
সামিনা লুৎফা নিত্রা জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ‘বটতলা’ নাট্য দলের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের অর্জন-ব্যর্থতা এবং রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।

সামিনা লুৎফা নিত্রা জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ‘বটতলা’ নাট্য দলের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের অর্জন-ব্যর্থতা এবং রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।

ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগে
ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে।
৫ ঘণ্টা আগে
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে।
৫ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১ দিন আগে
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গবেষণামূলক বই ‘নারী সত্তার অন্বেষণে’। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে একটি মহলের বিতর্কিত কথাবার্তা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটাক্ষ করছেন কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি মূল ধারার গণমাধ্যমেও তাঁদের এই কীর্তি করতে দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
প্রথমত, কারা এরা—সেই প্রশ্নটা জরুরি আমাদের জন্য। কারণ আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যেখানে আসলে ওই অর্থে অথরিটি বা বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরানা নেই, যেখান থেকে ভাবনা উৎপাদন হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দুর্বল হওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রটিও দুর্বল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই সুযোগে কিছু মানুষ তাঁদের নিজস্ব চিন্তা এবং যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ উৎপাদন করতে চান, তাঁরা সেই সুযোগের একধরনের সদ্ব্যবহার করছেন।
দ্বিতীয়ত, সাধারণত কোনো দেশের জন্ম হওয়ার পর সে দেশের নাগরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের লোকজনের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি থাকা লাগে। মানে নিজ দেশের, নিজ স্বাধীনতার এবং যুদ্ধ বা বিদ্রোহকে ধারণ করতে পারা। দুঃখজনক হলো, বিজয়ের এত বছর পার হওয়ার পরেও ব্যক্তি-দল-মত-পথ-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে আমাদের নিজেদের যে বিজয়ের ইতিহাস এবং নিজের অর্জনের ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নানা সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষ করার যে স্পর্ধা, সেটাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে অথবা ক্ষমতার অদল-বদলে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেই প্রশ্রয়েরই একটা দানবীয় রূপ ৫৪ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস এবং স্পর্ধা দেখাতে পারছে।
কিছু মীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এর পেছনে কোনো গূঢ় রহস্য আছে বলে মনে করেন কি?
এতে কোনো গূঢ় রহস্য নেই। তবে এটা একটা ঐতিহাসিক প্রকল্পের অংশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ হয়ে ওঠার গল্পটা এ দেশীয় নয়। ১৯৭১ সালের আগে থেকে একটা বিশেষ মহল একটা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানিদের ইতিহাসের বইপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেখানকার বক্তব্য কিন্তু একই ছিল। এখন তারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, আগেও তারা সেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে একাত্তরের সময় প্রতিবেশী যে দেশটি আমাদের সহযোগিতা করেছে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাদের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। এই উভয় পক্ষের প্রতি আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল প্রভাবিত। আবার ২০২৪-এর এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার পরেও তাদের অনেকের উদ্দেশ্য কিন্তু এখনো পাকিস্তানপন্থীদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা।
গত সরকারের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ তোলা যায়, তারা ভারতীয়দের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে, একইভাবে বর্তমান যাদের অধীনে আমরা শাসিত হচ্ছি, তারাও বীরদর্পে তাদের (বিগত সরকারের) অনুসরণে পাকিস্তানিদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠায় তৎপর।
এই সময়ে যে বা যারা এ ধরনের ন্যারেটিভ উৎপাদন করছে, তাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি। কারণ, আমাদের দেশটির একটা ইতিহাস আছে, সেটাই আমাদের শিকড়। এখন কেউ যদি শিকড় উৎপাটন করার চেষ্টা করে, সেটা গূঢ় রহস্য না, সেটা হলো একটা ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। মূলত বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির নিমিত্তে ও অবাধ ক্ষমতাচর্চার লক্ষ্যে মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে তারা বারবার বিতর্ক তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিতর্ক তৈরি করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, যাতে করে আমরা তাদের নিয়ে কথা বলি এবং আমাদের যা করণীয়, সে বিষয়গুলোতে মনোযোগ না দিই।
মুক্তিযুদ্ধের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। কিন্তু সেই ইতিহাসকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। সরকার এ ব্যাপারে কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না?
যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তো অন্তত একটা সতর্কবার্তা দেওয়ার দরকার ছিল এ সরকারের পক্ষ থেকে। কারণ, এ মাসটা হলো বিজয়ের। সেটুকুও কিন্তু করা হয়নি। মূল কারণ আমরা মোটামুটি সবাই বুঝতে পারি। কারণ, এই সরকারের সঙ্গে যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিশ্বাস করেন—এমন লোকজন যেমন আছেন, তেমনি যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতার অর্জনকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চান না, সে রকম লোকজনও (সম্ভবত) খুব শক্তিশালীভাবে আছেন। সে কারণে সরকার এ ধরনের বিষয়ে একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
তাঁদের এত আস্ফালনের পরেও কি আপনি মনে করেন তাঁরা সফল হতে পারবেন?
একাত্তর সালের আগে থেকেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসীম শক্তি আছে। আসলে একাত্তর সালের যুদ্ধটা ছিল গণমানুষের। এ দেশটা যখনই অন্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তখনই কিন্তু গণমানুষ বীরদর্পে প্রাণ দিয়ে দেশকে রক্ষার শপথ নিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। কাজেই এখন আস্ফালনটা দেখা যাচ্ছে এ কারণে যে বর্তমানে এখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার নেই। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পঙ্গু। আবার আমরা একটা অসময়ের মধ্যে আছি। এই অসময়েই কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রু-মিত্র, মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়। অন্ধকার সময়ে চেনা যায়, এ দেশকে কারা ধারণ করে এবং কারা এ দেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
আমি তো মনে করি, এই আস্ফালন আমাদের একটা যুগান্তকারী সুযোগ করে দিয়েছে। তার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি কারা বাংলাদেশের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে। এবং কারা আমাদের স্বাধীনতার অর্জনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে।
এই চেনার সুযোগটা আমাদের জন্য মন্দের ভালো বলা যেতে পারে। তবে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না, তারা জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশের জন্মের সংগ্রামের ইতিহাস, লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতার অর্জন—সেই আস্থা ও বিশ্বাস যতক্ষণ এ দেশের মানুষের মনে গেঁথে থাকবে, যতক্ষণ এ দেশের মানুষ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে; তার যদি গুটিকয়েকও হয়, তাহলেও আমি মনে করি, এই অপশক্তি অবশ্যই পরাজিত হবে। এই মুক্তিযুদ্ধকে যদি কোনো রাজনৈতিক দল তার নিজের বলে দাবি করে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবে, এটা কোনো একক দলের অর্জন না। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধকে যদি কেউ শুধু প্রতিরোধযুদ্ধ বা যুদ্ধটা সেভাবে আমাদের যুদ্ধ ছিল না—এ রকম বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাহলে সে বয়ানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ কড়ায়-গন্ডায় উপযুক্ত শিক্ষা দিতে প্রস্তুত বলে আমি বিশ্বাস করি।
আগামী জাতীয় নির্বাচন ইনক্লুসিভ এবং ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করতে পারি কি?
ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। আমরা আর কোনোভাবেই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের মতো অগণতান্ত্রিক কোনো নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা করি না। আমি মনে করি, এ দেশের মানুষের যথেষ্ট পরিমাণ বিবেক-বিবেচনা বোধ আছে। তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন যে কাকে নির্বাচিত করবেন আর কাকে করবেন না।
সে ক্ষেত্রে যদি অযাচিতভাবে আইনের অনুসরণ না করে অথবা ক্ষমতাবলে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব না, সেটা আর যা-ই হোক ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে না। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, যিনি বা যাঁরা জুলাই এবং একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁরা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করেন এবং সর্বোপরি অন্য কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে শুধু বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের সবাইকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই ভোল পাল্টে ফেলে। নতুনভাবে নির্বাচিত কোন সরকারের সে রকম হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?
এটা নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনটা কীভাবে হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে যদি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয় অর্থাৎ যেখানে জনগণের মতামতের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে, তাহলে ভয়াবহতার শঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও রাখার কোনো মানে দাঁড়ায় না।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রার্থীরা যেভাবে প্রচার-প্রচারণা করে নানা ধরনের অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছেন, তাতে যৌক্তিকভাবে সেসব দেওয়ার সুযোগ নেই। এতে প্রমাণ হয় যে তাঁরা আসলে নির্বাচনের জন্যই প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছেন। কোনো প্রার্থী এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন যেমন আমরা সবাই জানি, একটা শিশু জন্ম নিচ্ছে ঋণের বোঝা নিয়ে। সেখানে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এগুলো সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রতিশ্রুতি। এভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি তাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা তো সেসব রাখতে পারবেন না। তাঁরা মূলত প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য তা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়াটাই হলো তাঁদের মূল লক্ষ্য।
জুলাই আন্দোলনের পরেও আমরা যদি এসব থেকে বের হতে না পারি, তাহলে তো সমস্যা থেকে যাবে। ক্ষমতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ দেশকে সেবামূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা। আমি ক্ষমতায় যাব এ জন্য না যে আমার পেশি বা প্রশাসনিক শক্তি আছে। আমি ক্ষমতায় যাব এ কারণে যে জনগণ যেন বিশ্বাস করেন আমি তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারব।
যখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ জায়গায় চিন্তা করতে শুরু করবে, তখন একটা পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না এবং দেখাও যাচ্ছে না।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।
বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটাক্ষ করছেন কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি মূল ধারার গণমাধ্যমেও তাঁদের এই কীর্তি করতে দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
প্রথমত, কারা এরা—সেই প্রশ্নটা জরুরি আমাদের জন্য। কারণ আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যেখানে আসলে ওই অর্থে অথরিটি বা বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরানা নেই, যেখান থেকে ভাবনা উৎপাদন হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দুর্বল হওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রটিও দুর্বল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই সুযোগে কিছু মানুষ তাঁদের নিজস্ব চিন্তা এবং যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ উৎপাদন করতে চান, তাঁরা সেই সুযোগের একধরনের সদ্ব্যবহার করছেন।
দ্বিতীয়ত, সাধারণত কোনো দেশের জন্ম হওয়ার পর সে দেশের নাগরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের লোকজনের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি থাকা লাগে। মানে নিজ দেশের, নিজ স্বাধীনতার এবং যুদ্ধ বা বিদ্রোহকে ধারণ করতে পারা। দুঃখজনক হলো, বিজয়ের এত বছর পার হওয়ার পরেও ব্যক্তি-দল-মত-পথ-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে আমাদের নিজেদের যে বিজয়ের ইতিহাস এবং নিজের অর্জনের ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নানা সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষ করার যে স্পর্ধা, সেটাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে অথবা ক্ষমতার অদল-বদলে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেই প্রশ্রয়েরই একটা দানবীয় রূপ ৫৪ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস এবং স্পর্ধা দেখাতে পারছে।
কিছু মীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এর পেছনে কোনো গূঢ় রহস্য আছে বলে মনে করেন কি?
এতে কোনো গূঢ় রহস্য নেই। তবে এটা একটা ঐতিহাসিক প্রকল্পের অংশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ হয়ে ওঠার গল্পটা এ দেশীয় নয়। ১৯৭১ সালের আগে থেকে একটা বিশেষ মহল একটা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানিদের ইতিহাসের বইপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেখানকার বক্তব্য কিন্তু একই ছিল। এখন তারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, আগেও তারা সেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে একাত্তরের সময় প্রতিবেশী যে দেশটি আমাদের সহযোগিতা করেছে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাদের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। এই উভয় পক্ষের প্রতি আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল প্রভাবিত। আবার ২০২৪-এর এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার পরেও তাদের অনেকের উদ্দেশ্য কিন্তু এখনো পাকিস্তানপন্থীদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা।
গত সরকারের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ তোলা যায়, তারা ভারতীয়দের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে, একইভাবে বর্তমান যাদের অধীনে আমরা শাসিত হচ্ছি, তারাও বীরদর্পে তাদের (বিগত সরকারের) অনুসরণে পাকিস্তানিদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠায় তৎপর।
এই সময়ে যে বা যারা এ ধরনের ন্যারেটিভ উৎপাদন করছে, তাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি। কারণ, আমাদের দেশটির একটা ইতিহাস আছে, সেটাই আমাদের শিকড়। এখন কেউ যদি শিকড় উৎপাটন করার চেষ্টা করে, সেটা গূঢ় রহস্য না, সেটা হলো একটা ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। মূলত বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির নিমিত্তে ও অবাধ ক্ষমতাচর্চার লক্ষ্যে মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে তারা বারবার বিতর্ক তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিতর্ক তৈরি করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, যাতে করে আমরা তাদের নিয়ে কথা বলি এবং আমাদের যা করণীয়, সে বিষয়গুলোতে মনোযোগ না দিই।
মুক্তিযুদ্ধের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। কিন্তু সেই ইতিহাসকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। সরকার এ ব্যাপারে কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না?
যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তো অন্তত একটা সতর্কবার্তা দেওয়ার দরকার ছিল এ সরকারের পক্ষ থেকে। কারণ, এ মাসটা হলো বিজয়ের। সেটুকুও কিন্তু করা হয়নি। মূল কারণ আমরা মোটামুটি সবাই বুঝতে পারি। কারণ, এই সরকারের সঙ্গে যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিশ্বাস করেন—এমন লোকজন যেমন আছেন, তেমনি যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতার অর্জনকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চান না, সে রকম লোকজনও (সম্ভবত) খুব শক্তিশালীভাবে আছেন। সে কারণে সরকার এ ধরনের বিষয়ে একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
তাঁদের এত আস্ফালনের পরেও কি আপনি মনে করেন তাঁরা সফল হতে পারবেন?
একাত্তর সালের আগে থেকেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসীম শক্তি আছে। আসলে একাত্তর সালের যুদ্ধটা ছিল গণমানুষের। এ দেশটা যখনই অন্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তখনই কিন্তু গণমানুষ বীরদর্পে প্রাণ দিয়ে দেশকে রক্ষার শপথ নিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। কাজেই এখন আস্ফালনটা দেখা যাচ্ছে এ কারণে যে বর্তমানে এখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার নেই। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পঙ্গু। আবার আমরা একটা অসময়ের মধ্যে আছি। এই অসময়েই কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রু-মিত্র, মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়। অন্ধকার সময়ে চেনা যায়, এ দেশকে কারা ধারণ করে এবং কারা এ দেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
আমি তো মনে করি, এই আস্ফালন আমাদের একটা যুগান্তকারী সুযোগ করে দিয়েছে। তার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি কারা বাংলাদেশের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে। এবং কারা আমাদের স্বাধীনতার অর্জনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে।
এই চেনার সুযোগটা আমাদের জন্য মন্দের ভালো বলা যেতে পারে। তবে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না, তারা জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশের জন্মের সংগ্রামের ইতিহাস, লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতার অর্জন—সেই আস্থা ও বিশ্বাস যতক্ষণ এ দেশের মানুষের মনে গেঁথে থাকবে, যতক্ষণ এ দেশের মানুষ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে; তার যদি গুটিকয়েকও হয়, তাহলেও আমি মনে করি, এই অপশক্তি অবশ্যই পরাজিত হবে। এই মুক্তিযুদ্ধকে যদি কোনো রাজনৈতিক দল তার নিজের বলে দাবি করে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবে, এটা কোনো একক দলের অর্জন না। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধকে যদি কেউ শুধু প্রতিরোধযুদ্ধ বা যুদ্ধটা সেভাবে আমাদের যুদ্ধ ছিল না—এ রকম বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাহলে সে বয়ানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ কড়ায়-গন্ডায় উপযুক্ত শিক্ষা দিতে প্রস্তুত বলে আমি বিশ্বাস করি।
আগামী জাতীয় নির্বাচন ইনক্লুসিভ এবং ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করতে পারি কি?
ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। আমরা আর কোনোভাবেই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের মতো অগণতান্ত্রিক কোনো নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা করি না। আমি মনে করি, এ দেশের মানুষের যথেষ্ট পরিমাণ বিবেক-বিবেচনা বোধ আছে। তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন যে কাকে নির্বাচিত করবেন আর কাকে করবেন না।
সে ক্ষেত্রে যদি অযাচিতভাবে আইনের অনুসরণ না করে অথবা ক্ষমতাবলে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব না, সেটা আর যা-ই হোক ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে না। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, যিনি বা যাঁরা জুলাই এবং একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁরা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করেন এবং সর্বোপরি অন্য কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে শুধু বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের সবাইকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই ভোল পাল্টে ফেলে। নতুনভাবে নির্বাচিত কোন সরকারের সে রকম হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?
এটা নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনটা কীভাবে হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে যদি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয় অর্থাৎ যেখানে জনগণের মতামতের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে, তাহলে ভয়াবহতার শঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও রাখার কোনো মানে দাঁড়ায় না।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রার্থীরা যেভাবে প্রচার-প্রচারণা করে নানা ধরনের অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছেন, তাতে যৌক্তিকভাবে সেসব দেওয়ার সুযোগ নেই। এতে প্রমাণ হয় যে তাঁরা আসলে নির্বাচনের জন্যই প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছেন। কোনো প্রার্থী এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন যেমন আমরা সবাই জানি, একটা শিশু জন্ম নিচ্ছে ঋণের বোঝা নিয়ে। সেখানে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এগুলো সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রতিশ্রুতি। এভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি তাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা তো সেসব রাখতে পারবেন না। তাঁরা মূলত প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য তা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়াটাই হলো তাঁদের মূল লক্ষ্য।
জুলাই আন্দোলনের পরেও আমরা যদি এসব থেকে বের হতে না পারি, তাহলে তো সমস্যা থেকে যাবে। ক্ষমতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ দেশকে সেবামূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা। আমি ক্ষমতায় যাব এ জন্য না যে আমার পেশি বা প্রশাসনিক শক্তি আছে। আমি ক্ষমতায় যাব এ কারণে যে জনগণ যেন বিশ্বাস করেন আমি তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারব।
যখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ জায়গায় চিন্তা করতে শুরু করবে, তখন একটা পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না এবং দেখাও যাচ্ছে না।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে।
৫ ঘণ্টা আগে
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে।
৫ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১ দিন আগেআজাদুর রহমান চন্দন

ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে। সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডিসি-ইউএনও পাঠিয়ে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সরকার। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এগুলোর সল্যুশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে হয় না। এগুলো করতে পারে একটি রাজনৈতিক সরকার। কারণ তাদের এ মোরাল সল্যুশন করার সক্ষমতা থাকে। তাদের ভয়েসটা দিতে পারে। তাদের কর্মীরা আছে। তাদের সেটআপ আছে। কিন্তু এই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে ডিসিকে পাঠিয়ে, ইউএনওকে পাঠিয়ে এগুলো কন্ট্রোল করা ডিফিকাল্ট।’ উপদেষ্টা ‘রাজনৈতিক সরকার’ শব্দযুগল ব্যবহার করলেও কার্যত নির্বাচিত সরকারকেই বুঝিয়েছিলেন। দশ-বিশ-পঞ্চাশ বছর অনির্বাচিত সরকার রাখার বাসনা যাদের, তারা এ বক্তব্যে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকতেও পারেন। তবে অনির্বাচিত সরকারের একটি সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরায় সালেহউদ্দিন আহমেদ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রশংসা কুড়াবেন আরও বহুদিন।
অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন মাস ছয়েক আগে। কিন্তু ঘোষিত সময়ে নির্বাচন সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে কি না, সে নিয়ে শঙ্কা-সংশয়-সন্দেহ পিছু ছাড়েনি এক দিনের জন্যও। দেশে ক্রিয়াশীল সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও এমন সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কিন্তু তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খোদ রাজধানীতে সম্ভাব্য এক প্রার্থীকে গুলি করার ঘটনায় পুরোনো শঙ্কা-সংশয় আরও জোরালো হয়েছে। কে না জানে, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অন্যতম প্রধান শর্ত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ভালোমন্দ’ নির্ধারক প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী। সবশেষ গত শুক্রবার রাজধানীতে দিনদুপুরে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে, যিনি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। আগের মাসেই চট্টগ্রামে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এসব ঘটনাকে ‘সাধারণ অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা কঠিন।
হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো জায়গা নেই। কোনো সময়ই না। আমাদের মতাদর্শ যা-ই হোক, যে কেউ ভয়ভীতি বা শক্তির আশ্রয় নিলে তাকে একসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।’ গুলিবিদ্ধ হাদিকে দেখতে সেদিন বিকেলেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৮ আসনে দলটির ঘোষিত প্রার্থী মির্জা আব্বাস। সে সময় সেখানে উপস্থিত ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীদের এবং মির্জা আব্বাসের সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। উভয় পক্ষ পাল্টাপাল্টি স্লোগান দেয়। কিছুক্ষণ পর মির্জা আব্বাস তাঁর কর্মীদের নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে যান। এর আগে এবং বলা চলে হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপর এক ছাত্রনেতা ঘটনার জন্য ইঙ্গিতে বিএনপিকে দায়ী করে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানেরও ডাক দেন। শোনা যাচ্ছে, ওই ছাত্রনেতাও নাকি ঢাকা-৮ আসনে নিজ দলের প্রার্থী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে হাদির সঙ্গে তাঁরই মূলত ভোট ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অথচ আপাতদৃষ্টিতে বদনামের ভাগীদার বিএনপি!
হাদির ওপর হামলার মাধ্যমে কেউ এক ঢিলে বহু পাখি মারার চেষ্টা করেছে কি না, সেটি এখনই বলা যাবে না। তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই হয়তো প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করলেও করতে পারে। তবে বিষয়টি যে বিএনপিকে যথেষ্ট ভাবাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যে উদ্বেগ স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এভাবেই কি চলতে থাকবে? তাহলে কোনো মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না—এটা আজকে সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।’ তিনি বলেন, ‘কেউ আবার ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিচ্ছেন। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দল বিএনপিকে লক্ষ্য করে ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছে। এগুলোতে তো সন্দেহ জাগে। একজন উপদেষ্টা মাত্র চার-পাঁচ দিন আগে বলে দিলেন, জনগণ তো আমাদের ম্যান্ডেট দেয়নি কত দিন থাকব। সবকিছু মিলিয়েই নানা সন্দেহ, নানা সংশয়, নানা ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে।’
এদিকে ইনকিলাব মঞ্চের এক সদস্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, যারা ওসমান হাদির ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তাঁর প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য মোহাম্মদ ওসামা একটি গণমাধ্যমে জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুজনের মধ্য থেকে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি চালায়। এই দুজন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ওসমান হাদির প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। মাঝখানে কিছুদিন তাদের দেখা যায়নি। কয়েক দিন আগে তারা আবার এসে প্রচার কাজে যোগ দেয়। কেউ কেউ সন্দেহভাজন হামলাকারীদের মধ্যে একজনের অতীত ‘লীগসংশ্লিষ্টতা’ প্রমাণ করতেও বেজায় তৎপর।
এ তৎপরতা দেখে কেবলই মনে পড়ছে, গণ-অভ্যুত্থানের নায়কের আদলে যেসব ‘মুখ’ এখন ঝলসে উঠছে, তাদের বেশির ভাগেরই কিন্তু একই রকম সংশ্লিষ্টতা ছিল। অর্থাৎ তখন তারা ছিল লীগের ‘মুখোশ’। সন্দেহভাজন ব্যক্তিও তেমনই একজন মুখোশধারী কি না, কে বলতে পারে? কারণ এই ব্যক্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে ১৭ লাখ টাকা লুটের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়েছিল। আগে লীগসংশ্লিষ্ট হয়েও এখন তাহলে কোন সংশ্লিষ্টতার জাদুবলে এত সহজে জামিন পেয়ে ইনকিলাব মঞ্চে ভিড়ে একেবারে সংগঠনের শীর্ষনেতার গা ঘেঁষে বসার সুযোগ পেয়ে গেল?
এক দলের সদস্য হয়েও অন্য দলে কাজ করার নজির যে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল, তা কিন্তু নয়। স্বাধীনতা-পূর্বকালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকাবস্থায় দলটির অনেক সদস্য আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মতো বড় দলে কাজ করতেন। তবে তাঁরা ওই দলগুলোর জন্য বদনাম বয়ে আনার মতো কোনো কাজ করেননি। বরং তাঁদের কারণে সংশ্লিষ্ট দলগুলোই উপকৃত হয়েছিল। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদও একসময় গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। প্রয়াত মহিউদ্দীন আহমেদ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও ন্যাপের নেতা ছিলেন। পরে বাকশাল হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও তাঁর পরিচিতি ছিল ‘আওয়ামী লীগের ন্যাপ নেতা’ হিসেবে। সেই পরিচয় ছিল গৌরবের। তাঁরা কারও সঙ্গে প্রতারণা বা ছলনা করেননি। সে প্রসঙ্গ থাক।
জুলাই আন্দোলনের মাঝামাঝি থেকেই অনেকের মুখের মুখোশ খসে পড়ছিল। ৫ আগস্টের পর তো অনেকের মুখ থেকে মুখোশ পরার মাজেজাও বেরিয়ে আসে অবলীলায়। ইদানীং আবার শুরু হয়েছে মুখ ও মুখোশের খেলা। সামনের দিনগুলোতে নাকি এ খেলা জমজমাট হবে। এক অনুজ সংবাদকর্মীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, মুখোশ পরায় পারদর্শী একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা নাকি কিছুদিন আগে তাঁর ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপিতে তাঁদের কত লোক আছে, তা জানলে সবার চোখ কপালে উঠবে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, ওই ব্যক্তিরাও ততই বেশি সংখ্যায় বেরিয়ে আসবেন মুখোশ ছেড়ে! তথ্যটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, গত সপ্তাহেই নরসিংদীতে একটি ইউনিয়ন বিএনপির ৭৫ নেতা-কর্মী অন্য একটি দলে যোগ দিয়েছেন।
এমনিতেই গত বছর লুট হওয়া বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরকের সব এখনো উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার না হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা দেড় হাজারের মতো। গণ-অভ্যুত্থানের সময় এবং তার পরপর বিভিন্ন কারাগার, থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ স্থাপনা থেকে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরক লুট করা হয়েছিল। এসব অস্ত্রশস্ত্র কাদের অবৈধ দখলে থাকতে পারে, তা কি আঁচ করা একেবারেই অসম্ভব? অস্ত্রের রাজনীতিতে কারা সিদ্ধহস্ত, তা কি সবার অজানা? এই অস্ত্রধারীরা যে এক মুখোশ ছেড়ে নতুন কোনো মুখোশ নিয়ে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতে তৎপর হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী?
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে। সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডিসি-ইউএনও পাঠিয়ে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সরকার। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এগুলোর সল্যুশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে হয় না। এগুলো করতে পারে একটি রাজনৈতিক সরকার। কারণ তাদের এ মোরাল সল্যুশন করার সক্ষমতা থাকে। তাদের ভয়েসটা দিতে পারে। তাদের কর্মীরা আছে। তাদের সেটআপ আছে। কিন্তু এই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে ডিসিকে পাঠিয়ে, ইউএনওকে পাঠিয়ে এগুলো কন্ট্রোল করা ডিফিকাল্ট।’ উপদেষ্টা ‘রাজনৈতিক সরকার’ শব্দযুগল ব্যবহার করলেও কার্যত নির্বাচিত সরকারকেই বুঝিয়েছিলেন। দশ-বিশ-পঞ্চাশ বছর অনির্বাচিত সরকার রাখার বাসনা যাদের, তারা এ বক্তব্যে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকতেও পারেন। তবে অনির্বাচিত সরকারের একটি সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরায় সালেহউদ্দিন আহমেদ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রশংসা কুড়াবেন আরও বহুদিন।
অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন মাস ছয়েক আগে। কিন্তু ঘোষিত সময়ে নির্বাচন সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে কি না, সে নিয়ে শঙ্কা-সংশয়-সন্দেহ পিছু ছাড়েনি এক দিনের জন্যও। দেশে ক্রিয়াশীল সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও এমন সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কিন্তু তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খোদ রাজধানীতে সম্ভাব্য এক প্রার্থীকে গুলি করার ঘটনায় পুরোনো শঙ্কা-সংশয় আরও জোরালো হয়েছে। কে না জানে, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অন্যতম প্রধান শর্ত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ভালোমন্দ’ নির্ধারক প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী। সবশেষ গত শুক্রবার রাজধানীতে দিনদুপুরে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে, যিনি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। আগের মাসেই চট্টগ্রামে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এসব ঘটনাকে ‘সাধারণ অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা কঠিন।
হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো জায়গা নেই। কোনো সময়ই না। আমাদের মতাদর্শ যা-ই হোক, যে কেউ ভয়ভীতি বা শক্তির আশ্রয় নিলে তাকে একসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।’ গুলিবিদ্ধ হাদিকে দেখতে সেদিন বিকেলেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৮ আসনে দলটির ঘোষিত প্রার্থী মির্জা আব্বাস। সে সময় সেখানে উপস্থিত ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীদের এবং মির্জা আব্বাসের সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। উভয় পক্ষ পাল্টাপাল্টি স্লোগান দেয়। কিছুক্ষণ পর মির্জা আব্বাস তাঁর কর্মীদের নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে যান। এর আগে এবং বলা চলে হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপর এক ছাত্রনেতা ঘটনার জন্য ইঙ্গিতে বিএনপিকে দায়ী করে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানেরও ডাক দেন। শোনা যাচ্ছে, ওই ছাত্রনেতাও নাকি ঢাকা-৮ আসনে নিজ দলের প্রার্থী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে হাদির সঙ্গে তাঁরই মূলত ভোট ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অথচ আপাতদৃষ্টিতে বদনামের ভাগীদার বিএনপি!
হাদির ওপর হামলার মাধ্যমে কেউ এক ঢিলে বহু পাখি মারার চেষ্টা করেছে কি না, সেটি এখনই বলা যাবে না। তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই হয়তো প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করলেও করতে পারে। তবে বিষয়টি যে বিএনপিকে যথেষ্ট ভাবাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যে উদ্বেগ স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এভাবেই কি চলতে থাকবে? তাহলে কোনো মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না—এটা আজকে সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।’ তিনি বলেন, ‘কেউ আবার ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিচ্ছেন। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দল বিএনপিকে লক্ষ্য করে ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছে। এগুলোতে তো সন্দেহ জাগে। একজন উপদেষ্টা মাত্র চার-পাঁচ দিন আগে বলে দিলেন, জনগণ তো আমাদের ম্যান্ডেট দেয়নি কত দিন থাকব। সবকিছু মিলিয়েই নানা সন্দেহ, নানা সংশয়, নানা ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে।’
এদিকে ইনকিলাব মঞ্চের এক সদস্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, যারা ওসমান হাদির ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তাঁর প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য মোহাম্মদ ওসামা একটি গণমাধ্যমে জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুজনের মধ্য থেকে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি চালায়। এই দুজন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ওসমান হাদির প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। মাঝখানে কিছুদিন তাদের দেখা যায়নি। কয়েক দিন আগে তারা আবার এসে প্রচার কাজে যোগ দেয়। কেউ কেউ সন্দেহভাজন হামলাকারীদের মধ্যে একজনের অতীত ‘লীগসংশ্লিষ্টতা’ প্রমাণ করতেও বেজায় তৎপর।
এ তৎপরতা দেখে কেবলই মনে পড়ছে, গণ-অভ্যুত্থানের নায়কের আদলে যেসব ‘মুখ’ এখন ঝলসে উঠছে, তাদের বেশির ভাগেরই কিন্তু একই রকম সংশ্লিষ্টতা ছিল। অর্থাৎ তখন তারা ছিল লীগের ‘মুখোশ’। সন্দেহভাজন ব্যক্তিও তেমনই একজন মুখোশধারী কি না, কে বলতে পারে? কারণ এই ব্যক্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে ১৭ লাখ টাকা লুটের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়েছিল। আগে লীগসংশ্লিষ্ট হয়েও এখন তাহলে কোন সংশ্লিষ্টতার জাদুবলে এত সহজে জামিন পেয়ে ইনকিলাব মঞ্চে ভিড়ে একেবারে সংগঠনের শীর্ষনেতার গা ঘেঁষে বসার সুযোগ পেয়ে গেল?
এক দলের সদস্য হয়েও অন্য দলে কাজ করার নজির যে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল, তা কিন্তু নয়। স্বাধীনতা-পূর্বকালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকাবস্থায় দলটির অনেক সদস্য আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মতো বড় দলে কাজ করতেন। তবে তাঁরা ওই দলগুলোর জন্য বদনাম বয়ে আনার মতো কোনো কাজ করেননি। বরং তাঁদের কারণে সংশ্লিষ্ট দলগুলোই উপকৃত হয়েছিল। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদও একসময় গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। প্রয়াত মহিউদ্দীন আহমেদ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও ন্যাপের নেতা ছিলেন। পরে বাকশাল হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও তাঁর পরিচিতি ছিল ‘আওয়ামী লীগের ন্যাপ নেতা’ হিসেবে। সেই পরিচয় ছিল গৌরবের। তাঁরা কারও সঙ্গে প্রতারণা বা ছলনা করেননি। সে প্রসঙ্গ থাক।
জুলাই আন্দোলনের মাঝামাঝি থেকেই অনেকের মুখের মুখোশ খসে পড়ছিল। ৫ আগস্টের পর তো অনেকের মুখ থেকে মুখোশ পরার মাজেজাও বেরিয়ে আসে অবলীলায়। ইদানীং আবার শুরু হয়েছে মুখ ও মুখোশের খেলা। সামনের দিনগুলোতে নাকি এ খেলা জমজমাট হবে। এক অনুজ সংবাদকর্মীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, মুখোশ পরায় পারদর্শী একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা নাকি কিছুদিন আগে তাঁর ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপিতে তাঁদের কত লোক আছে, তা জানলে সবার চোখ কপালে উঠবে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, ওই ব্যক্তিরাও ততই বেশি সংখ্যায় বেরিয়ে আসবেন মুখোশ ছেড়ে! তথ্যটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, গত সপ্তাহেই নরসিংদীতে একটি ইউনিয়ন বিএনপির ৭৫ নেতা-কর্মী অন্য একটি দলে যোগ দিয়েছেন।
এমনিতেই গত বছর লুট হওয়া বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরকের সব এখনো উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার না হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা দেড় হাজারের মতো। গণ-অভ্যুত্থানের সময় এবং তার পরপর বিভিন্ন কারাগার, থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ স্থাপনা থেকে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরক লুট করা হয়েছিল। এসব অস্ত্রশস্ত্র কাদের অবৈধ দখলে থাকতে পারে, তা কি আঁচ করা একেবারেই অসম্ভব? অস্ত্রের রাজনীতিতে কারা সিদ্ধহস্ত, তা কি সবার অজানা? এই অস্ত্রধারীরা যে এক মুখোশ ছেড়ে নতুন কোনো মুখোশ নিয়ে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতে তৎপর হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী?
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগে
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে।
৫ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে। এই অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ৬০টি রিক্রুটিং এজেন্সি প্রায় ৪ হাজার ৫৪৫ কোটি ২০ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শ্রমিকের রক্ত-ঘাম ঝরানো এই বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত ১২৪ জন মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এ নিয়ে ১১ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। ২০১৮ সালে এই সিন্ডিকেটের কারণেই মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। দীর্ঘ আলোচনা ও চুক্তির পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শ্রমবাজারটি আবার চালু হলেও রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র আবারও তাদের পুরোনো কৌশল প্রয়োগ করেছে।
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকায় জনতা ট্রাভেলসের মালিক ও বিসিবির পরিচালক আমজাদ হোসেন এবং ত্রিবেণী ইন্টারন্যাশনালের সেলিনা আলী ও নাবিলা আলীর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম থাকায় ইঙ্গিত দেয়, এই অনিয়ম কেবল সামান্য কিছু এজেন্সির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর শিকড় আরও গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
যে শ্রমিকেরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে বড় ভূমিকা রাখেন, বিদেশে কাজের জন্য নিজেদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দেন, তাঁদের এমন অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়া চরম অমানবিকতা। সরকার যেখানে একটি নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করে দেয়, সেখানে এজেন্সির এমন মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায় চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং শ্রমিকের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা।
আমাদের প্রশ্ন, সরকারিভাবে ফি নির্ধারণ করা সত্ত্বেও কীভাবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এই অনিয়ম করতে পারল? তদারকি সংস্থাগুলো কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে? নাকি উচ্চপর্যায়ের যোগসাজশেই এ দুর্নীতি ডালপালা মেলেছে? দুদকের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এটি কেবল অতিরিক্ত অর্থ আদায়ই নয়, এটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলার শামিল।
দুদকের মামলা করার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে কেবল মামলা করাই যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং আত্মসাৎ করা অর্থ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার করে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ফিরিয়ে দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শুধু আর্থিক জরিমানা নয়; বরং তাদের লাইসেন্স বাতিল এবং মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের শ্রমবাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত রাখতে এবং কর্মীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর নিয়মিত তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই সরকার-নির্ধারিত ফির বেশি অর্থ আদায় করা সম্ভব না হয়। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য জনশক্তি রপ্তানিপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে। এই অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ৬০টি রিক্রুটিং এজেন্সি প্রায় ৪ হাজার ৫৪৫ কোটি ২০ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শ্রমিকের রক্ত-ঘাম ঝরানো এই বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত ১২৪ জন মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এ নিয়ে ১১ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। ২০১৮ সালে এই সিন্ডিকেটের কারণেই মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। দীর্ঘ আলোচনা ও চুক্তির পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শ্রমবাজারটি আবার চালু হলেও রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র আবারও তাদের পুরোনো কৌশল প্রয়োগ করেছে।
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকায় জনতা ট্রাভেলসের মালিক ও বিসিবির পরিচালক আমজাদ হোসেন এবং ত্রিবেণী ইন্টারন্যাশনালের সেলিনা আলী ও নাবিলা আলীর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম থাকায় ইঙ্গিত দেয়, এই অনিয়ম কেবল সামান্য কিছু এজেন্সির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর শিকড় আরও গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
যে শ্রমিকেরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে বড় ভূমিকা রাখেন, বিদেশে কাজের জন্য নিজেদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দেন, তাঁদের এমন অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়া চরম অমানবিকতা। সরকার যেখানে একটি নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করে দেয়, সেখানে এজেন্সির এমন মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায় চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং শ্রমিকের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা।
আমাদের প্রশ্ন, সরকারিভাবে ফি নির্ধারণ করা সত্ত্বেও কীভাবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এই অনিয়ম করতে পারল? তদারকি সংস্থাগুলো কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে? নাকি উচ্চপর্যায়ের যোগসাজশেই এ দুর্নীতি ডালপালা মেলেছে? দুদকের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এটি কেবল অতিরিক্ত অর্থ আদায়ই নয়, এটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলার শামিল।
দুদকের মামলা করার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে কেবল মামলা করাই যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং আত্মসাৎ করা অর্থ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার করে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ফিরিয়ে দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শুধু আর্থিক জরিমানা নয়; বরং তাদের লাইসেন্স বাতিল এবং মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের শ্রমবাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত রাখতে এবং কর্মীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর নিয়মিত তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই সরকার-নির্ধারিত ফির বেশি অর্থ আদায় করা সম্ভব না হয়। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য জনশক্তি রপ্তানিপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগে
ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে।
৫ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
১ দিন আগেশহীদ বুদ্বিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য।
সেলিম জাহান

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।
পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।
তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয্যা।
পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।
একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।
শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।
পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।
তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয্যা।
পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।
একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।
শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
৪ ঘণ্টা আগে
ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে।
৫ ঘণ্টা আগে
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে।
৫ ঘণ্টা আগে