Ajker Patrika

রাজনীতির রক্তাক্ত ছায়া এবং বিএনপির চ্যালেঞ্জ

আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৫, ০০: ৫৮
রাজনীতির রক্তাক্ত ছায়া এবং বিএনপির চ্যালেঞ্জ

রাজনীতির লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের সেবা, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান এবং সমাজে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার অনুশীলন নিশ্চিত করা। কিন্তু বাংলাদেশে দিনের পর দিন রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু অংশ যখন অপরাধ ও সহিংসতার আশ্রয় নেয়, তখন সেই রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা, নৈতিকতা ও কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। ৯ জুলাই মিটফোর্ড এলাকায় প্রকাশ্যে ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সোহাগকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে তীব্র আলোড়ন তুলেছে। এই নৃশংসতা শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়, বরং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। ঘটনাটি রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল; কারণ, এতে অভিযুক্তরা সবাই এককালের বা বর্তমানের বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী।

মিটফোর্ডের ঘটনাটি বিএনপির জন্য একটি বড় রাজনৈতিক ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। দলটি এরই মধ্যে ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে, জড়িতদের বহিষ্কার করেছে এবং স্পষ্ট করে বলেছে যে এ ধরনের বর্বরতাকে তারা প্রশ্রয় দেয় না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সত্যি সত্যি বিএনপির কতটা নিয়ন্ত্রণ আছে অঙ্গসংগঠনগুলোর ওপর। যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল বা ছাত্রদল—এই তিন সংগঠন বারবার সহিংসতার, দখলবাজির এবং অস্ত্রের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছে। বিএনপি বরাবরই দাবি করে আসছে, তারা গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের পক্ষে, কিন্তু এ ধরনের ঘটনা তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।

মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যাকাণ্ডের যে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে দেখা যায়, ইট দিয়ে মারা হচ্ছে, রক্তাক্ত দেহ টেনে-হিঁচড়ে ফেলা হচ্ছে, বুকের ওপর লাফিয়ে মারা হচ্ছে—এ দৃশ্য কেবল বর্বর নয়, এটি রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব—তিনটিরই ব্যর্থতার প্রতীক। যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তারা কেউ অপরিচিত নয়। তারা সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী, এলাকায় পরিচিত এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের বলয়েই সাহসী হয়ে উঠেছে। এ থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধীরা কেবল বেঁচে থাকে না, বরং সাহস পায়, রীতিমতো এলাকায় আধিপত্য কায়েম করে।

বিএনপি বলেছে, তারা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছে। কয়েকজনকে দল থেকে বহিষ্কার করে সেটির প্রমাণ দিতে চেয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে ভালো একটি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো, এই ব্যক্তিরা যখন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছিলেন, তখন দল কোথায় ছিল। একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব ছিল, তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোতে রাজনৈতিক শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলা, জনসম্পৃক্ত, গণতান্ত্রিক ও নৈতিক নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে অঙ্গসংগঠনের মাধ্যমে মূল সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের সময়েও ছাত্রদল ও যুবদলের বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রচুর অভিযোগ উঠেছিল। এখন যখন ক্ষমতার বাইরে বিএনপি, তখনো এমন ঘটনা ঘটছে—এটি বোঝায়, শুধু ক্ষমতা নয়, বরং রাজনীতির ভেতরে একধরনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ ও আদর্শিক প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে।

বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, তারা একটি গণতান্ত্রিক এবং বিকল্প শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে রাজনীতি করছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তারা যে একনায়কতন্ত্র, দমনপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে, তা অনেকাংশে সত্য এবং বাস্তবতা থেকেও উঠে আসে। কিন্তু একই সঙ্গে বিএনপিকে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের নৈতিক ও সাংগঠনিক জায়গাগুলোতে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে হবে।

বর্তমান সময়ে বিএনপির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো—নিজেদের শুদ্ধীকরণ, সংগঠনের ভিত্তিকে আদর্শিক শক্তি দিয়ে পুনর্গঠন এবং নেতৃত্বে এমন ব্যক্তিদের আনা, যাঁরা জনমানুষের আস্থা পাবে। বিএনপি যদি বারবার সংঘবদ্ধ অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলে, তবে রাজনৈতিক লড়াইয়ে তারা সত্যিই দুর্বল হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক বিরোধীরা তখন সহজে বলার সুযোগ পায়, যে বিএনপি সন্ত্রাসের দল, মাফিয়ার আশ্রয়স্থল। এত দিন এই ধরনের রাজনৈতিক প্রচার হয়তো সরকারি প্রোপাগান্ডা হিসেবে ধরা হতো, কিন্তু মিটফোর্ডের ভিডিও প্রকাশের পর সেটি বাস্তবতাও হয়ে উঠছে।

যে সময়টিতে বাংলাদেশ একটি নতুন রাজনৈতিক সংলাপ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং দ্বন্দ্বহীন নির্বাচনের জন্য পথ খুঁজছে, সেই সময় বিএনপির অভ্যন্তরে এমন ধরনের সহিংসতা তাদের জন্য আত্মঘাতী। দেশের মানুষ রাজনীতি চায়, কিন্তু খুনোখুনির রাজনীতি নয়। রাজনীতি যদি জীবিকা ও সমাজসেবার বদলে প্রতিপত্তির অস্ত্র হয়ে ওঠে, তবে সেটি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেয়। বিএনপির উচিত এখনই একটি শক্ত বার্তা দেওয়া যে তাদের সংগঠন ও নেতৃত্ব মানবিকতা, ন্যায্যতা এবং জবাবদিহির আদর্শে চলবে। শুধু বহিষ্কার করলেই চলবে না, বরং এই ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে স্থায়ী এবং কাঠামোগত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

একটি দলে কেউ অপরাধ করলে পুরো দল দোষী নয়, এ কথা সত্য। কিন্তু যখন দলীয় পরিচয়ে অপরাধীরা অপরাধ করে, তখন দলের দায় তৈরি হয়, দলীয় সংস্কৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিএনপির উচিত এখন এমন এক সাংগঠনিক সংস্কারপ্রক্রিয়া শুরু করা, যা কেন্দ্র থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে যাবে। প্রত্যেক নেতা-কর্মীর রাজনৈতিক আচরণ, অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।

এ ছাড়া বিএনপির নৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ফেরাতে দলের নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তনও দরকার। দীর্ঘদিন একই মুখ, একই ধারা এবং একই ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল ভাষ্য বিএনপিকে সাধারণ মানুষের সামনে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে না। জনগণ এমন একটি বিএনপি দেখতে চায়, যেটি তাদের অধিকার রক্ষায় নেতৃত্ব দেবে, কিন্তু নিজ দলের মধ্যেই অপরাধীদের আশ্রয় দেবে না।

এ মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে বিএনপির জন্য বড় সুযোগও রয়েছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী যে জনভিত্তি তৈরি হয়েছে, তা সংগঠিত করার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য ও সুসংগঠিত বিএনপির প্রয়োজন। মিটফোর্ডের ঘটনার মতো বর্বরতা এই জনভিত্তিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। মানুষ পরিবর্তন চায়, কিন্তু কেউই অপরাধী নেতৃত্বকে বিকল্প হিসেবে মেনে নিতে রাজি নয়। কাজেই বিএনপিকে এই অবস্থানে নিজেদের ভিন্ন প্রমাণ করতে হলে দায়িত্বশীলতা, মানবিকতা ও সংগঠনের গভীর সংস্কার ছাড়া বিকল্প নেই।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতি দিয়ে সোহাগ হত্যাকাণ্ডকে আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা এবং সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা এক অর্থে সত্য। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বিএনপি যদি সত্যিই গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে চায়, তাহলে নিজেদের ভেতরের রাজনীতিকে অপরাধ ও সহিংসতা থেকে মুক্ত করতেই হবে।

মিটফোর্ডের ঘটনা শুধুই বিচ্ছিন্ন হত্যা নয়; এটি একটি রাজনৈতিক বাস্তবতার গভীর সংকেত। যারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত, তারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির ছায়ায় অপরাধমূলক আচরণ করে এসেছে।

আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, দলীয় পরিচয়ে অপরাধের আশ্রয় নেওয়া এবং দলীয় দোহাই দিয়ে বিচারহীনতা উপভোগ করা। এটি শুধু বিএনপি নয়, সব দলের ক্ষেত্রে ঘটেছে। কিন্তু কেউ যদি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের ভাষ্যপট পরিবর্তন করতে চায়, তবে নিজেদের মধ্য থেকেই শুরু করতে হবে। বিএনপির এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় কাজ হওয়া উচিত—অভ্যন্তরীণ সংস্কার, নৈতিক নেতৃত্ব গঠন এবং অঙ্গসংগঠনের ভিত আদর্শ দিয়ে নির্মাণ করা।

রাজনীতিতে অপরাধীদের স্থান নেই—এই মন্ত্র কেবল মুখে বললে হবে না, তা প্রমাণ করতে হবে প্রতিটি পদক্ষেপে। যদি বিএনপি এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারে, তাহলে তারা শুধু ক্ষমতার পালাবদলের নয়, বরং রাজনীতির সংস্কারক শক্তি হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারবে। অন্যথায়, তারা হয়তো সরকারের দমনপীড়নের শিকার হবে, আবার তাদের নিজেদের কর্মীর হিংস্রতা ও অপরাধের বলিও হবে।

এখন সময়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার। রাজনীতি কি হবে নৈতিক নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠান, নাকি ব্যক্তিস্বার্থ ও অপরাধীর নিরাপদ আশ্রয়—বিএনপির সামনে এই প্রশ্ন এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে, কেবল কথায় নয়, কাজে প্রমাণ রেখে। সমাজ, গণতন্ত্র ও ভবিষ্যতের রাজনীতি তার জন্য অপেক্ষা করছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যা মামলার আসামি দুই ভাই নেত্রকোনায় গ্রেপ্তার

‘নৌকা আউট, শাপলা ইন’, সিইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে এনসিপির চাওয়া

পারটেক্স এমডি রুবেল আজিজের ১১৬ কোটি টাকার সম্পত্তি নিলামে তুলছে ব্যাংক এশিয়া

জরুরি অবস্থা ঘোষণায় লাগবে মন্ত্রিসভার অনুমোদন, প্রস্তাবে একমত রাজনৈতিক দলগুলো

যশোরে কেন্দ্রের ভুলে বিজ্ঞানের ৪৮ জন ফেল, সংশোধনে জিপিএ-৫ পেল সবাই

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত