শুধু দেখার জন্য কোরবানি দেয়, তাহলে আমি কী শেখাতে পেরেছি?
এই সময় থেকেই মিডিয়ার প্রভাব বাড়লো। টিভিতে ঈদের গরুর মেলা, ঢাকায় কে কতো বড় গরু আনলো, ‘রাজাবাবু’, ‘সুলতান’, ‘বাহুবলী’ নামের ষাঁড় নিয়ে হৈচৈ। গ্রামের হাটেও তার প্রভাব পড়লো। মানুষ গরু না দেখে নাম দেখে কিনতে লাগলো। একজনকে বলতে শুনেছি, ‘এইটা সেই “বম্বে বাবু” না?’
এই হুজুগ তৈরি করলো কারা?
ব্যবসায়ী আর রাজনীতিকেরা। ঈদের বাজার মানেই এখন কোটি টাকার খেলা। গরু মানেই প্যাকেজ—সার্ভিসিং, ডেলিভারি, ফেসবুক লাইভ, পোস্টার। ঈদের নামাজ পড়ে যখন দেখি পাশের লোক জামার হাতা উঁচু করে তার ব্র্যান্ড দেখাচ্ছে, মনে হয় নামাজের দোয়া পড়ার সময় ভুলে যাচ্ছে, কিন্তু স্টাইল ঠিকঠাক আছে।
রাজনীতি তো পরে আসলো। আগে রাজনীতি ছিল ত্যাগের জায়গা। এখন সেটা হচ্ছে সম্পদের প্রদর্শন। আগে যে নেতা মাঠে নামতো গরিবের ঈদের কাপড় জোগাড় করতে, এখন সে হাটে যায় ছবি তুলতে। ব্যানারে লেখে, ‘মাননীয় নেতার পক্ষ থেকে ঈদের শুভেচ্ছা’। নেতার পক্ষ থেকে মানে কী? উনি নিজে কোরবানি দিচ্ছেন না?
এইসব দেখে কষ্ট পাই, কিন্তু বেশি কষ্ট হয় নিজের সন্তানদের চোখে দেখি যখন তাদের ঈদের আনন্দে মাংসের চেয়ে মোবাইল ক্যামেরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা ঈদ বলে না, বলে—‘কন্টেন্ট’।
প্রশ্ন করি নিজেকে—কোথায় সেই অন্তরের সৌন্দর্য? মানুষ এখন এতটাই বাহ্যিক রঙে বিভোর যে একবেলার শান্তি, এক টুকরো হাসিমুখ, এক মুঠো মাংসের ভাগ—এগুলো আর মূল্য রাখে না। অথচ আমি জানি, আল্লাহ তাকওয়া দেখেন, পশু নয়।
আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত। তারা চেষ্টা করে আমাকে ভালো রাখার। ঈদের সময় পাকা মাংস আসে আমার বাসায়, ফ্রিজ ভর্তি থাকে। কিন্তু আমি বসে থাকি জানালার পাশে। অপেক্ষা করি যদি কেউ বলে— ‘চাচা, খাইতে আসেন।’ আজকাল কেউ বলে না। শহর বদলে দিয়েছে সম্পর্কের প্রকৃতি। দানের চেয়ে দৃষ্টির খোঁজ বেশি।
স্মৃতির এক কোণে আটকে আছি, যেখানে কোরবানির পর গরুর চামড়ায় পানি ঢেলে রাখতাম যেন শুকিয়ে না যায়, যেন মাদ্রাসার হুজুর এসে নিতে পারেন। আজ সেটা নিয়ে মারামারি হয়, কে নেবে, কোথায় দেবে। আল্লাহর নামে কোরবানি হয়, কিন্তু তা নিয়ে হিংসা, ঝগড়া— এ কেমন ত্যাগ?
আমার বিশ্বাস ছিল, ঈদ মানুষকে এক করে। এখন মনে হয়, ঈদ মানুষকে আলাদা করে দিচ্ছে— কে কতোটা পারছে, কে কতোটা দেখাতে পারছে।
তবু আশায় থাকি। নতুন প্রজন্ম আসুক আবার অন্তরের রঙ নিয়ে। প্যাকেজ ঈদ না, প্রাণের ঈদ ফিরে আসুক। কে কত বড় গরু দিল, তা নিয়ে নয়— কে কাকে ভালোবাসলো, কে কার পাশে দাঁড়ালো, সেই গল্প হোক ঈদের গল্প। ঈদ তো শেষ পর্যন্ত কোরবানির নাম, আত্মত্যাগের নাম। যদি তা ভুলে যাই, তাহলে সবকিছুই শুধু আয়োজন হয়ে যাবে— আনন্দ নয়।
আমি জানি, আমি বুড়ো। আমার কথার ওজন নেই। কিন্তু আমি ইতিহাসের একজন সাক্ষী। বলার অধিকার আমার আছে। তাই বলি—যারা ঈদের ভেতরের সৌন্দর্য ভুলে যাচ্ছো, তারা ভবিষ্যৎ হারিয়ে ফেলবে। ঈদের আনন্দ তখন আর থাকবে না, শুধু থাকবে শোরগোল।
আসুন, অন্তরের ঈদ ফিরিয়ে আনি!
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক
আবদুল হাই

আমার বয়স আশি পেরিয়েছে আরও বছর পাঁচেক আগে। আমি বলি, ত্রিকাল দেখেছি। এক কালে পাগড়ি পরা ইংরেজ সাহেবদের ঘোড়ায় চড়ে যেতে দেখেছি। পাকিস্তানি শাসকদের গোঁজামিল বুঝেছি। আর এই বাংলাদেশ নামের একটা বেদনাঘন স্বাধীন দেশকে দেখছি— প্রতিদিন বদলে যেতে, ভেঙে পড়তে, আবার দাঁড়াতে, আবার হোঁচট খেতে।
আমি এক সময়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিছু জায়গা-জমি আছে। নিজে কৃষিকাজও করেছি। মাসিক বেতন পঁচিশ টাকা দিয়ে শিক্ষকতার শুরু। সেই টাকায় সংসার, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, ঈদ আনন্দ—সবই চালিয়ে নিয়েছি। গায়ে হাওয়া দিতো অভাবের গন্ধ, তবু বুক ভরে শ্বাস নিতাম। আজকের মতো কষ্ট লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতাম না। বরং গর্ব ছিল— আমি সৎ, আমি শিক্ষক, আমি মানুষ গড়ার কারিগর।
ঈদের কথা মনে পড়ে খুব। সেকালের ঈদ...
ঈদ মানেই ছিল অন্তরের খুশি। আগে থেকেই প্রস্তুতি হতো, কিন্তু সেটা বাহারি নয়। সব বাড়িতে কোরবানি হতো না। গরু কোরবানি হতো খুব কম। অনেকে ভাগে গরু কোরবানি দিত, ছাগল কোরবানি হতো বেশি। আবার কারও বাড়িতে শুধু সাদা ভাত আর ডিমের কারি। কিন্তু সে নিয়েও কারও আফসোস ছিল না। বরং যার বাড়িতে কোরবানি হতো না, তার বাড়ির শিশুরাও আনন্দে ভেসে যেত। পাড়া-পড়শিরা বলতো, ‘আজ তোমার ছেলেকে আমাদের বাড়িতে পাঠিও, দেলোয়ার ভাইয়ের কোরবানি হবে তো, ওরাও খাবে।’
যারা কোরবানি দিতেন, তাঁদের মাংস ভাগ হতো তিন ভাগে— গরিব আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী, নিজের ঘর। সেই তিন ভাগেই তৃপ্তি ছিল। কোরবানির আগে আল্লাহর নামে পশুর মাথায় হাত রেখে বলতাম, ‘হে আল্লাহ, মন থেকে দিচ্ছি’। কে কোন ব্র্যান্ডের ছুরি দিল, কে কত টাকায় গরু কিনল, এসব বিষয় ছিলই না। দেখানোর জন্য নয়, দানের জন্যই কোরবানি ছিল। একবার আমার এক ছাত্র বলেছিল, ‘স্যার, আমার বাবা বলেছেন, কোরবানি করলে পাপ কাটে না, মন পরিষ্কার রাখতে হয়।’ আমি বলেছিলাম, ‘তোমার বাবার কথাই সত্য।’
আজকাল...
যখন রাস্তায় এক গাদা গরু, হরিণের মতো দামি ছাগল, ব্যানার লাগানো ‘কোরবানি স্পনসর্ড বাই...’ দেখি, তখন বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়। ঈদ কি এতটা প্রতিযোগিতার বিষয়? হিন্দি ছবির ডায়লগে যেমন বলে— ‘দুনিয়াদারি হি সব কুছ হ্যায়’। এই দুনিয়াদারিতেই ঈদের রুহ, কোরবানির মহিমা সব চাপা পড়ে গেছে।
মানি ইজ নো প্রবলেম—এই বাতিক কবে ধরলো আমাদের?
যদ্দূর মনে পড়ে, সত্তর দশকের শেষ ও আশির দশকের শুরুর দিক থেকে। তখন বিদেশে যারা কাজ করতেন, তাদের রেমিট্যান্সে বাড়ি, গরু, কোরবানি, জামা-কাপড়—সব পাল্টাতে লাগলো। তারপর রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতার খেলা খেলতে খেলতে সমাজটাকে এমন একটা অবস্থায় এনে ফেললো, যেখানে ‘কে কতোটা বেশি দেখাতে পারে’— এই হলো মূল সূচক।
রাজনীতি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠলো ঠিক তখনই, যখন সমাজের নেতৃত্ব চলে গেল টাকার মালিকদের হাতে। আগে নেতা মানে ছিল, যে গ্রামের মানুষের সেবায় এগিয়ে আসে। এখন নেতা মানে, যার ৫০টা গরু, বিশাল ব্যানার, বড় মাইকে ঈদের বাণী।
আমার প্রশ্ন: মানুষ কি অন্তরের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে? সেই মায়া, সেই হাসি, সেই একবেলার মাংস ভাগাভাগি, সেই ‘আমার বাড়িতে খেতে এসো’ ডাক— সব কি কেবল স্মৃতি হয়ে যাবে?
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সম্ভবত মোবাইল ফোন ঢুকছে দেশে। বিদেশফেরত লোকদের হাতে অনেক টাকা। গ্রামের মানুষ ভাবলো—ওরা উন্নত। ওদের মতো হতে হবে। ঈদের গরুর মাপ তখন ধীরে ধীরে মানুষের মাপের চেয়ে বড় হয়ে উঠলো।
আমার ছোট ছেলে তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। ঈদের সময় বললো, ‘আমরা এতো ছোট গরু কোরবানি দিই কেন? মজনুদের বাড়িতে দেখি বিশাল ষাঁড় আসছে।’ আমি চুপ করে ছিলাম। বললাম না, কারণ বললেই হয়তো আমার আয়ের সীমাবদ্ধতা বোঝা যাবে। আমার মনে কষ্ট হলো না, হলো ভয়। এই ছেলেটি যদি বড় হয়ে শুধু দেখার জন্য কোরবানি দেয়, তাহলে আমি কী শেখাতে পেরেছি?
এই সময় থেকেই মিডিয়ার প্রভাব বাড়লো। টিভিতে ঈদের গরুর মেলা, ঢাকায় কে কতো বড় গরু আনলো, ‘রাজাবাবু’, ‘সুলতান’, ‘বাহুবলী’ নামের ষাঁড় নিয়ে হৈচৈ। গ্রামের হাটেও তার প্রভাব পড়লো। মানুষ গরু না দেখে নাম দেখে কিনতে লাগলো। একজনকে বলতে শুনেছি, ‘এইটা সেই “বম্বে বাবু” না?’
এই হুজুগ তৈরি করলো কারা?
ব্যবসায়ী আর রাজনীতিকেরা। ঈদের বাজার মানেই এখন কোটি টাকার খেলা। গরু মানেই প্যাকেজ—সার্ভিসিং, ডেলিভারি, ফেসবুক লাইভ, পোস্টার। ঈদের নামাজ পড়ে যখন দেখি পাশের লোক জামার হাতা উঁচু করে তার ব্র্যান্ড দেখাচ্ছে, মনে হয় নামাজের দোয়া পড়ার সময় ভুলে যাচ্ছে, কিন্তু স্টাইল ঠিকঠাক আছে।
রাজনীতি তো পরে আসলো। আগে রাজনীতি ছিল ত্যাগের জায়গা। এখন সেটা হচ্ছে সম্পদের প্রদর্শন। আগে যে নেতা মাঠে নামতো গরিবের ঈদের কাপড় জোগাড় করতে, এখন সে হাটে যায় ছবি তুলতে। ব্যানারে লেখে, ‘মাননীয় নেতার পক্ষ থেকে ঈদের শুভেচ্ছা’। নেতার পক্ষ থেকে মানে কী? উনি নিজে কোরবানি দিচ্ছেন না?
এইসব দেখে কষ্ট পাই, কিন্তু বেশি কষ্ট হয় নিজের সন্তানদের চোখে দেখি যখন তাদের ঈদের আনন্দে মাংসের চেয়ে মোবাইল ক্যামেরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা ঈদ বলে না, বলে—‘কন্টেন্ট’।
প্রশ্ন করি নিজেকে—কোথায় সেই অন্তরের সৌন্দর্য? মানুষ এখন এতটাই বাহ্যিক রঙে বিভোর যে একবেলার শান্তি, এক টুকরো হাসিমুখ, এক মুঠো মাংসের ভাগ—এগুলো আর মূল্য রাখে না। অথচ আমি জানি, আল্লাহ তাকওয়া দেখেন, পশু নয়।
আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত। তারা চেষ্টা করে আমাকে ভালো রাখার। ঈদের সময় পাকা মাংস আসে আমার বাসায়, ফ্রিজ ভর্তি থাকে। কিন্তু আমি বসে থাকি জানালার পাশে। অপেক্ষা করি যদি কেউ বলে— ‘চাচা, খাইতে আসেন।’ আজকাল কেউ বলে না। শহর বদলে দিয়েছে সম্পর্কের প্রকৃতি। দানের চেয়ে দৃষ্টির খোঁজ বেশি।
স্মৃতির এক কোণে আটকে আছি, যেখানে কোরবানির পর গরুর চামড়ায় পানি ঢেলে রাখতাম যেন শুকিয়ে না যায়, যেন মাদ্রাসার হুজুর এসে নিতে পারেন। আজ সেটা নিয়ে মারামারি হয়, কে নেবে, কোথায় দেবে। আল্লাহর নামে কোরবানি হয়, কিন্তু তা নিয়ে হিংসা, ঝগড়া— এ কেমন ত্যাগ?
আমার বিশ্বাস ছিল, ঈদ মানুষকে এক করে। এখন মনে হয়, ঈদ মানুষকে আলাদা করে দিচ্ছে— কে কতোটা পারছে, কে কতোটা দেখাতে পারছে।
তবু আশায় থাকি। নতুন প্রজন্ম আসুক আবার অন্তরের রঙ নিয়ে। প্যাকেজ ঈদ না, প্রাণের ঈদ ফিরে আসুক। কে কত বড় গরু দিল, তা নিয়ে নয়— কে কাকে ভালোবাসলো, কে কার পাশে দাঁড়ালো, সেই গল্প হোক ঈদের গল্প। ঈদ তো শেষ পর্যন্ত কোরবানির নাম, আত্মত্যাগের নাম। যদি তা ভুলে যাই, তাহলে সবকিছুই শুধু আয়োজন হয়ে যাবে— আনন্দ নয়।
আমি জানি, আমি বুড়ো। আমার কথার ওজন নেই। কিন্তু আমি ইতিহাসের একজন সাক্ষী। বলার অধিকার আমার আছে। তাই বলি—যারা ঈদের ভেতরের সৌন্দর্য ভুলে যাচ্ছো, তারা ভবিষ্যৎ হারিয়ে ফেলবে। ঈদের আনন্দ তখন আর থাকবে না, শুধু থাকবে শোরগোল।
আসুন, অন্তরের ঈদ ফিরিয়ে আনি!
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক

আমার বয়স আশি পেরিয়েছে আরও বছর পাঁচেক আগে। আমি বলি, ত্রিকাল দেখেছি। এক কালে পাগড়ি পরা ইংরেজ সাহেবদের ঘোড়ায় চড়ে যেতে দেখেছি। পাকিস্তানি শাসকদের গোঁজামিল বুঝেছি। আর এই বাংলাদেশ নামের একটা বেদনাঘন স্বাধীন দেশকে দেখছি— প্রতিদিন বদলে যেতে, ভেঙে পড়তে, আবার দাঁড়াতে, আবার হোঁচট খেতে।
আমি এক সময়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিছু জায়গা-জমি আছে। নিজে কৃষিকাজও করেছি। মাসিক বেতন পঁচিশ টাকা দিয়ে শিক্ষকতার শুরু। সেই টাকায় সংসার, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, ঈদ আনন্দ—সবই চালিয়ে নিয়েছি। গায়ে হাওয়া দিতো অভাবের গন্ধ, তবু বুক ভরে শ্বাস নিতাম। আজকের মতো কষ্ট লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতাম না। বরং গর্ব ছিল— আমি সৎ, আমি শিক্ষক, আমি মানুষ গড়ার কারিগর।
ঈদের কথা মনে পড়ে খুব। সেকালের ঈদ...
ঈদ মানেই ছিল অন্তরের খুশি। আগে থেকেই প্রস্তুতি হতো, কিন্তু সেটা বাহারি নয়। সব বাড়িতে কোরবানি হতো না। গরু কোরবানি হতো খুব কম। অনেকে ভাগে গরু কোরবানি দিত, ছাগল কোরবানি হতো বেশি। আবার কারও বাড়িতে শুধু সাদা ভাত আর ডিমের কারি। কিন্তু সে নিয়েও কারও আফসোস ছিল না। বরং যার বাড়িতে কোরবানি হতো না, তার বাড়ির শিশুরাও আনন্দে ভেসে যেত। পাড়া-পড়শিরা বলতো, ‘আজ তোমার ছেলেকে আমাদের বাড়িতে পাঠিও, দেলোয়ার ভাইয়ের কোরবানি হবে তো, ওরাও খাবে।’
যারা কোরবানি দিতেন, তাঁদের মাংস ভাগ হতো তিন ভাগে— গরিব আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী, নিজের ঘর। সেই তিন ভাগেই তৃপ্তি ছিল। কোরবানির আগে আল্লাহর নামে পশুর মাথায় হাত রেখে বলতাম, ‘হে আল্লাহ, মন থেকে দিচ্ছি’। কে কোন ব্র্যান্ডের ছুরি দিল, কে কত টাকায় গরু কিনল, এসব বিষয় ছিলই না। দেখানোর জন্য নয়, দানের জন্যই কোরবানি ছিল। একবার আমার এক ছাত্র বলেছিল, ‘স্যার, আমার বাবা বলেছেন, কোরবানি করলে পাপ কাটে না, মন পরিষ্কার রাখতে হয়।’ আমি বলেছিলাম, ‘তোমার বাবার কথাই সত্য।’
আজকাল...
যখন রাস্তায় এক গাদা গরু, হরিণের মতো দামি ছাগল, ব্যানার লাগানো ‘কোরবানি স্পনসর্ড বাই...’ দেখি, তখন বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়। ঈদ কি এতটা প্রতিযোগিতার বিষয়? হিন্দি ছবির ডায়লগে যেমন বলে— ‘দুনিয়াদারি হি সব কুছ হ্যায়’। এই দুনিয়াদারিতেই ঈদের রুহ, কোরবানির মহিমা সব চাপা পড়ে গেছে।
মানি ইজ নো প্রবলেম—এই বাতিক কবে ধরলো আমাদের?
যদ্দূর মনে পড়ে, সত্তর দশকের শেষ ও আশির দশকের শুরুর দিক থেকে। তখন বিদেশে যারা কাজ করতেন, তাদের রেমিট্যান্সে বাড়ি, গরু, কোরবানি, জামা-কাপড়—সব পাল্টাতে লাগলো। তারপর রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতার খেলা খেলতে খেলতে সমাজটাকে এমন একটা অবস্থায় এনে ফেললো, যেখানে ‘কে কতোটা বেশি দেখাতে পারে’— এই হলো মূল সূচক।
রাজনীতি সর্বগ্রাসী হয়ে উঠলো ঠিক তখনই, যখন সমাজের নেতৃত্ব চলে গেল টাকার মালিকদের হাতে। আগে নেতা মানে ছিল, যে গ্রামের মানুষের সেবায় এগিয়ে আসে। এখন নেতা মানে, যার ৫০টা গরু, বিশাল ব্যানার, বড় মাইকে ঈদের বাণী।
আমার প্রশ্ন: মানুষ কি অন্তরের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলছে? সেই মায়া, সেই হাসি, সেই একবেলার মাংস ভাগাভাগি, সেই ‘আমার বাড়িতে খেতে এসো’ ডাক— সব কি কেবল স্মৃতি হয়ে যাবে?
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সম্ভবত মোবাইল ফোন ঢুকছে দেশে। বিদেশফেরত লোকদের হাতে অনেক টাকা। গ্রামের মানুষ ভাবলো—ওরা উন্নত। ওদের মতো হতে হবে। ঈদের গরুর মাপ তখন ধীরে ধীরে মানুষের মাপের চেয়ে বড় হয়ে উঠলো।
আমার ছোট ছেলে তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। ঈদের সময় বললো, ‘আমরা এতো ছোট গরু কোরবানি দিই কেন? মজনুদের বাড়িতে দেখি বিশাল ষাঁড় আসছে।’ আমি চুপ করে ছিলাম। বললাম না, কারণ বললেই হয়তো আমার আয়ের সীমাবদ্ধতা বোঝা যাবে। আমার মনে কষ্ট হলো না, হলো ভয়। এই ছেলেটি যদি বড় হয়ে শুধু দেখার জন্য কোরবানি দেয়, তাহলে আমি কী শেখাতে পেরেছি?
এই সময় থেকেই মিডিয়ার প্রভাব বাড়লো। টিভিতে ঈদের গরুর মেলা, ঢাকায় কে কতো বড় গরু আনলো, ‘রাজাবাবু’, ‘সুলতান’, ‘বাহুবলী’ নামের ষাঁড় নিয়ে হৈচৈ। গ্রামের হাটেও তার প্রভাব পড়লো। মানুষ গরু না দেখে নাম দেখে কিনতে লাগলো। একজনকে বলতে শুনেছি, ‘এইটা সেই “বম্বে বাবু” না?’
এই হুজুগ তৈরি করলো কারা?
ব্যবসায়ী আর রাজনীতিকেরা। ঈদের বাজার মানেই এখন কোটি টাকার খেলা। গরু মানেই প্যাকেজ—সার্ভিসিং, ডেলিভারি, ফেসবুক লাইভ, পোস্টার। ঈদের নামাজ পড়ে যখন দেখি পাশের লোক জামার হাতা উঁচু করে তার ব্র্যান্ড দেখাচ্ছে, মনে হয় নামাজের দোয়া পড়ার সময় ভুলে যাচ্ছে, কিন্তু স্টাইল ঠিকঠাক আছে।
রাজনীতি তো পরে আসলো। আগে রাজনীতি ছিল ত্যাগের জায়গা। এখন সেটা হচ্ছে সম্পদের প্রদর্শন। আগে যে নেতা মাঠে নামতো গরিবের ঈদের কাপড় জোগাড় করতে, এখন সে হাটে যায় ছবি তুলতে। ব্যানারে লেখে, ‘মাননীয় নেতার পক্ষ থেকে ঈদের শুভেচ্ছা’। নেতার পক্ষ থেকে মানে কী? উনি নিজে কোরবানি দিচ্ছেন না?
এইসব দেখে কষ্ট পাই, কিন্তু বেশি কষ্ট হয় নিজের সন্তানদের চোখে দেখি যখন তাদের ঈদের আনন্দে মাংসের চেয়ে মোবাইল ক্যামেরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা ঈদ বলে না, বলে—‘কন্টেন্ট’।
প্রশ্ন করি নিজেকে—কোথায় সেই অন্তরের সৌন্দর্য? মানুষ এখন এতটাই বাহ্যিক রঙে বিভোর যে একবেলার শান্তি, এক টুকরো হাসিমুখ, এক মুঠো মাংসের ভাগ—এগুলো আর মূল্য রাখে না। অথচ আমি জানি, আল্লাহ তাকওয়া দেখেন, পশু নয়।
আমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত। তারা চেষ্টা করে আমাকে ভালো রাখার। ঈদের সময় পাকা মাংস আসে আমার বাসায়, ফ্রিজ ভর্তি থাকে। কিন্তু আমি বসে থাকি জানালার পাশে। অপেক্ষা করি যদি কেউ বলে— ‘চাচা, খাইতে আসেন।’ আজকাল কেউ বলে না। শহর বদলে দিয়েছে সম্পর্কের প্রকৃতি। দানের চেয়ে দৃষ্টির খোঁজ বেশি।
স্মৃতির এক কোণে আটকে আছি, যেখানে কোরবানির পর গরুর চামড়ায় পানি ঢেলে রাখতাম যেন শুকিয়ে না যায়, যেন মাদ্রাসার হুজুর এসে নিতে পারেন। আজ সেটা নিয়ে মারামারি হয়, কে নেবে, কোথায় দেবে। আল্লাহর নামে কোরবানি হয়, কিন্তু তা নিয়ে হিংসা, ঝগড়া— এ কেমন ত্যাগ?
আমার বিশ্বাস ছিল, ঈদ মানুষকে এক করে। এখন মনে হয়, ঈদ মানুষকে আলাদা করে দিচ্ছে— কে কতোটা পারছে, কে কতোটা দেখাতে পারছে।
তবু আশায় থাকি। নতুন প্রজন্ম আসুক আবার অন্তরের রঙ নিয়ে। প্যাকেজ ঈদ না, প্রাণের ঈদ ফিরে আসুক। কে কত বড় গরু দিল, তা নিয়ে নয়— কে কাকে ভালোবাসলো, কে কার পাশে দাঁড়ালো, সেই গল্প হোক ঈদের গল্প। ঈদ তো শেষ পর্যন্ত কোরবানির নাম, আত্মত্যাগের নাম। যদি তা ভুলে যাই, তাহলে সবকিছুই শুধু আয়োজন হয়ে যাবে— আনন্দ নয়।
আমি জানি, আমি বুড়ো। আমার কথার ওজন নেই। কিন্তু আমি ইতিহাসের একজন সাক্ষী। বলার অধিকার আমার আছে। তাই বলি—যারা ঈদের ভেতরের সৌন্দর্য ভুলে যাচ্ছো, তারা ভবিষ্যৎ হারিয়ে ফেলবে। ঈদের আনন্দ তখন আর থাকবে না, শুধু থাকবে শোরগোল।
আসুন, অন্তরের ঈদ ফিরিয়ে আনি!
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক

ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
৯ ঘণ্টা আগে
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
৯ ঘণ্টা আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
৯ ঘণ্টা আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
১ দিন আগেজাহীদ রেজা নূর

ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
গত শতকের গোটা সময়টায় দুনিয়াজুড়ে সাম্যবাদের দিকে ঝুঁকেছিল প্রগতিবাদী মানুষ। উপনিবেশের শৃঙ্খল ভেঙে এশিয়া-আফ্রিকায় জন্ম হচ্ছিল নতুন নতুন দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিজয় আশার আলো জাগিয়েছিল শোষিত মানুষের মনে। সারা বিশ্বে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চে গেভারা ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে, উদ্বুদ্ধ করেছেন লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষকে। পৃথিবীর মেধাবী মানুষেরা সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। বিশেষ করে তরুণেরা ত্যাগ ও সংগ্রামকেই বেছে নিয়েছে জীবনের পথ হিসেবে। পুঁজিবাদ এই ভেঙে পড়ল বলে মনে হয়েছে।
কিন্তু আদৌ সে রকম কিছু ঘটেনি। নানা ধরনের অসংগতি নিয়ে পুঁজিবাদ টিকে আছে। সমাজতন্ত্রের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। চীনের শাসনব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক নাকি আধা-খ্যাঁচড়া পুঁজিবাদী কিছু—তা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। দেশে দেশে হানাহানি, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য যেকোনো পথ অবলম্বন করা, অন্যকে নিজের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করেই চলেছে পুঁজিবাদ।
২. আলোচনাটা তাত্ত্বিক আলোচনায় পরিণত হওয়ার আগেই থামা দরকার। যখন সমাজতান্ত্রিক জীবনের প্রতি মোহ ও মায়ায় আকৃষ্ট হয়েছে মানুষ, তখন তারা ভেবেও দেখেনি, তত্ত্ব থাকলেই তা রাষ্ট্রীয় জীবনে সুচারুভাবে প্রয়োগ করা যায় না। মানুষের সমাজে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে, তার সমাধানের জন্য তত্ত্বের বাইরেও চলে যান রাষ্ট্রের কর্তারা। তাঁরা নিজের তৈরি আইনে তখন দেশ চালান।
দেশে দেশে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচার এভাবেই দাঁড়িয়ে যায়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও গড়ে উঠেছিল পার্টি-আমলাতন্ত্র, যা আদর্শকে বিলীন করে দিয়ে নিজস্ব এক কঠোর ও নির্যাতনবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি আর জনগণের মধ্যে যখন বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হলো, পার্টি ক্রমেই তার গোপন গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে জনগণের ওপর নজরদারি শুরু করল, পার্টির মতামতের বাইরে অন্য কোনো মতকে কঠোর হাতে দমন করা শুরু করল, বিরুদ্ধমতের মানুষকে নির্বাসনে পাঠাতে লাগল, দেশত্যাগে বাধ্য করতে থাকল কিংবা শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে শুরু করল, তখন বোঝা গেল সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে সমাজতান্ত্রিক মনীষীরাই ভয়ংকরভাবে বিপথে নিয়ে যেতে পারেন। সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ইন্ধন তো আছেই। কিন্তু ভেতরটা নষ্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকলে কোনো দেশকে অন্য কোনো দেশ এসে ধ্বংস করে দিতে পারে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ১০ বছর ছিলাম। ৫ বছর ছিলাম গরবাচোভের পিরিস্ত্রোইকার আমলে, বাকি পাঁচ বছর ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্রে। ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্র ছিল এক কিম্ভূতকিমাকার ব্যবস্থা। চোখের নিমেষে বড় বড় মোড়লকে কোটিপতি হয়ে যেতে দেখেছি। এদের বেশির ভাগই একসময় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বড় বড় চাঁই ছিল। সারা দেশে মাফিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে স্থানীয় মাফিয়াদের টাকা দিয়ে পালতে হতো। কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম হতে থাকল প্রতিটি শহরেই। হঠাৎ করে নিষিদ্ধ পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশ ঘটতে লাগল। তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বদহজম হতে থাকল। সে এক আজব সময় পার করেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নবাসী।
প্রশ্ন হলো, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে দেশগুলো বের হলো, সে দেশগুলোয় কি গণতন্ত্র আদৌ জায়গা করে নিতে পেরেছে? কেন পারেনি, তার কারণগুলোও খতিয়ে দেখা দরকার।
৩. যে আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত দেশটিতে, তাতে পার্টির নামে যথেচ্ছাচার চলত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাশিয়া সফরে গিয়ে এই প্রশ্নটিই তুলেছিলেন। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু সমষ্টি দিয়ে কিছু গড়ে তোলা যায় কি না, অর্থাৎ সম্মিলিত নেতৃত্ব টিকতে পারে কি না, সে প্রশ্নই তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যক্তি যদি বিকশিত না হয়, সমষ্টিই যদি চলার পথের অনুপ্রেরণা হয়, তাহলে ভিন্নমত, বহুমত টিকবে কী করে? আসলেই টেকেনি। কারণ, বহুমতকে প্রবলভাবে হত্যা করে একটিমাত্র মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট নেতারা। মুখে বলেছেন সম্মিলিত নেতৃত্ব, কিন্তু দাঁড় করিয়েছেন পার্টি-স্বৈরাচার। দেয়ালেরও কান আছে—এই কথায় বিশ্বাস ছিল সোভিয়েত জনগণের।
বিতর্কটি আগামী দিনের জন্য তোলা থাকল। বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল একটি মতবাদ কী কারণে এক শ বছর পার হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ল, তা নিয়ে বহু তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। সে আলোচনাগুলোর কোনো কোনোটায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের জন্য শুধু বাইরের শক্তির ষড়যন্ত্রকেই দেখা হয়। আমাদের দেশের মনীষীদের মধ্যেও এ রকম ঝোঁক দেখতে পাই। কিন্তু কী করে ভেতরের সংকটটা ভাঙনকে ত্বরান্বিত করেছে এবং সেটাই হয়ে উঠেছে ভাঙনের মূল কারণ—সে কথা বুঝতে হলে সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসকারী মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা জরুরি। সে কাজটাই ক্রমান্বয়ে করা হবে।
৪. আমাদের দেশের তরুণেরাও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য জীবনপণ করেছিল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীব্যাপী প্রগতিশীল মানুষ বলতে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও-পড়া মানুষদেরকেই বোঝাত। আক্ষরিক অর্থেই এই মানুষেরা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করেছিলেন। নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে সংকট মোকাবিলায় নিজস্ব-সৃষ্ট তত্ত্বকে প্রাধান্য দিতে থাকায় মূল আদর্শের জায়গায় যে বিচ্যুতি ঘটেছিল, প্রাথমিকভাবে তা কর্মীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। সামনে শোষণহীন সমাজের অপার সম্ভাবনা, ফলে ছোটখাটো ভুলত্রুটিকে আমলে না নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল। এই এড়িয়ে যাওয়াটাই কাল হয়ে উঠেছিল। মানুষ প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিল এবং একসময় প্রশ্ন করাকেই ভয়াবহ অপরাধ বলে গণ্য করা শুরু হলো।
সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি শহরে যখন পড়াশোনা করছি, তখন পিরিস্ত্রোইকা আর গ্লাসনোস্ত এসে কাঁপিয়ে দিয়েছে সোভিয়েত সমাজকে। হঠাৎ করে এতটা মুক্তির আস্বাদ পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। মানুষ যখন মুখ খুলতে শুরু করেছে, তখন আর কিছুই ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। সমাজে প্রচলিত সব অসংগতি নিয়ে যেমন মানুষ কথা বলেছে, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি যে রাগ, অভিমান ছিল, সেটাও ধীরে ধীরে প্রকাশ করেছে। পার্টির ভেতরেই ভিন্ন ভিন্ন মত জেগে উঠেছে। এই বিপুল পরিবর্তন মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা গরবাচোভের ছিল না। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ তত দিনে পশ্চিমা দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
কিন্তু কী করে এই ভাঙনটি এল? সেটাই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আলোচনার চেষ্টা করব।
তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় রুশ সাহিত্যের ইতিহাস ক্লাসে ছিলেন এক তরুণ শিক্ষক। তিনি বললেন, বিখ্যাত সোভিয়েত সাহিত্যিক কনস্তান্তিন সিমোনভকে একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি এখন কী লিখছেন?’ সিমোনভ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এখনো ঠিক করিনি। পার্টি যে নির্দেশ দেবে, সেটাই লিখব।’
তখন গ্লাসনোস্তের কাল। তাই শিক্ষক এই কথাটি বলতে পেরেছিলেন। একজন সৃজনশীল মানুষ কী লিখবে, সেটাও নির্ভর করছে পার্টির সিদ্ধান্তের ওপর—এই কথাটি কিসের ইঙ্গিত দেয়, তা নিয়েও কথা বলব। আজকের নাতিদীর্ঘ লেখাটি শেষ করি ওই সোভিয়েতজীবনের একটি ঘটনা দিয়েই। তখন সদ্য সে দেশে গেছি। অন্য একটি শহর থেকে আমাদেরই এক বন্ধু ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। কথা প্রসঙ্গে ও বলছিল, এখনো প্রেমের সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ ব্যাপারে ও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। পার্টি যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটাই সে মেনে নেবে।
ঘটনাটি সত্য। পার্টির প্রতি আনুগত্য ব্যক্তিজীবনকেও ধ্বংস করে দিচ্ছিল, এ কথা তখন অনেকেই বোঝেনি। আর তখনই মনে পড়েছে মেকিয়াভেলির কথা। রাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’ ও ‘স্থিতিশীলতা’ রক্ষার জন্য শাসককে যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে, তা নৈতিক বা অনৈতিক যা-ই হোক না কেন। মেকিয়াভেলি মনে করেন মানুষ স্বার্থপর, ভিতু ও অবিশ্বাসী। তাই শাসককে মানুষের এই প্রকৃতি বুঝে কাজ করতে হবে। পৃথিবীজুড়েই কি এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না?
আমি কি সমাজতন্ত্র নিয়ে নিরাশার কথা বলছি? একেবারেই না। কেন তা নিরাশার জন্ম দিল, সে কারণগুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি মাত্র। আর তা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের স্বপ্নগুলোও কেন ভাঙতে থাকে, তার ইঙ্গিতও আমরা পেয়ে যাব।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
গত শতকের গোটা সময়টায় দুনিয়াজুড়ে সাম্যবাদের দিকে ঝুঁকেছিল প্রগতিবাদী মানুষ। উপনিবেশের শৃঙ্খল ভেঙে এশিয়া-আফ্রিকায় জন্ম হচ্ছিল নতুন নতুন দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিজয় আশার আলো জাগিয়েছিল শোষিত মানুষের মনে। সারা বিশ্বে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চে গেভারা ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে, উদ্বুদ্ধ করেছেন লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষকে। পৃথিবীর মেধাবী মানুষেরা সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। বিশেষ করে তরুণেরা ত্যাগ ও সংগ্রামকেই বেছে নিয়েছে জীবনের পথ হিসেবে। পুঁজিবাদ এই ভেঙে পড়ল বলে মনে হয়েছে।
কিন্তু আদৌ সে রকম কিছু ঘটেনি। নানা ধরনের অসংগতি নিয়ে পুঁজিবাদ টিকে আছে। সমাজতন্ত্রের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। চীনের শাসনব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক নাকি আধা-খ্যাঁচড়া পুঁজিবাদী কিছু—তা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। দেশে দেশে হানাহানি, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য যেকোনো পথ অবলম্বন করা, অন্যকে নিজের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করেই চলেছে পুঁজিবাদ।
২. আলোচনাটা তাত্ত্বিক আলোচনায় পরিণত হওয়ার আগেই থামা দরকার। যখন সমাজতান্ত্রিক জীবনের প্রতি মোহ ও মায়ায় আকৃষ্ট হয়েছে মানুষ, তখন তারা ভেবেও দেখেনি, তত্ত্ব থাকলেই তা রাষ্ট্রীয় জীবনে সুচারুভাবে প্রয়োগ করা যায় না। মানুষের সমাজে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে, তার সমাধানের জন্য তত্ত্বের বাইরেও চলে যান রাষ্ট্রের কর্তারা। তাঁরা নিজের তৈরি আইনে তখন দেশ চালান।
দেশে দেশে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচার এভাবেই দাঁড়িয়ে যায়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও গড়ে উঠেছিল পার্টি-আমলাতন্ত্র, যা আদর্শকে বিলীন করে দিয়ে নিজস্ব এক কঠোর ও নির্যাতনবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি আর জনগণের মধ্যে যখন বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হলো, পার্টি ক্রমেই তার গোপন গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে জনগণের ওপর নজরদারি শুরু করল, পার্টির মতামতের বাইরে অন্য কোনো মতকে কঠোর হাতে দমন করা শুরু করল, বিরুদ্ধমতের মানুষকে নির্বাসনে পাঠাতে লাগল, দেশত্যাগে বাধ্য করতে থাকল কিংবা শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে শুরু করল, তখন বোঝা গেল সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে সমাজতান্ত্রিক মনীষীরাই ভয়ংকরভাবে বিপথে নিয়ে যেতে পারেন। সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ইন্ধন তো আছেই। কিন্তু ভেতরটা নষ্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকলে কোনো দেশকে অন্য কোনো দেশ এসে ধ্বংস করে দিতে পারে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ১০ বছর ছিলাম। ৫ বছর ছিলাম গরবাচোভের পিরিস্ত্রোইকার আমলে, বাকি পাঁচ বছর ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্রে। ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্র ছিল এক কিম্ভূতকিমাকার ব্যবস্থা। চোখের নিমেষে বড় বড় মোড়লকে কোটিপতি হয়ে যেতে দেখেছি। এদের বেশির ভাগই একসময় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বড় বড় চাঁই ছিল। সারা দেশে মাফিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে স্থানীয় মাফিয়াদের টাকা দিয়ে পালতে হতো। কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম হতে থাকল প্রতিটি শহরেই। হঠাৎ করে নিষিদ্ধ পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশ ঘটতে লাগল। তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বদহজম হতে থাকল। সে এক আজব সময় পার করেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নবাসী।
প্রশ্ন হলো, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে দেশগুলো বের হলো, সে দেশগুলোয় কি গণতন্ত্র আদৌ জায়গা করে নিতে পেরেছে? কেন পারেনি, তার কারণগুলোও খতিয়ে দেখা দরকার।
৩. যে আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত দেশটিতে, তাতে পার্টির নামে যথেচ্ছাচার চলত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাশিয়া সফরে গিয়ে এই প্রশ্নটিই তুলেছিলেন। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু সমষ্টি দিয়ে কিছু গড়ে তোলা যায় কি না, অর্থাৎ সম্মিলিত নেতৃত্ব টিকতে পারে কি না, সে প্রশ্নই তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যক্তি যদি বিকশিত না হয়, সমষ্টিই যদি চলার পথের অনুপ্রেরণা হয়, তাহলে ভিন্নমত, বহুমত টিকবে কী করে? আসলেই টেকেনি। কারণ, বহুমতকে প্রবলভাবে হত্যা করে একটিমাত্র মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট নেতারা। মুখে বলেছেন সম্মিলিত নেতৃত্ব, কিন্তু দাঁড় করিয়েছেন পার্টি-স্বৈরাচার। দেয়ালেরও কান আছে—এই কথায় বিশ্বাস ছিল সোভিয়েত জনগণের।
বিতর্কটি আগামী দিনের জন্য তোলা থাকল। বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল একটি মতবাদ কী কারণে এক শ বছর পার হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ল, তা নিয়ে বহু তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। সে আলোচনাগুলোর কোনো কোনোটায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের জন্য শুধু বাইরের শক্তির ষড়যন্ত্রকেই দেখা হয়। আমাদের দেশের মনীষীদের মধ্যেও এ রকম ঝোঁক দেখতে পাই। কিন্তু কী করে ভেতরের সংকটটা ভাঙনকে ত্বরান্বিত করেছে এবং সেটাই হয়ে উঠেছে ভাঙনের মূল কারণ—সে কথা বুঝতে হলে সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসকারী মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা জরুরি। সে কাজটাই ক্রমান্বয়ে করা হবে।
৪. আমাদের দেশের তরুণেরাও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য জীবনপণ করেছিল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীব্যাপী প্রগতিশীল মানুষ বলতে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও-পড়া মানুষদেরকেই বোঝাত। আক্ষরিক অর্থেই এই মানুষেরা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করেছিলেন। নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে সংকট মোকাবিলায় নিজস্ব-সৃষ্ট তত্ত্বকে প্রাধান্য দিতে থাকায় মূল আদর্শের জায়গায় যে বিচ্যুতি ঘটেছিল, প্রাথমিকভাবে তা কর্মীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। সামনে শোষণহীন সমাজের অপার সম্ভাবনা, ফলে ছোটখাটো ভুলত্রুটিকে আমলে না নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল। এই এড়িয়ে যাওয়াটাই কাল হয়ে উঠেছিল। মানুষ প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিল এবং একসময় প্রশ্ন করাকেই ভয়াবহ অপরাধ বলে গণ্য করা শুরু হলো।
সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি শহরে যখন পড়াশোনা করছি, তখন পিরিস্ত্রোইকা আর গ্লাসনোস্ত এসে কাঁপিয়ে দিয়েছে সোভিয়েত সমাজকে। হঠাৎ করে এতটা মুক্তির আস্বাদ পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। মানুষ যখন মুখ খুলতে শুরু করেছে, তখন আর কিছুই ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। সমাজে প্রচলিত সব অসংগতি নিয়ে যেমন মানুষ কথা বলেছে, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি যে রাগ, অভিমান ছিল, সেটাও ধীরে ধীরে প্রকাশ করেছে। পার্টির ভেতরেই ভিন্ন ভিন্ন মত জেগে উঠেছে। এই বিপুল পরিবর্তন মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা গরবাচোভের ছিল না। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ তত দিনে পশ্চিমা দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
কিন্তু কী করে এই ভাঙনটি এল? সেটাই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আলোচনার চেষ্টা করব।
তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় রুশ সাহিত্যের ইতিহাস ক্লাসে ছিলেন এক তরুণ শিক্ষক। তিনি বললেন, বিখ্যাত সোভিয়েত সাহিত্যিক কনস্তান্তিন সিমোনভকে একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি এখন কী লিখছেন?’ সিমোনভ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এখনো ঠিক করিনি। পার্টি যে নির্দেশ দেবে, সেটাই লিখব।’
তখন গ্লাসনোস্তের কাল। তাই শিক্ষক এই কথাটি বলতে পেরেছিলেন। একজন সৃজনশীল মানুষ কী লিখবে, সেটাও নির্ভর করছে পার্টির সিদ্ধান্তের ওপর—এই কথাটি কিসের ইঙ্গিত দেয়, তা নিয়েও কথা বলব। আজকের নাতিদীর্ঘ লেখাটি শেষ করি ওই সোভিয়েতজীবনের একটি ঘটনা দিয়েই। তখন সদ্য সে দেশে গেছি। অন্য একটি শহর থেকে আমাদেরই এক বন্ধু ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। কথা প্রসঙ্গে ও বলছিল, এখনো প্রেমের সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ ব্যাপারে ও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। পার্টি যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটাই সে মেনে নেবে।
ঘটনাটি সত্য। পার্টির প্রতি আনুগত্য ব্যক্তিজীবনকেও ধ্বংস করে দিচ্ছিল, এ কথা তখন অনেকেই বোঝেনি। আর তখনই মনে পড়েছে মেকিয়াভেলির কথা। রাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’ ও ‘স্থিতিশীলতা’ রক্ষার জন্য শাসককে যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে, তা নৈতিক বা অনৈতিক যা-ই হোক না কেন। মেকিয়াভেলি মনে করেন মানুষ স্বার্থপর, ভিতু ও অবিশ্বাসী। তাই শাসককে মানুষের এই প্রকৃতি বুঝে কাজ করতে হবে। পৃথিবীজুড়েই কি এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না?
আমি কি সমাজতন্ত্র নিয়ে নিরাশার কথা বলছি? একেবারেই না। কেন তা নিরাশার জন্ম দিল, সে কারণগুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি মাত্র। আর তা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের স্বপ্নগুলোও কেন ভাঙতে থাকে, তার ইঙ্গিতও আমরা পেয়ে যাব।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

আবদুল হাই তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তুলে ধরেছেন ঈদের উৎসব কীভাবে সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে। আগে ঈদ ছিল আন্তরিকতা, ভাগাভাগি ও আত্মত্যাগের প্রতীক; আজ তা হয়ে উঠেছে প্রদর্শন, প্রতিযোগিতা ও বাহ্যিক আয়োজনের উৎসব। লেখক আক্ষেপ করেন, এখন ঈদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ‘কন্টেন্ট’, গরুর নাম, ব্যানার আর মোবাইল ক্যাম
০৭ জুন ২০২৫
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
৯ ঘণ্টা আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
৯ ঘণ্টা আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
১ দিন আগেস্বপ্না রেজা

এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যত কথা উঠেছে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যত চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, অনিয়মের বিরুদ্ধে যত আওয়াজ উঠেছে, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তার ন্যূনতম আলাপ-আলোচনা হতে দেখা যায়নি। কারোর দৃষ্টি ও উৎসাহ এই বিষয়ে ছিল বলেও মনে হয়নি। দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, রাষ্ট্র সংস্কারের চেতনায় শিক্ষাব্যবস্থাকে অচেতন অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং সেটা বিগত সময়ের মতোই। এককথায়, আমাদের দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যাবতীয় কাজ, পরিকল্পনা, উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে উত্তম ও কার্যকর পদক্ষেপ কোনো রাজনৈতিক সরকারকেই নিতে দেখা যায়নি। যেটুকু নেওয়া হয়েছে তা অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে করা হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। ফলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থেকেই গেছে। মেধাসম্পন্ন যোগ্য নাগরিক নয়, বরং রাজনৈতিক দল ও তার দলীয় চেতনায় দেশ গড়ার অন্যতম উপায় বলে প্রতিষ্ঠার হীন চেষ্টা চালানো হয়েছে সব সময়ই।
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে। সংবাদমাধ্যমে আরও জানা যায়, এই ফলকে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র বলে উল্লেখ করেছেন স্বয়ং শিক্ষা উপদেষ্টা। এটা তাঁর কৃতিত্বের ঢেকুর কি না, নাকি সাধারণ জনগণের মতো হতাশার উক্তি, সেটা বলা মুশকিল। যদি কৃতিত্বের ঢেকুর এমন হয়, তাঁদের আমলে কড়াকড়ি তথা যথাযথভাবে পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাই করা হয়েছে, তাই পাসের হার কম হয়েছে এবং এটাই বাস্তবতা। তাহলে বলতেই হয় যে এটা নিঃসন্দেহে একটা খোঁড়া যুক্তি। যদি পাসের হার বেশি হতো তাহলে হয়তো এমন যুক্তি দেওয়া থেকে তিনি বিরত থাকতেন। উল্টো বলা হতো, যথাযথ ও উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার উত্তম ফলাফল। সব সরকারই যেভাবে কৃতিত্ব নিতে উৎসাহ বোধ করে থাকে, সে রকমই ব্যাপারটা এবারও ঘটেছে।
তবে সাধারণ জনগণ ভাবছে অন্য কথা। তারা বলছে, পরীক্ষায় পাস না করার কারণ হতে পারে উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন ও প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষার্থীরা এবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। সোজাসুজি বললে দাঁড়ায়, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করেননি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে গেছেন বেশ অনেক দিন। তরুণ, কিশোর, যুবকদের মধ্যে অন্য ধরনের তাড়না লক্ষ করা গেছে, যা শিক্ষাসংক্রান্ত নয়। বরং স্কুলের প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিকে জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার মতো চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ দেখানো হয়েছে এই সময়ে। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও রাষ্ট্রের জন্য এক অশনিসংকেত। সরকার এই হীন কর্মকাণ্ডকে রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।
একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ দুঃখ করে বলছিলেন তাঁর সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতার কথা। যুবকদের নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তাঁকে সম্মানিত বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যুবকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে প্রথমেই জানতে চাইলেন, বক্তব্য দেওয়ার আগে জানতে চাই, তোমরা কয়জন নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছ, হাত তোলো? কিন্তু কারোর তোলা হাত তিনি দেখেননি। অবাক হন। জানতে চান, একটা হাতও না দেখার কারণ কী? তাদের কয়জন বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে বলে, তারা এখন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। সংস্কারকাজে জড়িত। রাষ্ট্র সংস্কার হলে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে। প্রবীণ ভদ্রলোক ভেবে নিলেন, এই মুহূর্তে যুবকদের জ্ঞান দেওয়া বৃথা। বরং তারাই তাঁকে জ্ঞান দিতে বেশি আগ্রহী। এমন আয়োজনও নেহাত শোআপ। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে অবস্থা, জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থাপনার যে চিত্র, তা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও প্রসারে সহায়ক নয়। যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব এই সেক্টরে। এই অভাব নতুন নয়, পুরোনো। বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে সার্বিক পরিস্থিতি তার ওপর গবেষণা চালালে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।
ফলাফলে দেখা গেছে, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। এবার ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাসের চেহারা দেখতে পারেনি। এর কারণ অনুসন্ধান করতে না পারলে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দূরত্ব বাড়বে বৈকি, যা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না, বরং প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। দেশের অস্তিত্ব সংকটের একটা কারণ হবে।
অটোপাসের দাবি কর্তৃপক্ষের মেনে নেওয়ার ঘটনাটি কখনোই উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না, শিক্ষিত এক জাতির পূর্বাভাস দেয় না। বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রচণ্ড সুযোগ দেয়। অতীতে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষার্থীদের কবজা করার প্রবণতা সব সরকারের ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু অটোপাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করবার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম এবং সেটা রাজনৈতিক ইস্যুতে। যেখানে ২৪-এর আন্দোলনের শুরুটা ছিল মেধার যোগ্যতায় বিসিএসে নিয়োগের দাবিতে, যদিও সেই আন্দোলন পৌঁছে যায় শেষ অবধি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। সেখানে অটোপাসের বিষয়টি মেধার গুরুত্বকে কোথায় নিয়ে যায় বা যাবে, সংশ্লিষ্টরা তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্ন থাকে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন ও তার প্রত্যয়, সেখানে মেধা ও শিক্ষার বিকল্প কী? উত্তর, কোনো বিকল্প নেই। একটা শিক্ষিত জাতি একটা দেশকে যতটা নিরাপদ করে রাখতে পারে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, স্থায়িত্বশীল উন্নয়নকে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে, অন্য কোনো মন্ত্র, থিওরি কিন্তু তা পারে না।
যদি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মনোযোগ ও গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তাহলে একদিন পাসের হার .০৫-এ নেমে গেলে কেউ আর আশ্চর্য হবে না। তখন এটাকে বাস্তব চিত্র বলে কৃতিত্ব নেওয়ার পথও থাকবে না। একজন ক্ষমতাসীনের চেয়ে একজন মেধাবী শিক্ষিতের প্রয়োজন এই দেশে সবচেয়ে বেশি।
স্বপ্না রেজা,কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যত কথা উঠেছে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যত চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, অনিয়মের বিরুদ্ধে যত আওয়াজ উঠেছে, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তার ন্যূনতম আলাপ-আলোচনা হতে দেখা যায়নি। কারোর দৃষ্টি ও উৎসাহ এই বিষয়ে ছিল বলেও মনে হয়নি। দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, রাষ্ট্র সংস্কারের চেতনায় শিক্ষাব্যবস্থাকে অচেতন অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং সেটা বিগত সময়ের মতোই। এককথায়, আমাদের দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যাবতীয় কাজ, পরিকল্পনা, উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে উত্তম ও কার্যকর পদক্ষেপ কোনো রাজনৈতিক সরকারকেই নিতে দেখা যায়নি। যেটুকু নেওয়া হয়েছে তা অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে করা হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। ফলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থেকেই গেছে। মেধাসম্পন্ন যোগ্য নাগরিক নয়, বরং রাজনৈতিক দল ও তার দলীয় চেতনায় দেশ গড়ার অন্যতম উপায় বলে প্রতিষ্ঠার হীন চেষ্টা চালানো হয়েছে সব সময়ই।
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে। সংবাদমাধ্যমে আরও জানা যায়, এই ফলকে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র বলে উল্লেখ করেছেন স্বয়ং শিক্ষা উপদেষ্টা। এটা তাঁর কৃতিত্বের ঢেকুর কি না, নাকি সাধারণ জনগণের মতো হতাশার উক্তি, সেটা বলা মুশকিল। যদি কৃতিত্বের ঢেকুর এমন হয়, তাঁদের আমলে কড়াকড়ি তথা যথাযথভাবে পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাই করা হয়েছে, তাই পাসের হার কম হয়েছে এবং এটাই বাস্তবতা। তাহলে বলতেই হয় যে এটা নিঃসন্দেহে একটা খোঁড়া যুক্তি। যদি পাসের হার বেশি হতো তাহলে হয়তো এমন যুক্তি দেওয়া থেকে তিনি বিরত থাকতেন। উল্টো বলা হতো, যথাযথ ও উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার উত্তম ফলাফল। সব সরকারই যেভাবে কৃতিত্ব নিতে উৎসাহ বোধ করে থাকে, সে রকমই ব্যাপারটা এবারও ঘটেছে।
তবে সাধারণ জনগণ ভাবছে অন্য কথা। তারা বলছে, পরীক্ষায় পাস না করার কারণ হতে পারে উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন ও প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষার্থীরা এবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। সোজাসুজি বললে দাঁড়ায়, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করেননি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে গেছেন বেশ অনেক দিন। তরুণ, কিশোর, যুবকদের মধ্যে অন্য ধরনের তাড়না লক্ষ করা গেছে, যা শিক্ষাসংক্রান্ত নয়। বরং স্কুলের প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিকে জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার মতো চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ দেখানো হয়েছে এই সময়ে। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও রাষ্ট্রের জন্য এক অশনিসংকেত। সরকার এই হীন কর্মকাণ্ডকে রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।
একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ দুঃখ করে বলছিলেন তাঁর সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতার কথা। যুবকদের নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তাঁকে সম্মানিত বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যুবকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে প্রথমেই জানতে চাইলেন, বক্তব্য দেওয়ার আগে জানতে চাই, তোমরা কয়জন নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছ, হাত তোলো? কিন্তু কারোর তোলা হাত তিনি দেখেননি। অবাক হন। জানতে চান, একটা হাতও না দেখার কারণ কী? তাদের কয়জন বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে বলে, তারা এখন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। সংস্কারকাজে জড়িত। রাষ্ট্র সংস্কার হলে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে। প্রবীণ ভদ্রলোক ভেবে নিলেন, এই মুহূর্তে যুবকদের জ্ঞান দেওয়া বৃথা। বরং তারাই তাঁকে জ্ঞান দিতে বেশি আগ্রহী। এমন আয়োজনও নেহাত শোআপ। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে অবস্থা, জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থাপনার যে চিত্র, তা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও প্রসারে সহায়ক নয়। যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব এই সেক্টরে। এই অভাব নতুন নয়, পুরোনো। বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে সার্বিক পরিস্থিতি তার ওপর গবেষণা চালালে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।
ফলাফলে দেখা গেছে, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। এবার ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাসের চেহারা দেখতে পারেনি। এর কারণ অনুসন্ধান করতে না পারলে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দূরত্ব বাড়বে বৈকি, যা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না, বরং প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। দেশের অস্তিত্ব সংকটের একটা কারণ হবে।
অটোপাসের দাবি কর্তৃপক্ষের মেনে নেওয়ার ঘটনাটি কখনোই উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না, শিক্ষিত এক জাতির পূর্বাভাস দেয় না। বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রচণ্ড সুযোগ দেয়। অতীতে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষার্থীদের কবজা করার প্রবণতা সব সরকারের ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু অটোপাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করবার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম এবং সেটা রাজনৈতিক ইস্যুতে। যেখানে ২৪-এর আন্দোলনের শুরুটা ছিল মেধার যোগ্যতায় বিসিএসে নিয়োগের দাবিতে, যদিও সেই আন্দোলন পৌঁছে যায় শেষ অবধি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। সেখানে অটোপাসের বিষয়টি মেধার গুরুত্বকে কোথায় নিয়ে যায় বা যাবে, সংশ্লিষ্টরা তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্ন থাকে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন ও তার প্রত্যয়, সেখানে মেধা ও শিক্ষার বিকল্প কী? উত্তর, কোনো বিকল্প নেই। একটা শিক্ষিত জাতি একটা দেশকে যতটা নিরাপদ করে রাখতে পারে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, স্থায়িত্বশীল উন্নয়নকে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে, অন্য কোনো মন্ত্র, থিওরি কিন্তু তা পারে না।
যদি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মনোযোগ ও গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তাহলে একদিন পাসের হার .০৫-এ নেমে গেলে কেউ আর আশ্চর্য হবে না। তখন এটাকে বাস্তব চিত্র বলে কৃতিত্ব নেওয়ার পথও থাকবে না। একজন ক্ষমতাসীনের চেয়ে একজন মেধাবী শিক্ষিতের প্রয়োজন এই দেশে সবচেয়ে বেশি।
স্বপ্না রেজা,কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

আবদুল হাই তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তুলে ধরেছেন ঈদের উৎসব কীভাবে সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে। আগে ঈদ ছিল আন্তরিকতা, ভাগাভাগি ও আত্মত্যাগের প্রতীক; আজ তা হয়ে উঠেছে প্রদর্শন, প্রতিযোগিতা ও বাহ্যিক আয়োজনের উৎসব। লেখক আক্ষেপ করেন, এখন ঈদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ‘কন্টেন্ট’, গরুর নাম, ব্যানার আর মোবাইল ক্যাম
০৭ জুন ২০২৫
ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
৯ ঘণ্টা আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
৯ ঘণ্টা আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সদর ইউনিয়নে। প্রকৃত দরিদ্র ব্যক্তিরা নয়, কার্ড পেয়েছেন ইউপি সদস্যের মেয়ে, প্রবাসীর স্ত্রী, চাকরিজীবীর পরিবার, এমনকি ১৫ বিঘা জমি ও পাকা বাড়ির মালিকেরাও। ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক, সচিব এবং একজন বিএনপিপন্থী প্রভাবশালী ইউপি সদস্যের যোগসাজশেই এই অনিয়মের কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে। ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে প্রকৃত দুস্থদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে, সচ্ছল পরিবারগুলোকে ভিজিডি কার্ড দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এই তালিকা প্রণয়ন শুধু নিয়ম ভঙ্গ করাই নয়, এটি অসহায় মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের শামিল।
শুধু দুস্থ ব্যক্তিদের কার্ডের জন্য নয়, সরকারের পক্ষ থেকে দারিদ্র্য নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ সম্প্রদায় বা পেশার জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করাসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজেও এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। বিধবা না হয়ে ভাতা উত্তোলন, ধনী হয়ে ভূমিহীনের জমি পাওয়া এবং প্রকৃত গৃহহীন মানুষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর না পাওয়াসহ নানা অভিযোগের খবর প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে মূলত নির্বাচিত চেয়ারম্যান না থাকায়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের কোনো ইউনিয়ন পরিষদে এখন আর নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্য নেই। এই ইউনিয়নে প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা। অনির্বাচিত ব্যক্তির সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বোধ থাকে না। সে জন্য অপকর্মটি এই প্রশাসকের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।
সবার প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আগে যেমন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ এসব করতেন, এখন সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ একই কাজ করছেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, তদন্ত চলাকালেই অনিয়মের মাধ্যমে কার্ড পাওয়া ব্যক্তিরা দুই মাসের চাল তুলে নিয়েছেন।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু যখন সেই কর্মসূচি দুর্নীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ পূরণ করা সম্ভব হয় না।
যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে অনিয়মকারীদের বিচারের আওতায় আনা হতো, তাহলে এ ধরনের দুর্নীতি কিছুটা কমত।
অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এই ঘটনায় যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শুধু ইউপি সচিব ও মেম্বারকে দায়ী করে প্রশাসককে রেহাই দেওয়া হলে তা ভুল বার্তা দেবে। সব স্তরের জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে যাঁরা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যথাযথ তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সদর ইউনিয়নে। প্রকৃত দরিদ্র ব্যক্তিরা নয়, কার্ড পেয়েছেন ইউপি সদস্যের মেয়ে, প্রবাসীর স্ত্রী, চাকরিজীবীর পরিবার, এমনকি ১৫ বিঘা জমি ও পাকা বাড়ির মালিকেরাও। ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক, সচিব এবং একজন বিএনপিপন্থী প্রভাবশালী ইউপি সদস্যের যোগসাজশেই এই অনিয়মের কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে। ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে প্রকৃত দুস্থদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে, সচ্ছল পরিবারগুলোকে ভিজিডি কার্ড দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এই তালিকা প্রণয়ন শুধু নিয়ম ভঙ্গ করাই নয়, এটি অসহায় মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের শামিল।
শুধু দুস্থ ব্যক্তিদের কার্ডের জন্য নয়, সরকারের পক্ষ থেকে দারিদ্র্য নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ সম্প্রদায় বা পেশার জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করাসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজেও এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। বিধবা না হয়ে ভাতা উত্তোলন, ধনী হয়ে ভূমিহীনের জমি পাওয়া এবং প্রকৃত গৃহহীন মানুষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর না পাওয়াসহ নানা অভিযোগের খবর প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে মূলত নির্বাচিত চেয়ারম্যান না থাকায়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের কোনো ইউনিয়ন পরিষদে এখন আর নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্য নেই। এই ইউনিয়নে প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা। অনির্বাচিত ব্যক্তির সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বোধ থাকে না। সে জন্য অপকর্মটি এই প্রশাসকের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।
সবার প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আগে যেমন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ এসব করতেন, এখন সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ একই কাজ করছেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, তদন্ত চলাকালেই অনিয়মের মাধ্যমে কার্ড পাওয়া ব্যক্তিরা দুই মাসের চাল তুলে নিয়েছেন।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু যখন সেই কর্মসূচি দুর্নীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ পূরণ করা সম্ভব হয় না।
যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে অনিয়মকারীদের বিচারের আওতায় আনা হতো, তাহলে এ ধরনের দুর্নীতি কিছুটা কমত।
অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এই ঘটনায় যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শুধু ইউপি সচিব ও মেম্বারকে দায়ী করে প্রশাসককে রেহাই দেওয়া হলে তা ভুল বার্তা দেবে। সব স্তরের জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে যাঁরা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যথাযথ তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আবদুল হাই তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তুলে ধরেছেন ঈদের উৎসব কীভাবে সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে। আগে ঈদ ছিল আন্তরিকতা, ভাগাভাগি ও আত্মত্যাগের প্রতীক; আজ তা হয়ে উঠেছে প্রদর্শন, প্রতিযোগিতা ও বাহ্যিক আয়োজনের উৎসব। লেখক আক্ষেপ করেন, এখন ঈদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ‘কন্টেন্ট’, গরুর নাম, ব্যানার আর মোবাইল ক্যাম
০৭ জুন ২০২৫
ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
৯ ঘণ্টা আগে
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
৯ ঘণ্টা আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

গাজীপুরের টঙ্গীতে এক ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল এলাকাবাসী। দুজন মিলে মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়েছিল, তাদের একজন পালিয়ে গিয়েছিল, অন্যজনকে ধরে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা।
টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়। যদি প্রতিদিন ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা হয় না কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল কি নেই? ছিনতাইয়ের স্পটগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে? এই দায় কার ওপর বর্তায়? যদি ছিনতাই রোধ করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হতো এবং ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তি হতো, তাহলে এ পথ কেউ মাড়াত না। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর তাই এখনো প্রতিদিন গড়ে ২০টা করে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।
ছিনতাই করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সেই সাজাই দিয়েছে ছিনতাইকারীকে। জনতা ছিনতাইকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেনি, বিচার চায়নি, বরং হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করেছে। এতটাই মেরেছে যে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়েছে। নিহত হওয়ার পর মৃতদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করেছে জনতা!
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই দৃষ্টান্ত মোটেই সুখকর কিছু নয়। যারা হত্যা করে, তারাই হত্যাকারী। এই হত্যার দায় কি এই উল্লসিত জনতা দেবে? প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? কেন একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? আইনের পথটি কি তাদের জানা নেই?
জানা আছে নিশ্চয়। কিন্তু দিনের পর দিন ছিনতাইকারীদের শাস্তি হচ্ছে না দেখে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশ কিংবা নিরাপত্তারক্ষীরা যদি সতর্ক হয়ে ছিনতাইকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারত, ছিনতাইকারীরা যদি তাদের অপরাধের সাজা পেত, তাহলে হয়তো মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিত না। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যদি কেউ কাউকে ছিনতাইকারী বলে পেটাতে শুরু করে, তাহলে সমবেত জনতার প্রত্যেকেই খায়েশ মিটিয়ে পেটাতে থাকবে। কারও সাতে-পাঁচে নেই—এমন একজন নিরীহ মানুষও এই মবের হাতে প্রাণ হারাতে পারে।
ধরা যাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ছিনতাইকারীদের ধরতে শুরু করল, তাতে কি জনতার এই উন্মত্ততা কমে যাবে? মনে হয় না। হিংস্রতা নিবারণের জন্য পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। সৎ গুণাবলি তৈরি করতে হলে তো সেটার চর্চা দরকার। সেই চর্চাই তো কমে গেছে। একজন মানুষের মনে যদি হিংসা, ঘৃণা, ক্ষোভ জমা হতে থাকে, কমে যেতে থাকে ভালোবাসা, মানবতা—তাহলে সে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে উল্লাসই করবে! এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা!

গাজীপুরের টঙ্গীতে এক ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল এলাকাবাসী। দুজন মিলে মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়েছিল, তাদের একজন পালিয়ে গিয়েছিল, অন্যজনকে ধরে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা।
টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়। যদি প্রতিদিন ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা হয় না কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল কি নেই? ছিনতাইয়ের স্পটগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে? এই দায় কার ওপর বর্তায়? যদি ছিনতাই রোধ করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হতো এবং ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তি হতো, তাহলে এ পথ কেউ মাড়াত না। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর তাই এখনো প্রতিদিন গড়ে ২০টা করে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।
ছিনতাই করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সেই সাজাই দিয়েছে ছিনতাইকারীকে। জনতা ছিনতাইকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেনি, বিচার চায়নি, বরং হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করেছে। এতটাই মেরেছে যে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়েছে। নিহত হওয়ার পর মৃতদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করেছে জনতা!
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই দৃষ্টান্ত মোটেই সুখকর কিছু নয়। যারা হত্যা করে, তারাই হত্যাকারী। এই হত্যার দায় কি এই উল্লসিত জনতা দেবে? প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? কেন একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? আইনের পথটি কি তাদের জানা নেই?
জানা আছে নিশ্চয়। কিন্তু দিনের পর দিন ছিনতাইকারীদের শাস্তি হচ্ছে না দেখে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশ কিংবা নিরাপত্তারক্ষীরা যদি সতর্ক হয়ে ছিনতাইকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারত, ছিনতাইকারীরা যদি তাদের অপরাধের সাজা পেত, তাহলে হয়তো মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিত না। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যদি কেউ কাউকে ছিনতাইকারী বলে পেটাতে শুরু করে, তাহলে সমবেত জনতার প্রত্যেকেই খায়েশ মিটিয়ে পেটাতে থাকবে। কারও সাতে-পাঁচে নেই—এমন একজন নিরীহ মানুষও এই মবের হাতে প্রাণ হারাতে পারে।
ধরা যাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ছিনতাইকারীদের ধরতে শুরু করল, তাতে কি জনতার এই উন্মত্ততা কমে যাবে? মনে হয় না। হিংস্রতা নিবারণের জন্য পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। সৎ গুণাবলি তৈরি করতে হলে তো সেটার চর্চা দরকার। সেই চর্চাই তো কমে গেছে। একজন মানুষের মনে যদি হিংসা, ঘৃণা, ক্ষোভ জমা হতে থাকে, কমে যেতে থাকে ভালোবাসা, মানবতা—তাহলে সে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে উল্লাসই করবে! এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা!

আবদুল হাই তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তুলে ধরেছেন ঈদের উৎসব কীভাবে সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে। আগে ঈদ ছিল আন্তরিকতা, ভাগাভাগি ও আত্মত্যাগের প্রতীক; আজ তা হয়ে উঠেছে প্রদর্শন, প্রতিযোগিতা ও বাহ্যিক আয়োজনের উৎসব। লেখক আক্ষেপ করেন, এখন ঈদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে ‘কন্টেন্ট’, গরুর নাম, ব্যানার আর মোবাইল ক্যাম
০৭ জুন ২০২৫
ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
৯ ঘণ্টা আগে
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
৯ ঘণ্টা আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
৯ ঘণ্টা আগে