Ajker Patrika

মেঘনা আলমের প্রশ্ন, অসহায় রাষ্ট্র

মাসুদ কামাল
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মেঘনা আলমের কথা মনে আছে?

জাতি হিসেবে আমরা খুবই ভুলোমনের। দ্রুতই সবকিছু ভুলে যাই। অর্জনের কথা ভুলে যাই, বিসর্জনের কথা ভুলে যাই, সম্মানের কথা ভুলে যাই, অপমানের কথাও ভুলে যাই। আমি মেঘনা আলম সম্পর্কে জানতাম না, তাঁকে চিনতামও না। তিনি যে জগতের মানুষ, সেই দুনিয়ার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। কাজেই তিনি কেন বিখ্যাত—সেটা আমার জানাও ছিল না। কিন্তু এই সবই আমার জন্য ছিল গুরুত্বহীন। তিনি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন ফেসবুকের একটা লাইভের মাধ্যমে। দেখলাম—একজন নারী কীভাবে একাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু লোকের দুর্বিনীত আচরণের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন! তাঁর বাসার বাইরে পুলিশের লোকজন ক্রমাগত নক করছে, তাঁকে ধরতে চাইছে, আর তিনি ক্রমাগত তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, একই সঙ্গে টেলিফোনে থানার সঙ্গে, পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলছেন।

শেষ পর্যন্ত, যতক্ষণ ওই ভিডিওটা চলছিল, তিনি হার মানেননি, নিজের নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছেন।

তার পরের ঘটনা আমরা মিডিয়াতে পেয়েছি, জেনেছি আগের ঘটনাও। সেই সময়ের সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, সম্পর্ক নষ্ট হওয়া, তাঁরই প্রভাবে প্রশাসন ও পুলিশের তৎপর হওয়া এবং সবশেষ মেঘনা আলমের ঘরের দরজা ভেঙে বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা। সেই মেঘনা আলমের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস আবার চোখে পড়ল গত মঙ্গলবার, ১ জুলাই। এবার তিনি সরকারের যুব, ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকারবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব

ভূঁইয়ার সঙ্গে তাঁর নিজের অবস্থানের তুলনা করে কিছু কথা লিখেছেন।

তাঁর লেখাটা শুরু হয়েছে এভাবে—‘কীভাবে হয় যে আসিফ, যে বয়সে আমার থেকে অনেক পিচ্ছি, সে দুনিয়ার সব আইন ভেঙে, এয়ারপোর্টের মতো নিরাপত্তা-সংবেদনশীল জায়গায় ammunition magazine নিয়ে ধরা পড়েও কিছু হয় না?

একজন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সামান্য ভুল হয়েছে বলে হেসে উড়িয়ে দেয়।

অথচ...মেঘনা আলম, যিনি বয়সে যথেষ্ট বড়, একজন প্রতিষ্ঠিত চেয়ারপারসন, তাকে Chairperson বলে সম্বোধন না করে, একটা মডেল ডেকে, কোনো প্রমাণ বা তদন্ত ছাড়াই একটা শোনা কথার ভিত্তিতে, ১৯৭৪ সালের স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট দেখিয়ে গোপনে তুলে নিয়ে গেল?’

আর লেখাটা শেষ করেছেন তিনি এভাবে—‘আইন কি শুধু পদবির জন্য আলাদা হয়? নাকি ন্যায়বিচার শুধু ক্ষমতাবানদের জন্য সংরক্ষিত?’

আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার ঘটনাটা কি আসলেই মারাত্মক কিছু নয়? বিষয়টা নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরি মনে করছি। তিনি একটা সম্মেলনে যোগ দিতে মরক্কো যাচ্ছিলেন। বিমানবন্দরে লাগেজ চেক করার সময় ধরা পড়ল তাঁর ব্যাগের মধ্যে একটা গুলিভর্তি ম্যাগজিন রয়েছে! আধুনিক সময়ে এটা একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ জানালেন, ভোরে ব্যাগ গোছানোর সময় ভুলক্রমে একটা ম্যাগজিন তাঁর ব্যাগে রয়ে গিয়েছিল। ভুল শুধরে ম্যাগজিনটি তিনি তখন তাঁর প্রটোকল অফিসারের হাতে দিয়ে প্লেনে গিয়ে ওঠেন।

বিষয়টি দ্রুতই জানাজানি হয়। বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়। নানা ধরনের প্রশ্ন উঠতে থাকে। কেউ কেউ জানতে চান, ওনার বয়স তো এখনো ৩০ হয়নি, তাহলে তিনি অস্ত্রের লাইসেন্স পান কীভাবে? তা ছাড়া, অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে হলে নিয়মিত তিন বছর ধরে কমপক্ষে তিন লাখ টাকা করে আয়কর দিতে হয়। সেটাইবা তিনি কীভাবে দিলেন। উপদেষ্টা হওয়ার আগে তো তাঁর ছাত্রত্বই শেষ হয়নি, বেকার ছিলেন। প্রতিবছর তিন লাখ টাকা করে আয়কর দিতে হলে যে অর্থ আয় করতে হয়, সেটা তো তাঁর পক্ষে আয় করা রীতিমতো অসম্ভব। তাহলে?

এসব প্রশ্নের জবাব কিছুটা রূঢ়ভাবেই দিলেন আসিফ মাহমুদ। তিনি অস্ত্র আইনের ৩২ ধারা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করে জানালেন, বয়স ও আয়কর প্রদানের বাধ্যবাধকতা উপদেষ্টা হওয়ার কারণে তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। তাঁর এমন দাবি যথার্থ। আসলেই মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা সমমর্যাদার ব্যক্তিদের জন্য অস্ত্রপ্রাপ্তির জন্য বিশেষ প্রবিধান বা কোটার ব্যবস্থা আছে। সেই নিয়মের মধ্য দিয়েই পেয়েছেন তিনি অস্ত্রের লাইসেন্স। কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা এই ছেলেরা যে প্রচলিত কোটার মাধ্যমেই অনেক কিছু লাভ করছেন—এ নিয়ে কেউ কেউ আপত্তি তুলতেই পারেন। বিষয়টির হয়তো আইনগত তেমন ভিত্তি নেই, কিন্তু নৈতিক ভিত্তি ঠিকই আছে।

তারপরও এ বিষয়টিকে আমি তেমন একটা গুরুত্ব দিতে চাই না। আমার কথা হলো, গুলিভর্তি ম্যাগজিন নিয়ে বিমানবন্দরে গিয়ে তিনি কি অন্যায় করেননি? এটা তো আসলে ক্রিমিন্যাল অফেন্স। আমার ঠিক মনে আছে, ২০১৯ সালে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক মজিবুর রহমান এ রকম ভুল করে তাঁর লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে এই বিমানবন্দরেই ঢুকে পড়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারক তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। বিমানবন্দর আসলে এ রকমই সংবেদনশীল এলাকা। এর জন্য আইনও এ রকমই কড়াকড়ি হয়ে থাকে। গুলি বা ম্যাগজিন অস্ত্রেরই একটা অংশ।

২০১৯-এর মজিবুর আর ২০২৫-এর আসিফ মাহমুদের অপরাধে গুণগত তেমন কোনো পার্থক্য নেই। বরং চুলচেরা বিচার করলে আসিফ মাহমুদের অপরাধ আরও গুরুতর। কারণ, ধরা পড়ার পর, তিনি তাঁর সেই গুলিভর্তি ম্যাগজিনটি তাঁর প্রটোকল অফিসারের হাতে দিয়ে দেন। তিনি আসলে এটাও পারেন না। এটা একেবারেই বেআইনি একটা কাজ। অস্ত্র খুবই ব্যক্তিগত একটি সম্পত্তি। এটি আপনি এমনকি আপনার পরিবারের সদস্যদের হাতেও দিতে পারবেন না। সে কারণেই অস্ত্র আইনের ৩৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, লাইসেন্সধারী ব্যক্তি যদি কখনো দেশের বাইরে যায়, সেই সময়ের জন্য তাঁর অস্ত্রটি জেলা মালখানা বা থানায় রেখে যেতে হবে। আসিফ মাহমুদ কি সেটা করেছিলেন? না, তিনি তা করেননি। অস্ত্র তিনি তাঁর বাসায় রেখে গেছেন। আইন অনুযায়ী এটাও তিনি পারেন না।

তিনি একের পর এক আইন ভেঙেছেন, আর রাষ্ট্র ও সরকার সেসব হাসিমুখে প্রশ্রয় দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জে. (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বিবেচনায় এসব নাকি সামান্য ভুল। মানুষ যেমন কোথাও যাওয়ার সময় ভুলে চশমা বা কলমটা বাসায় ফেলে চলে যায়, অনেকটা তেমনি! আমি বুঝি না, এই লোক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকেন কীভাবে? আজ ১১ মাস পরে এসেও যে আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের নানাবিধ হাহুতাশ শুনি, তার কারণটা মানুষ এখন বুঝতে পারে।

মেঘনা আলমের শেষ প্রশ্নটা আর একবার না হয় উচ্চারণ করি—‘আইন কি শুধু পদবির জন্য আলাদা হয়? নাকি ন্যায়বিচার শুধু ক্ষমতাবানদের জন্য সংরক্ষিত?’ এই প্রশ্নের কোনো জবাব কি জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কাছে আছে? আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের কাছে আছে? এই রাষ্ট্রের কাছে আছে?

একজন সাধারণ মানুষের এমন প্রশ্নের জবাব যখন রাষ্ট্রযন্ত্র দিতে না পারে, তখন সেই রাষ্ট্রকে কি ব্যর্থ রাষ্ট্র বলা যায়?

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত