Ajker Patrika

ভোট নিয়ে জট কতটা কাটল

আজাদুর রহমান চন্দন
ভোট নিয়ে জট কতটা কাটল

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছিলেন, বিএনপি তখন ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চেয়ে আসছিল। তবে গত ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলে তাতে একমত হওয়ার কথা জানায় বিএনপি। যদিও লন্ডন বৈঠকের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে একধরনের সংশয় তৈরি হয়েছিল। ওই ঘোষণার পর বেশ কিছুদিন পার হয়ে গেলেও নির্বাচন নিয়ে সরকারের দিক থেকে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছিল না। এর মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সাক্ষাৎ করে দীর্ঘ সময় একান্তে কথাও বলেন। কিন্তু ওই সাক্ষাতে নির্বাচনের সময় নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনো কথা হয়নি বলে পরে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন সিইসি। ৯ জুলাই আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশনা দেওয়ায় দলটির সংশয় কিছুটা কেটেছে।

৯ জুলাই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করেন। বৈঠকে নির্বাচনের নানা প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলে হবে। এর অর্থ হলো, নির্বাচনের জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দরকার, সেটি প্রস্তুত করতে যা কিছু প্রয়োজন, তা এখনই শুরু করতে হবে। প্রেস সচিব বলেন, এ জন্য সব প্রস্তুতি, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক প্রস্তুতিগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে নতুন নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ এ সময়ের মধ্যে শেষ করারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। যদিও তফসিল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত এটা বলার সুযোগ নেই যে রমজানের আগে নির্বাচন হচ্ছে। এমনকি তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার নজির আছে।

নির্বাচন ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলে হবে—প্রধান উপদেষ্টার এমন ঘোষণা নতুন কিছু নয়। গত ঈদুল আজহার আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও তিনি এমন কথাই বলেছিলেন। তবে লন্ডন বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সব প্রস্তুতি শেষ করা গেলে ২০২৬ সালে পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। সেই শর্তগুলো এখনো বহাল আছে।

বিএনপির কোনো নেতা যদিও নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সংশয়ের কথা বলেননি। তবে চায়ের দোকান, সেলুন কিংবা পাড়া-মহল্লার জটলায় লোকজন কিন্তু ঠিকই সংশয় প্রকাশ করছেন। এ ছাড়া সরকারি ভাষ্যেও সংশয়ের আলামত স্পষ্ট। ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পরে যে যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়, তাতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও সেখানে কিছু শর্ত আরোপ করে বলা হয়েছে, যদি সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা যায় এবং যদি বিচার ও সংস্কারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়। কিন্তু এই পর্যাপ্ত সংস্কারের মানদণ্ডটি পরিষ্কার নয়। অর্থাৎ বিচারের কোন পর্যায়কে পর্যাপ্ত বা কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি বলা হবে এবং সংস্কারের কোন বিষয়গুলো সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বা জামায়াত নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী নয়—তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি।

রাজনীতিতে এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর এনসিপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তাদের কেউই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে কোনো শক্ত অবস্থান নেয়নি। বরং তারা নির্বাচনের আগে বিচার ও সংস্কারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি চায়। নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের মতো দলগুলোর তত সুবিধা। কারণ, বেশির ভাগ মানুষের বিশ্বাস, এই মুহূর্তে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হলে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করবে। তাই যদি হয়, তাহলে জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের মতো দলগুলোর কী লাভ? তবে লন্ডন বৈঠকে সরকারের লাভ হয়েছে ষোলো আনা। কারণ, ওই বৈঠকের পর থেকে করিডর ও বন্দর ইস্যুতে মুখে কুলুপ এঁটেছেন বিএনপির নেতারা।

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানামুখী আলোচনার মধ্যে মার্কিন মুল্লুক থেকে এসেছে শুল্কের খড়্গ। বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সঙ্গে আলোচনায় সফল হতে না পারার এমন প্রেক্ষাপটে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন প্রস্তুতির প্রক্রিয়ার কথা জানায় সরকার। এর মধ্য দিয়ে বিএনপিসহ সংশয়ে পড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে এই বার্তা দেওয়া হলো যে সরকার নির্বাচনপ্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। হতে পারে এটাও সরকারের কোনো একটা কৌশল! সরকারের দিক থেকে এ ঘোষণায় নির্বাচন ফেব্রুয়ারির মধ্যে হওয়া নিয়ে সংশয়ে থাকা দলগুলোতে স্বস্তি ফিরেছে, বিশেষ করে বিএনপিতে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক আলোচনা সভায় বক্তব্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রস্তুতি শেষ হওয়া সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হতে পারে বলে সরকারের তরফ থেকে যে বার্তা এসেছে, সে জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানান।

তবে বিএনপির নির্বাচনের আশায় ছাই দেওয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তিরও কিন্তু কমতি নেই। বিএনপির একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতে ইসলামী শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার ডিসেম্বর থেকে জুনের সময়সীমাকে সাধুবাদ জানায়। বলে এই সময়সীমার যেকোনো মাসে নির্বাচন নিয়ে আপত্তি নেই তাদের। তবে দলটির অবস্থান এর পরেও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বিভিন্ন সময়। কখনো দলটি এই সময়সীমার মধ্যেই নির্দিষ্টভাবে এপ্রিল মাস, আবার কখনো ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলেছে। যদিও দলটির নেতারা এসব বক্তব্যকে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে দলের অবস্থানের পরিবর্তন হিসেবে দেখতে নারাজ। কিন্তু নির্বাচনের পরিস্থিতি নেই—এমন কথাও বলা হচ্ছে জামায়াতের পক্ষ থেকে। জামায়াত বলছে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়াও মৌলিক বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার এবং জুলাই সনদ নির্বাচনের আগেই হতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের আগে সংস্কারে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে বলে জামায়াত মনে করে।

তবে সংস্কার কিংবা নির্বাচন নিয়ে শুধু জামায়াত নয়, একই সময়ে আরও শক্ত বক্তব্য এসেছে এনসিপি থেকেও। দলটি বলেছে জুলাই ঘোষণাপত্র আর সংস্কার ছাড়া নির্বাচনেই না যাওয়ার কথা। কিন্তু এই সময়ে এসে এই কথার উদ্দেশ্য কী? জামায়াত এবং এনসিপি উভয় দলই মূলত বিএনপিসহ কয়েকটি দলকে ইঙ্গিত করেছে। এর কারণ হচ্ছে, সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু—বিশেষ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গেই বিরোধ তৈরি হচ্ছে এই দলগুলোর। নির্বাচনের পরিবেশ ও মৌলিক সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে এনসিপি এবং জামায়াতের নেতারা অনেকটা একই সুরে কথা বলছেন। আবার উভয় দলই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে অটল, যেটাকে আবার সমর্থন দিচ্ছে ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল। তবে নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ নাকচ করছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, তাঁরা তো ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের বিষয়ে রাজি হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাঁরা সংশোধনী প্রস্তাব এনেছেন কিংবা একমত হয়েছেন। এখন যদি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বা অন্য দলের প্রস্তাবে অযৌক্তিকভাবে শতভাগ একমত হতে বলা হয়, এমনকি অযৌক্তিকভাবে যেখানে সরকারের চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স ক্ষুণ্ন হবে রাষ্ট্র পরিচালনায়, সেখানেও যদি সবাইকে নিঃশর্ত রাজি হতে বলা হয়, সেটা তো সংস্কার হলো না।

এনসিপি জুলাই সনদকে সংবিধানের মূলনীতিতে যুক্ত করতে চায়। এটি নিয়েও বিএনপির সঙ্গে মতবিরোধ হতে পারে। এ রকম আরও অনেক বিষয় আছে যেগুলো নির্বাচনের পথে কাঁটা হয়ে দেখা দিতে পারে। এনসিপিকে দিয়ে নিজের কাজটি করিয়ে নিতে অন্তর্বর্তী সরকারও যে কতটা সিদ্ধহস্ত, তা বেশ কিছু ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে। নির্বাচন ইস্যুতেও সরকার এনসিপি-জামায়াতকে দিয়ে নিজের খেলাটা খেলিয়ে নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

লেখখ: সাংবাদিক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পারটেক্স এমডি রুবেল আজিজের ১১৬ কোটি টাকার সম্পত্তি নিলামে তুলছে ব্যাংক এশিয়া

গণভবনকে বাস্তিল দুর্গের সঙ্গে তুলনা করলেন ফরাসি রাষ্ট্রদূত

যশোরে কেন্দ্রের ভুলে বিজ্ঞানের ৪৮ জন ফেল, সংশোধনে জিপিএ-৫ পেল সবাই

১০০ গজ দূরেই ক্যাম্প, তবু সোহাগকে বাঁচাতে কেন এল না কেউ—যা বললেন আনসারপ্রধান

উচ্চকক্ষ ‘সিনেটে’ ৭৬ আসনের প্রস্তাব, সদস্য নির্বাচন জনগণের ভোটে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত