Ajker Patrika

নারীকে হতে হবে দশভুজার মতো

সানজিদা সামরিন
নারীকে হতে হবে দশভুজার মতো

সংসারে নারী যেন ছাঁচে গড়া পুতুল, একদম নিখুঁতে নিখুঁত হওয়া চাই। আর না হলে তবেই খুঁত ধরা শুরু! তুড়ি মেরে বলার লোকেরও অভাব নেই যে, ‘ছাড়ো তো! সেদিন কত আগেই গেছে! এখন প্রায় সব ঘরেই কর্মজীবী নারী। ওসব কথা পচে গেছে কত্ত আগে।’ তাদের কথা কানে না তুলে ফের বলছি, ২০২১ সালে এসেও নারী যতই গোটা সংসার খুঁটে খুঁটে সামলে নিক আর আর্থিকভাবে অংশগ্রহণ করুক না কেন, তাঁর দিকে আঙুল যেন তুলতেই হবে! কোনো ভুলও যদি না থাকে, তবু দোষ ধরার অজুহাতেও ভুল ধরতে হবে। এই বাক্যটা লেখার পর নিজেরই যেন কেমন লাগছে এখন। আহা, আমিও বুঝি আঙুল তুলছি! তবে ওই নারী আর্থিকভাবে স্বাধীন হোক, সংসারে অর্থের জোগান দিক, সবার সেবা ও কাজকর্মের সব দায়িত্ব নিক তাতে কী! বরং পাশের পুরুষ সদস্যটি তাঁর ওপর চড়াও হবেন, তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করবেন—এটাই তো মগজে গেঁথে নেওয়া আছে। জলের মতোই যেন স্বাভাবিক। এতটুকু পড়তে পড়তে যাঁরা পুরুষদ্রোহী বলে গালি দিতে উদ্যত হচ্ছেন, তাঁরা একটু থামুন। বলছি, ব্যাপারটা এককথায় এমন যে নারীকে হতে হবে দশভুজার মতো। একসঙ্গে সামলাতে হবে সব, না না, ‘সামলাতেই’ হবে সব। কিন্তু কর্তৃত্ব থাকবে পুরুষের। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ও চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা এবং অপব্যবহারের কাজটাও তিনিই সারবেন।

উদাহরণ ডিঙিয়ে সামনে এগোতে পারছি না। অফিসে একগাদা কাগজে ডুবে থাকা মুখ তুলতে হলো ফোনের রিংটোনে। রূপকের (ছদ্মনাম) ফোন। বিভা (ছদ্মনাম) কানে তুলতেই গর্জন শুনতে পেল–আচ্ছা, খাবারের বাটিটা ব্যাগে দেওয়ার সময় তুমি খেয়াল করোনি বিভা যে বাটির মুখটা ঠিকঠাক লাগেনি? তুমি বোঝনি যে এই বাটির মুখটা অত বেশি টাইট নয়? বিভা শান্তস্বরে উত্তর দিল, না, বুঝিনি, ঝোল তরকারি ছিল বলে একটা প্যাকেটে মুড়ে ব্যাগে ভরেছি। হুংকার ছেড়ে রূপক বলল, এটা না বোঝার তো কোনো কারণ নেই! এমন একটা বাটি ক্যারি করে নিয়ে আসব ব্যাগ উল্টেপাল্টে যাবে, সেটা তোমার বোঝা উচিত ছিল না? আমি বুঝিনি, উত্তর দিল বিভা। বোঝোনি ভালো করেছ, এ কথা বলে ফোন কেটে দিল রূপক। এখানে বলে রাখি রূপকের কথাগুলোয় যুক্তি ছিল, কিন্তু উপস্থাপনাটা একটা ব্যাপার।

স্বাভাবিকভাবেই ফোন রাখার পর মন ভালো রাখার কারণ নেই বিভার। মস্তিষ্কে খেলে গেল—বিয়ের আগে একদিন দেখা করার সময় বিভাকে একটা কাপড়ের শপিং ব্যাগে করে বিরিয়ানির প্যাকেট দিয়েছিল রূপক। অতটা দেখতেও যায়নি বিভা যে প্যাকেটটা কীভাবে আছে। রূপকের বাইকের পেছনে বসে বিরিয়ানির প্যাকেটটা কোলের ওপর রাখে সে। বাড়ির মূল দরজায় নেমে রূপককে বিদায় দেওয়ার পর বাতি জ্বালিয়ে সে লক্ষ করে, আকাশি রঙের জামার কোলের অংশটি তেলে মাখামাখি। হাতের শপিং ব্যাগটা দুহাতে খুলতেই দেখে বিরিয়ানির প্যাকেটটা আধখোলা, অনেকটা বিরিয়ানি পড়েছে কাপড়ের শপিং ব্যাগের ভেতরেও। যার ফলে তেল চুইয়ে তার কামিজে লেগেছে। জিনসের প্যান্টের কারণে কামিজ ভেদ করে সে তেল তার ত্বক স্পর্শ করেনি বলে এতক্ষণ সে টের পায়নি। বাড়ির বিনবাক্সে বিরিয়ানির প্যাকেটটা ফেলে দিতে হলেও রূপককে এ কথা বলেনি বিভা। কেন বলেনি? এই মেঘস্বরের ভার এড়াতে? তবে এটা ঠিক, জামাটা বিভা বাইরে আর পরতে পারেনি। হ্যাঁ, ঘরে অবশ্য পরেছিল কিছুদিন। বিভা যা যা করতে পারত–জামায় তেল লাগার কারণে রূপককে বিরক্তি দেখিয়ে দুটো কথা শোনাতে পারত। ভদ্রতা বিষয়েও কথা বলতে পারত। কারণ একজনকে খাবার দিতে হলে কীভাবে দিতে হয়, সেটা জানা দরকার বা ব্লা ব্লা ব্লা। কিন্তু বলেনি, কারণ কলার ঝাড়া দিয়ে নিজেকে বোহেমিয়ান জারি করা রূপককে এসব বলাটাই বৃথা। তাঁদের জন্যও পড়া বারণ এ লেখাটি, যাঁরা ভাবেন আরে ছেলেমানুষ তো এমনই হয়, অগোছালো। এই এমনই হয় সনদটা দেয় কারা?

বিভার মগজে চুপ করে বসে থাকা দুয়েকটা ঘটনা আরও বের হয়ে এল—রূপক বাড়ি থেকে বের হয় অথচ মূল দরজায় তালা ঝোলাতে ভুলে যায়। অফিস ধরতে বিভাকে রূপকের আগে বের হতে হয়। কিন্তু খাবার টেবিলে পরিপাটি করে রেখে যায় নাশতা। খাবার নেওয়ার ব্যাগে অফিসের লাঞ্চ রেখে যায় রূপকের। ইস্তিরি করা থাকে রূপকের অফিসে যাওয়ার কাপড়। যদিও বিভা যে কাপড়টি ইস্তিরি করে রাখে, রূপক সেটা না পরে অন্য একটা পরে। এটা প্রায় রোজকার ঘটনা। নাশতা করার পর বাড়তি খাবার ফ্রিজে তুলে রাখতে বা ঢেকে রাখতে বরাবরই নারাজ রূপক। না ঢেকে ফেলে রাখা খাবার বিভা রোজ ময়লার ঝুড়িতে ফেলে অফিস শেষে বাড়ি ফিরে। আর বরাবরই রূপক বোঝাতে চেয়েছে, সে এমনই আর এই উড়নচণ্ডীপনা মেনেই বিভাকে থাকতে হবে। না হলে তাকে বেরিয়ে যেতে হবে এ বাড়ি থেকে। হোস্টেলে উঠে যাওয়ার কথাও সে শুনেছে রূপকের কাছ থেকে। এটা শহরের কোনো একটা বাড়ির গল্প। কিন্তু আসলেই কি একটা বাড়ির ঘটনা? মেনে নেওয়া নামের ছোট্ট তবে কখনো গলার কাঁটা বা বিশাল পাথরখণ্ডের ওজনসম এই শব্দটা বহন করবে কেবল বাড়ির বউটি বা নারী সদস্যটি, তা যেন অলিখিত এক সংবিধান।  

আর মুদ্রার অপর পিঠ কি মেনে নেয় এতটুকু ভুল? ভুলের কথা পরে যদি বলি এতটুকু ভিন্নতা, ইচ্ছে, ভালো লাগা বা অপারগতা? মেনে নেয়? কেউ কি বলে, আহা, মেয়েটা একটু অগোছালো তো কী হয়েছে?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত আমদানির ঘোষণা দিতেই ভারতে হু হু করে বাড়ছে চালের দাম

‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’, চিরকুটে লেখা

জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে উচ্চপদস্থ বোর্ড গঠন: আইএসপিআর

ফেসবুকে ছাত্রলীগ নেতার ‘হুমকি’, রাবিতে ১৫ আগস্টের কনসার্টে যাচ্ছে না আর্টসেল

পাবনায় প্রবাসীর স্ত্রীকে নিয়ে এএসআই উধাও, থানায় শ্বশুরের জিডি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত