Ajker Patrika

লাটে ওঠা

রাজীব কুমার সাহা
লাটে ওঠা

বাংলা ভাষায় বহুল চর্চিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘লাটে ওঠা’। যাপিত জীবনে ‘লাটে ওঠা’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া রীতিমতো কঠিন। ইংরেজ আমলে লাটগিরি দেখাতে গিয়ে অনেক জমিদারের জমিদারি আক্ষরিক অর্থেই লাটে উঠেছিল। যদিও ভারতবর্ষের লাটসাহেবগণ তাঁদের লাটত্ব বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে আমাদের অনেকের ব্যবসা লাটে উঠেছে আবার কেউ ষড়যন্ত্র করে কারও ব্যবসা লাটে উঠিয়েছে। এমনকি আমাদের ছাত্রসমাজের পড়াশোনাও দিনে দিনে লাটে উঠতে দেখছি। এখন প্রশ্ন হলো, এই লাটে ওঠা মানে কী? আমরা অনেক সময় বলি, ‘কোথাকার কোন লাটবাহাদুর তুমি!’ লাটবাহাদুরের লাটের সঙ্গে কি এই লাটের কোনো সম্পর্ক রয়েছে? যদি না থাকে, তবে এই লাটের অর্থ কী? তবে চলুন আজ জানব ‘লাটে ওঠা’র আদ্যোপান্ত।

বাংলা ভাষায় লাট শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে। ইংরেজি শব্দ ‘লর্ড’ থেকে বাংলা লাট শব্দ তৈরি হয়েছে। এটি বিশেষ্য পদ। এর অর্থ হলো (অবিভক্ত ভারতের) প্রদেশের শাসক, রাজ্যপাল, গভর্নর; সামরিক সর্বাধিনায়ক; রাজ্যপালের ন্যায় মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। দ্বিতীয় লাট শব্দটি হলো দেশি। এটিও বিশেষ্য পদ। এর অর্থ হলো নষ্ট, বিপর্যস্ত, চটকানো, এলোমেলো করা হয়েছে এমন, পাটভাঙা (লাটকাপড়); ভূমিশায়ী, নির্জীব, শোচনীয় অবস্থাপ্রাপ্ত (মেরে লাট করা)। আরেকটি লাট হলো সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ হলো বিদগ্ধ ব্যক্তি; রসজ্ঞ ব্যক্তি; ছেঁড়া, পুরোনো, জীর্ণ (কাপড়গুলো লাট হয়েছে)। হিন্দি ‘লাঠ’ শব্দ থেকে জাত লাট শব্দের আরেকটি অর্থ হলো স্তম্ভ। আমরা যে অর্থে বলি অশোক লাট।

কিন্তু লাট শব্দের এত অর্থের ভিড়ে আমরা কিন্তু এখনো ‘লাটে ওঠা’ অর্থটি পাইনি। এবার আসি আসল কথায়। লাটে ওঠা শব্দবন্ধের লাট শব্দটি বাংলা। শব্দটি এসেছে ইংরেজি ‘লট’ শব্দ থেকে। এটি বিশেষ্য পদ। এর অর্থ নিলামে বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যসামগ্রী; জমিদারির অংশ (লাটের খাজনা); গুচ্ছ বা তাড়া (লাট লাট শাড়ি); নির্ধারিত দিনে দেয় রাজস্ব প্রভৃতি। সুতরাং লাটে ওঠার মূল অর্থ হলো লাটবন্দী বা খাজনা বাকি পড়ার দায়ে নিলামে বিক্রির জন্য দ্রব্যসামগ্রী তালিকাভুক্ত হওয়া বা লটারির মাধ্যমে নিলামে ওঠা। এক কথায় বললে দাঁড়ায়, খাজনা বাকি পড়ার দায়ে জমিদারি নিলামে ওঠা। এই বাক্যবন্ধের উৎপত্তি সেই জমিদারি আমলেই। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, একটি নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের মধ্যে যদি কোনো জমিদার পূর্বনির্ধারিত খাজনা দিতে না পারতেন, তাহলে গভর্নর জেনারেলের (বড়োলাট) তরফ থেকে তাঁর জমিদারি নিলাম করা হতো। এই নিলামকে বলা হতো ‘লাটের নিলাম’।

‘লাটে ওঠা’ একটি বহুমাত্রিক বাংলা প্রবাদ ও শক্তিশালী রূপক যা সাহিত্যের যে কোনো স্তরে গল্প, উপন্যাস, নাটক বা প্রবন্ধে অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন, সমাজ-রাজনীতির বিশৃঙ্খলা, পারিবারিক জটিলতা প্রভৃতি প্রবণতা বোঝাতে জোরালোভাবে ব্যবহৃত হয়। সাহিত্যে এই শব্দবন্ধের ব্যবহার আবেগ ও উত্তেজনার প্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। আবার সাহিত্যে মাঝে মাঝে ‘লাটে ওঠা’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয় হালকা ব্যঙ্গ বা উপহাস করতে। কোনো তুচ্ছ বিষয়ে মানুষ যখন অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়, তখন এ ধরনের রূপক ব্যবহার রসিকতার সৃষ্টি করে। কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় আমরা ‘লাটে ওঠা’ শব্দের প্রয়োগ পাই ‘নিলামে একত্রে বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যসমূহ’ অর্থে। তাঁর ভাষায়, ‘সে পাট উঠে কোন লাটে।’ আবার ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনা থেকে পাই, ‘নির্ধারিত দিনে দেয় রাজস্ব’ অর্থে। তাঁর ভাষায়, ‘লাটের দিন খাজনা হয় না আর।’ আবার মানিকরামের রচনায় লাট শব্দটি ‘নাটক’ বা ‘লীলাবিলাস’ অর্থে প্রয়োগ পাই। তাঁর ভাষায়, ‘দিবা নিশি কত দেখ্যাচি লাট।’ যদিও এই অর্থ নাটক শব্দের ব্যঙ্গাত্মক রূপ হিসেবে বিবেচিত।

লাটে ওঠার প্রসঙ্গটি জমিদারি আমলের প্রথা হলেও বর্তমানে তার ওই অর্থে প্রয়োগ নেই। তাই বলে আমাদের লাটে ওঠা থেমে নেই।

কখনো আমরা যথাযথ বিষয়বুদ্ধির অভাবে নিজেরা লাটে উঠছি, আবার ষড়যন্ত্র করে কাউকে লাটে ওঠানোর ঘৃণ্য কর্মে লিপ্ত হচ্ছি। বর্তমানে বিবর্তিত অর্থে লাটে ওঠার বিষয়টি সবকিছু শেষ হওয়া বা সর্বস্বান্ত হওয়া অর্থে দাঁড়িয়েছে।

চলতি কথায় আমরা ‘পড়াশোনা লাটে ওঠা’ বা ‘কাজকর্ম লাটে ওঠা’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে থাকি। যদিও যাপিত জীবনে উভয় অর্থেই আমাদের বারোটা বাজছে।

লেখক:– আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কৌশলে বিনিয়োগ সরাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি

বিমান বিধ্বস্ত: এক ঘণ্টা পর উদ্ধার হন পাইলট, তখনো বেঁচে ছিলেন

মোহাম্মদপুর থানায় ভুক্তভোগীকে হেনস্তা: চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার, ৩ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার

রংপুরের ১০ কিমি সড়কে ৩৬৫ টন পাথর উধাও

‘ওসি হয়েও আমার কম দামি ফোন, দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই তো হবেই’, ভুক্তভোগীকে মোহাম্মদপুরের ওসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত