Ajker Patrika

শুটিং চলছে, মামা

স্বপ্না রেজা
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় একটা নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ ধরনের বর্বরোচিত লোমহর্ষ হত্যাকাণ্ড ইতিপূর্বে ঘটেছে কি না মনে পড়ে না। একজন ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগকে আদিম যুগের আদলে পাথর দিয়ে আঘাত করে, তাঁর নিথর দেহের ওপর লাফিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। যদিও সন্দেহ থেকে যায়, আদিম যুগের মানুষের আচরণ এতটাই নির্মম ছিল কি না। পথচারীসহ অনেকেই এই নির্মম, পাশবিক হত্যাকাণ্ড নীরবে দেখেছে, দর্শক হয়ে থেকেছে, যেমনটা অনেক চলচ্চিত্র দর্শক পকেটের টাকা দিয়ে টিকিট কেটে সিনেমা দেখে থাকে। কিন্তু কেউ তাঁকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসেনি। আসলে সমাজ কোন দিকে এগোচ্ছে!

আগের অনেক ঘটনার মতো সোহাগের হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক আলাপচারিতা চলছে। অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে অপরাধের মাত্রা ও ভয়াবহতার কথা বলা হচ্ছে। আমাদের দেশে রাজনীতির সঙ্গে চাঁদাবাজি, ভাগ-বাঁটোয়ারা, টেন্ডারবাজি, দখলদারত্ব শব্দগুলোর জন্মগত সম্পর্ক আছে। ফলে কোনো ঘটনা ঘটলে তার রাজনৈতিক সূত্র ধরে টান দেওয়া হয়। সোহাগ হত্যাকাণ্ডের অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি নান্নুকেও ধরা হয়েছে। সাধারণত চলচ্চিত্রে দেখা যায়, খুনিদের পোষণকারী হয় রাষ্ট্র বা সমাজের ক্ষমতাধরেরা। যারা রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিক মানদণ্ডে, প্রশাসনিকভাবে ও দুর্নীতিতে শীর্ষস্থানীয়। সেই সূত্র ধরে বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, অন্যতম আসামি আদতে এরা নয়, এদের নেপথ্যের অবস্থানকারীরা। যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই অপরাধীরা মানুষ হত্যা করে, নানান ধরনের অপরাধ করে ও দৃশ্যমান হয় এবং বিচারপ্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্ত হলেও হতে পারে। দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য চলচ্চিত্রে অন্যতম আসামিকে আটক করা সম্ভব হলেও বাস্তবে সেটা সম্ভব হয় না। কারণ, বাস্তবে তারা সম্পূর্ণভাবে স্ক্রিপ্ট ও স্ক্রিনের বাইরে অবস্থান করে। বরং তারা যা করে সেটা হলো, আপামর জনগণের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে প্রকাশ্যে বলে, অপরাধী যে-ই হোক, যে দলের হোক তাকে শাস্তি দিতেই হবে। দক্ষিণি চলচ্চিত্রে পরিষ্কারভাবে অনেক ঘটনা তুলে ধরা হয় যেটা আমাদের চলচ্চিত্র পরিচালকেরা পারেন না। না পারার কারণ তাঁরা ভালো জানে। তবে আমাদের সাংস্কৃতিক জগতে রাজনৈতিক মেরুকরণের কথা কমবেশি সবাই জানে। কে কাকে কীভাবে খুশি করবে চলচ্চিত্র সেই কাজেও ব্যস্ত।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে বলা হলো, পল্লী বিদ্যুতের চোরাই তার ব্যবসার দ্বন্দ্বে সোহাগকে হত্যা করা হয়েছে। শঙ্কা তৈরি হলো, চোরাই তারের অজুহাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার সোহাগের পরিবার আদৌ ন্যায্য বিচার পাবে কি না। ইতিপূর্বে সোহাগের মেয়ে অভিযোগ করেছে, তাদের করা মামলার নথিতে তিনজন আসামির নামের জায়গায় নতুন করে নাম সংযুক্ত করা হয়েছে। এমন নাটকীয়তা দর্শকদের চলচ্চিত্রমুখী করবে, রহস্যের জালে আটকে ফেলবে বলে ধারণা করা যায়।

২. দু-তিনটা চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরপাক খাচ্ছে এক তরুণীর কথা। যে নাকি বাবা ও মায়ের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছে। তরুণী দাবি করছে, সে নাকি নিজের ইচ্ছায় এই জগতে আসেনি। সে এসেছে নাকি বাবা ও মায়ের প্রজনন প্রক্রিয়ায়। ইতিপূর্বে কোনো সন্তানের কাছ থেকে এমন অভিযোগ শুনেছি বলে মনে পড়ে না। আর যে ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে, তা-ও যেন সচরাচর শোনা যায় না। কারও জীবনে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটলেও বাবা ও মায়ের সম্মান রক্ষা করার প্রচেষ্টা চলে। সন্তানের জীবননাশ হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সেটা আর গোপন থাকে না, প্রকাশ পায়। বাবা কর্তৃক কন্যাসন্তানের ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা আমাদের সমাজে ঘটলেও সেটা কিন্তু প্রচলিত হয়ে ওঠেনি। হবেও না। কারণ, যারা এমন কাজ করে তারা বিকৃত মানসিকতার পুরুষ। আজ তরুণী যে অভিযোগ তার অভিভাবক সম্পর্কে করছে এবং আদালত প্রাঙ্গণে মিডিয়ার সামনে যে ভঙ্গিতে কথা বলছে, সেটা কিন্তু তার মানসিক সুস্থতার কথা বলে না। তরুণীর ভেতর সেলিব্রিটি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্র, বোঝা যায়। বাবা-মাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সেলিব্রিটি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা মানবাধিকারের কোন জায়গায় তাকে শেষ অবধি নিয়ে যাবে, এটা সে ভালো বুঝবে এবং তার নেপথ্যে যারা সক্রিয় আছে, সেটাও ভবিষ্যতে দৃশ্যমান হতে পারে। তার পেছনে কেউ আছে বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। সঙ্গে আছে আমাদের গন্তব্যহীন সমাজব্যবস্থা।

যে দাবি ও অভিযোগ নিয়ে তরুণী আজ তার বাবা-মাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজে ভাইরাল হয়েছে, তাকে পুঁজি করার কথা কেনই-বা ভাববে না অসাধু মানুষ। বয়সে তরুণী, ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলে, স্মার্ট। দু-চার লাইন লিখে এমন একটা আইটেম আপলোড করলেই তো ভিউয়ার্স তরতর করে বাড়বে। আবার অভিনব ঘটনা, গল্পের ভিন্নতা তো কমবেশি সবারই কাম্য, সবাইকে টান দেয়। লাভ, লোভের পরিমাণ যেন এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেয় দৌড়। সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বা হচ্ছে, এতেও কিন্তু সে সেলিব্রিটি হওয়ার পথে, স্ট্যাটাস তার যা-ই হোক। তরুণীর এমন আচরণে অনেকেই অনেক কথা বলছে, গল্প তৈরি করছে এবং সবই নিজেদের মতো করে। আধুনিক যুগের মানুষ যা বলে, সেটাই আধুনিক হয়ে ওঠে। পুরোনো কোনো যুক্তি দিয়ে তার রূপরস কমিয়ে আনা যায় না।

প্রিন্স মামুন, লায়লা কিংবা হিরো আলম, রিয়া মনি, মিথিলাদের কথা মোবাইল ইউজারদের প্রায় অনেকেই জানে বলে ধারণা করা যায়। এরাও যেন একধরনের সেলিব্রিটি। যাই হোক, তরুণীর কোনো অভিযোগকেই তার প্রাণনাশের কারণ বলে মনে হয়নি। যত দূর জানা গেছে, বাবা ও মা, মেয়ের অভিযোগের কোনো প্রতি উত্তর দেননি। মাথা নিচু করে থেকেছেন। দেশের দুটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে তাঁরা চাকরি করেন। একমাত্র সন্তান তাঁদের। এমন ঘটনায় মনে হচ্ছিল, কোনো চিত্রনাট্যকার হয়তো কোনো চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজকের সঙ্গে বসে পড়েছেন কীভাবে এমন কাহিনির চিত্রায়ণ করা যায়, কিংবা কী করলে দর্শক সিনেমা হলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে।

তরুণসমাজ কতটা সুস্থতার সঙ্গে বেড়ে উঠছে, বেড়ে উঠবে, কোনো ধরনের মানসিক অসুস্থতা তাকে গ্রাস করছে কি না। করলে তার ধরন ও কৌশল বিশ্লেষণ করে সুচিন্তিত পরিকল্পনা করার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ কখনো নেওয়া হয়েছে, এমন নজির কিন্তু নেই। সবকিছুতেই পরিবারকে দোষারোপ করা একটা ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। দোষারোপের সময় ভুলে যাওয়া হয় যে, পরিবার সমাজেরই একটা অংশ। আর সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্র। একটা রাষ্ট্রের সক্ষমতা, সুশাসন, আইনি ব্যবস্থা সবকিছুর প্রতিফলন পড়ে তার সমাজে। আর সমাজ রাষ্ট্রের দায় বহন করে।

ক্যামেরাম্যান, লাইটম্যান, সহকারী পরিচালক নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় একদল তরুণ এসে জানতে চাইল, শুটিং চলছে, মামা? লাইটম্যান জবাব দিল, চলবে।

স্বপ্না রেজা, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

রাষ্ট্রের গোপন নথি ফাঁস: এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব মুকিতুলের বিরুদ্ধে এবার মামলা

রক্ত কেনা যায় না—ইয়েমেনে নিমিশাকে ক্ষমা করতে অস্বীকৃতি মাহদির পরিবারের

২৫ সেকেন্ডে ১২ গুলি, হাসপাতালে গ্যাংস্টারের শরীর ঝাঁঝরা

গোপালগঞ্জে সহিংসতায় নিহত ৪ জনের ময়নাতদন্ত হলো না, প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন ডিআইজি

বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল: সাবেক এমপিসহ ৬০ জনের বিরুদ্ধে মামলা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত