বিভুরঞ্জন সরকার
বিবিসি (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন) বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতার এক পরম মানদণ্ড হয়ে উঠেছে। ১৯২২ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা এবং গণস্বার্থে সাংবাদিকতা করার অঙ্গীকারে বিশ্বাস রেখেছে—এমন একটি অবস্থান, যা বিশ্বের অসংখ্য দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে স্বস্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। তবে এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও কনটেন্ট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের নিরপেক্ষতার স্লোগান এক অর্থে সত্য, কিন্তু সব সময় বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার মতো নয়। অনেক সময় কাভারেজের ফোকাস, ভাষা নির্বাচন, প্রেক্ষাপট উপস্থাপন ও অনুপস্থিতি এমন এক ‘সাংবাদিকতা কাঠামো’ তৈরি করে, যা পক্ষপাত নয়; তবে পক্ষের ছায়া হয়ে থাকে। বিবিসি কখন কীভাবে কোন তথ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং কোন অংশটি বাদ দিচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, নিরপেক্ষতা অনেক সময় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও ভূকৌশলনির্ভর জটিল বাস্তবতায় আপেক্ষিক হয়ে ওঠে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অন্যতম অবশ্যপাঠ্য ইরাক যুদ্ধ নিয়ে বিবিসির কাভারেজ। ২০০৩ সালে বিবিসি দাবি করেছিল, ব্রিটিশ সরকার ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার তথ্য ‘sexed up’ করেছে, অর্থাৎ রিপোর্টকে আকর্ষণীয়ভাবে সাজিয়ে যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন তৈরির চেষ্টা করেছে। এই রিপোর্ট একদিকে বিবিসির সাহসী সাংবাদিকতার উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হলেও এর ফলে একজন সরকারি তথ্যদাতা বিজ্ঞানী ড. ডেভিড কেলির আত্মহত্যা এবং বিবিসির দুই শীর্ষ কর্মকর্তার পদত্যাগ একটি তীব্র প্রাতিষ্ঠানিক সংকটের জন্ম দিয়েছিল। ঘটনা প্রমাণ করে যে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে গিয়ে যখন সরকারবিরোধী অবস্থান নিতে হয়, তখন গণমাধ্যমও রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে পড়ে যায়। এই ঘটনার পর অনেকে প্রশ্ন তোলেন, যুদ্ধের ঠিক পূর্বমুহূর্তে কেন বিবিসি আরও গভীর অনুসন্ধান করতে পারেনি? এই ধরনের প্রশ্নগুলো বিবিসির সম্পাদকীয় বিবেচনার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে বিবিসির কাভারেজও আন্তর্জাতিক বিতর্কে পড়েছে। কখনো বিবিসির কাভারেজে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের দুঃখ ও বেদনার চিত্র অগ্রাধিকার পায়নি, আবার কখনো ইসরায়েলি সুরক্ষা বাহিনীর প্রতিক্রিয়াকে ‘আত্মরক্ষা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা যুদ্ধের বাস্তবতা ও আক্রমণাত্মক ভূমিকার মধ্যে পার্থক্য অস্পষ্ট করে ফেলে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনপন্থী সমর্থকেরা বিবিসিকে ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাত দেখানোর অভিযোগ এনেছে, আবার ইসরায়েলপন্থী মহল মনে করেছে, বিবিসি তাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করছে। পক্ষদ্বয়ের সমান অসন্তুষ্টি কারও কারও কাছে বিবিসির নিরপেক্ষতা প্রমাণ মনে হলেও বাস্তবে এটি প্রকাশ করে যে বিবিসির কাভারেজে জটিল ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভাষাগত ভারসাম্য কখনো কখনো হারিয়ে যায়।
ভারত ও কাশ্মীর ইস্যুতেও বিবিসির অবস্থান বহুবার বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছে। ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর বিবিসি কাশ্মীর ঘিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ প্রচার করে, যা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সমালোচনার মুখে পড়ে। সরকারি মহল বিবিসির বিরুদ্ধে একতরফাভাবে ‘অবস্থানগত’ প্রতিবেদন প্রচারের অভিযোগ তোলে। তবে এখানে লক্ষণীয় যে বিবিসি কখনো কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যক্রম বা পাকিস্তানপন্থী সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ে বড় কোনো ধারাবাহিক রিপোর্ট করে না, কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও কাশ্মীরি জনগণের বিভাজিত মতামতকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না। এতে তারা হয়তো নিরাপদ সাংবাদিকতার কৌশল বেছে নেয়, কিন্তু সেই কৌশলই প্রেক্ষাপটহীন প্রতিবেদন তৈরি করে। অর্থাৎ, পক্ষপাত না করেও যে প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর হতে পারে, সেটি এখানে প্রমাণিত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিবিসির ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে এই অঞ্চলের সংবাদ কাভারেজে সক্রিয় ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারের সেন্সরশিপ অতিক্রম করে বিবিসি যখন যুদ্ধ, নিপীড়ন ও শরণার্থী সংকটের খবর প্রচার করছিল, তখন সেটি এক ঐতিহাসিক কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠেছে, প্রথম দিকে কেন বিবিসি ‘গণহত্যা’ শব্দ এড়িয়ে গেছে, কিংবা কেন তারা ‘ইস্ট পাকিস্তান ক্রাইসিস’ বা ‘সিভিল ওয়ার’ শব্দে আটকে থেকেছে? এটি নিশ্চয় পাকিস্তান বা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়ে চলার একটি কৌশল ছিল। তবে এতে সত্যের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি তখনকার আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে পৌঁছায়নি।
বর্তমান সময়ে এসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা কিংবা বিরোধী দলের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিবিসির রিপোর্ট কখনো খুব দ্রুত, কখনো অদ্ভুত ধীরতায় হাজির হয়। বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও সহিংসতার কাভারেজে বিবিসি পুলিশের দমন-পীড়ন ও বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশ করেছে। এটি নিশ্চয় সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্বের আওতায় পড়ে। কিন্তু একই সময়ে যারা পিকেটিং, বাসে আগুন, রেললাইন কাটা ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলার মতো অপরাধ করেছে, সেই বিরোধীপন্থী সহিংসতা অনেক ক্ষেত্রে একেবারে প্রান্তিকভাবে বা একপক্ষীয়ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এতে কাহিনির ভারসাম্য হারায়। অনেক পাঠক বা গবেষক দেখেছেন, প্রতিবেদনের শিরোনাম এবং কাঠামো তৈরি হয় নির্দিষ্ট বার্তা পাঠানোর জন্য, যদিও তা সব সময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ‘Police crackdown on opposition protest’ শিরোনাম ব্যবহার করলেও ‘Protesters torch public transport killing driver’—এই অংশ কেবল উপশিরোনাম বা রিপোর্টের শেষাংশে ঠাঁই পায়। এতে সংবাদ পাঠকের কাছে নিরপেক্ষ চিত্র না দিয়ে একটি কৌশলী ফ্রেম তৈরি করে দেয়।
বাংলাদেশ-সংক্রান্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি নিয়ে বিবিসি অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন করে, বিশেষ করে নারী অধিকার, শ্রমিক আন্দোলন কিংবা জলবায়ু সংকট নিয়ে। তবে এই রিপোর্টগুলো বিবিসি বাংলা প্ল্যাটফর্মে থাকলেও আন্তর্জাতিক (ইংরেজি) মাধ্যমগুলোতে সেগুলোর গুরুত্ব কম দেখা যায়। এতে বাংলাদেশের ইতিবাচক রূপান্তরের চিত্র আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছায় না। একে পক্ষপাত বলা যাবে না, কিন্তু এটিও কাভারেজের ভারসাম্যের প্রশ্ন তোলে।
সার্বিকভাবে বিবিসি কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে একপেশে বা পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রচার করে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু সাংবাদিকতা কেবল সত্য প্রকাশ নয়, সত্যকে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সেই দৃষ্টিকোণও গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদ পরিবেশনের ভাষা, কাভারেজের সময় নির্বাচন, সূত্রের বৈচিত্র্য এবং প্রতিবেদন কাঠামোর প্যাটার্ন—এসবই নির্ধারণ করে কোন সত্যটি বড় হয়ে উঠছে, কোন সত্যটি আড়ালে যাচ্ছে। বিবিসি তার অভ্যন্তরীণ নীতিমালায় নিরপেক্ষতা ও ভারসাম্যের অঙ্গীকার করলেও বাস্তব প্রেক্ষাপটে তা এক ঘণ্টায়, এক মিনিটে বা এক অনুচ্ছেদে পুরোপুরি প্রকাশ পায় না। ফলে পাঠক বা দর্শককে নির্ভর করতে হয় সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপট বোঝার দক্ষতার ওপর এবং এটাই বিবিসির মতো বিশ্ব গণমাধ্যমের পাঠকের ওপর রাখা সর্বাধিক বোঝা।
এই বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কোনো মিডিয়া, যত প্রভাবশালী বা ঐতিহাসিক হোক না কেন, তাদের প্রতিবেদনও প্রেক্ষাপটনির্ভর, কাঠামোনির্ভর এবং সর্বোপরি, ভাষাগত প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে পাঠকের মধ্যে নির্দিষ্ট একটি প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। একে প্রশ্ন করা মানে নিরপেক্ষতাকে প্রশ্ন করা নয়, বরং সাংবাদিকতার কাঠামোকে আরও পরিশীলিত করার আহ্বান। বিবিসির শক্তি তার ইতিহাস ও পরিসরের মধ্যে নিহিত, তবে তার সীমাবদ্ধতা বোঝাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে যেসব দেশ এখনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিবরণকে কেন্দ্র করে নিজেদের চিত্র নির্মাণ করে চলে।
বিবিসি (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন) বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকতার এক পরম মানদণ্ড হয়ে উঠেছে। ১৯২২ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা এবং গণস্বার্থে সাংবাদিকতা করার অঙ্গীকারে বিশ্বাস রেখেছে—এমন একটি অবস্থান, যা বিশ্বের অসংখ্য দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে স্বস্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। তবে এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও কনটেন্ট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাদের নিরপেক্ষতার স্লোগান এক অর্থে সত্য, কিন্তু সব সময় বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার মতো নয়। অনেক সময় কাভারেজের ফোকাস, ভাষা নির্বাচন, প্রেক্ষাপট উপস্থাপন ও অনুপস্থিতি এমন এক ‘সাংবাদিকতা কাঠামো’ তৈরি করে, যা পক্ষপাত নয়; তবে পক্ষের ছায়া হয়ে থাকে। বিবিসি কখন কীভাবে কোন তথ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং কোন অংশটি বাদ দিচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, নিরপেক্ষতা অনেক সময় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও ভূকৌশলনির্ভর জটিল বাস্তবতায় আপেক্ষিক হয়ে ওঠে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অন্যতম অবশ্যপাঠ্য ইরাক যুদ্ধ নিয়ে বিবিসির কাভারেজ। ২০০৩ সালে বিবিসি দাবি করেছিল, ব্রিটিশ সরকার ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার তথ্য ‘sexed up’ করেছে, অর্থাৎ রিপোর্টকে আকর্ষণীয়ভাবে সাজিয়ে যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন তৈরির চেষ্টা করেছে। এই রিপোর্ট একদিকে বিবিসির সাহসী সাংবাদিকতার উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হলেও এর ফলে একজন সরকারি তথ্যদাতা বিজ্ঞানী ড. ডেভিড কেলির আত্মহত্যা এবং বিবিসির দুই শীর্ষ কর্মকর্তার পদত্যাগ একটি তীব্র প্রাতিষ্ঠানিক সংকটের জন্ম দিয়েছিল। ঘটনা প্রমাণ করে যে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে গিয়ে যখন সরকারবিরোধী অবস্থান নিতে হয়, তখন গণমাধ্যমও রাজনীতির ঘূর্ণিপাকে পড়ে যায়। এই ঘটনার পর অনেকে প্রশ্ন তোলেন, যুদ্ধের ঠিক পূর্বমুহূর্তে কেন বিবিসি আরও গভীর অনুসন্ধান করতে পারেনি? এই ধরনের প্রশ্নগুলো বিবিসির সম্পাদকীয় বিবেচনার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে বিবিসির কাভারেজও আন্তর্জাতিক বিতর্কে পড়েছে। কখনো বিবিসির কাভারেজে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের দুঃখ ও বেদনার চিত্র অগ্রাধিকার পায়নি, আবার কখনো ইসরায়েলি সুরক্ষা বাহিনীর প্রতিক্রিয়াকে ‘আত্মরক্ষা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা যুদ্ধের বাস্তবতা ও আক্রমণাত্মক ভূমিকার মধ্যে পার্থক্য অস্পষ্ট করে ফেলে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনপন্থী সমর্থকেরা বিবিসিকে ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাত দেখানোর অভিযোগ এনেছে, আবার ইসরায়েলপন্থী মহল মনে করেছে, বিবিসি তাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করছে। পক্ষদ্বয়ের সমান অসন্তুষ্টি কারও কারও কাছে বিবিসির নিরপেক্ষতা প্রমাণ মনে হলেও বাস্তবে এটি প্রকাশ করে যে বিবিসির কাভারেজে জটিল ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভাষাগত ভারসাম্য কখনো কখনো হারিয়ে যায়।
ভারত ও কাশ্মীর ইস্যুতেও বিবিসির অবস্থান বহুবার বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছে। ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর বিবিসি কাশ্মীর ঘিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ প্রচার করে, যা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সমালোচনার মুখে পড়ে। সরকারি মহল বিবিসির বিরুদ্ধে একতরফাভাবে ‘অবস্থানগত’ প্রতিবেদন প্রচারের অভিযোগ তোলে। তবে এখানে লক্ষণীয় যে বিবিসি কখনো কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যক্রম বা পাকিস্তানপন্থী সন্ত্রাসী তৎপরতা নিয়ে বড় কোনো ধারাবাহিক রিপোর্ট করে না, কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও কাশ্মীরি জনগণের বিভাজিত মতামতকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না। এতে তারা হয়তো নিরাপদ সাংবাদিকতার কৌশল বেছে নেয়, কিন্তু সেই কৌশলই প্রেক্ষাপটহীন প্রতিবেদন তৈরি করে। অর্থাৎ, পক্ষপাত না করেও যে প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর হতে পারে, সেটি এখানে প্রমাণিত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিবিসির ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে এই অঞ্চলের সংবাদ কাভারেজে সক্রিয় ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারের সেন্সরশিপ অতিক্রম করে বিবিসি যখন যুদ্ধ, নিপীড়ন ও শরণার্থী সংকটের খবর প্রচার করছিল, তখন সেটি এক ঐতিহাসিক কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন উঠেছে, প্রথম দিকে কেন বিবিসি ‘গণহত্যা’ শব্দ এড়িয়ে গেছে, কিংবা কেন তারা ‘ইস্ট পাকিস্তান ক্রাইসিস’ বা ‘সিভিল ওয়ার’ শব্দে আটকে থেকেছে? এটি নিশ্চয় পাকিস্তান বা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়ে চলার একটি কৌশল ছিল। তবে এতে সত্যের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি তখনকার আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে পৌঁছায়নি।
বর্তমান সময়ে এসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা কিংবা বিরোধী দলের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিবিসির রিপোর্ট কখনো খুব দ্রুত, কখনো অদ্ভুত ধীরতায় হাজির হয়। বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও সহিংসতার কাভারেজে বিবিসি পুলিশের দমন-পীড়ন ও বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশ করেছে। এটি নিশ্চয় সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্বের আওতায় পড়ে। কিন্তু একই সময়ে যারা পিকেটিং, বাসে আগুন, রেললাইন কাটা ও সাধারণ মানুষের ওপর হামলার মতো অপরাধ করেছে, সেই বিরোধীপন্থী সহিংসতা অনেক ক্ষেত্রে একেবারে প্রান্তিকভাবে বা একপক্ষীয়ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এতে কাহিনির ভারসাম্য হারায়। অনেক পাঠক বা গবেষক দেখেছেন, প্রতিবেদনের শিরোনাম এবং কাঠামো তৈরি হয় নির্দিষ্ট বার্তা পাঠানোর জন্য, যদিও তা সব সময় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ‘Police crackdown on opposition protest’ শিরোনাম ব্যবহার করলেও ‘Protesters torch public transport killing driver’—এই অংশ কেবল উপশিরোনাম বা রিপোর্টের শেষাংশে ঠাঁই পায়। এতে সংবাদ পাঠকের কাছে নিরপেক্ষ চিত্র না দিয়ে একটি কৌশলী ফ্রেম তৈরি করে দেয়।
বাংলাদেশ-সংক্রান্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি নিয়ে বিবিসি অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন করে, বিশেষ করে নারী অধিকার, শ্রমিক আন্দোলন কিংবা জলবায়ু সংকট নিয়ে। তবে এই রিপোর্টগুলো বিবিসি বাংলা প্ল্যাটফর্মে থাকলেও আন্তর্জাতিক (ইংরেজি) মাধ্যমগুলোতে সেগুলোর গুরুত্ব কম দেখা যায়। এতে বাংলাদেশের ইতিবাচক রূপান্তরের চিত্র আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছায় না। একে পক্ষপাত বলা যাবে না, কিন্তু এটিও কাভারেজের ভারসাম্যের প্রশ্ন তোলে।
সার্বিকভাবে বিবিসি কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে একপেশে বা পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ প্রচার করে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু সাংবাদিকতা কেবল সত্য প্রকাশ নয়, সত্যকে কীভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সেই দৃষ্টিকোণও গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদ পরিবেশনের ভাষা, কাভারেজের সময় নির্বাচন, সূত্রের বৈচিত্র্য এবং প্রতিবেদন কাঠামোর প্যাটার্ন—এসবই নির্ধারণ করে কোন সত্যটি বড় হয়ে উঠছে, কোন সত্যটি আড়ালে যাচ্ছে। বিবিসি তার অভ্যন্তরীণ নীতিমালায় নিরপেক্ষতা ও ভারসাম্যের অঙ্গীকার করলেও বাস্তব প্রেক্ষাপটে তা এক ঘণ্টায়, এক মিনিটে বা এক অনুচ্ছেদে পুরোপুরি প্রকাশ পায় না। ফলে পাঠক বা দর্শককে নির্ভর করতে হয় সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপট বোঝার দক্ষতার ওপর এবং এটাই বিবিসির মতো বিশ্ব গণমাধ্যমের পাঠকের ওপর রাখা সর্বাধিক বোঝা।
এই বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কোনো মিডিয়া, যত প্রভাবশালী বা ঐতিহাসিক হোক না কেন, তাদের প্রতিবেদনও প্রেক্ষাপটনির্ভর, কাঠামোনির্ভর এবং সর্বোপরি, ভাষাগত প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে পাঠকের মধ্যে নির্দিষ্ট একটি প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। একে প্রশ্ন করা মানে নিরপেক্ষতাকে প্রশ্ন করা নয়, বরং সাংবাদিকতার কাঠামোকে আরও পরিশীলিত করার আহ্বান। বিবিসির শক্তি তার ইতিহাস ও পরিসরের মধ্যে নিহিত, তবে তার সীমাবদ্ধতা বোঝাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ; বিশেষ করে যেসব দেশ এখনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিবরণকে কেন্দ্র করে নিজেদের চিত্র নির্মাণ করে চলে।
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
২০ ঘণ্টা আগে২০২৫-এর এসএসসি পরীক্ষার ফল বের হলো ১০ জুলাই। এবার বিগত প্রায় ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল হলো। সব বোর্ডের গড় পাসের হার ৬৮.৪৫, যা অতীতের অনেক বছরের চেয়ে সর্বনিম্ন। মোট অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬ লাখের বেশি। ভাবা যায়! শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। সারা দেশে..
২০ ঘণ্টা আগেসাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী একের পর এক সহিংস ও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ায় রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, দলটি কি নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, নাকি কোনো বিশেষ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নানা দুষ্কর্মের সঙ্গে বিএনপিকে জড়িয়ে বদনামের ভাগিদার করা হচ্ছে? মাঠপর্যায়ে শৃঙ্খলার অভাব, অপরাধের প্রতি...
২০ ঘণ্টা আগেরাজনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের সেবা, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান এবং সমাজে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার অনুশীলন নিশ্চিত করা। কিন্তু বাংলাদেশে দিনের পর দিন রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু অংশ যখন অপরাধ ও সহিংসতার আশ্রয় নেয়, তখন সেই রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা, নৈতিকতা ও কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়ে।
১ দিন আগে