মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। সেখানে চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের বিচারকেও এই ট্রাইব্যুনালের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের প্রায় ১০ মাস পর গত ১ জুন শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়।
পুরো প্রক্রিয়াটি ডিজিটাল মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা ছিল বাংলাদেশের বিচারিক কার্যক্রমের ইতিহাসে অভূতপূর্ব বিষয়। আদালতের কার্যক্রমের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচ্য একটি দিক ছিল আইসিটির চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের বক্তব্য। তাঁর বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং এর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব রয়েছে। যত কিছুই হোক এ হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার সকলেরই কাম্য। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার না হলে বাংলাদেশ যে কতটা পিছিয়ে যাবে সেটা ভাবনারও বাইরে।
জুলাই হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত ও বিচার কেমন হবে— তা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। আপাতত চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। চিফ প্রসিকিউটরের পেশাগত ও রাজনৈতিক দিক থেকে অতীতে যে সংশ্লিষ্টতা সেটি বিবেচনায় নিলে এই প্রশ্নগুলোকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি। কারণ বাংলাদেশে শোষণ, নিপীড়ন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে জুলাই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারের কোনো বিকল্প নেই।
জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ১৩টি ভলিউমে সাড়ে ৮ হাজার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে প্রসিকিউশন। শুনানি শুরুর আগে সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। তার এই সূচনা বক্তব্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে, যেগুলো এই মামলার গুরুত্ব এবং ভবিষ্যত গতিপথ বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে। তবে সবচেয়ে খটকা লেগেছে তাঁর একটি মন্তব্যে— তিনি বলেছেন, ‘এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা।’
টেলিভিশনে যখন সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল, তখন দেখা যাচ্ছিল তিনি লিখিত বক্তব্য পড়ছিলেন। তাঁর মানে তিনি যথেষ্ট প্রস্তুতি সহকারে এই বক্তব্য লিখেছেন। সেক্ষেত্রে তিনি যদি বলতেন, এই বিচার কোনো অতীতের প্রতিশোধ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা, তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠতো না। বরং রাজনৈতিক ও পেশাগত দিক থেকে তাঁর অতীতের সংশ্লিষ্টতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনে যে সন্দেহ, সেটির প্রতি একটি শক্ত বার্তা হতে পারতো। কিন্তু তিনি ‘কেবল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তার মুখ থেকে নিঃসৃত বাক্যটির সোজাসাপ্টা অর্থ হয়, এটি শুধু অতীতের প্রতিশোধ নয়।
একজন আইনজীবী হিসেবে মামলার শুনানির সূচনা বক্তব্যে এ ধরনের মন্তব্য অনেকগুলো প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক, কারণ এরই মধ্যে অন্য একটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্বের অভিযোগ উঠেছে। এ প্রশ্ন আইনজীবী থেকে শুরু করে মামলার পর্যবেক্ষকরাও তুলেছেন। প্রশ্নটি উঠেছে জামায়াতে ইসলামী নেতা এটি এম আজহারুল ইসলামকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃতুদণ্ড থেকে খালাস দেয়ার মামলায়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধের মামলায় যারা দণ্ডিত হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ থাকলেও তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার যথাযথ না থাকার কারণে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ঠিক একইভাবে ৫ আগস্টের পর মানতাবিরোধী অপরাধের বিচার যেভাবে হচ্ছে, সেটাও যথাযথ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যরিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া অভিযোগ করেছেন, প্রসিকিউটর নিয়োগে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, অতীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুালে বিচারাধীন জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন তাজুল ইসলাম, আজহারুল ইসলামের পক্ষেও আইনি সহায়তা দিয়েছিলেন তিনি। আজহারুলের মামলায় তিনি সরাসরি আপিল বিভাগের শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন না, তবু তার নেতৃত্বাধীন প্রসিকিউশন টিমের সদস্যরা ট্রাইব্যুনালের পক্ষে আপিল বিভাগে লড়েছেন। এই ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত হয়েছে বলে মনে করেন বার্গম্যান ও জ্যোর্তিময় বড়ুয়া।
জনাব আজহারুলকে খালাস দেয়ার অনেক আগেই ২০২৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই প্রশ্নটি তোলা হয়েছিল। সেই নিবন্ধে আইনজীবী শাহদীন মালিকসহ অনেকে প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর বাদী হিসেবে থাকেন চিফ প্রসিকিউটর। এ কারণে আজহারুলের রিভিউ শুনানিতে তাজুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ না করলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিনি এখন এই মামলার বাদী। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে মামলাগুলোতে তিনি বিবাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন, চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি হয়ে গেছেন বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী। অবশ্য চিফ প্রসিকিউটরের অফিস থেকে এ সংক্রান্ত একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই ধরনের অপরাধে বা একই দলের বা গোষ্ঠীর কোনো ব্যক্তির পক্ষে ডিফেন্স করেছেন বলে একজন আইনজীবী সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো ব্যক্তির প্রসিকিউশন করতে পারবেন না, এমন কোনো আইনগত বাধানিষেধ পৃথিবীর কোথাও নেই।
যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক দর্শন আছে। সেটি হলো, বিচারিক প্রক্রিয়ায় সব ধরনের নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা যথাযথভাবে রক্ষা করা। কারণ ফৌজদারি মামলার বিচারের ক্ষেত্রে দেখা হয়, কোনো নিরাপরাধ মানুষ কিংবা কেউ যেন ক্ষোভ, রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে শাস্তি না পান। অর্থাৎ আগে থেকে যেন এমন সন্দেহের উদ্রেক না হয় যাতে বিচারের ফলাফল অনুমান করা যায়। এটাকে বলা হয় অনিশ্চয়তা। এ অনিশ্চয়তা না থাকলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হবেন, নাকি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন, মানে তাদেরকে জোর করে দণ্ড দেয়া হবে কী হবে না এমন অনিশ্চয়তা না থাকলে বিষয়টি হয়ে পড়বে ‘বিচার মানি তালগাছ আমার’ প্রবাদের মতো। যেমন, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে বিরোধী মতগুলোকে দমনের জন্য বহু মামলা করা হয়েছিল। খোদ এখনকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা করা হয়েছিল, যেগুলোর মেরিট বা ভিত্তি নেই বললেই চলে। আবার ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল— এটি সত্যি। কিন্তু যেভাবে নিতান্তই গায়ের জোরে অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া বিগত সরকারের আমলে ছিল, সেটি থেকে এমন ধারণা হয়েছিল— বিচার প্রক্রিয়া যাই হোক শাস্তি অবধারিত। বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়া হবে— এমন সন্দেহ থাকলে সেখানে ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে এমনটাই স্বাভাবিক।
আইসিটিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা মামলাটি ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম আসামি শেখ হাসিনা গং’ মামলা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। অতীতের যুদ্ধাপরাধ মামলাগুলোর বিচার যেহেতু প্রশ্নবিদ্ধ, তাই অতীতের আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
এমন পরিস্থিতে চিফ প্রসিকিউটর যখন আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা’, তখন সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দেয়। এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। এখনও আইসিটিতে বিগত সরকারের আমলে দায়ের করা যুদ্ধাপরাধের অনেকগুলো মামলা চলমান আছে। বলা ভালো, সেগুলো এখন হিমাগারে চলে গেছে। খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন তোলা কি খুব অমূলক হবে যে, যারা আগে বিবাদী পক্ষের আইনজীবী ছিলেন তারা এখন রাষ্ট্র বা বাদীপক্ষের আইনজীবী হওয়ায় পাশার দান পুরো উল্টে গেছে? এটা তো সত্যি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। আগের আমলে বিচার প্রক্রিয়া যদি নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে বর্তমান সরকারের উচিত বিদ্যমান মামলাগুলোর বিচার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।
কিন্তু বর্তমানে আইসিটির প্রসিকিউশন টিমের যে রেকর্ড তাতে আব্দুল আলীমের সেই বিখ্যাত লাইনগুলো মনে পড়ে যেতে পারে, ‘তুমি হাকিম হইয়া হুকুম কর পুলিশ হইয়া ধর, সর্প হইয়া দংশন কর ওঝা হইয়া ঝাড়।’ চিফ প্রসিকিউটর আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমরা প্রমাণ করতে চাই, একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে, সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে, সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না।’ কিন্তু তাঁর অতীত ট্র্যাক রেকর্ড আর ‘কেবল’ জুড়ে দেয়া বাক্যটি এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সন্দেহটি আরো বাড়ে যখন শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটরের দেয়া বক্তব্য আমরা শুনি। শুনানিতে শেখ হাসিনাকে একজন ‘নিষ্ঠুর শাসক’ উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘ফ্যাসিস্ট শাসক হিসেবে তিনি (শেখ হাসিনা) এককভাবে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তার উদ্দেশ্য ছিল যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা। শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধের নিউক্লিয়াস। হাসিনা টিকে থাকলে তাঁরাও (আওয়ামী লীগের নেতা ও সে সময়ের মন্ত্রী) টিকে থাকবেন এ মানসিকতা ছিল তাদের। সে হিসেবে শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধের প্রাণভ্রোমরা। তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আর আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তা বাস্তবায়ন করেছেন।’
এছাড়া রাষ্ট্রীয় স্থাপনাগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের লোকেরাই হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টার অভিযোগ করেন চিফ প্রসিকিউটর। এত স্পর্শকাতর একটি মামলায় এমন ঢালাওভাবে অভিযোগ আনার অর্থ হলো প্রসিকিউশন মামলাটির তদন্ত ও উপস্থাপন গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে না।
মেট্রো রেলে আগুন দেয়া প্রসঙ্গে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয়া এক সমন্বয়কের মন্তব্য গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে বেশ হই চই ফেলে দিয়েছিল। ‘যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না’— বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসির ‘প্রযত্নে বাংলাদেশ’ টকশোতে অংশ নিয়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম।
এমন বক্তব্যের জন্য সংগঠন থেকে তাকে শোকজও করা হয়েছিল। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমরা এটাকে বিপ্লব বলছি বা গণঅভ্যুত্থান, যাই বলি না কেন, এটা কোনো সাংবিধানিক নিয়ম মেনে হয়নি, আইন মেনে হয়নি। আইন যদি মানতে যেতাম, তাহলে কিন্তু এই বিপ্লবগুলো হতো না। যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না। এখানে কিন্তু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, পৃথিবীর সকল বিপ্লবই সংবিধান বা নিয়মের বাইরে যেয়ে হয়েছে। এ কারণে আইনের বাইরে যেয়ে বা সাংবাধানিক পদ শূন্য হবে এরকম কথা বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে কতটা যৌক্তিক সেটা আমার কাছে মনে হচ্ছে না।’
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, প্রসিকিউশন চিফ আর সমন্বয়কের বক্তব্য পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। দুজনই কিন্তু জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য লড়ছেন। একজন আদালতে, আরেকজন রাজপথে। এমন সাংঘর্ষিক বক্তব্য অবশ্যই এই বিচার প্রক্রিয়ার দিকে আঙ্গুল তুলবে। সেখানে যতই নিরপেক্ষতার দাবি করা হোক না কেন প্রসিকিউশন টিমের অতীত টেনে এনে তাঁদের ‘প্রতিশোধপরায়ণতা সম্পর্কে ধারণাকে’ অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। যদি আগুন দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগের সমর্থনে পর্যাপ্ত ও অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করা না যায়, অথবা যদি প্রমাণগুলো পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
যদি বিচার প্রক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বলে মনে হয়, অর্থাৎ যদি মনে হয় যে ক্ষমতার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এই অভিযোগ আনা হয়েছে এবং বিচারিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠবে। এক্ষেত্রে, ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। অভিযোগপত্রে জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ‘সমন্বিত নির্মূল পরিকল্পনা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা ‘ব্যাপক’ ও ‘পদ্ধতিগত’ ছিল। কিন্তু প্রসিকিউশন ও আন্দোলনকারীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে ‘সিস্টেমেটিক’ অপরাধ প্রমাণ করা যাবে না।
অভিযোগের শুনানিতে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, এই বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয় বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন’, ‘রোম স্ট্যাটিউট অব দি আইসিসি’ এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য। আন্তর্জাতিক মানের বিচারের জন্য তদন্ত, প্রসিকিউশন, বিচার— সবকিছু আন্তর্জাতিক মানের হওয়া উচিত। ডেভিড বার্গম্যানের একটি নিবন্ধ দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল গত বছরের ২৪ অক্টোবর। সেখানে তিনি আইসিটিতে নিয়োগকৃত বিচারকদের সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, যেগুলো বেশ যৌক্তিক যদি আমরা জুলাই হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক মানের বিচার চাই। বার্গম্যান বলছেন, এই আদালতের বিচারকদের কারোরই কর্মজীবনে কোনো মামলায় আন্তর্জাতিক আইনের নীতি প্রয়োগ করার কোনো অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয় না। আলোচ্য বিচারের সঙ্গে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং তাকে ঘিরে থাকা জটিল আইন জড়িত। তাই এই অভিজ্ঞতা বিচারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা বলে মনে হয়।
আবার এই আদালতের বেশিরভাগ বিচারক বেশ কয়েক বছরে কোনো ধরনের ফৌজদারি মামলার বিচারক ছিলেন না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হলেও, এর কার্যপদ্ধতি এবং বিচারিক মান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি প্রক্রিয়াগত ত্রুটি থাকে বা অভিযুক্তের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
শুরু থেকেই অনেকে বলছিলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হওয়াই ভাল। এমনকি জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও তা বলা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করলে যদিও তার রায় পেতে সময় বেশি লাগতো, কিন্তু প্রক্রিয়াটি স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যেতো, যেটি বিচারের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বাড়িয়ে তুলতো। এমনকি আইসিসি যদি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতো, তাহলে সেটির রাজনৈতিক প্রভাব অনেক ব্যাপক হতো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদল ঘটে, তাহলে রায়ের কোনো পরিবর্তন করা যেতো না।
‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না’— এই নীতিবাক্যটি গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। তবে, এই নীতিকে বাস্তবায়িত করতে হলে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। জুলাই আন্দোলনের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই অস্থিতিশীল। এই অবস্থায় একটি উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের নিঃসন্দেহে একটি সংবেদনশীল বিষয়।
এই ট্রাইব্যুনালের আগে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত হলেও এর এখতিয়ার ও কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক দেখা গেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ধরন এবং তার আইনি প্রক্রিয়া এই ট্রাইব্যুনালের ভবিষ্যতের কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপরও প্রভাব ফেলবে। আদালতের বিচার কাজ সরাসরি সম্প্রচার করে, রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে হয়তো এক পক্ষের বাহবা পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু সেটি কোনোভাবেই বিচারের মানদণ্ড নিশ্চিত করতে পারে না। যদি ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে না পারে তাহলে আইনের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। দেশটির জাতীয় ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপর ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। [সিন্ডিকেটেড কনটেন্ট হিসেবে ডয়চে ভেলে থেকে প্রকাশিত]
লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। সেখানে চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের বিচারকেও এই ট্রাইব্যুনালের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের প্রায় ১০ মাস পর গত ১ জুন শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়।
পুরো প্রক্রিয়াটি ডিজিটাল মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা ছিল বাংলাদেশের বিচারিক কার্যক্রমের ইতিহাসে অভূতপূর্ব বিষয়। আদালতের কার্যক্রমের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচ্য একটি দিক ছিল আইসিটির চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের বক্তব্য। তাঁর বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং এর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব রয়েছে। যত কিছুই হোক এ হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার সকলেরই কাম্য। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার না হলে বাংলাদেশ যে কতটা পিছিয়ে যাবে সেটা ভাবনারও বাইরে।
জুলাই হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত ও বিচার কেমন হবে— তা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। আপাতত চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। চিফ প্রসিকিউটরের পেশাগত ও রাজনৈতিক দিক থেকে অতীতে যে সংশ্লিষ্টতা সেটি বিবেচনায় নিলে এই প্রশ্নগুলোকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি। কারণ বাংলাদেশে শোষণ, নিপীড়ন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে জুলাই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারের কোনো বিকল্প নেই।
জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ১৩টি ভলিউমে সাড়ে ৮ হাজার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে প্রসিকিউশন। শুনানি শুরুর আগে সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। তার এই সূচনা বক্তব্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে, যেগুলো এই মামলার গুরুত্ব এবং ভবিষ্যত গতিপথ বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে। তবে সবচেয়ে খটকা লেগেছে তাঁর একটি মন্তব্যে— তিনি বলেছেন, ‘এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা।’
টেলিভিশনে যখন সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল, তখন দেখা যাচ্ছিল তিনি লিখিত বক্তব্য পড়ছিলেন। তাঁর মানে তিনি যথেষ্ট প্রস্তুতি সহকারে এই বক্তব্য লিখেছেন। সেক্ষেত্রে তিনি যদি বলতেন, এই বিচার কোনো অতীতের প্রতিশোধ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা, তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠতো না। বরং রাজনৈতিক ও পেশাগত দিক থেকে তাঁর অতীতের সংশ্লিষ্টতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনে যে সন্দেহ, সেটির প্রতি একটি শক্ত বার্তা হতে পারতো। কিন্তু তিনি ‘কেবল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তার মুখ থেকে নিঃসৃত বাক্যটির সোজাসাপ্টা অর্থ হয়, এটি শুধু অতীতের প্রতিশোধ নয়।
একজন আইনজীবী হিসেবে মামলার শুনানির সূচনা বক্তব্যে এ ধরনের মন্তব্য অনেকগুলো প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক, কারণ এরই মধ্যে অন্য একটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্বের অভিযোগ উঠেছে। এ প্রশ্ন আইনজীবী থেকে শুরু করে মামলার পর্যবেক্ষকরাও তুলেছেন। প্রশ্নটি উঠেছে জামায়াতে ইসলামী নেতা এটি এম আজহারুল ইসলামকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃতুদণ্ড থেকে খালাস দেয়ার মামলায়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধের মামলায় যারা দণ্ডিত হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ থাকলেও তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার যথাযথ না থাকার কারণে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ঠিক একইভাবে ৫ আগস্টের পর মানতাবিরোধী অপরাধের বিচার যেভাবে হচ্ছে, সেটাও যথাযথ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যরিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া অভিযোগ করেছেন, প্রসিকিউটর নিয়োগে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, অতীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুালে বিচারাধীন জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন তাজুল ইসলাম, আজহারুল ইসলামের পক্ষেও আইনি সহায়তা দিয়েছিলেন তিনি। আজহারুলের মামলায় তিনি সরাসরি আপিল বিভাগের শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন না, তবু তার নেতৃত্বাধীন প্রসিকিউশন টিমের সদস্যরা ট্রাইব্যুনালের পক্ষে আপিল বিভাগে লড়েছেন। এই ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত হয়েছে বলে মনে করেন বার্গম্যান ও জ্যোর্তিময় বড়ুয়া।
জনাব আজহারুলকে খালাস দেয়ার অনেক আগেই ২০২৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই প্রশ্নটি তোলা হয়েছিল। সেই নিবন্ধে আইনজীবী শাহদীন মালিকসহ অনেকে প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর বাদী হিসেবে থাকেন চিফ প্রসিকিউটর। এ কারণে আজহারুলের রিভিউ শুনানিতে তাজুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ না করলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিনি এখন এই মামলার বাদী। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে মামলাগুলোতে তিনি বিবাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন, চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি হয়ে গেছেন বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী। অবশ্য চিফ প্রসিকিউটরের অফিস থেকে এ সংক্রান্ত একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই ধরনের অপরাধে বা একই দলের বা গোষ্ঠীর কোনো ব্যক্তির পক্ষে ডিফেন্স করেছেন বলে একজন আইনজীবী সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো ব্যক্তির প্রসিকিউশন করতে পারবেন না, এমন কোনো আইনগত বাধানিষেধ পৃথিবীর কোথাও নেই।
যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক দর্শন আছে। সেটি হলো, বিচারিক প্রক্রিয়ায় সব ধরনের নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা যথাযথভাবে রক্ষা করা। কারণ ফৌজদারি মামলার বিচারের ক্ষেত্রে দেখা হয়, কোনো নিরাপরাধ মানুষ কিংবা কেউ যেন ক্ষোভ, রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে শাস্তি না পান। অর্থাৎ আগে থেকে যেন এমন সন্দেহের উদ্রেক না হয় যাতে বিচারের ফলাফল অনুমান করা যায়। এটাকে বলা হয় অনিশ্চয়তা। এ অনিশ্চয়তা না থাকলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হবেন, নাকি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন, মানে তাদেরকে জোর করে দণ্ড দেয়া হবে কী হবে না এমন অনিশ্চয়তা না থাকলে বিষয়টি হয়ে পড়বে ‘বিচার মানি তালগাছ আমার’ প্রবাদের মতো। যেমন, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে বিরোধী মতগুলোকে দমনের জন্য বহু মামলা করা হয়েছিল। খোদ এখনকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা করা হয়েছিল, যেগুলোর মেরিট বা ভিত্তি নেই বললেই চলে। আবার ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল— এটি সত্যি। কিন্তু যেভাবে নিতান্তই গায়ের জোরে অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া বিগত সরকারের আমলে ছিল, সেটি থেকে এমন ধারণা হয়েছিল— বিচার প্রক্রিয়া যাই হোক শাস্তি অবধারিত। বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়া হবে— এমন সন্দেহ থাকলে সেখানে ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে এমনটাই স্বাভাবিক।
আইসিটিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা মামলাটি ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম আসামি শেখ হাসিনা গং’ মামলা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। অতীতের যুদ্ধাপরাধ মামলাগুলোর বিচার যেহেতু প্রশ্নবিদ্ধ, তাই অতীতের আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
এমন পরিস্থিতে চিফ প্রসিকিউটর যখন আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা’, তখন সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দেয়। এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। এখনও আইসিটিতে বিগত সরকারের আমলে দায়ের করা যুদ্ধাপরাধের অনেকগুলো মামলা চলমান আছে। বলা ভালো, সেগুলো এখন হিমাগারে চলে গেছে। খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন তোলা কি খুব অমূলক হবে যে, যারা আগে বিবাদী পক্ষের আইনজীবী ছিলেন তারা এখন রাষ্ট্র বা বাদীপক্ষের আইনজীবী হওয়ায় পাশার দান পুরো উল্টে গেছে? এটা তো সত্যি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। আগের আমলে বিচার প্রক্রিয়া যদি নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে বর্তমান সরকারের উচিত বিদ্যমান মামলাগুলোর বিচার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।
কিন্তু বর্তমানে আইসিটির প্রসিকিউশন টিমের যে রেকর্ড তাতে আব্দুল আলীমের সেই বিখ্যাত লাইনগুলো মনে পড়ে যেতে পারে, ‘তুমি হাকিম হইয়া হুকুম কর পুলিশ হইয়া ধর, সর্প হইয়া দংশন কর ওঝা হইয়া ঝাড়।’ চিফ প্রসিকিউটর আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমরা প্রমাণ করতে চাই, একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে, সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে, সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না।’ কিন্তু তাঁর অতীত ট্র্যাক রেকর্ড আর ‘কেবল’ জুড়ে দেয়া বাক্যটি এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সন্দেহটি আরো বাড়ে যখন শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটরের দেয়া বক্তব্য আমরা শুনি। শুনানিতে শেখ হাসিনাকে একজন ‘নিষ্ঠুর শাসক’ উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘ফ্যাসিস্ট শাসক হিসেবে তিনি (শেখ হাসিনা) এককভাবে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তার উদ্দেশ্য ছিল যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা। শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধের নিউক্লিয়াস। হাসিনা টিকে থাকলে তাঁরাও (আওয়ামী লীগের নেতা ও সে সময়ের মন্ত্রী) টিকে থাকবেন এ মানসিকতা ছিল তাদের। সে হিসেবে শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধের প্রাণভ্রোমরা। তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আর আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তা বাস্তবায়ন করেছেন।’
এছাড়া রাষ্ট্রীয় স্থাপনাগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের লোকেরাই হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টার অভিযোগ করেন চিফ প্রসিকিউটর। এত স্পর্শকাতর একটি মামলায় এমন ঢালাওভাবে অভিযোগ আনার অর্থ হলো প্রসিকিউশন মামলাটির তদন্ত ও উপস্থাপন গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে না।
মেট্রো রেলে আগুন দেয়া প্রসঙ্গে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয়া এক সমন্বয়কের মন্তব্য গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে বেশ হই চই ফেলে দিয়েছিল। ‘যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না’— বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসির ‘প্রযত্নে বাংলাদেশ’ টকশোতে অংশ নিয়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম।
এমন বক্তব্যের জন্য সংগঠন থেকে তাকে শোকজও করা হয়েছিল। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমরা এটাকে বিপ্লব বলছি বা গণঅভ্যুত্থান, যাই বলি না কেন, এটা কোনো সাংবিধানিক নিয়ম মেনে হয়নি, আইন মেনে হয়নি। আইন যদি মানতে যেতাম, তাহলে কিন্তু এই বিপ্লবগুলো হতো না। যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না। এখানে কিন্তু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, পৃথিবীর সকল বিপ্লবই সংবিধান বা নিয়মের বাইরে যেয়ে হয়েছে। এ কারণে আইনের বাইরে যেয়ে বা সাংবাধানিক পদ শূন্য হবে এরকম কথা বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে কতটা যৌক্তিক সেটা আমার কাছে মনে হচ্ছে না।’
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, প্রসিকিউশন চিফ আর সমন্বয়কের বক্তব্য পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। দুজনই কিন্তু জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য লড়ছেন। একজন আদালতে, আরেকজন রাজপথে। এমন সাংঘর্ষিক বক্তব্য অবশ্যই এই বিচার প্রক্রিয়ার দিকে আঙ্গুল তুলবে। সেখানে যতই নিরপেক্ষতার দাবি করা হোক না কেন প্রসিকিউশন টিমের অতীত টেনে এনে তাঁদের ‘প্রতিশোধপরায়ণতা সম্পর্কে ধারণাকে’ অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। যদি আগুন দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগের সমর্থনে পর্যাপ্ত ও অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করা না যায়, অথবা যদি প্রমাণগুলো পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
যদি বিচার প্রক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বলে মনে হয়, অর্থাৎ যদি মনে হয় যে ক্ষমতার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এই অভিযোগ আনা হয়েছে এবং বিচারিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠবে। এক্ষেত্রে, ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। অভিযোগপত্রে জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ‘সমন্বিত নির্মূল পরিকল্পনা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা ‘ব্যাপক’ ও ‘পদ্ধতিগত’ ছিল। কিন্তু প্রসিকিউশন ও আন্দোলনকারীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে ‘সিস্টেমেটিক’ অপরাধ প্রমাণ করা যাবে না।
অভিযোগের শুনানিতে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, এই বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয় বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন’, ‘রোম স্ট্যাটিউট অব দি আইসিসি’ এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য। আন্তর্জাতিক মানের বিচারের জন্য তদন্ত, প্রসিকিউশন, বিচার— সবকিছু আন্তর্জাতিক মানের হওয়া উচিত। ডেভিড বার্গম্যানের একটি নিবন্ধ দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল গত বছরের ২৪ অক্টোবর। সেখানে তিনি আইসিটিতে নিয়োগকৃত বিচারকদের সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, যেগুলো বেশ যৌক্তিক যদি আমরা জুলাই হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক মানের বিচার চাই। বার্গম্যান বলছেন, এই আদালতের বিচারকদের কারোরই কর্মজীবনে কোনো মামলায় আন্তর্জাতিক আইনের নীতি প্রয়োগ করার কোনো অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয় না। আলোচ্য বিচারের সঙ্গে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং তাকে ঘিরে থাকা জটিল আইন জড়িত। তাই এই অভিজ্ঞতা বিচারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা বলে মনে হয়।
আবার এই আদালতের বেশিরভাগ বিচারক বেশ কয়েক বছরে কোনো ধরনের ফৌজদারি মামলার বিচারক ছিলেন না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হলেও, এর কার্যপদ্ধতি এবং বিচারিক মান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি প্রক্রিয়াগত ত্রুটি থাকে বা অভিযুক্তের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
শুরু থেকেই অনেকে বলছিলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হওয়াই ভাল। এমনকি জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও তা বলা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করলে যদিও তার রায় পেতে সময় বেশি লাগতো, কিন্তু প্রক্রিয়াটি স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যেতো, যেটি বিচারের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বাড়িয়ে তুলতো। এমনকি আইসিসি যদি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতো, তাহলে সেটির রাজনৈতিক প্রভাব অনেক ব্যাপক হতো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদল ঘটে, তাহলে রায়ের কোনো পরিবর্তন করা যেতো না।
‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না’— এই নীতিবাক্যটি গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। তবে, এই নীতিকে বাস্তবায়িত করতে হলে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। জুলাই আন্দোলনের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই অস্থিতিশীল। এই অবস্থায় একটি উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের নিঃসন্দেহে একটি সংবেদনশীল বিষয়।
এই ট্রাইব্যুনালের আগে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত হলেও এর এখতিয়ার ও কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক দেখা গেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ধরন এবং তার আইনি প্রক্রিয়া এই ট্রাইব্যুনালের ভবিষ্যতের কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপরও প্রভাব ফেলবে। আদালতের বিচার কাজ সরাসরি সম্প্রচার করে, রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে হয়তো এক পক্ষের বাহবা পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু সেটি কোনোভাবেই বিচারের মানদণ্ড নিশ্চিত করতে পারে না। যদি ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে না পারে তাহলে আইনের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। দেশটির জাতীয় ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপর ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। [সিন্ডিকেটেড কনটেন্ট হিসেবে ডয়চে ভেলে থেকে প্রকাশিত]
লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৬ জুন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আগামী জুলাই মাসেই সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে আমরা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারব বলে আশা করছি।’
২৭ মিনিট আগেদীর্ঘ ছুটির অবসান হতে চলেছে। দেশে বেশির ভাগ অফিস-আদালত (সরকারি বা বেসরকারি) এখনো খোলেনি, কিন্তু জীবনের প্রবাহ কোথাও বন্ধ হয়নি। বাইরে থেকে তালাবদ্ধ রাখা হলেও ভেতরে সবই চলছে। সরকারের প্রধান ব্যক্তির বিদেশ সফর বন্ধ হয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের কর্মকাণ্ড এত দিনে নতুন নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে।
৭ ঘণ্টা আগেএকজন শিক্ষকের জন্ম হয় কীভাবে? শুধু একটি নিয়োগপত্র কিংবা একটি প্রশিক্ষণ সনদ পেলেই কি তিনি শিক্ষক হয়ে ওঠেন? নাকি তার আগে-পরে থাকে একটি দীর্ঘ পথচলা, আত্মমর্যাদাবোধ ও দায়বদ্ধতার ধ্যান?
৭ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় একটি অতিপরিচিত শব্দ হলো ষড়যন্ত্র। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই এর শিকার হয়েছি। কখনো কখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্তও হয়েছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ষড়যন্ত্র কি আদৌ কোনো যন্ত্র? এ যন্ত্র কীভাবে কাজ করে? আমরা প্রায় সবাই জানি ষড়্ঋতু মানে ছয় ঋতু। কেননা, বলা হয়ে থাকে, ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ।
৭ ঘণ্টা আগে