Ajker Patrika

সরকার বদলালেও ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। ছবি সংগৃহীত
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। ছবি সংগৃহীত

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তার বছরপূর্তি সামনে রেখে ওই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামের একটি সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি, জুলাই অভ্যুত্থান ছিল শুধু সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন নয়, বরং একটি ফ্যাসিবাদবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসানের জন্য পরিচালিত সংগ্রাম। কিন্তু এক বছর পর দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, সেই সংগ্রামের কাঙ্ক্ষিত পরিণতি মেলেনি। সরকার বদলালেও ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি, বরং আগের ব্যবস্থাই এখন নতুন নেতৃত্বের হাতে পুনঃস্থাপিত হয়েছে। এই বক্তব্যে আমরা একটি হতাশা লক্ষ করি, কিন্তু সেই হতাশার গভীরে ভবিষ্যতের জন্য একধরনের দায়িত্ববোধের প্রতিফলনও দেখতে পাই। নাহিদ ইসলামের ভাষায়, ‘আমাদের লড়াইটা ছিল ব্যবস্থার সঙ্গে। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে, কিন্তু ব্যবস্থার বিলোপ ঘটেনি।’ এখানে মূল সংকেত হলো—শুধু সরকার পরিবর্তন কোনো কৃতিত্ব নয়, বরং মূল কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এই পরিবর্তন বাহ্যিক।

এই অভ্যুত্থানের সময় প্রস্তুতির অভাব ছিল, নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন ছিল এবং সবচেয়ে বড় যে ঘাটতিটি ছিল তা হলো সংগঠন ও দর্শনের পরিষ্কার কাঠামো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল এক প্রবল শক্তি, কিন্তু সেটি কোনো সংগঠিত প্ল্যাটফর্ম ছিল না। ৫ আগস্টের পর যখন এটিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করা হয়, তখনই নানা প্রতিকূলতা দেখা দেয়। নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা, কর্মসূচির অস্পষ্টতা এবং প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষার্থীদের স্থায়ীভাবে মাঠে রাখা যায়নি। ফলে আন্দোলনের সংগঠিত কাঠামো গড়ে ওঠেনি, বরং একেকটি গোষ্ঠী নিজ নিজ অভিপ্রায় অনুযায়ী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নাহিদ ইসলাম এখানে যে কথাটি বলেন তা আন্দোলনের প্রকৃত ব্যর্থতা: ‘জুলাইয়ের পরে প্রত্যেকে যার যার অ্যাজেন্ডায় চলে গেছে।’ এই চলে যাওয়ার পেছনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের লড়াই এবং পুরোনো ব্যবস্থার মোহ।

নাহিদ বলেছেন, যে ঐক্যটি শুরুতে তৈরি হয়েছিল—ছাত্র, সেনাবাহিনী, কিছু রাজনৈতিক দল এবং অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি সমর্থনের এক অলিখিত সমঝোতা—তা অভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়ে। শেখ হাসিনার পতন পর্যন্ত সবাই একত্র ছিল, কিন্তু পতনের পর কেউ আর এক জায়গায় থাকেনি। ফলে, রাষ্ট্র পুনর্গঠনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা নষ্ট হয়ে যায়। এই ব্যর্থতার দায় কেবল কোনো একটি গোষ্ঠীর নয়, বরং অভ্যুত্থানের সব পক্ষের মধ্যে সামষ্টিক সমন্বয়ের অভাব এর জন্য দায়ী।

বর্তমান সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নাহিদ যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি মনে করেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো, কিন্তু সেই পরিস্থিতি ধরে রাখার জন্য যে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত। পুলিশের সক্রিয়তা শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ৫ আগস্টের পর অনেক থানাই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে সক্রিয় হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সংগঠিত না রাখতে পারায় সেই গতিও থেমে যায়। সরকার যখন প্রো-অ্যাকটিভ থাকে না, তখনই আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। নাহিদ মনে করেন, যাদের ‘মব’ বলে অপমান করা হচ্ছে, তারা আসলে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা। সঠিক কর্মসূচি ও নেতৃত্ব না থাকার কারণে তারা বিভ্রান্ত হয়েছে, ব্যবহার হয়েছে। এই বাস্তবতা বুঝতে না পারলে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কিন্তু এই ‘মব’ নামক সামাজিক শক্তির বেপরোয়া আচরণ দমন না করলে পরবর্তী সময়ে এটা আরও বিস্ফোরক রূপ নিতে পারে।

এই এক বছরে অভ্যুত্থানের শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ হয়নি, পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ায় রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং শহীদ পরিবারদের অভিযোগও উপেক্ষিত থেকেছে। সরকার বাজেট বরাদ্দ দিলেও তা সরাসরি ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছায়নি। নাহিদ মনে করেন, এই দেরি ও অব্যবস্থার পেছনে রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব এবং সদিচ্ছার ঘাটতি। সরকার চাইলে তালিকাপ্রক্রিয়াটি উন্মুক্ত করে দিয়ে শহীদদের সংখ্যা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারত, নিখোঁজদের অবস্থান জানাতে পারত। কিন্তু তা করা হয়নি।

অভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ঐক্য ছিল, তা কেন দ্রুত ভেঙে গেল, সে প্রশ্নের উত্তরও স্পষ্ট করেছেন নাহিদ। তিনি মনে করেন, অনেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে ওঠেন। কে উপদেষ্টা হতে পারল আর কে পারল না—এই প্রশ্ন অনেকের মধ্যে ঈর্ষা তৈরি করে। আবার আন্দোলনের সময় যেসব ছাত্রসংগঠনের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়েনি, তারাও পরে নিজেকে ঐক্যভুক্ত অংশ বলে দাবি করে। নাহিদ এ বিষয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো সর্বদলীয় ঐক্য প্ল্যাটফর্ম ছিল না। এরপরও তিনি ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রত্যাশার কথা বলেন, জাতির প্রয়োজনে যেন সবাই এক হতে পারে, সেই সম্পর্ক রক্ষা করে চলা উচিত।

নাহিদ ইসলাম এই মুহূর্তে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি মনে করেন, পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই অভ্যুত্থানের শক্তিকে ধারণ করতে পারবে না বলেই তাঁরা নতুন দল গঠন করেছেন। যদিও দলের সংগঠন এখনো পুরোপুরি মাঠে গড়ায়নি, তবু জনগণের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান। তিনি এটাও স্বীকার করেন, তাঁদের পারফরম্যান্সে সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। তাঁর মতে, নতুন একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এনসিপি নিজেরা আগে সংগঠিত হতে চায়, তার পরই নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করা হবে। নির্বাচন নিয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন ৫ আগস্টের পর, যদি এর আগে প্রতিশ্রুত ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশ করা যায়।

এখানে এসে একটি গভীর প্রশ্ন সামনে আসে, জুলাই সনদ এক বছরেও কেন হয়নি? সরকার দুই দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা দিতে পারেনি। ফলে এনসিপি এখন নিজেই সেই সনদ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা একটি বিকল্প দর্শন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা দিতে চায়। তাদের ভাষায়, যদি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের দিশা না দেওয়া যায়, তাহলে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে।

তবে রাজনৈতিক কাঠামো গড়তে গিয়ে তাঁরা নানা বাধার মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে ছাত্র উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ, নেতাদের ব্যক্তিগত অডিও ফাঁস ইত্যাদি নানা ঘটনা অভ্যুত্থানের নৈতিক ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এসব বিষয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, শুরুতে দুর্নীতি ছিল না, কিন্তু পুরোনো ব্যবস্থার লোকেরা সুযোগ পেয়ে পুরোনো প্রক্রিয়া চালু করেছেন। অন্য ছাত্রসংগঠনের সুযোগসন্ধানী কেউ কেউ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচয় ব্যবহার করে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি হয়েছে অপপ্রচার। মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চরিত্র হননের চেষ্টা হয়েছে, বিশেষ করে নারীনেত্রীদের বিরুদ্ধে। নাহিদ বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের একটি প্রধান নৈতিক শক্তি ছিল নারীরা। তাই নারীদের রাজপথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো চলছে।’

একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান এবং ইসলামপন্থীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে। অনেকেই তাদের একটি ইসলামপন্থী দলের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করেন। নাহিদ ইসলাম এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, এনসিপি মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনীতি করতে চায়। একাত্তর, ইসলাম, নারী–এ বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার। তিনি মনে করেন, যোগাযোগের ঘাটতি এবং একটি সংগঠিত অপপ্রচারই এই ভুল ধারণার সৃষ্টি করছে। তাঁর মতে, আওয়ামী লীগ যুগের রাজনীতির ভাষা দিয়ে নতুন রাজনীতিকে বিচার করা ঠিক নয়। নাহিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি হলো, ‘সুশীল সমাজ এই গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়নি। গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে সাধারণ ছাত্র-জনতার মাধ্যমে।’

বিএনপির ভূমিকাও এনসিপি ইতিবাচকভাবে নিতে পারছে না। তাদের মতে, বিএনপি পুরোনো বন্দোবস্তের বিপক্ষে নয় এবং শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়। তারা আওয়ামী লীগের পরিবর্তে নিজেরাই ‘নতুন আওয়ামী লীগ’ হতে চায়। তারা নিজস্ব রাজনীতি, অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং জামায়াত সম্পর্কিত অবস্থান পরিষ্কার করছে না। ফলে একটি পুরোনো ধাঁচের রাজনীতিই আবার ফিরে আসছে।

সবশেষে যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, অভ্যুত্থানের এক বছরে আপনি সরকারের পারফরম্যান্সকে কত নম্বর দেবেন, তখন তিনি নম্বর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, সরকার কেবল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছে, অন্য কোনো দলের কাছ থেকে নয়। সেনাবাহিনীর কাছ থেকেও প্রত্যাশিত সমর্থন আসেনি। সরকারের পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি মনে করেন, সরকারকে বারবার পুরোনো বন্দোবস্তে ঢোকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু তাঁরা সেটা প্রত্যাখ্যান করেছেন। নাহিদ নিজে উপদেষ্টা পদ ছাড়ার পর নিজের ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশ করেছেন, কোনো বিদেশ সফর করেননি। সরকারে থেকেও কোনো অনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করেননি বলে দাবি করেন।

নাহিদের পুরো বক্তব্যের সারকথা হলো—ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থান যদি একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে রূপান্তরিত না হয়, তবে তা ব্যর্থ হবে। শুধু শেখ হাসিনার পতন কোনো অর্জন নয়। নাহিদ ইসলাম যে কথাটি বলেন, সেটি এই রাজনৈতিক মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি উপলব্ধি—‘নতুন বন্দোবস্ত না হলে, আওয়ামী লীগের পতন করে কী লাভ হলো, যদি আরেকটা আওয়ামী লীগই আসে?’ এই কথাটি নিছক একটি বাক্য নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি একটি নতুন রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব, নাকি পুরোনো কুশাসনের পাথরে ফের মাথা ঠুকব? প্রশ্নের উত্তর এখনো সময়ের হাতে। সময়ের সময় কবে শেষ হবে, দেখার বিষয় সেটাই।

লেখক:– জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সন্তানের নাম মুহাম্মদ রাখা কি আদবের খেলাপ

জামায়াতের সমাবেশের জন্য বিশেষ ট্রেন, যে ব্যাখ্যা দিল রেল মন্ত্রণালয়

কোটালীপাড়ায় আওয়ামী লীগের দেড় হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ১২

আবাসিক হোটেলে অভিযানে গিয়ে অবরুদ্ধ ভ্রাম্যমাণ আদালতের কর্মকর্তারা, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে উদ্ধার

ঢাকায় সমাবেশের জন্য ৩ জোড়া ট্রেন ভাড়া করেছে জামায়াত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত