
সামিনা লুৎফা নিত্রা জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ‘বটতলা’ নাট্য দলের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের অর্জন-ব্যর্থতা এবং রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।

সামিনা লুৎফা নিত্রা জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ‘বটতলা’ নাট্য দলের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের অর্জন-ব্যর্থতা এবং রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।
বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।
বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।
সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।
দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।
জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?
সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।
আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?
প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।
এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।
অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।
এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?
সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।
প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।
অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?
সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।
যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।
এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।
কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।
আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?
জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।
তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।
আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।
আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।

ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
১ দিন আগে
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
১ দিন আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
১ দিন আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
২ দিন আগেজাহীদ রেজা নূর

ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
গত শতকের গোটা সময়টায় দুনিয়াজুড়ে সাম্যবাদের দিকে ঝুঁকেছিল প্রগতিবাদী মানুষ। উপনিবেশের শৃঙ্খল ভেঙে এশিয়া-আফ্রিকায় জন্ম হচ্ছিল নতুন নতুন দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিজয় আশার আলো জাগিয়েছিল শোষিত মানুষের মনে। সারা বিশ্বে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চে গেভারা ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে, উদ্বুদ্ধ করেছেন লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষকে। পৃথিবীর মেধাবী মানুষেরা সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। বিশেষ করে তরুণেরা ত্যাগ ও সংগ্রামকেই বেছে নিয়েছে জীবনের পথ হিসেবে। পুঁজিবাদ এই ভেঙে পড়ল বলে মনে হয়েছে।
কিন্তু আদৌ সে রকম কিছু ঘটেনি। নানা ধরনের অসংগতি নিয়ে পুঁজিবাদ টিকে আছে। সমাজতন্ত্রের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। চীনের শাসনব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক নাকি আধা-খ্যাঁচড়া পুঁজিবাদী কিছু—তা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। দেশে দেশে হানাহানি, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য যেকোনো পথ অবলম্বন করা, অন্যকে নিজের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করেই চলেছে পুঁজিবাদ।
২. আলোচনাটা তাত্ত্বিক আলোচনায় পরিণত হওয়ার আগেই থামা দরকার। যখন সমাজতান্ত্রিক জীবনের প্রতি মোহ ও মায়ায় আকৃষ্ট হয়েছে মানুষ, তখন তারা ভেবেও দেখেনি, তত্ত্ব থাকলেই তা রাষ্ট্রীয় জীবনে সুচারুভাবে প্রয়োগ করা যায় না। মানুষের সমাজে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে, তার সমাধানের জন্য তত্ত্বের বাইরেও চলে যান রাষ্ট্রের কর্তারা। তাঁরা নিজের তৈরি আইনে তখন দেশ চালান।
দেশে দেশে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচার এভাবেই দাঁড়িয়ে যায়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও গড়ে উঠেছিল পার্টি-আমলাতন্ত্র, যা আদর্শকে বিলীন করে দিয়ে নিজস্ব এক কঠোর ও নির্যাতনবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি আর জনগণের মধ্যে যখন বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হলো, পার্টি ক্রমেই তার গোপন গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে জনগণের ওপর নজরদারি শুরু করল, পার্টির মতামতের বাইরে অন্য কোনো মতকে কঠোর হাতে দমন করা শুরু করল, বিরুদ্ধমতের মানুষকে নির্বাসনে পাঠাতে লাগল, দেশত্যাগে বাধ্য করতে থাকল কিংবা শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে শুরু করল, তখন বোঝা গেল সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে সমাজতান্ত্রিক মনীষীরাই ভয়ংকরভাবে বিপথে নিয়ে যেতে পারেন। সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ইন্ধন তো আছেই। কিন্তু ভেতরটা নষ্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকলে কোনো দেশকে অন্য কোনো দেশ এসে ধ্বংস করে দিতে পারে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ১০ বছর ছিলাম। ৫ বছর ছিলাম গরবাচোভের পিরিস্ত্রোইকার আমলে, বাকি পাঁচ বছর ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্রে। ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্র ছিল এক কিম্ভূতকিমাকার ব্যবস্থা। চোখের নিমেষে বড় বড় মোড়লকে কোটিপতি হয়ে যেতে দেখেছি। এদের বেশির ভাগই একসময় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বড় বড় চাঁই ছিল। সারা দেশে মাফিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে স্থানীয় মাফিয়াদের টাকা দিয়ে পালতে হতো। কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম হতে থাকল প্রতিটি শহরেই। হঠাৎ করে নিষিদ্ধ পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশ ঘটতে লাগল। তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বদহজম হতে থাকল। সে এক আজব সময় পার করেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নবাসী।
প্রশ্ন হলো, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে দেশগুলো বের হলো, সে দেশগুলোয় কি গণতন্ত্র আদৌ জায়গা করে নিতে পেরেছে? কেন পারেনি, তার কারণগুলোও খতিয়ে দেখা দরকার।
৩. যে আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত দেশটিতে, তাতে পার্টির নামে যথেচ্ছাচার চলত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাশিয়া সফরে গিয়ে এই প্রশ্নটিই তুলেছিলেন। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু সমষ্টি দিয়ে কিছু গড়ে তোলা যায় কি না, অর্থাৎ সম্মিলিত নেতৃত্ব টিকতে পারে কি না, সে প্রশ্নই তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যক্তি যদি বিকশিত না হয়, সমষ্টিই যদি চলার পথের অনুপ্রেরণা হয়, তাহলে ভিন্নমত, বহুমত টিকবে কী করে? আসলেই টেকেনি। কারণ, বহুমতকে প্রবলভাবে হত্যা করে একটিমাত্র মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট নেতারা। মুখে বলেছেন সম্মিলিত নেতৃত্ব, কিন্তু দাঁড় করিয়েছেন পার্টি-স্বৈরাচার। দেয়ালেরও কান আছে—এই কথায় বিশ্বাস ছিল সোভিয়েত জনগণের।
বিতর্কটি আগামী দিনের জন্য তোলা থাকল। বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল একটি মতবাদ কী কারণে এক শ বছর পার হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ল, তা নিয়ে বহু তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। সে আলোচনাগুলোর কোনো কোনোটায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের জন্য শুধু বাইরের শক্তির ষড়যন্ত্রকেই দেখা হয়। আমাদের দেশের মনীষীদের মধ্যেও এ রকম ঝোঁক দেখতে পাই। কিন্তু কী করে ভেতরের সংকটটা ভাঙনকে ত্বরান্বিত করেছে এবং সেটাই হয়ে উঠেছে ভাঙনের মূল কারণ—সে কথা বুঝতে হলে সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসকারী মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা জরুরি। সে কাজটাই ক্রমান্বয়ে করা হবে।
৪. আমাদের দেশের তরুণেরাও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য জীবনপণ করেছিল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীব্যাপী প্রগতিশীল মানুষ বলতে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও-পড়া মানুষদেরকেই বোঝাত। আক্ষরিক অর্থেই এই মানুষেরা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করেছিলেন। নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে সংকট মোকাবিলায় নিজস্ব-সৃষ্ট তত্ত্বকে প্রাধান্য দিতে থাকায় মূল আদর্শের জায়গায় যে বিচ্যুতি ঘটেছিল, প্রাথমিকভাবে তা কর্মীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। সামনে শোষণহীন সমাজের অপার সম্ভাবনা, ফলে ছোটখাটো ভুলত্রুটিকে আমলে না নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল। এই এড়িয়ে যাওয়াটাই কাল হয়ে উঠেছিল। মানুষ প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিল এবং একসময় প্রশ্ন করাকেই ভয়াবহ অপরাধ বলে গণ্য করা শুরু হলো।
সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি শহরে যখন পড়াশোনা করছি, তখন পিরিস্ত্রোইকা আর গ্লাসনোস্ত এসে কাঁপিয়ে দিয়েছে সোভিয়েত সমাজকে। হঠাৎ করে এতটা মুক্তির আস্বাদ পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। মানুষ যখন মুখ খুলতে শুরু করেছে, তখন আর কিছুই ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। সমাজে প্রচলিত সব অসংগতি নিয়ে যেমন মানুষ কথা বলেছে, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি যে রাগ, অভিমান ছিল, সেটাও ধীরে ধীরে প্রকাশ করেছে। পার্টির ভেতরেই ভিন্ন ভিন্ন মত জেগে উঠেছে। এই বিপুল পরিবর্তন মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা গরবাচোভের ছিল না। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ তত দিনে পশ্চিমা দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
কিন্তু কী করে এই ভাঙনটি এল? সেটাই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আলোচনার চেষ্টা করব।
তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় রুশ সাহিত্যের ইতিহাস ক্লাসে ছিলেন এক তরুণ শিক্ষক। তিনি বললেন, বিখ্যাত সোভিয়েত সাহিত্যিক কনস্তান্তিন সিমোনভকে একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি এখন কী লিখছেন?’ সিমোনভ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এখনো ঠিক করিনি। পার্টি যে নির্দেশ দেবে, সেটাই লিখব।’
তখন গ্লাসনোস্তের কাল। তাই শিক্ষক এই কথাটি বলতে পেরেছিলেন। একজন সৃজনশীল মানুষ কী লিখবে, সেটাও নির্ভর করছে পার্টির সিদ্ধান্তের ওপর—এই কথাটি কিসের ইঙ্গিত দেয়, তা নিয়েও কথা বলব। আজকের নাতিদীর্ঘ লেখাটি শেষ করি ওই সোভিয়েতজীবনের একটি ঘটনা দিয়েই। তখন সদ্য সে দেশে গেছি। অন্য একটি শহর থেকে আমাদেরই এক বন্ধু ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। কথা প্রসঙ্গে ও বলছিল, এখনো প্রেমের সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ ব্যাপারে ও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। পার্টি যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটাই সে মেনে নেবে।
ঘটনাটি সত্য। পার্টির প্রতি আনুগত্য ব্যক্তিজীবনকেও ধ্বংস করে দিচ্ছিল, এ কথা তখন অনেকেই বোঝেনি। আর তখনই মনে পড়েছে মেকিয়াভেলির কথা। রাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’ ও ‘স্থিতিশীলতা’ রক্ষার জন্য শাসককে যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে, তা নৈতিক বা অনৈতিক যা-ই হোক না কেন। মেকিয়াভেলি মনে করেন মানুষ স্বার্থপর, ভিতু ও অবিশ্বাসী। তাই শাসককে মানুষের এই প্রকৃতি বুঝে কাজ করতে হবে। পৃথিবীজুড়েই কি এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না?
আমি কি সমাজতন্ত্র নিয়ে নিরাশার কথা বলছি? একেবারেই না। কেন তা নিরাশার জন্ম দিল, সে কারণগুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি মাত্র। আর তা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের স্বপ্নগুলোও কেন ভাঙতে থাকে, তার ইঙ্গিতও আমরা পেয়ে যাব।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
গত শতকের গোটা সময়টায় দুনিয়াজুড়ে সাম্যবাদের দিকে ঝুঁকেছিল প্রগতিবাদী মানুষ। উপনিবেশের শৃঙ্খল ভেঙে এশিয়া-আফ্রিকায় জন্ম হচ্ছিল নতুন নতুন দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিজয় আশার আলো জাগিয়েছিল শোষিত মানুষের মনে। সারা বিশ্বে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য চে গেভারা ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশে, উদ্বুদ্ধ করেছেন লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষকে। পৃথিবীর মেধাবী মানুষেরা সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। বিশেষ করে তরুণেরা ত্যাগ ও সংগ্রামকেই বেছে নিয়েছে জীবনের পথ হিসেবে। পুঁজিবাদ এই ভেঙে পড়ল বলে মনে হয়েছে।
কিন্তু আদৌ সে রকম কিছু ঘটেনি। নানা ধরনের অসংগতি নিয়ে পুঁজিবাদ টিকে আছে। সমাজতন্ত্রের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। চীনের শাসনব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক নাকি আধা-খ্যাঁচড়া পুঁজিবাদী কিছু—তা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। দেশে দেশে হানাহানি, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য যেকোনো পথ অবলম্বন করা, অন্যকে নিজের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করেই চলেছে পুঁজিবাদ।
২. আলোচনাটা তাত্ত্বিক আলোচনায় পরিণত হওয়ার আগেই থামা দরকার। যখন সমাজতান্ত্রিক জীবনের প্রতি মোহ ও মায়ায় আকৃষ্ট হয়েছে মানুষ, তখন তারা ভেবেও দেখেনি, তত্ত্ব থাকলেই তা রাষ্ট্রীয় জীবনে সুচারুভাবে প্রয়োগ করা যায় না। মানুষের সমাজে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে থাকে, তার সমাধানের জন্য তত্ত্বের বাইরেও চলে যান রাষ্ট্রের কর্তারা। তাঁরা নিজের তৈরি আইনে তখন দেশ চালান।
দেশে দেশে একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচার এভাবেই দাঁড়িয়ে যায়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নেও গড়ে উঠেছিল পার্টি-আমলাতন্ত্র, যা আদর্শকে বিলীন করে দিয়ে নিজস্ব এক কঠোর ও নির্যাতনবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি আর জনগণের মধ্যে যখন বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হলো, পার্টি ক্রমেই তার গোপন গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে জনগণের ওপর নজরদারি শুরু করল, পার্টির মতামতের বাইরে অন্য কোনো মতকে কঠোর হাতে দমন করা শুরু করল, বিরুদ্ধমতের মানুষকে নির্বাসনে পাঠাতে লাগল, দেশত্যাগে বাধ্য করতে থাকল কিংবা শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে শুরু করল, তখন বোঝা গেল সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে সমাজতান্ত্রিক মনীষীরাই ভয়ংকরভাবে বিপথে নিয়ে যেতে পারেন। সেই সঙ্গে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ইন্ধন তো আছেই। কিন্তু ভেতরটা নষ্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকলে কোনো দেশকে অন্য কোনো দেশ এসে ধ্বংস করে দিতে পারে না।
সোভিয়েত ইউনিয়নে ১০ বছর ছিলাম। ৫ বছর ছিলাম গরবাচোভের পিরিস্ত্রোইকার আমলে, বাকি পাঁচ বছর ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্রে। ইয়েলৎসিনের গণতন্ত্র ছিল এক কিম্ভূতকিমাকার ব্যবস্থা। চোখের নিমেষে বড় বড় মোড়লকে কোটিপতি হয়ে যেতে দেখেছি। এদের বেশির ভাগই একসময় সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বড় বড় চাঁই ছিল। সারা দেশে মাফিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হলে স্থানীয় মাফিয়াদের টাকা দিয়ে পালতে হতো। কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম হতে থাকল প্রতিটি শহরেই। হঠাৎ করে নিষিদ্ধ পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশ ঘটতে লাগল। তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বদহজম হতে থাকল। সে এক আজব সময় পার করেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নবাসী।
প্রশ্ন হলো, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে দেশগুলো বের হলো, সে দেশগুলোয় কি গণতন্ত্র আদৌ জায়গা করে নিতে পেরেছে? কেন পারেনি, তার কারণগুলোও খতিয়ে দেখা দরকার।
৩. যে আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত দেশটিতে, তাতে পার্টির নামে যথেচ্ছাচার চলত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাশিয়া সফরে গিয়ে এই প্রশ্নটিই তুলেছিলেন। ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু সমষ্টি দিয়ে কিছু গড়ে তোলা যায় কি না, অর্থাৎ সম্মিলিত নেতৃত্ব টিকতে পারে কি না, সে প্রশ্নই তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যক্তি যদি বিকশিত না হয়, সমষ্টিই যদি চলার পথের অনুপ্রেরণা হয়, তাহলে ভিন্নমত, বহুমত টিকবে কী করে? আসলেই টেকেনি। কারণ, বহুমতকে প্রবলভাবে হত্যা করে একটিমাত্র মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট নেতারা। মুখে বলেছেন সম্মিলিত নেতৃত্ব, কিন্তু দাঁড় করিয়েছেন পার্টি-স্বৈরাচার। দেয়ালেরও কান আছে—এই কথায় বিশ্বাস ছিল সোভিয়েত জনগণের।
বিতর্কটি আগামী দিনের জন্য তোলা থাকল। বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল একটি মতবাদ কী কারণে এক শ বছর পার হওয়ার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ল, তা নিয়ে বহু তাত্ত্বিক আলোচনা আছে। সে আলোচনাগুলোর কোনো কোনোটায় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের জন্য শুধু বাইরের শক্তির ষড়যন্ত্রকেই দেখা হয়। আমাদের দেশের মনীষীদের মধ্যেও এ রকম ঝোঁক দেখতে পাই। কিন্তু কী করে ভেতরের সংকটটা ভাঙনকে ত্বরান্বিত করেছে এবং সেটাই হয়ে উঠেছে ভাঙনের মূল কারণ—সে কথা বুঝতে হলে সে সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসকারী মানুষের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা জরুরি। সে কাজটাই ক্রমান্বয়ে করা হবে।
৪. আমাদের দেশের তরুণেরাও শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য জীবনপণ করেছিল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীব্যাপী প্রগতিশীল মানুষ বলতে মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিন-মাও-পড়া মানুষদেরকেই বোঝাত। আক্ষরিক অর্থেই এই মানুষেরা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করেছিলেন। নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ধীরে ধীরে সংকট মোকাবিলায় নিজস্ব-সৃষ্ট তত্ত্বকে প্রাধান্য দিতে থাকায় মূল আদর্শের জায়গায় যে বিচ্যুতি ঘটেছিল, প্রাথমিকভাবে তা কর্মীদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। সামনে শোষণহীন সমাজের অপার সম্ভাবনা, ফলে ছোটখাটো ভুলত্রুটিকে আমলে না নেওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছিল। এই এড়িয়ে যাওয়াটাই কাল হয়ে উঠেছিল। মানুষ প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিল এবং একসময় প্রশ্ন করাকেই ভয়াবহ অপরাধ বলে গণ্য করা শুরু হলো।
সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি শহরে যখন পড়াশোনা করছি, তখন পিরিস্ত্রোইকা আর গ্লাসনোস্ত এসে কাঁপিয়ে দিয়েছে সোভিয়েত সমাজকে। হঠাৎ করে এতটা মুক্তির আস্বাদ পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। মানুষ যখন মুখ খুলতে শুরু করেছে, তখন আর কিছুই ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। সমাজে প্রচলিত সব অসংগতি নিয়ে যেমন মানুষ কথা বলেছে, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি যে রাগ, অভিমান ছিল, সেটাও ধীরে ধীরে প্রকাশ করেছে। পার্টির ভেতরেই ভিন্ন ভিন্ন মত জেগে উঠেছে। এই বিপুল পরিবর্তন মোকাবিলা করার মতো ক্ষমতা গরবাচোভের ছিল না। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ তত দিনে পশ্চিমা দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
কিন্তু কী করে এই ভাঙনটি এল? সেটাই তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আলোচনার চেষ্টা করব।
তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় রুশ সাহিত্যের ইতিহাস ক্লাসে ছিলেন এক তরুণ শিক্ষক। তিনি বললেন, বিখ্যাত সোভিয়েত সাহিত্যিক কনস্তান্তিন সিমোনভকে একবার এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি এখন কী লিখছেন?’ সিমোনভ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এখনো ঠিক করিনি। পার্টি যে নির্দেশ দেবে, সেটাই লিখব।’
তখন গ্লাসনোস্তের কাল। তাই শিক্ষক এই কথাটি বলতে পেরেছিলেন। একজন সৃজনশীল মানুষ কী লিখবে, সেটাও নির্ভর করছে পার্টির সিদ্ধান্তের ওপর—এই কথাটি কিসের ইঙ্গিত দেয়, তা নিয়েও কথা বলব। আজকের নাতিদীর্ঘ লেখাটি শেষ করি ওই সোভিয়েতজীবনের একটি ঘটনা দিয়েই। তখন সদ্য সে দেশে গেছি। অন্য একটি শহর থেকে আমাদেরই এক বন্ধু ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। কথা প্রসঙ্গে ও বলছিল, এখনো প্রেমের সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ ব্যাপারে ও নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। পার্টি যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটাই সে মেনে নেবে।
ঘটনাটি সত্য। পার্টির প্রতি আনুগত্য ব্যক্তিজীবনকেও ধ্বংস করে দিচ্ছিল, এ কথা তখন অনেকেই বোঝেনি। আর তখনই মনে পড়েছে মেকিয়াভেলির কথা। রাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’ ও ‘স্থিতিশীলতা’ রক্ষার জন্য শাসককে যেকোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে, তা নৈতিক বা অনৈতিক যা-ই হোক না কেন। মেকিয়াভেলি মনে করেন মানুষ স্বার্থপর, ভিতু ও অবিশ্বাসী। তাই শাসককে মানুষের এই প্রকৃতি বুঝে কাজ করতে হবে। পৃথিবীজুড়েই কি এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না?
আমি কি সমাজতন্ত্র নিয়ে নিরাশার কথা বলছি? একেবারেই না। কেন তা নিরাশার জন্ম দিল, সে কারণগুলো খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি মাত্র। আর তা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, আমাদের দেশের স্বপ্নগুলোও কেন ভাঙতে থাকে, তার ইঙ্গিতও আমরা পেয়ে যাব।
লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
১ দিন আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
১ দিন আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
২ দিন আগেস্বপ্না রেজা

এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যত কথা উঠেছে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যত চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, অনিয়মের বিরুদ্ধে যত আওয়াজ উঠেছে, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তার ন্যূনতম আলাপ-আলোচনা হতে দেখা যায়নি। কারোর দৃষ্টি ও উৎসাহ এই বিষয়ে ছিল বলেও মনে হয়নি। দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, রাষ্ট্র সংস্কারের চেতনায় শিক্ষাব্যবস্থাকে অচেতন অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং সেটা বিগত সময়ের মতোই। এককথায়, আমাদের দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যাবতীয় কাজ, পরিকল্পনা, উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে উত্তম ও কার্যকর পদক্ষেপ কোনো রাজনৈতিক সরকারকেই নিতে দেখা যায়নি। যেটুকু নেওয়া হয়েছে তা অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে করা হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। ফলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থেকেই গেছে। মেধাসম্পন্ন যোগ্য নাগরিক নয়, বরং রাজনৈতিক দল ও তার দলীয় চেতনায় দেশ গড়ার অন্যতম উপায় বলে প্রতিষ্ঠার হীন চেষ্টা চালানো হয়েছে সব সময়ই।
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে। সংবাদমাধ্যমে আরও জানা যায়, এই ফলকে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র বলে উল্লেখ করেছেন স্বয়ং শিক্ষা উপদেষ্টা। এটা তাঁর কৃতিত্বের ঢেকুর কি না, নাকি সাধারণ জনগণের মতো হতাশার উক্তি, সেটা বলা মুশকিল। যদি কৃতিত্বের ঢেকুর এমন হয়, তাঁদের আমলে কড়াকড়ি তথা যথাযথভাবে পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাই করা হয়েছে, তাই পাসের হার কম হয়েছে এবং এটাই বাস্তবতা। তাহলে বলতেই হয় যে এটা নিঃসন্দেহে একটা খোঁড়া যুক্তি। যদি পাসের হার বেশি হতো তাহলে হয়তো এমন যুক্তি দেওয়া থেকে তিনি বিরত থাকতেন। উল্টো বলা হতো, যথাযথ ও উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার উত্তম ফলাফল। সব সরকারই যেভাবে কৃতিত্ব নিতে উৎসাহ বোধ করে থাকে, সে রকমই ব্যাপারটা এবারও ঘটেছে।
তবে সাধারণ জনগণ ভাবছে অন্য কথা। তারা বলছে, পরীক্ষায় পাস না করার কারণ হতে পারে উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন ও প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষার্থীরা এবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। সোজাসুজি বললে দাঁড়ায়, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করেননি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে গেছেন বেশ অনেক দিন। তরুণ, কিশোর, যুবকদের মধ্যে অন্য ধরনের তাড়না লক্ষ করা গেছে, যা শিক্ষাসংক্রান্ত নয়। বরং স্কুলের প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিকে জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার মতো চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ দেখানো হয়েছে এই সময়ে। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও রাষ্ট্রের জন্য এক অশনিসংকেত। সরকার এই হীন কর্মকাণ্ডকে রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।
একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ দুঃখ করে বলছিলেন তাঁর সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতার কথা। যুবকদের নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তাঁকে সম্মানিত বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যুবকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে প্রথমেই জানতে চাইলেন, বক্তব্য দেওয়ার আগে জানতে চাই, তোমরা কয়জন নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছ, হাত তোলো? কিন্তু কারোর তোলা হাত তিনি দেখেননি। অবাক হন। জানতে চান, একটা হাতও না দেখার কারণ কী? তাদের কয়জন বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে বলে, তারা এখন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। সংস্কারকাজে জড়িত। রাষ্ট্র সংস্কার হলে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে। প্রবীণ ভদ্রলোক ভেবে নিলেন, এই মুহূর্তে যুবকদের জ্ঞান দেওয়া বৃথা। বরং তারাই তাঁকে জ্ঞান দিতে বেশি আগ্রহী। এমন আয়োজনও নেহাত শোআপ। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে অবস্থা, জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থাপনার যে চিত্র, তা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও প্রসারে সহায়ক নয়। যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব এই সেক্টরে। এই অভাব নতুন নয়, পুরোনো। বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে সার্বিক পরিস্থিতি তার ওপর গবেষণা চালালে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।
ফলাফলে দেখা গেছে, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। এবার ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাসের চেহারা দেখতে পারেনি। এর কারণ অনুসন্ধান করতে না পারলে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দূরত্ব বাড়বে বৈকি, যা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না, বরং প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। দেশের অস্তিত্ব সংকটের একটা কারণ হবে।
অটোপাসের দাবি কর্তৃপক্ষের মেনে নেওয়ার ঘটনাটি কখনোই উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না, শিক্ষিত এক জাতির পূর্বাভাস দেয় না। বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রচণ্ড সুযোগ দেয়। অতীতে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষার্থীদের কবজা করার প্রবণতা সব সরকারের ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু অটোপাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করবার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম এবং সেটা রাজনৈতিক ইস্যুতে। যেখানে ২৪-এর আন্দোলনের শুরুটা ছিল মেধার যোগ্যতায় বিসিএসে নিয়োগের দাবিতে, যদিও সেই আন্দোলন পৌঁছে যায় শেষ অবধি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। সেখানে অটোপাসের বিষয়টি মেধার গুরুত্বকে কোথায় নিয়ে যায় বা যাবে, সংশ্লিষ্টরা তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্ন থাকে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন ও তার প্রত্যয়, সেখানে মেধা ও শিক্ষার বিকল্প কী? উত্তর, কোনো বিকল্প নেই। একটা শিক্ষিত জাতি একটা দেশকে যতটা নিরাপদ করে রাখতে পারে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, স্থায়িত্বশীল উন্নয়নকে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে, অন্য কোনো মন্ত্র, থিওরি কিন্তু তা পারে না।
যদি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মনোযোগ ও গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তাহলে একদিন পাসের হার .০৫-এ নেমে গেলে কেউ আর আশ্চর্য হবে না। তখন এটাকে বাস্তব চিত্র বলে কৃতিত্ব নেওয়ার পথও থাকবে না। একজন ক্ষমতাসীনের চেয়ে একজন মেধাবী শিক্ষিতের প্রয়োজন এই দেশে সবচেয়ে বেশি।
স্বপ্না রেজা,কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যত কথা উঠেছে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে যত চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, অনিয়মের বিরুদ্ধে যত আওয়াজ উঠেছে, শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তার ন্যূনতম আলাপ-আলোচনা হতে দেখা যায়নি। কারোর দৃষ্টি ও উৎসাহ এই বিষয়ে ছিল বলেও মনে হয়নি। দুঃখজনক হলেও বলতে হয় যে, রাষ্ট্র সংস্কারের চেতনায় শিক্ষাব্যবস্থাকে অচেতন অবস্থায় রাখা হয়েছে এবং সেটা বিগত সময়ের মতোই। এককথায়, আমাদের দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যাবতীয় কাজ, পরিকল্পনা, উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে উত্তম ও কার্যকর পদক্ষেপ কোনো রাজনৈতিক সরকারকেই নিতে দেখা যায়নি। যেটুকু নেওয়া হয়েছে তা অযোগ্য ও অদক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে করা হয়েছে বলে অনেকের অভিযোগ। ফলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থেকেই গেছে। মেধাসম্পন্ন যোগ্য নাগরিক নয়, বরং রাজনৈতিক দল ও তার দলীয় চেতনায় দেশ গড়ার অন্যতম উপায় বলে প্রতিষ্ঠার হীন চেষ্টা চালানো হয়েছে সব সময়ই।
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল বলে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে। সংবাদমাধ্যমে আরও জানা যায়, এই ফলকে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র বলে উল্লেখ করেছেন স্বয়ং শিক্ষা উপদেষ্টা। এটা তাঁর কৃতিত্বের ঢেকুর কি না, নাকি সাধারণ জনগণের মতো হতাশার উক্তি, সেটা বলা মুশকিল। যদি কৃতিত্বের ঢেকুর এমন হয়, তাঁদের আমলে কড়াকড়ি তথা যথাযথভাবে পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাই করা হয়েছে, তাই পাসের হার কম হয়েছে এবং এটাই বাস্তবতা। তাহলে বলতেই হয় যে এটা নিঃসন্দেহে একটা খোঁড়া যুক্তি। যদি পাসের হার বেশি হতো তাহলে হয়তো এমন যুক্তি দেওয়া থেকে তিনি বিরত থাকতেন। উল্টো বলা হতো, যথাযথ ও উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার উত্তম ফলাফল। সব সরকারই যেভাবে কৃতিত্ব নিতে উৎসাহ বোধ করে থাকে, সে রকমই ব্যাপারটা এবারও ঘটেছে।
তবে সাধারণ জনগণ ভাবছে অন্য কথা। তারা বলছে, পরীক্ষায় পাস না করার কারণ হতে পারে উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন ও প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষার্থীরা এবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। সোজাসুজি বললে দাঁড়ায়, শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া করেননি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে গেছেন বেশ অনেক দিন। তরুণ, কিশোর, যুবকদের মধ্যে অন্য ধরনের তাড়না লক্ষ করা গেছে, যা শিক্ষাসংক্রান্ত নয়। বরং স্কুলের প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিকে জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার মতো চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ দেখানো হয়েছে এই সময়ে। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও রাষ্ট্রের জন্য এক অশনিসংকেত। সরকার এই হীন কর্মকাণ্ডকে রোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।
একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ দুঃখ করে বলছিলেন তাঁর সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতার কথা। যুবকদের নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তাঁকে সম্মানিত বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যুবকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে প্রথমেই জানতে চাইলেন, বক্তব্য দেওয়ার আগে জানতে চাই, তোমরা কয়জন নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছ, হাত তোলো? কিন্তু কারোর তোলা হাত তিনি দেখেননি। অবাক হন। জানতে চান, একটা হাতও না দেখার কারণ কী? তাদের কয়জন বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে বলে, তারা এখন দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। সংস্কারকাজে জড়িত। রাষ্ট্র সংস্কার হলে তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরবে। প্রবীণ ভদ্রলোক ভেবে নিলেন, এই মুহূর্তে যুবকদের জ্ঞান দেওয়া বৃথা। বরং তারাই তাঁকে জ্ঞান দিতে বেশি আগ্রহী। এমন আয়োজনও নেহাত শোআপ। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে অবস্থা, জাতীয় পর্যায়ে ব্যবস্থাপনার যে চিত্র, তা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি ও প্রসারে সহায়ক নয়। যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব এই সেক্টরে। এই অভাব নতুন নয়, পুরোনো। বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে সার্বিক পরিস্থিতি তার ওপর গবেষণা চালালে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে।
ফলাফলে দেখা গেছে, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাসের হার মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেশি। এবার ২০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাসের চেহারা দেখতে পারেনি। এর কারণ অনুসন্ধান করতে না পারলে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দূরত্ব বাড়বে বৈকি, যা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না, বরং প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। দেশের অস্তিত্ব সংকটের একটা কারণ হবে।
অটোপাসের দাবি কর্তৃপক্ষের মেনে নেওয়ার ঘটনাটি কখনোই উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না, শিক্ষিত এক জাতির পূর্বাভাস দেয় না। বরং শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের প্রচণ্ড সুযোগ দেয়। অতীতে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও তার শিক্ষার্থীদের কবজা করার প্রবণতা সব সরকারের ছিল এবং এখনো আছে। কিন্তু অটোপাস দিয়ে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করবার ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম এবং সেটা রাজনৈতিক ইস্যুতে। যেখানে ২৪-এর আন্দোলনের শুরুটা ছিল মেধার যোগ্যতায় বিসিএসে নিয়োগের দাবিতে, যদিও সেই আন্দোলন পৌঁছে যায় শেষ অবধি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। সেখানে অটোপাসের বিষয়টি মেধার গুরুত্বকে কোথায় নিয়ে যায় বা যাবে, সংশ্লিষ্টরা তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল কি না, প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্ন থাকে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন ও তার প্রত্যয়, সেখানে মেধা ও শিক্ষার বিকল্প কী? উত্তর, কোনো বিকল্প নেই। একটা শিক্ষিত জাতি একটা দেশকে যতটা নিরাপদ করে রাখতে পারে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, স্থায়িত্বশীল উন্নয়নকে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে, অন্য কোনো মন্ত্র, থিওরি কিন্তু তা পারে না।
যদি শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মনোযোগ ও গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তাহলে একদিন পাসের হার .০৫-এ নেমে গেলে কেউ আর আশ্চর্য হবে না। তখন এটাকে বাস্তব চিত্র বলে কৃতিত্ব নেওয়ার পথও থাকবে না। একজন ক্ষমতাসীনের চেয়ে একজন মেধাবী শিক্ষিতের প্রয়োজন এই দেশে সবচেয়ে বেশি।
স্বপ্না রেজা,কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
১ দিন আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
১ দিন আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সদর ইউনিয়নে। প্রকৃত দরিদ্র ব্যক্তিরা নয়, কার্ড পেয়েছেন ইউপি সদস্যের মেয়ে, প্রবাসীর স্ত্রী, চাকরিজীবীর পরিবার, এমনকি ১৫ বিঘা জমি ও পাকা বাড়ির মালিকেরাও। ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক, সচিব এবং একজন বিএনপিপন্থী প্রভাবশালী ইউপি সদস্যের যোগসাজশেই এই অনিয়মের কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে। ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে প্রকৃত দুস্থদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে, সচ্ছল পরিবারগুলোকে ভিজিডি কার্ড দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এই তালিকা প্রণয়ন শুধু নিয়ম ভঙ্গ করাই নয়, এটি অসহায় মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের শামিল।
শুধু দুস্থ ব্যক্তিদের কার্ডের জন্য নয়, সরকারের পক্ষ থেকে দারিদ্র্য নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ সম্প্রদায় বা পেশার জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করাসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজেও এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। বিধবা না হয়ে ভাতা উত্তোলন, ধনী হয়ে ভূমিহীনের জমি পাওয়া এবং প্রকৃত গৃহহীন মানুষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর না পাওয়াসহ নানা অভিযোগের খবর প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে মূলত নির্বাচিত চেয়ারম্যান না থাকায়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের কোনো ইউনিয়ন পরিষদে এখন আর নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্য নেই। এই ইউনিয়নে প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা। অনির্বাচিত ব্যক্তির সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বোধ থাকে না। সে জন্য অপকর্মটি এই প্রশাসকের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।
সবার প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আগে যেমন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ এসব করতেন, এখন সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ একই কাজ করছেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, তদন্ত চলাকালেই অনিয়মের মাধ্যমে কার্ড পাওয়া ব্যক্তিরা দুই মাসের চাল তুলে নিয়েছেন।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু যখন সেই কর্মসূচি দুর্নীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ পূরণ করা সম্ভব হয় না।
যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে অনিয়মকারীদের বিচারের আওতায় আনা হতো, তাহলে এ ধরনের দুর্নীতি কিছুটা কমত।
অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এই ঘটনায় যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শুধু ইউপি সচিব ও মেম্বারকে দায়ী করে প্রশাসককে রেহাই দেওয়া হলে তা ভুল বার্তা দেবে। সব স্তরের জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে যাঁরা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যথাযথ তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সদর ইউনিয়নে। প্রকৃত দরিদ্র ব্যক্তিরা নয়, কার্ড পেয়েছেন ইউপি সদস্যের মেয়ে, প্রবাসীর স্ত্রী, চাকরিজীবীর পরিবার, এমনকি ১৫ বিঘা জমি ও পাকা বাড়ির মালিকেরাও। ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক, সচিব এবং একজন বিএনপিপন্থী প্রভাবশালী ইউপি সদস্যের যোগসাজশেই এই অনিয়মের কালো অধ্যায় রচিত হয়েছে। ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে প্রকৃত দুস্থদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে, সচ্ছল পরিবারগুলোকে ভিজিডি কার্ড দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার তোয়াক্কা না করে এই তালিকা প্রণয়ন শুধু নিয়ম ভঙ্গ করাই নয়, এটি অসহায় মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের শামিল।
শুধু দুস্থ ব্যক্তিদের কার্ডের জন্য নয়, সরকারের পক্ষ থেকে দারিদ্র্য নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ সম্প্রদায় বা পেশার জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করাসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজেও এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। বিধবা না হয়ে ভাতা উত্তোলন, ধনী হয়ে ভূমিহীনের জমি পাওয়া এবং প্রকৃত গৃহহীন মানুষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর না পাওয়াসহ নানা অভিযোগের খবর প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে মূলত নির্বাচিত চেয়ারম্যান না থাকায়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের কোনো ইউনিয়ন পরিষদে এখন আর নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্য নেই। এই ইউনিয়নে প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা। অনির্বাচিত ব্যক্তির সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বোধ থাকে না। সে জন্য অপকর্মটি এই প্রশাসকের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।
সবার প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আগে যেমন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেউ কেউ এসব করতেন, এখন সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ একই কাজ করছেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, তদন্ত চলাকালেই অনিয়মের মাধ্যমে কার্ড পাওয়া ব্যক্তিরা দুই মাসের চাল তুলে নিয়েছেন।
সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু যখন সেই কর্মসূচি দুর্নীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ পূরণ করা সম্ভব হয় না।
যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে অনিয়মকারীদের বিচারের আওতায় আনা হতো, তাহলে এ ধরনের দুর্নীতি কিছুটা কমত।
অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এই ঘটনায় যাঁরা সরাসরি জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিভাগীয় ও ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শুধু ইউপি সচিব ও মেম্বারকে দায়ী করে প্রশাসককে রেহাই দেওয়া হলে তা ভুল বার্তা দেবে। সব স্তরের জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে যাঁরা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যথাযথ তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
১ দিন আগে
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
১ দিন আগে
হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

গাজীপুরের টঙ্গীতে এক ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল এলাকাবাসী। দুজন মিলে মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়েছিল, তাদের একজন পালিয়ে গিয়েছিল, অন্যজনকে ধরে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা।
টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়। যদি প্রতিদিন ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা হয় না কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল কি নেই? ছিনতাইয়ের স্পটগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে? এই দায় কার ওপর বর্তায়? যদি ছিনতাই রোধ করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হতো এবং ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তি হতো, তাহলে এ পথ কেউ মাড়াত না। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর তাই এখনো প্রতিদিন গড়ে ২০টা করে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।
ছিনতাই করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সেই সাজাই দিয়েছে ছিনতাইকারীকে। জনতা ছিনতাইকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেনি, বিচার চায়নি, বরং হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করেছে। এতটাই মেরেছে যে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়েছে। নিহত হওয়ার পর মৃতদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করেছে জনতা!
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই দৃষ্টান্ত মোটেই সুখকর কিছু নয়। যারা হত্যা করে, তারাই হত্যাকারী। এই হত্যার দায় কি এই উল্লসিত জনতা দেবে? প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? কেন একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? আইনের পথটি কি তাদের জানা নেই?
জানা আছে নিশ্চয়। কিন্তু দিনের পর দিন ছিনতাইকারীদের শাস্তি হচ্ছে না দেখে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশ কিংবা নিরাপত্তারক্ষীরা যদি সতর্ক হয়ে ছিনতাইকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারত, ছিনতাইকারীরা যদি তাদের অপরাধের সাজা পেত, তাহলে হয়তো মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিত না। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যদি কেউ কাউকে ছিনতাইকারী বলে পেটাতে শুরু করে, তাহলে সমবেত জনতার প্রত্যেকেই খায়েশ মিটিয়ে পেটাতে থাকবে। কারও সাতে-পাঁচে নেই—এমন একজন নিরীহ মানুষও এই মবের হাতে প্রাণ হারাতে পারে।
ধরা যাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ছিনতাইকারীদের ধরতে শুরু করল, তাতে কি জনতার এই উন্মত্ততা কমে যাবে? মনে হয় না। হিংস্রতা নিবারণের জন্য পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। সৎ গুণাবলি তৈরি করতে হলে তো সেটার চর্চা দরকার। সেই চর্চাই তো কমে গেছে। একজন মানুষের মনে যদি হিংসা, ঘৃণা, ক্ষোভ জমা হতে থাকে, কমে যেতে থাকে ভালোবাসা, মানবতা—তাহলে সে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে উল্লাসই করবে! এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা!

গাজীপুরের টঙ্গীতে এক ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল এলাকাবাসী। দুজন মিলে মোবাইল ছিনতাই করতে গিয়েছিল, তাদের একজন পালিয়ে গিয়েছিল, অন্যজনকে ধরে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় সেই ছিনতাইকারীর। সেখানে ঘটনা থেমে থাকেনি, লোকটির শরীরে লবণ দিয়ে উল্লাস করতে থাকে জনতা।
টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০টি করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থারই ইঙ্গিত দেয়। যদি প্রতিদিন ২০টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধ করা হয় না কেন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকবল কি নেই? ছিনতাইয়ের স্পটগুলো কি চিহ্নিত করা হয়েছে? এই দায় কার ওপর বর্তায়? যদি ছিনতাই রোধ করার মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হতো এবং ছিনতাইকারীদের উপযুক্ত শাস্তি হতো, তাহলে এ পথ কেউ মাড়াত না। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে সংশ্লিষ্টরা। আর তাই এখনো প্রতিদিন গড়ে ২০টা করে ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে।
ছিনতাই করার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতা সেই সাজাই দিয়েছে ছিনতাইকারীকে। জনতা ছিনতাইকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেনি, বিচার চায়নি, বরং হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে বেদম প্রহার করেছে। এতটাই মেরেছে যে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়েছে। নিহত হওয়ার পর মৃতদেহে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করেছে জনতা!
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এই দৃষ্টান্ত মোটেই সুখকর কিছু নয়। যারা হত্যা করে, তারাই হত্যাকারী। এই হত্যার দায় কি এই উল্লসিত জনতা দেবে? প্রশ্ন জাগে, মানুষ কেন এতটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? কেন একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে? আইনের পথটি কি তাদের জানা নেই?
জানা আছে নিশ্চয়। কিন্তু দিনের পর দিন ছিনতাইকারীদের শাস্তি হচ্ছে না দেখে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। পুলিশ কিংবা নিরাপত্তারক্ষীরা যদি সতর্ক হয়ে ছিনতাইকারীদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারত, ছিনতাইকারীরা যদি তাদের অপরাধের সাজা পেত, তাহলে হয়তো মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিত না। কিন্তু এখন এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যদি কেউ কাউকে ছিনতাইকারী বলে পেটাতে শুরু করে, তাহলে সমবেত জনতার প্রত্যেকেই খায়েশ মিটিয়ে পেটাতে থাকবে। কারও সাতে-পাঁচে নেই—এমন একজন নিরীহ মানুষও এই মবের হাতে প্রাণ হারাতে পারে।
ধরা যাক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়ে ছিনতাইকারীদের ধরতে শুরু করল, তাতে কি জনতার এই উন্মত্ততা কমে যাবে? মনে হয় না। হিংস্রতা নিবারণের জন্য পারিবারিক শিক্ষা, সচেতনতা ইত্যাদির প্রয়োজন পড়ে। সৎ গুণাবলি তৈরি করতে হলে তো সেটার চর্চা দরকার। সেই চর্চাই তো কমে গেছে। একজন মানুষের মনে যদি হিংসা, ঘৃণা, ক্ষোভ জমা হতে থাকে, কমে যেতে থাকে ভালোবাসা, মানবতা—তাহলে সে মৃত মানুষের লাশ নিয়ে উল্লাসই করবে! এ এক ভয়াবহ বাস্তবতা!

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং
১৩ জুলাই ২০২৫
ছোট ছিলাম যখন, তখন শোনা কথাগুলোকে অমূল্য মনে হতো। বুঝে না-বুঝে প্রচলিত কথাগুলোকেই বিশ্বাস করতাম। বয়স বাড়তে লাগল, বুঝতে পারলাম, জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে, যা আদর্শবাদের সঙ্গে যায় না। বাস্তব একেবারে অন্য কিছু।
১ দিন আগে
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল বেশ খারাপ। বলা যায়, সন্তোষজনক নয়। যদিও পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে, পাসের হার বেশি হবে, তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ বা উদ্যোগ কিন্তু ছিল না। বরাবরের মতো গত নয়-দশ মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ, তৎপরতা চোখে পড়েনি।
১ দিন আগে
গরিব ও দরিদ্র মানুষদের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড (পরিবর্তিত নাম ভিডব্লিউবি) বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আজকের পত্রিকায় ২১ অক্টোবর সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে।
১ দিন আগে