Ajker Patrika

মাইলস্টোন নীতিহীনতার মাইলফলক হলো

প্রজ্ঞা দাস
মাইলস্টোনে আছড়ে পড়া বিমানটি ছিল ‘ফ্লাইং কফিন’। ছবি: আজকের পত্রিকা
মাইলস্টোনে আছড়ে পড়া বিমানটি ছিল ‘ফ্লাইং কফিন’। ছবি: আজকের পত্রিকা

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা গোটা জাতিকে গভীর বেদনায় নিমজ্জিত করেছে। শিশুর কান্না, অভিভাবকের আর্তনাদ কেবল কারও ব্যক্তিগত ক্ষত বা ক্ষতি নয়, বরং একটি রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত দুর্বলতার দিকটিকে সামনে এনেছে। প্রশিক্ষণ বিমান কোথায় চালানো উচিত, সেটা আগের দুর্ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া দরকার ছিল। তারপরও আমরা সতর্ক হইনি। এই ঘটনাটি কোনোভাবেই একটি নিছক অসাবধানতার কারণে দুর্ঘটনা নয়, বরং অবহেলা, অসাবধানতা, অদক্ষতা এবং নিরাপত্তা-চিন্তার অভাবের নগ্ন প্রকাশ ফুটে উঠেছে।

ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। মাত্র ৩০৬ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ২ কোটির অধিক মানুষের বসবাস এই মহানগরীতে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, আদালত সবকিছু মিলিয়ে এই শহর কেবল প্রশাসনিক নয়, বরং দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। এমন একটি শহরের ওপর দিয়ে প্রশিক্ষণ বিমান ওড়ানো মানে হলো দাহ্য পদার্থ পরিপূর্ণ একটি জায়গার ওপর দিয়ে দিনের পর দিন আগুনের ফুলকি ছড়ানো। শহরের ওপর দিয়ে বিমান চলাচলের পরিণতি শুধু শব্দদূষণেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি জনমানসে ভীতি তৈরি করে, শিশুমনে আতঙ্কের বীজ বপন করে এবং শিক্ষালাভের পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে ফেলে।

সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো, তেজগাঁও বিমানবন্দর যখন গড়ে উঠেছিল, তখন কুর্মিটোলা অঞ্চল ছিল এক বিস্তৃত বনজ-নির্জন প্রান্তর। তখন ঢাকার নবাববাড়ি ও অভিজাত শ্রেণির শিকারবিলাসীদের পদচারণে মুখর এই এলাকা জনমানবহীনই ছিল প্রায়। সেই সময় ঢাকায় উড্ডয়ন ক্লাব স্থাপন ও সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ হয়তো যৌক্তিক ছিল। কিন্তু সময় পাল্টেছে, বদলেছে ঢাকা শহরের চেহারা। এখন কুর্মিটোলার আশপাশে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ভবন, গলিঘুঁজির মধ্য দিয়ে গিজগিজ করছে নগরের শ্রেণিশিক্ষা কেন্দ্রগুলো। সেই বাস্তবতায় এখনো ঢাকার মাঝখানে উড্ডয়ন প্রশিক্ষণের মতো কর্মকাণ্ডের স্থিতি রাখার সিদ্ধান্ত শুধু অযৌক্তিক নয়, নাগরিক জীবনের ওপর এক নির্মমতা।

বাংলাদেশের ভেতরে লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, শমশেরনগর, কুমিল্লা কিংবা ফেনীর মতো এলাকায় বহু পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি রয়েছে, যেগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল। এসব রানওয়ে আজও দৃশ্যমান। জনবসতিমুক্ত, অপেক্ষাকৃত খোলামেলা ও প্রশিক্ষণের উপযোগী পরিবেশে এসব অঞ্চলকে উপযুক্ত পরিকল্পনায় আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রূপান্তর করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী যেভাবে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেভাবে বিমানবাহিনীও চরাঞ্চলভিত্তিক নিরাপদ প্রশিক্ষণ অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারে। এতে করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমবে, জনমানুষের জীবনও থাকবে সুরক্ষিত।

বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গত এক দশকে বিমানবাহিনীর অভ্যন্তরে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র প্রকট হয়েছে বারবার। বিমান কেনার মতো মূল খাতে খরচ না করে গেট, বাগান, প্রাচীর আর দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। পুরোনো, জীর্ণ, কর্মক্ষমতাহীন বিমানের মধ্যেই চালানো হচ্ছে প্রশিক্ষণ। যাকে ‘ফ্লাইং কফিন’ নামে অভিহিত করা হয়। এই ফ্লাইং কফিন উড্ডয়ন মানে শুধু ঝুঁকি নয়, একপ্রকার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যেখানে প্রাণের চেয়ে প্রাচীর বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বিমান চলাচলের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিছু নীতিমালা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইসিএও)-এর নিয়ম অনুযায়ী, প্রশিক্ষণ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল এড়িয়ে নিরাপদ এবং খোলা আকাশ-পরিধি নির্বাচন করা বাধ্যতামূলক। অনেক দেশেই এই নিয়ম কঠোরভাবে মানা হলেও বাংলাদেশে এখনো ঢাকার মতো মহানগরের মধ্যে এমন অনুশীলন চালু থাকা নিয়মহীনতার প্রকাশ। এটা সাধারণ জনগণের জীবনের প্রতি রাষ্ট্রের এক নির্মম উদাসীনতার প্রমাণ। এমন অনৈতিক অবস্থানের কারণে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে, অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পরে মুখে রুটিনমাফিক বিবৃতি দিয়ে শোক প্রকাশ ছাড়া কার্যকর কোনো সংস্কার উদ্যোগ নিচ্ছে না।

অন্যদিকে এ দুর্ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে রাজধানী ঢাকার আশপাশে স্কুল-কলেজের অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রেও রয়েছে ভয়াবহ নীতিহীনতা। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পুরোপুরি নিয়মনীতিবহির্ভূত কাজ। ফলে বিমান ওঠানামার বিকট শব্দ, অনিয়ন্ত্রিত ও ঝুঁকিপূর্ণ উড্ডয়ন, এসব থেকে সৃষ্টি হওয়া মানসিক চাপ শিক্ষার্থীদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। অথচ এসব বিষয়ে নীতিমালা করার কথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং সিভিল এভিয়েশনের। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও তারা নীরব দর্শক, যা ভবিষ্যতে আরও মারাত্মক বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে।

এই দুর্ঘটনায় আরও একটি দুঃখজনক দিক ছিল রক্তসংকট। একদিকে হাসপাতালে রক্তের চাহিদা তীব্র, অন্যদিকে প্রায় দুই কোটি মানুষের রাজধানীতে নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত মজুতে ব্যর্থতা আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্বলতা ও অব্যবস্থাপনাকে তুলে ধরেছে। জরুরি পরিস্থিতিতে রক্ত সংরক্ষণের ন্যূনতম কৌশল বা প্রস্তুতি নেই, নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রক্তব্যাংক রুটিন কার্যক্রম। শুধু দুর্ঘটনার সময় ফেসবুকে ‘রক্ত দান করুন’ আহ্বান দিয়ে রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা সম্পন্ন হয় না।

তাই রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ এবং জননিরাপত্তাসহ এর সঙ্গে জড়িত সবকিছুই এখন এক নতুনভাবে পর্যালোচনার সময় এসেছে। এ দুর্ঘটনা যেন আরেকটি স্ট্যাটাস, আরেকটি টক শোর বিষয় হয়ে হারিয়ে না যায়, সেদিকে গুরুত্বের সঙ্গে দৃষ্টিপাত করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় রাষ্ট্র যদি সত্যিই এ থেকে শিক্ষা নিতে চায়, তবে তাকে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে সচেতন, মানবিক ও প্রযুক্তিনির্ভর পদক্ষেপ নিতে হবে। নিরাপত্তা যেন সাধারণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হয়ে ওঠে, প্রশিক্ষণ যেন শুধু দক্ষতা নয়, জীবনের প্রতিও শ্রদ্ধাবোধ শেখায়, দুর্নীতির পরিবর্তে যেন সততা এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হয় এমন নীতি নির্মাণ করাই এখন সময়ের সবচেয়ে জরুরি চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই একমাত্র গঠিত হবে নিরাপদ, মানবিক ও দূরদর্শী এক বাংলাদেশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘ওসি হয়েও আমার কম দামি ফোন, দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই তো হবেই’, ভুক্তভোগীকে মোহাম্মদপুরের ওসি

এনসিপির পদযাত্রা উপলক্ষে ‘স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত’, প্রধান শিক্ষকের দুই রকম বক্তব্য

মোহাম্মদপুর থানায় ভুক্তভোগীকে হেনস্তা: চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার, ৩ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার

হিন্দু মন্দির নিয়ে কেন সংঘাতে জড়াল বৌদ্ধ-অধ্যুষিত থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া

বলিদান ও শয়তান পূজার বুদ্ধি দিল চ্যাটজিপিটি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত