ড. মইনুল ইসলাম
২০২৩ সালের মে মাসে ভোলা-বরিশাল গ্যাসলাইন প্রকল্পের যৌক্তিকতা তুলে ধরে একটি কলাম লিখেছিলাম, কিন্তু সেটা সাবেক সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনার জন্য বিষয়টি আবারও তুলে ধরছি। ১১ মে ২০২৩ বাপেক্স দৈনিক যুগান্তর এবং দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার খবরে ভোলার ইলিশায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কৃত হওয়ার খবরটি নিশ্চিত করেছিল। ওই নিউজ আইটেমগুলোর মাধ্যমে জানা গেল, ভোলায় ইতিমধ্যে ইলিশাসহ মোট যে ৯টি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলোতে প্রাপ্ত গ্যাসের সম্ভাব্য পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছে প্রায় ১.৭৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। ওয়াকিবহাল মহলের মতে ভোলা দ্বীপটি প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ভাসছে। যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এই দ্বীপে গ্যাস অনুসন্ধান চালালে নাকি এখানকার বিভিন্ন স্থানে আরও ৮ টিসিএফের বেশি গ্যাস পাওয়া যাবে আগামী কয়েক বছরে, এটাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবছর গ্যাস ব্যবহৃত হয় প্রায় এক টিসিএফ। সে হিসাবে শুধু ভোলার গ্যাস দিয়ে বাংলাদেশের গ্যাসের চাহিদা মেটানো যাবে প্রায় ১০ বছর। এটা যে দেশের জন্য কত বড় সুখবর, সেটা বোঝা যাবে একটি খবর থেকে: এখন দেশের এলএনজি চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিবছর আমাদের এলএনজি আমদানিতে ব্যয় করতে হচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা। আরও গুরুতর সমস্যা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দামে যে উল্লম্ফন ঘটেছে, তার ফলে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ এলএনজি আমদানিও করতে পারছি না। অথচ, ভোলার গ্যাস দেশের গ্যাস গ্রিডে আনা যাচ্ছে না একটি পাইপলাইনের মাধ্যমে ভোলার ১.৭৫ টিসিএফ গ্যাস এত দিনেও মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসার ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি বিধায়।
বছরের পর বছর ধরে সরকারের জ্বালানিবিষয়ক নীতিনির্ধারকদের পরিচিত গলাবাজির বুলি ছিল পাইপলাইনের মাধ্যমে ভোলার গ্যাস মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিধায় অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এটা একটা ভুয়া যুক্তি। কোনো বিশ্বাসযোগ্য ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’র মাধ্যমে এহেন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়নি। এর আসল কারণ কয়েকজন অত্যন্ত প্রভাবশালী এলএনজি আমদানিকারককে অন্যায্য ফায়দা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এসব প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর কারণেই দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে গত এক দশকে আমদানিকৃত এলএনজিনির্ভর করে গড়ে তোলা হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, তাঁদের মুনাফাবাজিকে টিকিয়ে রাখার জন্যই ২০০৯ সাল থেকে দেশের স্থলভাগ এবং বিপুল সমুদ্রাঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকে অবহেলা করা হচ্ছে। ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের বিরুদ্ধে সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মামলা জেতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার ওপর নিয়ন্ত্রণাধিকার (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন) অর্জন করা সত্ত্বেও গত ১১ বা ১৩ বছরেও এই বিশাল সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শুরুই করতে পারেনি। এই অক্ষম্য ব্যর্থতার দায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে, কারণ তিনিই তো ছিলেন সাবেক সরকারের জ্বালানিমন্ত্রী!
এটা কি আমরা জানি যে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার অদূরে সেন্ট মার্টিন উপকূলের কাছে মিয়ানমার তাদের সমুদ্রসীমায় দেড় দশক আগেই ৪ টিসিএফের বেশি গ্যাস আবিষ্কার করে ওই গ্যাস চীনে রপ্তানি করছে? (ওই গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবটিকে বিএনপি-জামায়াত সরকার প্রত্যাখ্যান করেছিল)। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, সমুদ্রের তলদেশের ভূ-কাঠামো বিবেচনায় একই কাঠামো বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায়ও রয়েছে। তাই, এরূপ গ্যাসক্ষেত্র বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায়ও বিস্তৃত রয়েছে বলে গ্যাস বিশেষজ্ঞরা মত ব্যক্ত করেছেন। ২০০৯ সালে ওই এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানি জাহাজভর্তি সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হলে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদের ফিরে আসতে বাধ্য করেছিল, এলাকাটি মিয়ানমারের দাবি করে। কিন্তু ২০১২ সালে ইটলসের রায়ে ওই এলাকা বাংলাদেশ পেয়ে গেছে। কিন্তু গত ১৩ বছরেও আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওই এলাকার সাগরে কোনো ইজারাদার কোম্পানি গ্যাস অনুসন্ধানের প্রয়াস চালায়নি কেন? মিয়ানমারের ভয়ে? (ভারতের ওএনজিসি দুটো ব্লকে বর্তমানে অনুসন্ধান চালালেও তাদের তুলনামূলক নিষ্ক্রিয়তা রহস্যজনক, হয়তো ভারতের স্বার্থহানিকর কিছু তারা করবে না)।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সমুদ্র-সীমান্তের অদূরে ভারত গোদাগাড়ি এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে বিরাট গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে গ্যাস উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ, বাংলাদেশ এখনো নিজেদের সমুদ্রসীমায় আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণ করার জন্য একটি মাল্টি-ক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে পর্যন্ত সম্পন্ন করতে পারেনি। (একটি সিসমিক সার্ভে চলছিল, যার ফলাফল গত বছরের শেষ নাগাদ পাওয়ার কথা ছিল)। কিছুদিন আগে মার্কিন বহুজাতিক তেল কোম্পানি এক্সন-মবিল বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র এলাকার ১৫টি ব্লকে তেল অনুসন্ধানের আগ্রহ দেখিয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সম্পন্ন টেন্ডারে তারা অংশগ্রহণই করেনি। এ ব্যাপারেও সরকারের রহস্যজনক নীরবতা লক্ষণীয়।
হয়তো উল্লিখিত প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই ভোলার গ্যাস এদ্দিনে দেশের গ্যাস-গ্রিডে নিয়ে আসার ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়নি! এখন যখন এলএনজি আমদানি ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে গেছে, তখন সরকারের টনক নড়বে কি? মূল সমস্যা হলো, ভোলায় ইতিমধ্যে পাওয়া গ্যাসকে অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিসংগত উপায়ে দেশের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা। ভবিষ্যতে যদি ভোলায় আরও গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় তাহলে এই ব্যাপারটি দেশের অর্থনীতিতে বড়সড় ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। ২০২৩ সালের ১১ মে দৈনিক যুগান্তরের ওই নিউজ আইটেমে জানা গেল, ভোলার শাহবাজপুর গ্যাস ফিল্ড ও ভোলা নর্থ গ্যাস ফিল্ড থেকে বরিশালের লাহারহাট পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে ভোলার গ্যাস বরিশালে নিয়ে আসার জন্য ১৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব ওই সময়ে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছিল। পরবর্তী সময়ে এই গ্যাস পাইপলাইনটি কুয়াকাটা-বরিশাল-গোপালগঞ্জ-খুলনা পাইপলাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্যাস-গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা। আমার মতে, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির প্রকৃত বাস্তবায়ন ব্যয় পরবর্তী সময়ে ১৫০০-২০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও এটাকে অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিবেচনা করতে হবে। কারণ, বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম ১ এমএমবিটিউ ১৪-১৬ ডলার। তাহলে ভোলার ১.৭৫ টিসিএফ গ্যাসের মোট মূল্য দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। মাত্র দেড়-দুই হাজার কোটি টাকার পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে যদি আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা এই ১.৭৫ টিসিএফ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে এই পাইপলাইন অর্থনীতির জন্য কতখানি উপকার বয়ে আনতে পারবে, সেটা কি আমরা অনুধাবন করতে পারছি? ইতিমধ্যে ইন্ট্রাকোকে ঠিকাদারি দিয়ে সিলিন্ডারে ভরে ভোলার গ্যাস ঢাকায় নিয়ে আসার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, সেটা অর্থনৈতিকভাবে তেমন উল্লেখযোগ্য সুফল বয়ে আনবে না। অতএব এই পাইপলাইন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের সঙ্গে সরকারের চুক্তি বহাল রাখা যেতে পারে, পাইপলাইন স্থাপনের বিরুদ্ধে এটাকে যেন বাধা হিসেবে খাড়া করা না হয়।
প্রস্তাবিত পাইপলাইনটি আরেকটি দিক থেকেও বাংলাদেশকে সুফল দেবে। বর্তমানে বাংলাদেশের এলএনজি আমদানির টার্মিনালগুলো মহেশখালী-কক্সবাজার অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো বৈরিতা দেখা দিলে ভোলায় আরেকটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করে প্রস্তাবিত ভোলা-বরিশাল পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানিকৃত এলএনজি জাতীয় গ্রিডে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তবে, আমার মতে প্রস্তাবিত পাইপলাইনটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভবিষ্যৎ-ব্যবহার নিশ্চিত হবে যদি বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোতে গ্যাস পেয়ে যায়। তখন এলএনজির আকারে গভীর সমুদ্রের গ্যাস জাতীয় গ্রিডে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই পাইপলাইন সবচেয়ে ব্যয়-সাশ্রয়ী উপায় হয়ে উঠবে। এমনকি এই সম্ভাবনাটি মাথায় রেখে পাইপলাইনের ব্যাস ৩০ ইঞ্চি থেকে আরও বাড়ানো যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হতে পারে।
ওপরে উল্লিখিত আলোচনা-বিশ্লেষণ থেকে আমি অনুসিদ্ধান্ত টানতে চাই, প্রস্তাবিত ভোলা-বরিশাল গ্যাস পাইপলাইনটি একটি যুগান্তকারী প্রকল্প হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ধারণ করছে। বর্তমান বিদ্যুৎসংকট, গ্যাসের চলমান ঘাটতি সমস্যা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারা এবং ডলার-সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য এটাকে দেশের জনগণের জন্য আল্লাহর রহমত হিসেবে বিবেচনা করা উচিত মনে করি। অবশ্য যদি প্রস্তাবিত বরিশাল-ভোলা সেতু প্রকল্পের কাজ যথাসম্ভব শিগগির শুরু করা যায় তাহলে আলাদা গ্যাস পাইপলাইন প্রয়োজন হবে না। ওই সেতুতেই গ্যাস পাইপলাইন সংযুক্ত করা যাবে।
২০২৩ সালের মে মাসে ভোলা-বরিশাল গ্যাসলাইন প্রকল্পের যৌক্তিকতা তুলে ধরে একটি কলাম লিখেছিলাম, কিন্তু সেটা সাবেক সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বিবেচনার জন্য বিষয়টি আবারও তুলে ধরছি। ১১ মে ২০২৩ বাপেক্স দৈনিক যুগান্তর এবং দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার খবরে ভোলার ইলিশায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কৃত হওয়ার খবরটি নিশ্চিত করেছিল। ওই নিউজ আইটেমগুলোর মাধ্যমে জানা গেল, ভোলায় ইতিমধ্যে ইলিশাসহ মোট যে ৯টি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলোতে প্রাপ্ত গ্যাসের সম্ভাব্য পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছে প্রায় ১.৭৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। ওয়াকিবহাল মহলের মতে ভোলা দ্বীপটি প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ভাসছে। যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এই দ্বীপে গ্যাস অনুসন্ধান চালালে নাকি এখানকার বিভিন্ন স্থানে আরও ৮ টিসিএফের বেশি গ্যাস পাওয়া যাবে আগামী কয়েক বছরে, এটাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিবছর গ্যাস ব্যবহৃত হয় প্রায় এক টিসিএফ। সে হিসাবে শুধু ভোলার গ্যাস দিয়ে বাংলাদেশের গ্যাসের চাহিদা মেটানো যাবে প্রায় ১০ বছর। এটা যে দেশের জন্য কত বড় সুখবর, সেটা বোঝা যাবে একটি খবর থেকে: এখন দেশের এলএনজি চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিবছর আমাদের এলএনজি আমদানিতে ব্যয় করতে হচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা। আরও গুরুতর সমস্যা হলো, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দামে যে উল্লম্ফন ঘটেছে, তার ফলে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ এলএনজি আমদানিও করতে পারছি না। অথচ, ভোলার গ্যাস দেশের গ্যাস গ্রিডে আনা যাচ্ছে না একটি পাইপলাইনের মাধ্যমে ভোলার ১.৭৫ টিসিএফ গ্যাস এত দিনেও মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসার ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি বিধায়।
বছরের পর বছর ধরে সরকারের জ্বালানিবিষয়ক নীতিনির্ধারকদের পরিচিত গলাবাজির বুলি ছিল পাইপলাইনের মাধ্যমে ভোলার গ্যাস মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিধায় অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে না। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এটা একটা ভুয়া যুক্তি। কোনো বিশ্বাসযোগ্য ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’র মাধ্যমে এহেন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়নি। এর আসল কারণ কয়েকজন অত্যন্ত প্রভাবশালী এলএনজি আমদানিকারককে অন্যায্য ফায়দা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এসব প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর কারণেই দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে গত এক দশকে আমদানিকৃত এলএনজিনির্ভর করে গড়ে তোলা হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, তাঁদের মুনাফাবাজিকে টিকিয়ে রাখার জন্যই ২০০৯ সাল থেকে দেশের স্থলভাগ এবং বিপুল সমুদ্রাঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকে অবহেলা করা হচ্ছে। ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের বিরুদ্ধে সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মামলা জেতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার ওপর নিয়ন্ত্রণাধিকার (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন) অর্জন করা সত্ত্বেও গত ১১ বা ১৩ বছরেও এই বিশাল সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শুরুই করতে পারেনি। এই অক্ষম্য ব্যর্থতার দায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে, কারণ তিনিই তো ছিলেন সাবেক সরকারের জ্বালানিমন্ত্রী!
এটা কি আমরা জানি যে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার অদূরে সেন্ট মার্টিন উপকূলের কাছে মিয়ানমার তাদের সমুদ্রসীমায় দেড় দশক আগেই ৪ টিসিএফের বেশি গ্যাস আবিষ্কার করে ওই গ্যাস চীনে রপ্তানি করছে? (ওই গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবটিকে বিএনপি-জামায়াত সরকার প্রত্যাখ্যান করেছিল)। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, সমুদ্রের তলদেশের ভূ-কাঠামো বিবেচনায় একই কাঠামো বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায়ও রয়েছে। তাই, এরূপ গ্যাসক্ষেত্র বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায়ও বিস্তৃত রয়েছে বলে গ্যাস বিশেষজ্ঞরা মত ব্যক্ত করেছেন। ২০০৯ সালে ওই এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানি জাহাজভর্তি সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হলে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদের ফিরে আসতে বাধ্য করেছিল, এলাকাটি মিয়ানমারের দাবি করে। কিন্তু ২০১২ সালে ইটলসের রায়ে ওই এলাকা বাংলাদেশ পেয়ে গেছে। কিন্তু গত ১৩ বছরেও আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওই এলাকার সাগরে কোনো ইজারাদার কোম্পানি গ্যাস অনুসন্ধানের প্রয়াস চালায়নি কেন? মিয়ানমারের ভয়ে? (ভারতের ওএনজিসি দুটো ব্লকে বর্তমানে অনুসন্ধান চালালেও তাদের তুলনামূলক নিষ্ক্রিয়তা রহস্যজনক, হয়তো ভারতের স্বার্থহানিকর কিছু তারা করবে না)।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের সমুদ্র-সীমান্তের অদূরে ভারত গোদাগাড়ি এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে বিরাট গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে গ্যাস উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ, বাংলাদেশ এখনো নিজেদের সমুদ্রসীমায় আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোকে আকর্ষণ করার জন্য একটি মাল্টি-ক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে পর্যন্ত সম্পন্ন করতে পারেনি। (একটি সিসমিক সার্ভে চলছিল, যার ফলাফল গত বছরের শেষ নাগাদ পাওয়ার কথা ছিল)। কিছুদিন আগে মার্কিন বহুজাতিক তেল কোম্পানি এক্সন-মবিল বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র এলাকার ১৫টি ব্লকে তেল অনুসন্ধানের আগ্রহ দেখিয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সম্পন্ন টেন্ডারে তারা অংশগ্রহণই করেনি। এ ব্যাপারেও সরকারের রহস্যজনক নীরবতা লক্ষণীয়।
হয়তো উল্লিখিত প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই ভোলার গ্যাস এদ্দিনে দেশের গ্যাস-গ্রিডে নিয়ে আসার ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়নি! এখন যখন এলএনজি আমদানি ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে গেছে, তখন সরকারের টনক নড়বে কি? মূল সমস্যা হলো, ভোলায় ইতিমধ্যে পাওয়া গ্যাসকে অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিসংগত উপায়ে দেশের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা। ভবিষ্যতে যদি ভোলায় আরও গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় তাহলে এই ব্যাপারটি দেশের অর্থনীতিতে বড়সড় ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। ২০২৩ সালের ১১ মে দৈনিক যুগান্তরের ওই নিউজ আইটেমে জানা গেল, ভোলার শাহবাজপুর গ্যাস ফিল্ড ও ভোলা নর্থ গ্যাস ফিল্ড থেকে বরিশালের লাহারহাট পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে ভোলার গ্যাস বরিশালে নিয়ে আসার জন্য ১৩০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব ওই সময়ে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছিল। পরবর্তী সময়ে এই গ্যাস পাইপলাইনটি কুয়াকাটা-বরিশাল-গোপালগঞ্জ-খুলনা পাইপলাইনের মাধ্যমে জাতীয় গ্যাস-গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা। আমার মতে, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির প্রকৃত বাস্তবায়ন ব্যয় পরবর্তী সময়ে ১৫০০-২০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেলেও এটাকে অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিবেচনা করতে হবে। কারণ, বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম ১ এমএমবিটিউ ১৪-১৬ ডলার। তাহলে ভোলার ১.৭৫ টিসিএফ গ্যাসের মোট মূল্য দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি। মাত্র দেড়-দুই হাজার কোটি টাকার পাইপলাইন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে যদি আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা এই ১.৭৫ টিসিএফ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে এই পাইপলাইন অর্থনীতির জন্য কতখানি উপকার বয়ে আনতে পারবে, সেটা কি আমরা অনুধাবন করতে পারছি? ইতিমধ্যে ইন্ট্রাকোকে ঠিকাদারি দিয়ে সিলিন্ডারে ভরে ভোলার গ্যাস ঢাকায় নিয়ে আসার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, সেটা অর্থনৈতিকভাবে তেমন উল্লেখযোগ্য সুফল বয়ে আনবে না। অতএব এই পাইপলাইন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের সঙ্গে সরকারের চুক্তি বহাল রাখা যেতে পারে, পাইপলাইন স্থাপনের বিরুদ্ধে এটাকে যেন বাধা হিসেবে খাড়া করা না হয়।
প্রস্তাবিত পাইপলাইনটি আরেকটি দিক থেকেও বাংলাদেশকে সুফল দেবে। বর্তমানে বাংলাদেশের এলএনজি আমদানির টার্মিনালগুলো মহেশখালী-কক্সবাজার অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো বৈরিতা দেখা দিলে ভোলায় আরেকটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করে প্রস্তাবিত ভোলা-বরিশাল পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানিকৃত এলএনজি জাতীয় গ্রিডে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তবে, আমার মতে প্রস্তাবিত পাইপলাইনটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভবিষ্যৎ-ব্যবহার নিশ্চিত হবে যদি বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোতে গ্যাস পেয়ে যায়। তখন এলএনজির আকারে গভীর সমুদ্রের গ্যাস জাতীয় গ্রিডে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই পাইপলাইন সবচেয়ে ব্যয়-সাশ্রয়ী উপায় হয়ে উঠবে। এমনকি এই সম্ভাবনাটি মাথায় রেখে পাইপলাইনের ব্যাস ৩০ ইঞ্চি থেকে আরও বাড়ানো যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হতে পারে।
ওপরে উল্লিখিত আলোচনা-বিশ্লেষণ থেকে আমি অনুসিদ্ধান্ত টানতে চাই, প্রস্তাবিত ভোলা-বরিশাল গ্যাস পাইপলাইনটি একটি যুগান্তকারী প্রকল্প হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ধারণ করছে। বর্তমান বিদ্যুৎসংকট, গ্যাসের চলমান ঘাটতি সমস্যা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারা এবং ডলার-সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য এটাকে দেশের জনগণের জন্য আল্লাহর রহমত হিসেবে বিবেচনা করা উচিত মনে করি। অবশ্য যদি প্রস্তাবিত বরিশাল-ভোলা সেতু প্রকল্পের কাজ যথাসম্ভব শিগগির শুরু করা যায় তাহলে আলাদা গ্যাস পাইপলাইন প্রয়োজন হবে না। ওই সেতুতেই গ্যাস পাইপলাইন সংযুক্ত করা যাবে।
একাত্তরের যুদ্ধকালের মতো সমষ্টিগত দুঃসময় আমাদের জীবনে আর কখনো আসেনি। যুদ্ধটা ছিল রাজনৈতিক এবং তাতে জাতীয়তাবাদ নানাভাবে ও বিভিন্ন দিক দিয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তি সে সময়ে বিশেষভাবে প্রকাশ পায়, তার দুর্বলতাও যে ধরা পড়েনি এমন নয়। বাঙালির জাতীয়তাবাদের শক্তি ছিল ঐক্যে...
৯ ঘণ্টা আগেনতুন শিল্পকারখানায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর একটি প্রস্তাবের ওপর আয়োজিত এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) এক গণশুনানি সব শ্রেণির গ্রাহক প্রতিনিধিদের তীব্র বিরোধিতা ও প্রতিবাদের মুখে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারেনি। গত বুধবার ইস্কাটনের বিয়াম মিলনায়তনে দিনব্যাপী এই গণশুনানির আয়োজন করেছিল বিইআরসি।
৯ ঘণ্টা আগেবর্তমান পরিস্থিতিতে গত কয়েক দিনে সামাজিক অপরাধের ব্যাপকতার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি জনমনে যথেষ্ট আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি। সমাজ হলো নাগরিকদের জন্য একটি দায়বদ্ধতার জায়গা। যেখানে মানবিক ও পারস্পরিক সম্পর্কগুলোর প্রতিনিয়ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার...
৯ ঘণ্টা আগেরচিত হয়েছিল। এর মধ্যেই নিহিত ছিল এক নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও দিকনির্দেশনা। স্বাধীনতার পর প্রায় পাঁচ দশক পেরিয়ে এলেও সংবিধানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আজও অপরিসীম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাও দেখা দিয়েছে। তবে সেই পরিবর্তন বা সংশোধন হবে কীভাবে—এটাই এখন বিতর্কের বিষয়।
৯ ঘণ্টা আগে