মনজিল মোরসেদ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিনিয়র অ্যাডভোকেট। তিনি ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ (এইচআরপিবি)-এর প্রেসিডেন্ট। জনস্বার্থে এ পর্যন্ত তিনি ২২৫টির বেশি মামলা করে মানবাধিকার ও পরিবেশ সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা
সংবিধান সংস্কারের খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
কিছু প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আমি সংস্কার কমিশনকে ধন্যবাদ দিতে চাই, কিছু প্রস্তাবের ব্যাপারে আমি নিন্দা জানাতে চাই আর কিছু প্রস্তাবের ক্ষেত্রে বলতে চাই, কমিশন কাউকে সহায়তা করার জন্য প্রস্তাবগুলো দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কোনো ব্যক্তি দুবারের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করা হবে। প্রস্তাব অনুযায়ী এসব কাজ করা হলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের জন্য ভালো হবে এবং জনগণের উপকার হবে। এগুলো অনেক মানুষের মাথায় ছিল। এসব প্রস্তাব করায় আমি তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই।
সংবিধানের কতগুলো মৌলিক ব্যাপার আছে। ’৭১ সালে যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়, তখন আমাদের কোনো লিগ্যাল ডকুমেন্ট ছিল না। সেই দলিল তৈরি হয়েছিল ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে। সেই দলিলের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে সংবিধান গ্রহণ করার আগপর্যন্ত সেটার ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছিল। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাটা হলো আমাদের ‘ভিত্তিমূল’। কিন্তু বর্তমান সংস্কার কমিশন সেটা বাতিল করার সুপারিশ করেছে। যেকোনো দেশের সংবিধানে একটা প্রস্তাবনা থাকে। সেই প্রস্তাবনা প্রেক্ষাপট, সময়—এগুলোর ওপর ভিত্তি করে করা হয়। সংবিধানের সেই প্রস্তাবনাকে পরিবর্তনের কথা কমিশন বলেছে। এটা নিন্দনীয় ব্যাপার। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন বিষয়টা ধরে সবকিছু নির্ধারণ করা হয়েছিল। ৫৪ বছর পর সেটা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। আমি এটার শুধু সমালোচনা না করে সরাসরি নিন্দা করছি। কারণ, এটা একটা গর্হিত কাজ হয়েছে। মানে, মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করা হয়েছে। যুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, আমার দৃষ্টিতে সেটাকে ছোট করা হয়েছে।
কিছু জায়গায় কাউকে সহায়তা করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব আনা হয়েছে। বর্তমান সংবিধানে প্রার্থী হওয়ার বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ বছর। কারণ এই সময়ের মধ্যে সাধারণত একজন ব্যক্তির পড়াশোনা সমাপ্ত হয়ে যায়। তারপর তিনি পেশাজীবনে প্রবেশ করেন। পেশাজীবনে তিনি রাজনীতিতে আসতেই পারেন। এখন প্রস্তাব করা হয়েছে ২১ বছর। আমার কাছে মনে হচ্ছে, নতুন যে রাজনৈতিক দলের কথা শোনা যাচ্ছে, তার দিকে দৃষ্টি রেখেই এই প্রস্তাব করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন, ২১ বছরে তো কারও মাস্টার্সই শেষ হবে না। তাহলে তাঁরা পড়াশোনা শেষ না করেই রাজনীতিতে চলে আসবেন। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই রাজনীতিতে চলে আসবেন। এতে আমাদের শিক্ষিত জাতি গঠনের প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। আবার সংস্কার প্রস্তাবে আনা হয়েছে, প্রতিটি দলের জন্য নমিনেশন প্রার্থী ১০ শতাংশ তরুণ-তরুণীদের জন্য নির্ধারিত থাকতে হবে। এটাও করা হয়েছে বিশেষ একটা গোষ্ঠীকে সহায়তা করার জন্য।
’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতির অধিকাংশ বাতিল করার প্রস্তাব কি যৌক্তিক মনে হয় আপনার কাছে?
’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতি তো সেই সময়ই নির্ধারিত হয়েছে। তারপর ’৭৪ সালে যদি কিছু মূলনীতি সংযোজন করা হয়ে থাকে, সেটা সংশোধনের প্রস্তাব করা যেত। কিন্তু ’৭২ সালে এ দেশের জনগণ যে মূলনীতি গ্রহণ করেছে, সেটা তো পরিবর্তন করা যায় না। এবার বড় যে পরিবর্তনটা আনা হয়েছে, সেটা হলো ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করা হয়েছে। সেই সময়ের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। কারণ, আমরা পাকিস্তানের ইতিহাস জানি। পাকিস্তান আমলে বিভিন্নভাবে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। সে কারণে সব ধর্মের মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিল। উদ্দেশ্য, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সে কারণে সেই সময় সংবিধানে নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম রাখা হয়নি। কারণ, ধর্ম সবার ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে থাকবে। আর ধর্মনিরপেক্ষতা কাজ করবে রাষ্ট্র পলিসির ক্ষেত্রে। কিন্তু সেই ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এতে সংবিধানের বড় বিচ্যুতি ঘটেছে এবং এটা উদ্দেশ্যমূলক বলে আমার মনে হয়। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সমাজতন্ত্র যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এটাকে এখন বাদ দেওয়া অযৌক্তিক হবে না। কারণ, তার বিপরীতে সাম্য, সমতা শব্দগুলো পরবর্তী সংশোধনে চলে এসেছে।
‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি’ সংবিধানের এই ধারা বিলুপ্তের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এ নিয়ে আপনার মত কী?
এটাও বিতর্ক সৃষ্টির জন্য করা হয়েছে। এটা তারা করতে পারে না। কারণ, আপিল বিভাগের একটা জাজমেন্ট আছে। আমরা জাতীয় পরিচয় কীভাবে দেব, সেটা সেখানে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আপিল বিভাগ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এ দেশের মানুষ বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশি পরিচয় দেবে। আর নিজ দেশের মধ্যে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেবে। এ বিষয়গুলো রায়ের মধ্যে নির্ধারিত করা হয়েছে। তাই এগুলোকে বিতর্কিত করার সুযোগ নেই।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার করবে, নির্বাচিত সরকার সেটা মানবে—এমন নিশ্চয়তা কি আছে?
সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমি আগেও বলেছি, বর্তমান সরকারের সংবিধান সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। বিভিন্ন আইন নিয়ে রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে পারে। কারণ, রাষ্ট্রপতিকে সরকার যা বলে, তিনি তা-ই করেন। এ জন্য তারা আইন করতে পারে। এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তারা এসব কেন করছে? কারণ, মানুষ কিছু পরিবর্তন চায়, এসব আলোচনা চলছে। নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো না কোনো দল তো ক্ষমতায় আসবে। মানুষ কী চায়, সেটা বিবেচনা করে কমিশন যদি আলোচনাগুলো তুলে ধরত, তাহলে ভবিষ্যতে যে ক্ষমতায় আসবে, তারা সেসব করতে পারত। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করে যেসব প্রস্তাব গ্রহণ করছে, সেগুলোর তেমন কোনো মূল্য নেই। নির্বাচিত হয়ে যারা সরকার গঠন করবে, তারা যদি এসব প্রস্তাব পালনে অনাগ্রহী হয়, তাহলে অন্য কারও কিছু করার সুযোগ নেই।
এখন বড় দল হিসেবে বিএনপি আছে। নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে বলে অনেকের ধারণা। তাই বিএনপির কনসেন্ট নিয়ে সংস্কার প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করা হলে ভবিষ্যতে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এখন বিএনপি যেসব বিষয়ে দ্বিমত করছে, সেসব বিবেচনায় না নিয়ে সংস্কার করা হলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেসব মেনে নেবে বলে আমার মনে হয় না। তাহলে তো প্রস্তাবগুলো স্বাভাবিকভাবেই ভেস্তে যাবে।
শুধু সংবিধান সংস্কার করলেই হবে না। তার চেয়ে জরুরি রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতির পরিবর্তন। সেটা কীভাবে সম্ভব?
এসব কথায় আমি বেশি গুরুত্ব দিতে চাই না। আপনি যখন সিঙ্গাপুরে যাবেন, তখন কলা খেয়ে খোসাটা রাস্তায় ফেলবেন না। আপনি চিপস খেলে তার প্যাকেটটা আপনার পকেটে রেখে দেবেন। এরপর কোথাও যখন ডাস্টবিন পাবেন, সেখানে সেসব ফেলে দেবেন। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ সৌদি আরবে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করেন এবং সে দেশের আইন যথারীতি মেনে চলেন। তাঁরা দেশে থাকতে কি তা মানতেন? ওই দেশে যেহেতু আইনের প্রয়োগ আছে, তাই তারা আইন মেনে চলেন। সে জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, রুল অব ল-এর প্রয়োগ।
গণতান্ত্রিত পদ্ধতি যেভাবে চলে, সেটা যদি শক্তিশালীভাবে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষও আইন মেনে চলতে বাধ্য হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, যারাই যখন ক্ষমতায় গেছে, তারা তাদের ইচ্ছেমতো এবং জোর করে তাদের সুবিধামতো আইনকে ব্যবহার করেছেন। এ জন্য মানুষের চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে।
কোনো দল যখন ক্ষমতায় থেকে আইন করে বলে ব্যবসা করতে হলে আমাদের দল করতে হবে, তখন ব্যবসায়ীরা তাদের দল করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু ব্যবসা যদি আইনকানুনের অধীনে করা
সম্ভব হতো এবং দলবাজ ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত সুবিধা না পেতেন, তাহলে বাধ্য হয়ে কেউ আর সরকারি দল করতেন না। এ জন্য সিস্টেমের উন্নতি করতে হবে। সেটা করা হলে এ দেশের মানুষ আইন মেনে চলতে বাধ্য হতো।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এই সরকার নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
বিগত সরকারের অনেক কর্মকাণ্ড জনগণ পছন্দ করত না। বিশেষ করে রুল অব ল, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-হত্যা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করা—মোটাদাগে এসব কারণে জনগণের মধ্যে বিক্ষুব্ধতা তৈরি হয়েছিল। জনগণ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভীষণ অখুশি ছিল। সে জন্য মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল। জনগণের প্রথম দাবি আসলে পরিবর্তনের জন্য। জনগণ কিন্তু বলেনি, আমরা হাসিনা সরকারের পরিবর্তন করে সমন্বয়কদের মাধ্যমে একটা অনির্বাচিত সরকার তৈরি করে দেশ চালাব। সে সময় এসব কথা বললে সত্যি জনগণ আন্দোলনে যুক্ত হতো কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মানুষ মনে করেছে, সরকার পরিবর্তন হলে তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে। নির্বাচন হলে জনগণ যাদের চাইবে, তারাই সরকার গঠন করবে। এটাই ছিল আসল ব্যাপার।
জনগণ সেই প্রত্যাশা থেকে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জনগণের চাওয়া হচ্ছে নির্বাচন। সংবিধানে তো বলা আছে, সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। যারা নির্বাচিত হবে, তারাই পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে গত সরকারের সময় যেভাবে লুটপাট, গুম-খুন করা হয়েছে, সেসবের মামলা করে তদন্ত করুক, এসব উদ্যোগ নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা হলো এমন এক নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করে দেওয়া, যাতে যারাই ক্ষমতায় আসবে, নির্বাচন নিয়ে তারা যেন কোনো ‘মেকানিজম’ করতে না পারে। এটা করা হলে ভবিষ্যতে গণতন্ত্র বিপদমুক্ত হবে। কেউ আর স্বৈরাচার হতে পারবে না। আর কোনো দল ক্ষমতায় থেকে যদি খারাপ কাজ করে, তাহলে তারা আর পরে ভোট পাবে না। সে জন্য তারা খারাপ কাজ করার সাহস পাবে না। যদি করে, তাহলে জনগণ তাদের ছুড়ে ফেলে দেবে।
সংবিধান সংস্কারের খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
কিছু প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আমি সংস্কার কমিশনকে ধন্যবাদ দিতে চাই, কিছু প্রস্তাবের ব্যাপারে আমি নিন্দা জানাতে চাই আর কিছু প্রস্তাবের ক্ষেত্রে বলতে চাই, কমিশন কাউকে সহায়তা করার জন্য প্রস্তাবগুলো দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কোনো ব্যক্তি দুবারের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। দলের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করা হবে। প্রস্তাব অনুযায়ী এসব কাজ করা হলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের জন্য ভালো হবে এবং জনগণের উপকার হবে। এগুলো অনেক মানুষের মাথায় ছিল। এসব প্রস্তাব করায় আমি তাদের ধন্যবাদ দিতে চাই।
সংবিধানের কতগুলো মৌলিক ব্যাপার আছে। ’৭১ সালে যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়, তখন আমাদের কোনো লিগ্যাল ডকুমেন্ট ছিল না। সেই দলিল তৈরি হয়েছিল ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে। সেই দলিলের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে সংবিধান গ্রহণ করার আগপর্যন্ত সেটার ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছিল। সে কারণে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাটা হলো আমাদের ‘ভিত্তিমূল’। কিন্তু বর্তমান সংস্কার কমিশন সেটা বাতিল করার সুপারিশ করেছে। যেকোনো দেশের সংবিধানে একটা প্রস্তাবনা থাকে। সেই প্রস্তাবনা প্রেক্ষাপট, সময়—এগুলোর ওপর ভিত্তি করে করা হয়। সংবিধানের সেই প্রস্তাবনাকে পরিবর্তনের কথা কমিশন বলেছে। এটা নিন্দনীয় ব্যাপার। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন বিষয়টা ধরে সবকিছু নির্ধারণ করা হয়েছিল। ৫৪ বছর পর সেটা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। আমি এটার শুধু সমালোচনা না করে সরাসরি নিন্দা করছি। কারণ, এটা একটা গর্হিত কাজ হয়েছে। মানে, মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করা হয়েছে। যুদ্ধের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, আমার দৃষ্টিতে সেটাকে ছোট করা হয়েছে।
কিছু জায়গায় কাউকে সহায়তা করার জন্য সংস্কার প্রস্তাব আনা হয়েছে। বর্তমান সংবিধানে প্রার্থী হওয়ার বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ বছর। কারণ এই সময়ের মধ্যে সাধারণত একজন ব্যক্তির পড়াশোনা সমাপ্ত হয়ে যায়। তারপর তিনি পেশাজীবনে প্রবেশ করেন। পেশাজীবনে তিনি রাজনীতিতে আসতেই পারেন। এখন প্রস্তাব করা হয়েছে ২১ বছর। আমার কাছে মনে হচ্ছে, নতুন যে রাজনৈতিক দলের কথা শোনা যাচ্ছে, তার দিকে দৃষ্টি রেখেই এই প্রস্তাব করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন, ২১ বছরে তো কারও মাস্টার্সই শেষ হবে না। তাহলে তাঁরা পড়াশোনা শেষ না করেই রাজনীতিতে চলে আসবেন। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই রাজনীতিতে চলে আসবেন। এতে আমাদের শিক্ষিত জাতি গঠনের প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। আবার সংস্কার প্রস্তাবে আনা হয়েছে, প্রতিটি দলের জন্য নমিনেশন প্রার্থী ১০ শতাংশ তরুণ-তরুণীদের জন্য নির্ধারিত থাকতে হবে। এটাও করা হয়েছে বিশেষ একটা গোষ্ঠীকে সহায়তা করার জন্য।
’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতির অধিকাংশ বাতিল করার প্রস্তাব কি যৌক্তিক মনে হয় আপনার কাছে?
’৭২-এর সংবিধানের মূলনীতি তো সেই সময়ই নির্ধারিত হয়েছে। তারপর ’৭৪ সালে যদি কিছু মূলনীতি সংযোজন করা হয়ে থাকে, সেটা সংশোধনের প্রস্তাব করা যেত। কিন্তু ’৭২ সালে এ দেশের জনগণ যে মূলনীতি গ্রহণ করেছে, সেটা তো পরিবর্তন করা যায় না। এবার বড় যে পরিবর্তনটা আনা হয়েছে, সেটা হলো ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করা হয়েছে। সেই সময়ের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। কারণ, আমরা পাকিস্তানের ইতিহাস জানি। পাকিস্তান আমলে বিভিন্নভাবে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। সে কারণে সব ধর্মের মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিল। উদ্দেশ্য, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সে কারণে সেই সময় সংবিধানে নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম রাখা হয়নি। কারণ, ধর্ম সবার ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে থাকবে। আর ধর্মনিরপেক্ষতা কাজ করবে রাষ্ট্র পলিসির ক্ষেত্রে। কিন্তু সেই ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এতে সংবিধানের বড় বিচ্যুতি ঘটেছে এবং এটা উদ্দেশ্যমূলক বলে আমার মনে হয়। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সমাজতন্ত্র যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এটাকে এখন বাদ দেওয়া অযৌক্তিক হবে না। কারণ, তার বিপরীতে সাম্য, সমতা শব্দগুলো পরবর্তী সংশোধনে চলে এসেছে।
‘বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি’ সংবিধানের এই ধারা বিলুপ্তের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এ নিয়ে আপনার মত কী?
এটাও বিতর্ক সৃষ্টির জন্য করা হয়েছে। এটা তারা করতে পারে না। কারণ, আপিল বিভাগের একটা জাজমেন্ট আছে। আমরা জাতীয় পরিচয় কীভাবে দেব, সেটা সেখানে সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আপিল বিভাগ স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এ দেশের মানুষ বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশি পরিচয় দেবে। আর নিজ দেশের মধ্যে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেবে। এ বিষয়গুলো রায়ের মধ্যে নির্ধারিত করা হয়েছে। তাই এগুলোকে বিতর্কিত করার সুযোগ নেই।
অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার করবে, নির্বাচিত সরকার সেটা মানবে—এমন নিশ্চয়তা কি আছে?
সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমি আগেও বলেছি, বর্তমান সরকারের সংবিধান সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই। বিভিন্ন আইন নিয়ে রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে পরিবর্তন করতে পারে। কারণ, রাষ্ট্রপতিকে সরকার যা বলে, তিনি তা-ই করেন। এ জন্য তারা আইন করতে পারে। এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, তারা এসব কেন করছে? কারণ, মানুষ কিছু পরিবর্তন চায়, এসব আলোচনা চলছে। নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো না কোনো দল তো ক্ষমতায় আসবে। মানুষ কী চায়, সেটা বিবেচনা করে কমিশন যদি আলোচনাগুলো তুলে ধরত, তাহলে ভবিষ্যতে যে ক্ষমতায় আসবে, তারা সেসব করতে পারত। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করে যেসব প্রস্তাব গ্রহণ করছে, সেগুলোর তেমন কোনো মূল্য নেই। নির্বাচিত হয়ে যারা সরকার গঠন করবে, তারা যদি এসব প্রস্তাব পালনে অনাগ্রহী হয়, তাহলে অন্য কারও কিছু করার সুযোগ নেই।
এখন বড় দল হিসেবে বিএনপি আছে। নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে বলে অনেকের ধারণা। তাই বিএনপির কনসেন্ট নিয়ে সংস্কার প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করা হলে ভবিষ্যতে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এখন বিএনপি যেসব বিষয়ে দ্বিমত করছে, সেসব বিবেচনায় না নিয়ে সংস্কার করা হলে ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেসব মেনে নেবে বলে আমার মনে হয় না। তাহলে তো প্রস্তাবগুলো স্বাভাবিকভাবেই ভেস্তে যাবে।
শুধু সংবিধান সংস্কার করলেই হবে না। তার চেয়ে জরুরি রাজনৈতিক দলের সংস্কৃতির পরিবর্তন। সেটা কীভাবে সম্ভব?
এসব কথায় আমি বেশি গুরুত্ব দিতে চাই না। আপনি যখন সিঙ্গাপুরে যাবেন, তখন কলা খেয়ে খোসাটা রাস্তায় ফেলবেন না। আপনি চিপস খেলে তার প্যাকেটটা আপনার পকেটে রেখে দেবেন। এরপর কোথাও যখন ডাস্টবিন পাবেন, সেখানে সেসব ফেলে দেবেন। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ সৌদি আরবে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করেন এবং সে দেশের আইন যথারীতি মেনে চলেন। তাঁরা দেশে থাকতে কি তা মানতেন? ওই দেশে যেহেতু আইনের প্রয়োগ আছে, তাই তারা আইন মেনে চলেন। সে জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, রুল অব ল-এর প্রয়োগ।
গণতান্ত্রিত পদ্ধতি যেভাবে চলে, সেটা যদি শক্তিশালীভাবে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষও আইন মেনে চলতে বাধ্য হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, যারাই যখন ক্ষমতায় গেছে, তারা তাদের ইচ্ছেমতো এবং জোর করে তাদের সুবিধামতো আইনকে ব্যবহার করেছেন। এ জন্য মানুষের চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে।
কোনো দল যখন ক্ষমতায় থেকে আইন করে বলে ব্যবসা করতে হলে আমাদের দল করতে হবে, তখন ব্যবসায়ীরা তাদের দল করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু ব্যবসা যদি আইনকানুনের অধীনে করা
সম্ভব হতো এবং দলবাজ ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত সুবিধা না পেতেন, তাহলে বাধ্য হয়ে কেউ আর সরকারি দল করতেন না। এ জন্য সিস্টেমের উন্নতি করতে হবে। সেটা করা হলে এ দেশের মানুষ আইন মেনে চলতে বাধ্য হতো।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এই সরকার নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
বিগত সরকারের অনেক কর্মকাণ্ড জনগণ পছন্দ করত না। বিশেষ করে রুল অব ল, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-হত্যা এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করা—মোটাদাগে এসব কারণে জনগণের মধ্যে বিক্ষুব্ধতা তৈরি হয়েছিল। জনগণ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভীষণ অখুশি ছিল। সে জন্য মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল। জনগণের প্রথম দাবি আসলে পরিবর্তনের জন্য। জনগণ কিন্তু বলেনি, আমরা হাসিনা সরকারের পরিবর্তন করে সমন্বয়কদের মাধ্যমে একটা অনির্বাচিত সরকার তৈরি করে দেশ চালাব। সে সময় এসব কথা বললে সত্যি জনগণ আন্দোলনে যুক্ত হতো কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মানুষ মনে করেছে, সরকার পরিবর্তন হলে তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে। নির্বাচন হলে জনগণ যাদের চাইবে, তারাই সরকার গঠন করবে। এটাই ছিল আসল ব্যাপার।
জনগণ সেই প্রত্যাশা থেকে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় এই সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জনগণের চাওয়া হচ্ছে নির্বাচন। সংবিধানে তো বলা আছে, সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। যারা নির্বাচিত হবে, তারাই পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে গত সরকারের সময় যেভাবে লুটপাট, গুম-খুন করা হয়েছে, সেসবের মামলা করে তদন্ত করুক, এসব উদ্যোগ নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা হলো এমন এক নির্বাচনী ব্যবস্থা তৈরি করে দেওয়া, যাতে যারাই ক্ষমতায় আসবে, নির্বাচন নিয়ে তারা যেন কোনো ‘মেকানিজম’ করতে না পারে। এটা করা হলে ভবিষ্যতে গণতন্ত্র বিপদমুক্ত হবে। কেউ আর স্বৈরাচার হতে পারবে না। আর কোনো দল ক্ষমতায় থেকে যদি খারাপ কাজ করে, তাহলে তারা আর পরে ভোট পাবে না। সে জন্য তারা খারাপ কাজ করার সাহস পাবে না। যদি করে, তাহলে জনগণ তাদের ছুড়ে ফেলে দেবে।
জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই দ্রুত নির্বাচন এবং অন্তর্বর্তী সরকার যাতে বেশি দিন ক্ষমতায় না থাকে, সে বিষয়ে সোচ্চার বিএনপি। এমনকি সরকার যেসব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলোও নির্বাচিত সরকার ছাড়া বাস্তবায়ন করা যাবে না বলে দলটি মনে করে।
৩ ঘণ্টা আগেজয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলায় যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটেছে, সে ঘটনায় আর যাই হোক আক্কেলের কোনো পরিচয় দেখা যাচ্ছে না। সোজা কথায়, এটা বেআক্কেলি কর্মকাণ্ড। জয়পুরহাট ও রংপুরের নারী ফুটবল দলের মধ্যে ফুটবল খেলার আয়োজন করা হয়েছিল ২৯ জানুয়ারি।
৩ ঘণ্টা আগেজুলাই গণ-অভ্যুত্থানের গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) যে তদন্ত করেছে, ২৭ জানুয়ারি সে তদন্তের ৫৫ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এইচআরডব্লিউর একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে...
১ দিন আগেবাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে ফেব্রুয়ারি একটি অনন্য মাস। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি আমাদের জন্য যে পথ রচনা করে দিয়েছে, সেই পথই দেশকে পৌঁছে দিয়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। প্রকৃতপক্ষে এ দেশের আপামর ছাত্র-শ্রমিক-জনতা রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে সেই পথকে করেছে মসৃণ...
১ দিন আগে