সেলিম জাহান
আবারও বন্যা, আবারও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দেশের পূর্বাঞ্চলে, বিশেষত ফেনী অঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে একাধিক নদীর প্লাবন এবং সেই সঙ্গে অবিরাম বর্ষণের ফলে উত্তরবঙ্গও বন্যা প্লাবিত হতে পারে। ইতিমধ্যে তিস্তা, ধরলা ও গঙ্গার পানি বাড়ছে। অল্প সময়েই একাধিক জেলা, জনপদ এবং লোকালয়ের মানুষের জীবনচিত্র বদলে গেছে।
ফেনী অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষ জলবন্দী ছিল। ৩০ মিনিটে আড়াই তলার সমান পানি বেড়েছে ফেনীতে। তবে স্বস্তির কথা হচ্ছে, কোনো কোনো অঞ্চলে বন্যার পানি নেমে যেতে শুরু করেছে। ফলে আশ্রয়বন্দী মানুষেরা ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। মে মাস থেকেই স্থানীয় লোকজন আশঙ্কা করছিল যে, বেড়িবাঁধে ফাটল ধরতে পারে। জনতার ভয় সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় বেড়িবাঁধের ক্ষত দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে যে বেড়িবাঁধ টেকসই ছিল না। বন্যার্ত অঞ্চলগুলোর অসহায়ত্ব নিয়ে কাতর আমরা সবাই। যদিও বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে, তবু বন্যা-উদ্ভূত অবস্থায় মানুষের কষ্ট, তার অসহায়ত্ব আর আর্তিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। বন্যার ফলে সংকট দেখা দিচ্ছে খাবারের, বিশুদ্ধ পানির, বস্ত্রের, আশ্রয়ের।
এ মুহূর্তে করণীয় তিনটিই। প্রথমত, জরুরি ভিত্তিতে মানুষের জীবন রক্ষা করা। সে কাজটি অতি দ্রুত দুটি পর্যায়ে করতে হবে—এক. মানুষকে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর। বন্যায় আটকে পড়া মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে উপকরণ এবং জনবল নিয়ে। দুই. বন্যাকবলিত মানুষের খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপদ পানীয়, বস্ত্র আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক জিনিসের ব্যবস্থা করা। অনতিবিলম্বে তাদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া। মনে রাখতে হবে, সেই সব জিনিসই তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যেগুলো তাদের লাগবে এবং প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই তারা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে। অতীতে দেখা গেছে, বন্যার ত্রাণ হিসেবে বন্যার্তদের এমন সব সামগ্রী দেওয়া হয়েছে, যেগুলো তারা ওই মুহূর্তে ব্যবহার করতে পারছে না। যেমন, প্রক্রিয়াজাত খাবারের বদলে শুকনা খাদ্যসামগ্রী তাদের এখন দরকার। বিশুদ্ধ পানীয়র চেয়ে পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি তাদের বেশি প্রয়োজন।
ত্রাণকাজের জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে, দরকার আছে সরকারি এবং বেসরকারি ত্রাণকাজের মধ্যে সমন্বয়ের। বেসরকারি খাতের সহযোগিতাও অত্যন্ত জরুরি।
দ্বিতীয়ত, বন্যার পানি নেমে গেলে মধ্য মেয়াদে তিনটি জিনিস প্রকট হয়ে দেখা দেবে। প্রথমত, অভাব সবকিছুর—খাদ্যের, কর্মের, আয়ের। বুভুক্ষু সেখানে জায়গা করে নেবে। এখন থেকেই সে ব্যাপারে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। খোলাবাজার-ব্যবস্থার মাধ্যমে জরুরি খাদ্যসামগ্রী তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যেহেতু বন্যার ফলে আগাম ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, তাই সময়মতো কৃষকের কাছে কৃষির নানান উপকরণ বীজ, সার কী করে পৌঁছানো যায়, তার জন্য এখন থেকেই চিন্তাভাবনা প্রয়োজন।
জরুরি ভিত্তিতে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কিংবা গ্রামের নানান পুনর্গঠন নির্মাণকাজ, যেমন রাস্তাঘাট পুনর্নির্মাণ কিংবা সংস্কারের মাধ্যমেও কর্মনিয়োজন বাড়ানো যেতে পারে। গ্রামীণ অর্থনীতির অবকাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে একদিকে যেমন কাজের সৃষ্টি হবে, তেমনি গ্রামের রাস্তাঘাটও একটি শক্ত ভূমির ওপরে দাঁড়াতে পারবে।
বন্যার পরপরই নানান পানিবাহিত এবং অন্যান্য রোগের প্রকোপ দেখা দেবে। সেই সঙ্গে বর্তমান সময়ে দেশে চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি বন্যাকবলিত অঞ্চলে আরও সংকটময় হয়ে আবির্ভূত হতে পারে। সুতরাং জরুরি ভিত্তিতে দুস্থ মানুষের কাছে পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র এবং চিকিৎসা-সুবিধা লভ্য করে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে বিশেষ নজর দিতে হবে শিশুদের প্রতি।
বন্যা পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলে গ্রাম থেকে নিরন্ন উদ্বাস্তু মানুষের শহরে অভিবাসন ঘটতে পারে। সে অবস্থায় এইসব শরণার্থীর নানান চাহিদা মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকেই চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। যেমন বেশির ভাগ নিরন্ন মানুষই আসবে কাজের খোঁজে। সেই কর্ম-সুযোগ শহুরে অর্থনীতিতে কী করে তৈরি করা সম্ভব, সেটা চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, বন্যা মোকাবিলার সমাধান চাইতে হবে দীর্ঘ মেয়াদেও। সন্দেহ নেই, আমাদের দেশের বন্যার একটা আন্তরাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপট আছে। সেদিকটাতে নজর ফেরাতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই। চিন্তায় রাখা দরকার যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাই কি যথেষ্ট, নাকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো নিয়ে বহুপক্ষীয় পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে? শেষ বিষয়টি বর্তমান সময়ে বিশেষ বিবেচনার দাবিদার। ঠিক এই সময়ে উত্তরাঞ্চলের বন্যার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী দেশও বন্যাকবলিত। তাদের বন্যার কারণ এবং প্রভাব আমাদেরই মতো। সুতরাং এই বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানের জন্য আঞ্চলিক উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।
বন্যা মোকাবিলার জন্য অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন। দেশি-বিদেশি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতার মাধ্যমে একটি অর্থভান্ডার গড়ে তুলতে, যার একটি আনুষ্ঠানিক স্থায়িত্বের প্রয়োজন হবে। যেহেতু আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে বন্যা উপর্যুপরিভাবে ঘটবে, সে জন্য বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাববার অবকাশ আছে। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে অতীতে ত্রাণকার্যের জন্য জোগাড় করা অর্থ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। ত্রাণের অর্থ বা ত্রাণসামগ্রী লোপাট হয়ে গেছে, তা জনগণের কাছে পৌঁছায়নি। এটা বন্ধের উপায়গুলো ভাবা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি এবং জনগণের নজরদারির কোনো বিকল্প নেই।
আমি পানি বিশেষজ্ঞ নই, বন্যাবিশারদও নই। কিন্তু সাধারণ জ্ঞানে কয়েকটা বিষয় তো বুঝতে পারি। এক. বাংলাদেশে বন্যা স্মরণাতীত কাল ধরে হয়ে এসেছে এবং এ দেশে বন্যার আপাতন অনেকটা অর্থনীতির বাণিজ্য চক্রের মতোই কাজ করেছে। যেমন ঐতিহাসিকভাবে বেশ কয়েক বছর (ধরা যাক ৫-৭ বছর) ছোট ছোট বন্যার পরে একটা বড় বন্যা হয়েছে, তারপর একনাগাড়ে অনেকগুলো ছোট বন্যার পরে বড় একটা। ছোট বন্যাগুলো তাদের বুকে ধরে পলিমাটি নিয়ে এসেছে, যা আমাদের ভূমিকে করেছে উর্বর। তাই একটি বড় বন্যার ক্ষতিকে যখন তার পূর্ববর্তী ৫-৭টি ছোট বন্যার পলি এবং তা থেকে উৎসারিত ফসলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, তখন নিট ক্ষতি কিন্তু তত বেশি হয়। বলা বাহুল্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ চিত্রটি কিন্তু বদলে গেছে।
দুই. বড় বন্যাগুলো যখন ৫-৭ বছর পরে এসেছে, তখন ১২ ঘণ্টার মধ্যে সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তাই আমরা তাকে বলেছি বান। কোথাও আবদ্ধ হয়ে থাকেনি পানি। ক্ষতি হয়েছে জনপদের, সম্পদের, মানুষের জীবনে। কিন্তু বানের পানি নেমে গেছে অতি দ্রুত। সাম্প্রতিক বন্যাগুলোর ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। বন্যার পানি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘদিন।
তিন. আমাদের নদীকাঠামোর নাব্যতা উত্তর থেকে দক্ষিণে। জলধারা ওপর থেকে নিচে নেমে আসে। কিন্তু, বহু বছর ধরে ভৌত অবকাঠামো—বাঁধ, সড়ক নির্মিত হয়েছে পূর্ব-পশ্চিমে। ফলে জলধারার বা বন্যার স্বাভাবিক গতিধারা বিঘ্নিত হয়েছে এবং এর ফলে বন্যার পানি দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকা। এতে মানুষের ভোগান্তির কাল এবং গভীরতা দুটোই বেড়েছে। শহরাঞ্চলের জলাশয়, পুকুর এগুলো বুজিয়ে হর্ম্যরাজি উঠেছে ঠিকই। কিন্তু বিঘ্নিত হয়েছে জলের স্বাভাবিক চলাচল। সামান্য বৃষ্টিতেই তাই আমাদের নগরগুলোতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছাড়া বন্যার তাণ্ডবকে রোখা যাবে না আমাদের দেশে। সব সমস্যার মতো বন্যারও একটি উপশমের দিক আছে, আবার একটি নিবারণেরও দিক আছে। এ মুহূর্তে উপশমটাই জরুরি, কারণ ‘মানুষকে বাঁচাতে হবে’, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে নিবারণটি অত্যাবশ্যকীয় কারণ ‘মানবতাকে বাঁচাতে হবে’। দুটোর জন্যই আবেগও লাগবে, সেই সঙ্গে বিবেকও লাগবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
আবারও বন্যা, আবারও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। দেশের পূর্বাঞ্চলে, বিশেষত ফেনী অঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে একাধিক নদীর প্লাবন এবং সেই সঙ্গে অবিরাম বর্ষণের ফলে উত্তরবঙ্গও বন্যা প্লাবিত হতে পারে। ইতিমধ্যে তিস্তা, ধরলা ও গঙ্গার পানি বাড়ছে। অল্প সময়েই একাধিক জেলা, জনপদ এবং লোকালয়ের মানুষের জীবনচিত্র বদলে গেছে।
ফেনী অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষ জলবন্দী ছিল। ৩০ মিনিটে আড়াই তলার সমান পানি বেড়েছে ফেনীতে। তবে স্বস্তির কথা হচ্ছে, কোনো কোনো অঞ্চলে বন্যার পানি নেমে যেতে শুরু করেছে। ফলে আশ্রয়বন্দী মানুষেরা ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। মে মাস থেকেই স্থানীয় লোকজন আশঙ্কা করছিল যে, বেড়িবাঁধে ফাটল ধরতে পারে। জনতার ভয় সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় বেড়িবাঁধের ক্ষত দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে যে বেড়িবাঁধ টেকসই ছিল না। বন্যার্ত অঞ্চলগুলোর অসহায়ত্ব নিয়ে কাতর আমরা সবাই। যদিও বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে, তবু বন্যা-উদ্ভূত অবস্থায় মানুষের কষ্ট, তার অসহায়ত্ব আর আর্তিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। বন্যার ফলে সংকট দেখা দিচ্ছে খাবারের, বিশুদ্ধ পানির, বস্ত্রের, আশ্রয়ের।
এ মুহূর্তে করণীয় তিনটিই। প্রথমত, জরুরি ভিত্তিতে মানুষের জীবন রক্ষা করা। সে কাজটি অতি দ্রুত দুটি পর্যায়ে করতে হবে—এক. মানুষকে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর। বন্যায় আটকে পড়া মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে উপকরণ এবং জনবল নিয়ে। দুই. বন্যাকবলিত মানুষের খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপদ পানীয়, বস্ত্র আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক জিনিসের ব্যবস্থা করা। অনতিবিলম্বে তাদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া। মনে রাখতে হবে, সেই সব জিনিসই তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যেগুলো তাদের লাগবে এবং প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াই তারা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে। অতীতে দেখা গেছে, বন্যার ত্রাণ হিসেবে বন্যার্তদের এমন সব সামগ্রী দেওয়া হয়েছে, যেগুলো তারা ওই মুহূর্তে ব্যবহার করতে পারছে না। যেমন, প্রক্রিয়াজাত খাবারের বদলে শুকনা খাদ্যসামগ্রী তাদের এখন দরকার। বিশুদ্ধ পানীয়র চেয়ে পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি তাদের বেশি প্রয়োজন।
ত্রাণকাজের জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে, দরকার আছে সরকারি এবং বেসরকারি ত্রাণকাজের মধ্যে সমন্বয়ের। বেসরকারি খাতের সহযোগিতাও অত্যন্ত জরুরি।
দ্বিতীয়ত, বন্যার পানি নেমে গেলে মধ্য মেয়াদে তিনটি জিনিস প্রকট হয়ে দেখা দেবে। প্রথমত, অভাব সবকিছুর—খাদ্যের, কর্মের, আয়ের। বুভুক্ষু সেখানে জায়গা করে নেবে। এখন থেকেই সে ব্যাপারে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। খোলাবাজার-ব্যবস্থার মাধ্যমে জরুরি খাদ্যসামগ্রী তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যেহেতু বন্যার ফলে আগাম ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, তাই সময়মতো কৃষকের কাছে কৃষির নানান উপকরণ বীজ, সার কী করে পৌঁছানো যায়, তার জন্য এখন থেকেই চিন্তাভাবনা প্রয়োজন।
জরুরি ভিত্তিতে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কিংবা গ্রামের নানান পুনর্গঠন নির্মাণকাজ, যেমন রাস্তাঘাট পুনর্নির্মাণ কিংবা সংস্কারের মাধ্যমেও কর্মনিয়োজন বাড়ানো যেতে পারে। গ্রামীণ অর্থনীতির অবকাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে একদিকে যেমন কাজের সৃষ্টি হবে, তেমনি গ্রামের রাস্তাঘাটও একটি শক্ত ভূমির ওপরে দাঁড়াতে পারবে।
বন্যার পরপরই নানান পানিবাহিত এবং অন্যান্য রোগের প্রকোপ দেখা দেবে। সেই সঙ্গে বর্তমান সময়ে দেশে চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতি বন্যাকবলিত অঞ্চলে আরও সংকটময় হয়ে আবির্ভূত হতে পারে। সুতরাং জরুরি ভিত্তিতে দুস্থ মানুষের কাছে পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র এবং চিকিৎসা-সুবিধা লভ্য করে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে বিশেষ নজর দিতে হবে শিশুদের প্রতি।
বন্যা পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলে গ্রাম থেকে নিরন্ন উদ্বাস্তু মানুষের শহরে অভিবাসন ঘটতে পারে। সে অবস্থায় এইসব শরণার্থীর নানান চাহিদা মোকাবিলা করার জন্য এখন থেকেই চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। যেমন বেশির ভাগ নিরন্ন মানুষই আসবে কাজের খোঁজে। সেই কর্ম-সুযোগ শহুরে অর্থনীতিতে কী করে তৈরি করা সম্ভব, সেটা চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, বন্যা মোকাবিলার সমাধান চাইতে হবে দীর্ঘ মেয়াদেও। সন্দেহ নেই, আমাদের দেশের বন্যার একটা আন্তরাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপট আছে। সেদিকটাতে নজর ফেরাতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই। চিন্তায় রাখা দরকার যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাই কি যথেষ্ট, নাকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো নিয়ে বহুপক্ষীয় পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে? শেষ বিষয়টি বর্তমান সময়ে বিশেষ বিবেচনার দাবিদার। ঠিক এই সময়ে উত্তরাঞ্চলের বন্যার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী দেশও বন্যাকবলিত। তাদের বন্যার কারণ এবং প্রভাব আমাদেরই মতো। সুতরাং এই বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানের জন্য আঞ্চলিক উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।
বন্যা মোকাবিলার জন্য অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন। দেশি-বিদেশি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতার মাধ্যমে একটি অর্থভান্ডার গড়ে তুলতে, যার একটি আনুষ্ঠানিক স্থায়িত্বের প্রয়োজন হবে। যেহেতু আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশে বন্যা উপর্যুপরিভাবে ঘটবে, সে জন্য বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাববার অবকাশ আছে। সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে অতীতে ত্রাণকার্যের জন্য জোগাড় করা অর্থ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। ত্রাণের অর্থ বা ত্রাণসামগ্রী লোপাট হয়ে গেছে, তা জনগণের কাছে পৌঁছায়নি। এটা বন্ধের উপায়গুলো ভাবা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি এবং জনগণের নজরদারির কোনো বিকল্প নেই।
আমি পানি বিশেষজ্ঞ নই, বন্যাবিশারদও নই। কিন্তু সাধারণ জ্ঞানে কয়েকটা বিষয় তো বুঝতে পারি। এক. বাংলাদেশে বন্যা স্মরণাতীত কাল ধরে হয়ে এসেছে এবং এ দেশে বন্যার আপাতন অনেকটা অর্থনীতির বাণিজ্য চক্রের মতোই কাজ করেছে। যেমন ঐতিহাসিকভাবে বেশ কয়েক বছর (ধরা যাক ৫-৭ বছর) ছোট ছোট বন্যার পরে একটা বড় বন্যা হয়েছে, তারপর একনাগাড়ে অনেকগুলো ছোট বন্যার পরে বড় একটা। ছোট বন্যাগুলো তাদের বুকে ধরে পলিমাটি নিয়ে এসেছে, যা আমাদের ভূমিকে করেছে উর্বর। তাই একটি বড় বন্যার ক্ষতিকে যখন তার পূর্ববর্তী ৫-৭টি ছোট বন্যার পলি এবং তা থেকে উৎসারিত ফসলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, তখন নিট ক্ষতি কিন্তু তত বেশি হয়। বলা বাহুল্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ চিত্রটি কিন্তু বদলে গেছে।
দুই. বড় বন্যাগুলো যখন ৫-৭ বছর পরে এসেছে, তখন ১২ ঘণ্টার মধ্যে সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তাই আমরা তাকে বলেছি বান। কোথাও আবদ্ধ হয়ে থাকেনি পানি। ক্ষতি হয়েছে জনপদের, সম্পদের, মানুষের জীবনে। কিন্তু বানের পানি নেমে গেছে অতি দ্রুত। সাম্প্রতিক বন্যাগুলোর ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। বন্যার পানি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘদিন।
তিন. আমাদের নদীকাঠামোর নাব্যতা উত্তর থেকে দক্ষিণে। জলধারা ওপর থেকে নিচে নেমে আসে। কিন্তু, বহু বছর ধরে ভৌত অবকাঠামো—বাঁধ, সড়ক নির্মিত হয়েছে পূর্ব-পশ্চিমে। ফলে জলধারার বা বন্যার স্বাভাবিক গতিধারা বিঘ্নিত হয়েছে এবং এর ফলে বন্যার পানি দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকা। এতে মানুষের ভোগান্তির কাল এবং গভীরতা দুটোই বেড়েছে। শহরাঞ্চলের জলাশয়, পুকুর এগুলো বুজিয়ে হর্ম্যরাজি উঠেছে ঠিকই। কিন্তু বিঘ্নিত হয়েছে জলের স্বাভাবিক চলাচল। সামান্য বৃষ্টিতেই তাই আমাদের নগরগুলোতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধান ছাড়া বন্যার তাণ্ডবকে রোখা যাবে না আমাদের দেশে। সব সমস্যার মতো বন্যারও একটি উপশমের দিক আছে, আবার একটি নিবারণেরও দিক আছে। এ মুহূর্তে উপশমটাই জরুরি, কারণ ‘মানুষকে বাঁচাতে হবে’, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে নিবারণটি অত্যাবশ্যকীয় কারণ ‘মানবতাকে বাঁচাতে হবে’। দুটোর জন্যই আবেগও লাগবে, সেই সঙ্গে বিবেকও লাগবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ
সম্প্রতি মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় একটা নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ ধরনের বর্বরোচিত লোমহর্ষ হত্যাকাণ্ড ইতিপূর্বে ঘটেছে কি না মনে পড়ে না। একজন ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগকে আদিম যুগের আদলে পাথর দিয়ে আঘাত করে, তাঁর নিথর দেহের ওপর লাফিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে।
৫ ঘণ্টা আগেজীবনের যাত্রাপথে আমরা অনেক মানুষের সান্নিধ্যে আসি। কেউ কেউ কেবল সহযাত্রী, কেউ কেউ হয়ে ওঠেন বাতিঘর। অধ্যাপক বদিউর রহমান ছিলেন তেমন একজন—নিঃশব্দ আলোকবর্তিকা, যিনি নিজের আলোয় নিজেকে পোড়াতে জানতেন, কিন্তু কখনো আলো জ্বালাতে চেষ্টার ভান করতেন না।
৫ ঘণ্টা আগেবুধবার গোপালগঞ্জে যে সংঘর্ষ হলো, তা কি এড়ানো যেত না? আবার ঝরে পড়ল চারটি তাজা প্রাণ। এনসিপির সমাবেশে হামলা হলো, সংঘর্ষ হলো, গুলি চলল, আহত হলো শতাধিক মানুষ।
৫ ঘণ্টা আগেদেশ কোন পথে যাত্রা করেছে, তা নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে দেশের জনগণ। এক বছর আগে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে ঐক্য দেখা দিয়েছিল, এখন সেই ঐক্যের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। বিভিন্ন দল তাদের নিজেদের পথ বেছে নিয়েছে। একে অন্যের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে বিভিন্ন দল বিভিন্ন...
১ দিন আগে