Ajker Patrika

বুদ্ধিজীবীরা কি মৌনই থাকবেন

অজয় দাশগুপ্ত
বুদ্ধিজীবীরা কি মৌনই থাকবেন

আমি তখন ক্লাস টেনের ছাত্র। প্রধান শিক্ষক ডেকে পাঠিয়েছেন শুনে আমি তো রীতিমতো ঘামতে শুরু করে দিয়েছি। এ কে মাহমুদুল হক ছিলেন রাশভারী কিন্তু মজার মানুষ। আবার কড়া বলতে কড়ার গুরু। তিনি ডেকে পাঠাবেন কেন? এই প্রশ্নের জবাব মিলল তাঁর রুমে যাওয়ার পর। হঠাৎ করেই স্কুলে উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল—বক্তৃতা করতে হবে! তখন ঢাকার কাগজে, চট্টগ্রামে আমার ছড়া ছাপা হচ্ছে মাত্র। কিন্তু ভাষণ তো দিতে শিখিনি। উপস্থিত বক্তৃতা তো আরও কঠিন। কিন্তু স্যারের আদেশ। যা মনে এল বলে চলে এলাম।

পরদিন জানলাম আমার জন্য উপহার আছে। আমি প্রথম হয়েছি। সে উপহারের বইটি নিয়ে কিছু বলার আগে একটা কথা বলতে চাই। এখন আমাদের সমাজে হঠাৎ করে শিক্ষকের মানহানি বেড়ে গেছে। যে শিক্ষক মানে গুরু বা অভিভাবক, সেই শিক্ষক এখন নানা ধরনের অত্যাচার আর নির্যাতনের শিকার। আমি এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাই না। কারণ এর পক্ষে-বিপক্ষে কথা আছে। কিন্তু এটা মানতে হবে, এই শিক্ষকেরাই ছিলেন আমাদের গুরু, আমাদের পিতৃতুল্য। এই যে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমাকে হঠাৎ করে উপস্থিত বক্তৃতার জন্য মনোনীত করা, এটা আমার কাছে বিস্ময়ের মনে হয়েছিল। অথচ আজ মধ্য ষাটে দাঁড়িয়ে আমি জানি, আমি বলতে ভালোবাসি। লেখার চেয়েও আমার কথা ভালোবাসেন, এমন মানুষের সংখ্যা বেশি। প্রায় নির্গুণ একজন মানুষকে যে এই গুণটি দিয়ে পাঠানো হয়েছিল, তা আমি হয়তো কোনো দিনও জানতাম না; যা আমাদের শিক্ষক আমার সে বয়সে জানতেন বা বুঝে নিয়েছিলেন।

আমার উপহার পাওয়া বইটি ছিল আহমদ ছফার। সেই বইয়ে লেখা ছিল—বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে দেশ স্বাধীন হতো না, যা বলছেন শুনলে দেশের উন্নতি হবে না। ছফা ভাই এমন কটাক্ষ করলেও তা কিন্তু অসত্য বলা যাবে না। কথাগুলো বললাম এই কারণে যে, আজকাল এত ঘটনা, এত সব অঘটন, অথচ চেনা পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের কোথাও দেখি না। একসময় যাঁরা নিয়মিত লিখতেন, বলতেন, যাঁদের কথা ও বলায় আমরা শক্তি পেতাম, জেগে উঠতাম, আজ তাঁরা থেকেও যেন নেই।

এবার দেশে বিশাল এক পরিবর্তন ঘটে গেছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো সরকারপ্রধান দেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। পলায়ন বা দেশত্যাগে বাধ্য সরকারের আমলে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা জানলেই আপনি বুঝবেন কেন তাঁরা আজ ফুলের জলসায় নীরব। চারদিকে খালি ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ আর ‘জি জি’ বলার ধুম তখন। যাঁরা ‘না’ বলতেন বা বলতে জানতেন, তাঁদের ধীরে ধীরে আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জুলুম হোক, আর নীরব গোপন অপমান যা-ই হোক না কেন, তাঁদের দেখা যেত না। এটা মানি, ভারসাম্য আমাদের সমাজে কখনোই ছিল না। রাজনীতি সেই ভারসাম্য বজায় রাখতে দেয়নি। যে দল দেশ শাসনে, তাদের ভালো বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলতে হবে—এটাই ছিল নিয়ম। এর ভেতর কোনো বাদ-প্রতিবাদ হলেই ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হতো। যে ট্যাগটি লাগাতে তাদের খুব আনন্দ হতো সে ট্যাগটি ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’ নামে ফিরে এসেছিল। যার ফলে পতন হয়ে উঠেছিল অনিবার্য।

এখন সেসব বিবেকহীন বুদ্ধিজীবীর কেউ কেউ নিরাপদ ভূমিতে বসবাস করেও পাথরের মতো নীরব। তাঁদের যেন কোনো আফসোস, দুঃখ বা রাগ নেই। এই যে মহামতি বুদ্ধ বনে যাওয়া—এটাও মুখোশ, এটাও সময়ের জন্য সবুর করা। কারণ, বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে তাঁরা তাই করতেন—কখন ঝোপ বুঝে কোপ মারা যায়। এখন দেখছেন বাতাস কোন দিকে। তা না হলে কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেও তাঁরা দু-চার লাইন লিখতেন

বা বলতেন। মুখে ঝামা, বুকে পাথর—বুদ্ধিজীবীরা আমাদের কোন কাজে লেগেছিলেন? রাজকবি, সভাকবি, সভালেখক, ফরমায়েশি বক্তারা মিলে দেশের কী ভালোটা করেছিলেন? অকারণে খালি ভাগাভাগি করাই ছিল তাঁদের কাজ। সে ভাগের জন্য কেউ পদ-পদবি, কেউ পদক পেতেন। ধন্য ধন্য পড়ে যেত। সামাজিক মিডিয়া ভেসে যেত আনন্দ আর অভিবাদনের বন্যায়। অথচ এদের একটি লেখাও কেউ পড়েনি কোনো দিন। আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই জটিল সময়ে কলকাতা যখন ধর্ষণের বিচার চেয়ে তপ্ত, তখন ওপার বাংলার কত লেখক-সুধীজন তাঁদের পদক ফিরিয়ে দিলেন। আমাদের দেশে কি এমন নজির আছে না দেখেছেন? দু-একজন বিবেকের তাড়নায় তা করলেও বাকিরা তাঁদের ক্রেস্টগুলো ঝোলায় ভরেই কাজের জায়গা বা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। বিশ্বযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের মতো কঠিন সময়েও বুদ্ধিজীবীরা এমন করেননি। করেননি বলেই আমাদের দেশে একটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আছে। গৌরবের মৃত্যুর ভেতর রচিত সেই উপাখ্যানের কি যবনিকা হয়ে গেছে?

যে কথাটি বলতে চাই, আমাদের সমাজে আজ বুদ্ধিজীবীদের প্রয়োজন অনেক বেশি। তাঁরা কথা বললে, লিখলে, সামনে আসলে অনেক বিষয়ে দিকনির্দেশনা পাওয়া যাওয়ার কথা। আমলভেদে একধরনের বুদ্ধিজীবীর চেয়ে আমাদের দরকার দেশপ্রেমিক খাঁটি বুদ্ধিজীবী। যাঁরা সব আমলেই সত্য বলেন। তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। নব্য বুদ্ধিজীবীর কম পড়ে না এ দেশে। গজায়, ডানা ঝাপটায় আবার মরেও যায়। এইসব মৌসুমি নয়, আমাদের চাই চিরপরিচিত হিতৈষী মানুষজন। যাঁদের পঠন-পাঠন আর বিদ্যার কাছে নতজানু হতে পারবে মানুষ। যাঁরা সমাজে শৃঙ্খলা আর নিয়ম ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবেন। যাঁরা আমাদের মুক্তবুদ্ধি ও গণতন্ত্রের পাঠদান করবেন।

প্রধানত তিন ধরনের ব্যক্তিত্বরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজে পরিচিতি পেতে পারেন। বুদ্ধিজীবী একজন ব্যক্তি, যিনি চিন্তা ও কারণকে ব্যবহার করেন। বুদ্ধি এবং সমালোচনা ও বিশ্লেষণাত্মক কারণও তাঁর মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সম্পৃক্ত। পেশাদার অথবা ব্যক্তিগত চাহিদায় যিনি একজন বিশেষজ্ঞ, তিনিই বুদ্ধিজীবী।

প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় বারবার বলেন, তিনি সমালোচনা শুনতে চান। এটা পজিটিভ। এর বিকল্প নেই। যাঁরা শুনতেন না বা স্তুতি পছন্দ করে দেশ শাসন করেন বা করতেন, তাঁদের পরিণাম আমরা দেখেছি। তাঁরা নিজেরা নিরাপদ থাকলেও দেশ বা মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে না। তাই আজ মুখর সাহসী ও জ্ঞানী মানুষের বিকল্প নেই। যাঁরা সত্য বলবেন, পথ দেখাবেন, আধুনিকায়নের পথে টানবেন, কোথায় তাঁরা?

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পারটেক্স এমডি রুবেল আজিজের ১১৬ কোটি টাকার সম্পত্তি নিলামে তুলছে ব্যাংক এশিয়া

গণভবনকে বাস্তিল দুর্গের সঙ্গে তুলনা করলেন ফরাসি রাষ্ট্রদূত

যশোরে কেন্দ্রের ভুলে বিজ্ঞানের ৪৮ জন ফেল, সংশোধনে জিপিএ-৫ পেল সবাই

১০০ গজ দূরেই ক্যাম্প, তবু সোহাগকে বাঁচাতে কেন এল না কেউ—যা বললেন আনসারপ্রধান

উচ্চকক্ষ ‘সিনেটে’ ৭৬ আসনের প্রস্তাব, সদস্য নির্বাচন জনগণের ভোটে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত