Ajker Patrika

পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দাও

প্রনয় চাকমা
আপডেট : ২২ জুন ২০২২, ২১: ০৮
Thumbnail image

খাগড়াছড়ি সদর স্বনির্ভর বাজারের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কাপতলা পাড়া। ২৬৬ নম্বর বাঙ্গাল কাটি মৌজার অন্তর্গত ৪ নম্বর পেরাছড়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মনমাতানো চিরসবুজ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি গ্ৰাম। চারপাশে দৈত্যাকৃতির পাহাড়ে জুমে পাহাড়ি ফসলের সমারোহে মুহূর্তে মন ভরে ওঠে। কাপতলা পাড়ার পর আরও কয়েকটি জুমিয়া গ্ৰাম রয়েছে। ভাঙ্গা মুড়া পাড়া, মায়ুংতৈক্লু নামক গ্ৰামে শত পরিবারের বসবাস। পাহাড়ের মাটি আঁকড়ে ধরে বাস করা ওই এলাকার মানুষগুলো সাধারণত জুম চাষ, আদা, হলুদ, কলা ইত্যাদি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে বর্তমানে বাহারি আম, লিচু চাষের প্রতি বেশ আগ্ৰহ দেখা যায়। বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ি হাটবাজারের দিন। পাহাড়ে উৎপাদিত ফলন বিক্রি করে পুরো সপ্তাহের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্ৰী কিনতে বাজারে আসতে হয়। 

কাপতলা পাড়া আর ভাঙ্গা মুড়া পাড়ার মধ্যে সংযোগস্থলে হাতির মাথা আকৃতির একটা বিরাট খাড়া পাহাড় রয়েছে। ভাঙ্গা মুড়া পাড়ার মানুষের ওই পাহাড় বেয়ে বাজারে আসা-যাওয়া করতে হয়। এটি ওদের আসা-যাওয়ার একমাত্র শর্টকাট রাস্তাও বটে! হাটবাজারের দিনে কাঁধে বস্তাভর্তি আদা, হলুদ, কলার ছড়া, জুমের ধান ইত্যাদি বেয়ে নামা সত্যিই অনেক কষ্টসাধ্য। অনেকের কাছে এটি সময়ের সেরা বিভৎস পথের একটি! কিন্তু বাচ্চাদের স্কুলে আসা-যাওয়া থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের হাঁটাচলার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ওই পথই একমাত্র ভরসা। ওই রাস্তা না ছুঁয়ে গ্ৰামের অর্থনৈতিক অগ্ৰগতি কল্পনাও করা যায় না। আজ থেকে ৮-১০ বছর আগেও বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি নড়বড়ে একটা সিঁড়ি বেয়ে যাতায়াত করতে হতো। তবে ২০১৫ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরার আন্তরিকতায় ও বোর্ডের অর্থায়নে তিন শতাধিক সিঁড়িবিশিষ্ট একটি দৃষ্টিনন্দন লোহার সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়। শত শত মানুষের দুর্ভোগের অবসান ঘটে। এ জন্য তাঁর কাছে আমি এবং আমরা কৃতজ্ঞ। 

এই সিঁড়ি এ এলাকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে। তা ছাড়া সিঁড়ির পূর্ব পাশে চেঙ্গী নদীর মাধুর্য আর পানছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কের পাশে গড়ে ওঠা গ্ৰামগুলোর শহুরে মোহনীয় সৌন্দর্য, পশ্চিমের সারি সারি পাহাড়ে সবুজের মনমাতানো চাহনি, বৃষ্টির দিনে মেঘের ঘনঘটা এর সৌন্দর্যে অন্য মাত্রা এনে দেয়। এ সৌন্দর্যের টানে ধীরে ধীরে স্থানীয় মানুষের আনাগোনা বাড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর কথা ছড়াতে সময় লাগেনি। ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ক্রমে। এভাবেই মানুষের কাছে মায়ুং কপাল হয়ে ওঠে জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। 

কয়েকটি গ্ৰামের যাতায়াতের সীমাহীন দুর্ভোগ লাঘব করা দৃষ্টিনন্দন এই সিঁড়ি নিয়ে নাটকীয়তার শেষ নেই। চাকমা জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় এটি ‘এদোছিড়ে মোন’ নামে পরিচিত ছিল, যার বাংলা ‘হাতি মাথা’। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো এটি কী করে যেন ‘স্বর্গের সিঁড়ি’ উপাধি লাভ করে! কে বা কারা এ নাম দিয়েছে জানা নেই। কিছু পর্যটক বা তথাকথিত ব্লগার অতিরঞ্জিত করে এ নামের অভ্যুদয় ঘটিয়ে থাকতে পারে। এখন অনেকে ‘হাতি মাথা’ বা ‘স্বর্গের সিঁড়ি’ নামে একে চিনলেও ‘মায়ুং কপাল’ পড়েছে অপরিচয়ের ফেরে। এখানেই আমার তীব্র আপত্তি। প্রাকৃতিক গঠনশৈলীর ওপর নির্ভর করে দেওয়া নামের বদলে অন্য ভাষার সমার্থক শব্দের নাম ব্যবহার শত বছরের নামের মাহাত্ম্য বিকৃতি ছাড়া কিছুই নয়। নামের প্রকৃত ইতিহাস জানা থাকা দরকার। প্রচারের সুবিধার্থে নিজের মতো নাম প্রয়োগ করা চরম বোকামি। এতে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হয়। ইতিহাস সম্পর্কে তারা অন্ধকারে থেকে যায়। খেয়াল করে দেখুন, আমাদের শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক নামগুলো কিন্তু এভাবেই অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। মায়ুং কপালের বিকল্প নাম ব্যবহারের প্রভাব বর্তমানে তেমন বড় কিছু না হলেও এটিই কিন্তু পরবর্তীতে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে এভাবে বহু নাম কিন্তু হারিয়ে গেছে। এ আগ্ৰাসনকে থামাতে হবে। 

আমাদের বাড়ি থেকে মায়ুং কপাল যেতে বড়জোর ৩০-৪০ মিনিট লাগে। ছোটবেলা থেকেই মায়ুং কপালের নাম শুনে বড় হয়েছি। ত্রিপুরাদের স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় হাতিকে মায়ুং বলা হয়। 

প্রসঙ্গত, মায়ুং কপাল কিন্তু স্বীকৃত পর্যটন কেন্দ্র নয়। জেলা প্রশাসনের লাখ লাখ টাকায় নির্মিত আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র কিংবা জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন হর্টিকালচার পার্কের মতো এটি নয়। শতাধিক পরিবারকে উচ্ছেদ করে গড়ে তোলা সাজেকের মতো পরিকল্পিত পর্যটনকেন্দ্র এটি নয়। এটা স্রেফ যাতায়াতের সুবিধার্থে নির্মিত টেকসই সিঁড়ি ছাড়া কিছুই নয়। তবে প্রকৃতির মোহে যদি কেউ ঘুরতে আসে, তাতে আপত্তি নেই। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনকেন্দ্রগুলো আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। কার্যত, এতে স্থানীয়দের লাভের কিছুই নেই। শতাধিক পরিবারকে উচ্ছেদ করে যে পর্যটনকেন্দ্র তৈরি হলো, সেখানে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলো কী সুফল পাচ্ছে? শতকোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক রুচিসম্পন্ন রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে। রাস্তাঘাট সম্প্রসারণ করা হয়েছে। কিন্তু একটা মানসম্মত প্রাথমিক স্কুল নেই। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারে—এমন কোনো ক্লিনিক নেই। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাজেকের প্রকৃতি উপভোগ করতে, মেঘের মিতালী দেখতে, রিসোর্টের বেলকনি থেকে মিজোরাম দেখতে আসেন অনেকে। কিন্তু স্থানীয় আদিবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা অনুধাবনের দৃষ্টিভঙ্গি কি তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে? বরং রাস্তার পাশে থাকা বাচ্চাদের ভিক্ষাবৃত্তিতে টেনে আনছে এ পর্যটন। এখানে আসা অনেকে মেয়েদের হাঁটু পর্যন্ত পিনোন পরা পোশাক উপভোগ করতে আসেন। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের চকলেট ছুড়ে মেরে ভিডিও করে মজা নেন! পথিমধ্যে একটা অসহায় বাচ্চা ছেলে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে মায়া কান্না দেখাতে আসেন। ফেসবুকে ইউটিউবে ভিডিও বা ছবি আপলোড করে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে এ দৃশ্য দেখিয়ে মজা পান! এটাকে আমরা কি আশীর্বাদ বলব? 

একদিনের ঘটনা বলি। পাহাড়ের পাদদেশে রাস্তার পাশে ছোট্ট একটা টিলার ওপর আমাদের বাড়ি। বাংলাদেশে করোনার আঘাত হানার আগে এক অপরাহ্নে গায়ে শুধু একটা গামছা পরে গরুগুলো বাড়িতে আনতে গিয়েছিলাম। আসার সময় শুকনো কিছু কাপড় হাতে ‘হে রে ব ব তি তি’ করে উঠতে যাব, সে সময় দেখি হঠাৎ সাত-আটজনের একদল অপরিচিত মানুষ রাস্তার পাশে খালে গোসলরত বাচ্চাদের ভিডিও করছে। গাঁয়ের মেয়েরা কেউ কেউ পানি তুলছে। তাদের বেশ আপত্তিজনক ভাবে ভিডিও করছে। কিছুক্ষণ পর আমার দিকে এসে বেশ কাছ থেকে ছবি তোলার চেষ্টা করল। আমি বাধা দিলাম। 

কোথা থেকে এসেছে জিজ্ঞেস করলাম। ওদের মধ্যে একজন কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক। তিনি বললেন, ‘আমরা ঢাকা থেকে আসছি।’ বললাম, ‘আপনারা গ্ৰামে এসে অবলীলায় ইচ্ছামতো ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন। গ্ৰামে কার মাধ্যমে আসছেন?’ জবাব শুনে বিমর্ষ হলাম। গ্ৰামে কাউকে চেনেন না, জানেন না। বললাম, ‘আপনারা বিনা অনুমতিতে ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন। অন্তত আপত্তি থাকুক বা না থাকুক, অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। গ্ৰামে কাউকে চিনেন না বা কোনো গাইড আপনাদের নেই। আপনাদের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু হলে এর দায় কে নেবে?’ কিছু বললেন না। পরে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আপনার ছবি ডিলিট করে দেওয়া হবে।’ পরে ওদের সোজা রাস্তা দেখিয়ে চলে যেতে বললাম। তখন প্রায় সন্ধ্যে। 

করোনা আঘাত হানার পর দেশে ঘোরতর লকডাউন চলমান ছিল। একটা বিশেষ কাজে দোকানে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে চেঙ্গী নদীতে একদল পর্যটকের সঙ্গে দেখা। লকডাউন চলছে। এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায় যাওয়া কঠিন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওরা পানছড়ি থেকে আসছে। মায়ুং কপাল দেখতে যাবে। করোনার বিধিনিষেধ সম্পর্কে ওদের সঙ্গে কথা হলো। ওরা নাছোড়বান্দা। চেঙ্গী নদীর পাড়ে একটা যাত্রীছাউনি আছে। দেখলাম, গ্ৰামের কয়েকজন মুরুব্বি যাত্রীছাউনিতে বসে আছেন। স্বয়ং কারবারি মহোদয়কেও দেখলাম। তারপর মায়ুং কপাল গমনেচ্ছুদের সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে দ্রুত এসে মুরুব্বিদের অবহিত করলাম। করোনার আগ্ৰাসনের দিনেও ন্যূনতম সামাজিক বিধিনিষেধ অমান্য করে তাঁরা ঘুরতে এসেছেন! 

প্রতিদিন স্থানীয়-অস্থানীয় অনেক মানুষ মায়ুং কপাল দেখতে যায়। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শত শত মানুষের ঢল নামে। কিছুদিন আগে আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে লোহার কংক্রিটগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে জং ধরেছে। একটা সিঁড়ির একদম খাড়া অংশের পাটাতন ভেঙে গেছে। যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। সবার ওপরের অংশে কে বা কারা লোহার অংশগুলো সুবিধাজনকভাবে ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। কতিপয় মানুষের মুখ থেকে তথাকথিত পর্যটনকেন্দ্র বলে জাহির করা না হলে হয়তো এ অবস্থা হতো না। 

আমি সবসময় একটা কথা বলি, পাহাড়কে পাহাড়ের মতো থাকতে দাও! পাহাড়ের স্বকীয়তা বজায় রাখতে দাও। আধুনিকতার আবশ্যকতা সবসময় থাকে না। ইতিহাস বিকৃত করে কোনো আধুনিক শ্রুতিমধুর নাম নির্ধারণের পরিণতি সুখকর নাও হতে পারে। 

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, চট্টগ্রাম

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত