Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

এই দুর্ঘটনার জন্য ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা যেতে পারে

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী। ছবি: আজকের পত্রিকা

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর। বর্তমানে তিনি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন। সম্প্রতি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানার সঙ্গে।

আপডেট : ২৫ জুলাই ২০২৫, ০৭: ৪০

আজকের পত্রিকা: আপনি বিমানবাহিনীর একজন অভিজ্ঞ সাবেক কর্মকর্তা হিসেবে বলবেন, প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো কী হতে পারে?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: প্রথমত, দুর্ঘটনাটা হয়েছে এফ-৭ ফাইটার বিমানের প্রশিক্ষণ ভার্সন (এফটি-৭) থেকে। আসলে এটা প্রশিক্ষণ বিমান ছিল না। যেহেতু এফ-৭ বিমানটি একজন পাইলট চালিয়ে থাকেন, তাই প্রথমবার একা ওড়াবার আগে পাইলটকে কিছু গ্রাউন্ড ট্রেনিং করতে হয়, বিমানের বিভিন্ন সিস্টেম সম্পর্কে জানতে হয়। তারপর প্রথমে দুই সিটওয়ালা এফটি-৭ চালাতে দেওয়া হয়। সামনের সিটে প্রশিক্ষণার্থী এবং পেছনের সিটে প্রশিক্ষক থাকেন। প্রশিক্ষক কয়েকটি মিশনের পর যখন মনে করবেন যে প্রশিক্ষণার্থী একাই বিমানটি চালাতে সক্ষম, তখন প্রশিক্ষক বিমান থেকে নেমে যান এবং প্রশিক্ষণার্থী পাইলটকে একাই বিমান চালাতে অনুমতি দিয়ে থাকেন। এটাকে ‘সলো ফ্লাইং’ বলা হয়, যা ২১ জুলাইয়ে হয়েছিল। পাইলটের উড্ডয়ন করার কিছুক্ষণ পরেই ল্যান্ড করার কথা ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত উড্ডয়নের কয়েক মিনিটের মধ্যে বিমানটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়। আমাদের বেসিক ফ্লাইং ট্রেনিং হয় যশোরে। কিছু অ্যাডভান্স ট্রেনিং চট্টগ্রামেও হয়। ঢাকায় যেসব ফাইটার বিমান আছে, তা হলো অপারেশনের জন্য। এখানে মিগ-২৯ এবং এফ-৭ আছে। এফ-৭ বিমানটি ১৯৮০ সালের দিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যুক্ত হয় এবং সেই থেকে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে বিমানবাহিনীতে এটা ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিমধ্যে মূল এফ-৭ বিমানটি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আরও উন্নত ও সমরসক্ষম করা হয়েছে।

তবে এখন চীন সেটা আর তৈরি করছে না। আমরাও এটা আর ক্রয় করছি না। একটা এয়ারক্রাফট কেনার পর সেটা ২৫-৩০ বছর ব্যবহারোপযোগী থাকে। এর মধ্যে ইঞ্জিনসহ অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি পরিবর্তন করতে হয়। তারপর এমন এক পর্যায়ে আসে, যখন সেটা আর উড্ডয়নের উপযোগী থাকে না। আমাদের যে কয়েকটা এফ-৭ বিমান আছে, তার সবগুলো এখনো আকাশে ওড়ার উপযোগী। প্রতিটি এয়ারক্রাফট দেখভালের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ান আগে চেক করেন এবং তিনি সার্টিফাই করার পর সেটা উড্ডয়নের জন্য পাইলটের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে এত কিছুর পরেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, যেটা এবার মাইলস্টোনের ঘটনায় ঘটেছে।

আজকের পত্রিকা: তাহলে কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটল?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: উড়তে গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সামরিক ও বেসামরিক উভয় ধরনের বিমানই দুর্ঘটনায় পতিত হতে পারে, তবে সামরিক বিমানের দুর্ঘটনার হার স্বাভাবিকভাবেই বেশি। এর মধ্যে জঙ্গিবিমানের দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেক বেশি। জঙ্গিবিমান এমন অনেক ঝুঁকিপূর্ণ বিমান মহড়া করে থাকে, যা অন্য কোনো বিমান করে না। যতই দিন যাচ্ছে এয়ারক্রাফট ততই উন্নত হচ্ছে। দুর্ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অত্যাধুনিক বিমানও তো দুর্ঘটনার মধ্যে পড়তে পারে এবং সেটা হচ্ছেও। সুতরাং দুর্ঘটনা হবে না—এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারে না।

আজকের পত্রিকা: তাহলে এই দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ঘাটতি কী ছিল?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে যত ধরনের বিমান দুর্ঘটনা ঘটে, তার অধিকাংশই ল্যান্ডিংয়ের অব্যবহিত আগে নতুবা টেকঅফের অব্যবহিত পরে ঘটে থাকে। এ ক্ষেত্রেও টেকঅফের দু-তিন মিনিট পরে সমস্যা দেখার পরে পাইলট ফেরত আসার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ফেরত আসতে পারেননি। তিনি ইচ্ছে করলে উড্ডয়নকালে বিমান থেকে ইজেক্ট করে বেরিয়ে আসতে পারতেন, তাহলেও বিমানটি কোথাও না কোথাও গিয়ে পড়তই। আমাদের বড় সমস্যা হলো, বিমানবন্দরের চারদিকে বাড়িঘরের এত বিস্তৃতি ঘটেছে যে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। গতকালই আমি দেখলাম, ২০০৫ সালের উত্তরা এবং ২০২৫ সালের উত্তরায় আকাশ-পাতাল তফাত। বিশেষ করে উত্তরার বসতবাড়ি তৈরি করা শুরু হয়েছে রানওয়ের পর থেকেই। তারপর সেটা বিস্তৃত হয়েছে পশ্চিম দিকে। হতে হতে এখন সেটা মিরপুরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আগে তো উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় একটা বড় জলাভূমি ছিল। শুধু জলাভূমি না, সেটা গভীরও ছিল। ২৫ বছর আগে সেখানে একটা বিমান দুর্ঘটনা হয়েছিল এবং সেটা একটা পুকুরের মধ্যে পড়েছিল, আর সব যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। আজকে দিয়াবাড়িতে যেসব উঁচু ভবন দেখা যাচ্ছে, সেগুলো একসময় গভীর জলাশয় ছিল। জলাভূমিকে আমরা এখন শহর করে ফেলেছি।

আজকের পত্রিকা: এর জন্য দায়ী কে?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: দায়ী আমরা সবাই। তেজগাঁও ও কুর্মিটোলার বিমানবন্দর দুটি ১৯৪৫ সালে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান যখন হলো, তখন তেজগাঁওয়ে বিমানবন্দর করা হলো বেশ বড় আকারে। এরপর ১৯৬৪ সালে নগরায়ণ ও জনসংখ্যা বাড়ার কারণে তেজগাঁওয়ের বদলে কুর্মিটোলার বিমানবন্দর বড় পরিসরে চালু করার পরিকল্পনা করা হয়। শেষ পর্যন্ত সেটা চালু করা হলো ১৯৮০ সালে। তখনো কিন্তু উত্তরা মূলত খালি ছিল। তাই বলছি, ২১ তারিখ যে দুর্ঘটনা ঘটল, সেটা তো ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে হওয়ার আশঙ্কা আছে। মনে করুন, বড় একটা বেসামরিক বিমান যদি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এবং সেটা কোনো উঁচু ভবনের ওপর গিয়ে পড়ে! তখন তো আরও ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াবে, কিছুদিন আগে যেটা ভারতের আহমেদাবাদে ঘটল।

আজকের পত্রিকা: বিমানবন্দরের আশপাশে বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরেও কেন সেটা রোধ করা যাচ্ছে না? সরকার কেন সেটা করতে দিচ্ছে?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: অনুমতি নেওয়ার পরে অনেকে নকশার বাইরে নির্মাণকাজ করছে। যত তলার অনুমতি আছে তার থেকে বেশি কেউ কেউ করছে, কিন্তু এগুলোর নজরদারি অনেক কম অথবা দুর্বল। মাইলস্টোন স্কুলটি কিন্তু রানওয়ের কাছে এবং বিমানের ‘গ্লাইড প্যাথ’-এর ওপরে অবস্থিত। এখানে তো মিনিটে মিনিটে বিমান ওঠানামা করছে। এতে তো স্কুলের বাচ্চাদেরও সমস্যা হচ্ছে। এতে বাচ্চাদের শ্রবণেও সমস্যা হতে পারে। এখানে কেন স্কুলটা নির্মাণ করা হলো? স্কুল কর্তৃপক্ষ কি অনুমতি নিয়েছে? স্কুলের কাগজপত্র ঠিক আছে কি না? সেটা ঠিক না থাকলে, তাদেরও দায় আছে। এই এলাকায় ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ নির্মাণকাজও চলছে।

আজকের পত্রিকা: এই ঘটনায় অনেক শিশুর মৃত্যু এবং অনেক আহত হয়েছে। এদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে কী ব্যবস্থা করা যেতে পারে?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: এই দুর্ঘটনার জন্য একটা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা যেতে পারে, যে ফান্ড পরিচালনা করতে পারে সমাজকল্যাণ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই বাচ্চাগুলোর দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা করাতে হবে। একই সঙ্গে কেউ যদি পঙ্গুত্ববরণ করে, তার চাকরি থেকে সবকিছুর দায়িত্ব নেবে এই ফান্ড। শিক্ষা ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেই অর্থের ব্যবস্থা করবে। এভাবে ৫০-৬০ কোটি টাকার একটা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা যেতে পারে। যারা নিহত হয়েছে, তাদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।

আজকের পত্রিকা: এ ঘটনায় কি বিমানবাহিনীর কোনো দায় নেই?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: দায়ভার তো তদন্তের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। অনেক সময় রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনের ক্ষেত্রে সামান্য ত্রুটির কারণে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকার, বিমান সংস্থা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিমান তৈরির কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্তদের বড় ধরনের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। যে শিশুরা আহত হয়েছে, তাদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের একটা হেলথ কার্ড ইস্যু করা যায়, যার ফলে তারা বিমানবাহিনীর হাসপাতালে অথবা সিএমএইচ থেকে আজীবন চিকিৎসাসুবিধা পেতে পারে।

আজকের পত্রিকা: ভবিষ্যতে এ রকম দুর্ঘটনা রোধে বিমানবাহিনী, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং রাষ্ট্রের করণীয় কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: আমি মনে করি, বর্তমান বিমানবন্দরটিকে ঢাকার অদূরে সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। এখন যদি সেই পরিকল্পনা নেওয়া যায়, তাহলে সেটা বাস্তবায়ন করতে ১০-১৫ বছর লাগবে। সে জন্য এখনই পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। সেই সঙ্গে বিমানবাহিনীর জঙ্গিবিমানের আধুনিকায়ন জরুরি। এফ-৭-এর পরিবর্তে আধুনিক জঙ্গিবিমান ক্রয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিমান চলাচলের ‘ফ্লাইট প্যাথ’ থেকে সব অবৈধ স্থাপনা সরানোর কাজ অনতিবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে।

আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘ওসি হয়েও আমার কম দামি ফোন, দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই তো হবেই’, ভুক্তভোগীকে মোহাম্মদপুরের ওসি

এনসিপির পদযাত্রা উপলক্ষে ‘স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত’, প্রধান শিক্ষকের দুই রকম বক্তব্য

মোহাম্মদপুর থানায় ভুক্তভোগীকে হেনস্তা: চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার, ৩ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার

হিন্দু মন্দির নিয়ে কেন সংঘাতে জড়াল বৌদ্ধ-অধ্যুষিত থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া

বলিদান ও শয়তান পূজার বুদ্ধি দিল চ্যাটজিপিটি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত