Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

বৈষম্যহীন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে গেছে

সামিনা লুৎফা নিত্রা

সামিনা লুৎফা নিত্রা জুলাই আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ‘বটতলা’ নাট্য দলের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছরের অর্জন-ব্যর্থতা এবং রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আপনি একাত্ম ছিলেন। এক বছর পর এই আন্দোলনের অর্জন ও ব্যর্থতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

আন্দোলনের অর্জন বলতে আমরা শুধু একটা রেজিমের পতন চাইনি, ব্যবস্থাটার পতন চেয়েছিলাম। তবে এটা সত্যি, আওয়ামী লীগ যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছিল—দুর্নীতি, হত্যা, সহিংসতা ইত্যাদির রূপটা আমরা সরিয়ে দিতে পেরেছি, সেটা একটা বড় অর্জন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের পতন, আওয়ামী লীগের পতন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আওয়ামী লীগের সব রকম গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়া—পুরো বিষয়টা একটা অর্জন। কিন্তু এসব ছাড়া আর কোনো অর্জন তেমন একটা নেই।

বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা যায়, আমরা যেটা খুঁজেও পাচ্ছি না—অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়াটা ছিল জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার। জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে কয়েকটি কারফিউ ভেঙেছি এবং প্রতিবাদে শামিল হয়েছি, আমরা বারবার বলেছি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে হবে। যাঁরা আহত হয়েছেন এবং যাঁদের আন্দোলনের সময় আটক করা হয়েছে, তাঁদের মামলাগুলোকে ঠিকভাবে দেখতে হবে। আহতদের সঠিক চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে সরকার প্রতিটা পদে ব্যর্থ হয়েছে। এখনো জুলাইয়ের নিহতদের তালিকায় শুধু ৮০০ জনের নাম পাওয়া গেছে। অথচ জাতিসংঘের গবেষণায় সেটার সংখ্যা ১৪০০। সরকার এক বছরে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারল না। এটার চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কী হতে পারে? তাঁদের জীবনের বিনিময়ে অনেকে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আন্দোলনে যুক্ত না হয়েও কেউ কেউ সরকারের পার্ট হয়েছেন।

বাংলাদেশ তো আসলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বাইরে না। সেই জায়গা থেকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টা ভেঙে গেছে শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যখন একজন ব্যক্তি এবং তাঁর পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা কূটনৈতিকভাবেও অদ্ভুত ব্যাপার। এটাও ব্যর্থতা। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে যে ধরনের অবজেকটিভ সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা সরকার তৈরি করতে পারেনি।

সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। বাজারে পণ্যের দামে একটা প্রবল ঊর্ধ্বগতি হয়েছিল সেটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। সেটা সরকারের একটা অর্জন। তবে ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটা বড় ব্যাপার হলো, জুলাই আন্দোলনের মামলা নিয়ে বড় ধরনের বাণিজ্য করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে। শত শত অজ্ঞাত এবং অপরাধী নয়, এ রকম মানুষদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের চিহ্নিত অপরাধীরা যাঁদের ছবি ও ভিডিও আছে তাঁরা বহাল তবিয়তে পাশের দেশসহ বিশ্বের নানা দেশে চলে গেছেন। আবার তাঁরাই সেখান থেকে নানা ধরনের কাণ্ডকারখানা করছেন। যদি এই মানুষগুলোকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বিচারের আওতায় আনা যেত, তাহলে তাঁরা বিদেশে বসে যে অ্যাকটিভিজম করছেন, সেটা এত সহজে সম্ভব হতো না।

দেশের মধ্যে আওয়ামী লীগের যাঁরা সমর্থক ছিলেন, যাঁরা ভয়াবহ নিপীড়নেও একটা টুঁ শব্দ করেননি এবং এই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন, তাঁদেরও কোনো ধরনের অনুশোচনা হয়নি। আসলে তো আমরা দেখতে পাচ্ছি না যে সঠিকভাবে বিচারটা শুরু হয়েছে। ট্রুথ অ্যান্ড রিকন্সিলেশনে আমরা পৌঁছাতে পারিনি। আমরা শুধু ভাঙাভাঙি দেখছি। আমরা বুঝতে পারছি, আলটিমেটলি জননিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়েছে। সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে যখন বৈধতা দেওয়া হয়, তখন এই সহিংসতা নিজের বিরুদ্ধে হবে, তখন কিছু বলার আর থাকে না। মূল সমস্যাটা হলো বিচার। সরকার সেটা করছে না কেন? সঠিক পদ্ধতি না মেনে একদল মানুষ যখন বিচার করতে বসেন, সে অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে? আগস্টের ৫ তারিখে ভাস্কর্য ভাঙা, বত্রিশ বা গণভবন ভাঙা ছিল আন্দোলনকারী জনতার রোষ। কিন্তু সাত-আট মাস পর যখন ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা, বিভিন্ন পত্রিকা অফিসের সামনে জেয়াফত করা—সেটা তো সংঘবদ্ধ সহিংসতাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এর সবগুলো ঘটনা সরকারের ব্যর্থতার কারণে ঘটেছে।

জুলাই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল না, বরং এটাকে বিভিন্ন সামাজিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থান বলা যায়। রেজিম পরিবর্তনের পরে সামাজিক শক্তিগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কেন?

সামাজিক শক্তির একতা হয়েছিল হত্যাকাণ্ডগুলো থামানোর জন্য। আর হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল একটা জায়গা থেকে। মানে আওয়ামী লীগ ও তার সরকার এবং তার বাহিনী দ্বারা। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। সেই বাহিনীগুলো আবার দলীয় প্রভাবে পরিচালিত হয়েছে। সেই জায়গায় পুরো দেশের মানুষের প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ। এখন কিন্তু সবাই সবার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সামনে নির্বাচন। সে জন্য অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষার কারণে যে যত বেশি স্কোর করতে পারে সেই স্কোরের খেলায় সবাই সবার বিরুদ্ধে লেগে গেছে। যাঁরা জুলাইয়ে রাস্তায় ছিলেন তাঁদের কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের অনুভূতিটা কী? সরকারের কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসা করেনি।

আমি নিজেই তৃণমূল পর্যায়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে শামিল ছিলেন। সবার মধ্যে প্রবল বোধ তৈরি হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে তাঁদের কেউ গোনার মধ্যে রাখেনি এবং তাঁদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। তাঁদের যে ভয়াবহ আন্দোলনের ট্রমা আছে, সেই ট্রমাটা যদি কেউ ড্রিল না করে তাহলে সমাজের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার বোধ জাগ্রত হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, ‘ফিলিং অব এলিয়েনেশন’ বা ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’। পাশাপাশি শিকড় ছেড়া অবস্থা তৈরি হয়। তাঁরা কিছু পেয়েছে কি পায়নি, তার চেয়েও বড় কথা হলো, তাঁরা সমাজের সঙ্গে যুক্ততা বোধ করছেন না এখন আর। কারণ, এত বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জনগোষ্ঠীকে যখন মূল্য দেওয়া হয় না এবং তাদের চরকিনাচনের মধ্যে রাখা হয়, তাদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তখন অস্বাভাবিক দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

আহত-নিহতদের দায়িত্ব না নেওয়ার দায়টা আসলে কার?

প্রথম দায়টা হলো সরকারের। দ্বিতীয় দায় হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফলভোগী দলগুলোরও।

এই গণ-অভ্যুত্থান একটা বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ এনেছিল, সে সুযোগটা হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?

হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ। তবে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের যে সুযোগ এসেছিল সেটাকে সবচেয়ে অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করল বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো। আর রাজনৈতিক দলগুলোর বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না এই গণ-অভ্যুত্থান সফল হলে তারা কী করবে! যদিও তারা এখন ক্রেডিটের দাবি তুলছে। এই ক্রেডিটের দাবি নিয়ে তারা আবার সবাই প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। সবকিছুই কিন্তু প্রবলভাবে ক্ষতটাকে আরও খুঁচিয়েছে। তারা আবার পুরোনো বন্দোবস্তের রাস্তায় হাঁটছে। তারা ভাবছেই না এখানে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা জাগ্রত সচেতনতার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে কাজে লাগানো দরকার। তারা এই জাগ্রত অবস্থাটাকে আবার কীভাবে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ফর্মুলা নিয়ে সারাক্ষণ জপছে। দর্শক হিসেবে আমার এসবই মনে হয়।

অসংখ্য তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল, তারা কিন্তু রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। এই সচেতন ছেলেমেয়েগুলোকে স্পেস দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। আসলে তাদের কোনো ভাবনা ও প্রস্তুতিই নেই। সত্যিই তাদের গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই, যে গণতন্ত্রে দলগুলোকে কেউ প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে। কারণ, শিক্ষার্থীরা তো সবাইকে প্রশ্ন করছিল। এখনো তারা সেটা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয় রাজনৈতিক দলগুলো। এ কারণে পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোতে তেমন কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা মনে করছেন তাঁরা ক্ষমতায় চলে যাচ্ছেন বা ক্ষমতায় অলরেডি চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু সাড়া পেলেও বেশির ভাগ তরুণ দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে।

এই তরুণদের প্রচণ্ড শক্তিকে দেশের কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। তারা যেভাবে ট্রাফিকব্যবস্থা, বন্যা পরিস্থিতি এবং ডাকাতি অবস্থাকে ট্যাকেল করল—প্রতিটা ক্ষেত্রে তারা কিন্তু তাদের কর্তব্যটা পালন করেছে। তারা তাদের কর্তব্যের চেয়ে বেশি পালন করেছে। এই তরুণদের চেয়ে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সামর্থ্য বেশি তারা কিন্তু তরুণদের কাজে লাগাতে পারেনি। এই জায়গা থেকে আমি বলব, আসলেই বৈপ্লবিক মুহূর্তটা স্লিপ করে গেছে। তারা সংস্কার নিয়ে এক জিনিসের মধ্যে যে আটকে আছে, সেখান থেকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জায়গায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ জনগণ এখনো জাগ্রত অবস্থার মধ্যে আছে। তারা প্রবল বাধার মুখেও কিন্তু রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তাদের মতামতটা ব্যক্ত করতে চাচ্ছে। এগুলো সবই ইতিবাচক ব্যাপার। কিন্তু তাদের যে সহযোগিতা পাওয়া উচিত ছিল, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে পায়নি। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই শক্তিকে বুঝতেই পারছে না।

অন্তর্বর্তী সরকার বৈপ্লবিক পরিবর্তনে কেন কিছু করতে পারছে না?

সরকার কেন পারছে না, সেটা তো উপদেষ্টাদের দিকে তাকালে বোঝা যায়। কারণ, বেশির ভাগ উপদেষ্টার ব্যাকগ্রাউন্ড হলো এনজিও। তাঁরা তো বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে দায়িত্ব নেননি। তাঁরা তো নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য গেছেন। এখন তাঁরা আরও সময় নিচ্ছেন, সেটা তো অন্য হিসাব। আগস্ট-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের সে জায়গায় নিয়ে গেছে।

প্রথম থেকে কি এ সরকারকে মনে হয়েছে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যাবে? তারা তো আসলে নিউ লিবারেল ডেভলপমেন্টের অন্যতম মুখপাত্র। সে কারণে তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে যেতে চাইবে না। যেমন ধরুন, শিক্ষার্থীদের যে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি। এই দল যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, সেটা তাদের ক্ষতি করছে। এনসিপির মধ্যে যদি বৈপ্লবিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, সেগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট করছে। এখন তারা জনগণের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু ছয় মাস আগে সেটা করা দরকার ছিল। আমি তাদের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বলেছিলাম, তাদের আসলে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যাওয়া উচিত। কিন্তু তখন তারা সরকারে চলে গেছে। তারা যে এক বছরের মধ্যে প্রত্যেক শহীদের বাসায় যেতে পারল না, সেটা হতাশাজনক।

অভ্যুত্থানে নারীদের অসাধারণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা প্রথম থেকেই দেখছি নারীরা বিভিন্নভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। এরপর মুরাদনগরে ভয়াবহ যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটল। কেন সরকার নারীদের সুরক্ষায় জোরালো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না?

সরকার বলছে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু আমরা নাকি সেসব দেখতে পাই না। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ফ্যাক্টর আছে। ৫ আগস্টের পর থেকে পাশের দেশ থেকে একটা বিশাল ক্যাম্পেইন করা হয়েছে—‘শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ জঙ্গি রাষ্ট্র হয়ে গেছে, দেশটা নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।’ সেই ক্যাম্পেইনের বিষয়টা স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই, এখন যেকোনো ঘটনাকে বেশি করে প্রচারে আনা হয়। যেটা আগে তারা করত না, অন্য কেউ করত। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সমস্যা থাকার পরেও সরকারের উচিত ছিল ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষদের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর তারা যে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না সেটা নিয়ে পরিষ্কার করে কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না। যেমন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট যখন পেশ করা হলো, তখন প্রধান উপদেষ্টা বললেন, এটা একটা যুগান্তকারী দলিল, এটা সবার জন্য পাঠ্য হওয়া উচিত। কিন্তু যেই মুহূর্তে এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য শোনা যায়নি। সরকারই কিন্তু নারী কমিশনের জন্য সম্মানিত ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এই নারীদের অপমানের শিকার হতে হলো। তার বিরুদ্ধে সরকার তো কিছু বলল না এবং করল না। এ দায় যে সরকারের সেটাও স্বীকার করল না। সরকার কি তাহলে তাদের ভয় পেয়েছে? না আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে, সরকার ভয় পায়। এটা নিয়ে আমি একটু সন্দিহান। আমার কাছে মনে হয়, দুটোই হতে পারে।

যদি দ্বিতীয়টি হয় তাহলে চিন্তার ব্যাপার। আর প্রথমটি হলে অন্য রকম চিন্তার ব্যাপার। দুটোই আসলে বাংলাদেশের নারীদের জন্য ভয়াবহ ব্যাপার। কারণ নারীদের জন্য সারভাইবালের বিষয়। আমার যা বয়স, আমাকে কেউ সাইবার বুলিং করলে আমি সেটাকে পাত্তা দেব না। কিন্তু ১৭, ১৮, ১৯ বছর বয়সের মেয়েদের যখন এটা করা হবে, সেটা তো তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কারণ সাইবার স্পেসে বুলিংটা তো জনপরিসরে করা হয়ে থাকে। আর সেটা আবার থেকে যাচ্ছে। কারও যদি ডিপ ফেক ভিডিও ছেড়ে দেওয়া হয়, সেটা থেকে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে এ ধরনের ভিডিওকে আলাদা করতে পারে না। সে কারণে নারীটির সারা জীবনের জন্য ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব কিছু নেতিবাচকতার দিকে চলে যায়। তাঁর পরিবার থেকে সবাই তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে থাকে।

এসবের পরেও যেসব নারী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন, তাঁদের স্যালুট জানাই। এ ক্ষেত্রে আমি বলব, এটা একমাত্র দেশের নারীদের অর্জন। এত কিছুর পরেও তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে এ রকম সক্রিয় নারীদের অংশগ্রহণ এর আগে আমরা কিন্তু দেখিনি। সব আন্দোলনে নারীরা অংশগ্রহণ করলেও এভাবে আর কখনো নারীদের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়নি।

কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, দেশে আবার দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদের উত্থান হতে পারে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

সেটা তো আসতেই পারে। তবে এর দায়টা আসলে সবার। আমরা সবাই পদপদবি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যেই মুহূর্তে পদপদবি নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হলো, সেই সময়ে এ-ওর বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিল। আওয়ামী লীগের লোকের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু, নিজেরা নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে। কারণ, তখন ‘কলঙ্কিতকরণ’ পদ্ধতিটাকে ব্যবহার করা হলো। আপনি যখন নিজের সহযোদ্ধাকে কলঙ্কিত করছেন, যাতে তিনি কোনো পদপদবি না পান। এর চেয়ে সুবিধাজনক সময় ফ্যাসিবাদের কাছে কী থাকতে পারে? কারণ, বিগত সরকার তার আমলাতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কাঠামো রেখে গেছে। কিন্তু সেই কাঠামোকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি।

আর এ ধরনের পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশের সমাজ তৈরি ছিল না। সরকার গঠনের আগে জনগণকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। আর এলিটরা তো সেই কাঠামো পরিবর্তন করতে চাইবে না। সে জন্য বলছি, বিগত সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল, সেগুলো তৈরি করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। বরং উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আগে যেমন আওয়ামী লীগ করার জন্য সবকিছু পাওয়া যেত, এখন সেখানে আওয়ামী লীগ করেন না, সেটা প্রমাণ করতে পারলে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছেন। কেন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তৈরি করা গেল না, সেই দায় এই সুবিধাভোগীদের। কিন্তু বেশি দায় হলো সরকারের—যারা সংস্কার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু সময়টা পার করল, কিন্তু কোনোভাবেই আসল কাজটি করল না।

জুলাই আন্দোলনের চেতনা কেন আমরা ধরে রাখতে পারলাম না?

জুলাই আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কী? সেটাও তো আমরা সবাই জানি না। কারণ, সে সময় তো এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ ছিল না। আমরা সবাই চেয়েছি হত্যাকাণ্ড থামানো এবং শেখ হাসিনার পতন। দিন দিন সরকার বেশি অ্যাগ্রেসিভ হয়েছে এবং আরও বেশি ক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু এইবার যখন এত বেশি ফোর্স প্রয়োগ করার পরেও মানুষ মনে করেছে হাসিনাকে সরাতে পারলে হত্যাকাণ্ড থামানো যাবে। তাঁকে হটানো ছাড়া এর বেশি কোনো চিন্তা কারও মধ্যে ছিল না।

তবে আমি দেখেছিলাম, জুলাই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সে সময় দেয়ালে যেসব কথাবার্তা লিখেছে বা ডিজিটাল কনটেন্ট বানিয়েছে, সেখানে একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তাদের কাছে ইনক্লুসিভনেসের কথা ছিল। তারা বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারের কথা বলেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য মুক্তির কথা বলেছে। আমরা আসলেই আন্দোলনকারীদের মধ্যে বৈষম্যহীন এবং ইনক্লুসিভনেসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হারিয়ে গেছে। কারণ, ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম সংখ্যাগরিষ্ঠের আকাঙ্ক্ষাটা এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইসলামী আন্দোলন ও হেফাজতে ইসলাম ৩ আগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিল। এদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা অনুযায়ী আমাদের চলতে হবে—এ পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো? আমার মনে হয়, এ পরিস্থিতিটাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। আবার এদের গুরুত্ব হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো কারও শক্তি থাকতে পারে। এদের পেছনে আসলে দেশের মধ্যে বা বাইরের কোনো শক্তি বা উত্তর পাড়ার ইন্ধন থাকতে পারে কি না সেটা আমার জানা নেই। তবে ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার কাছে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষাটাই আমার চাওয়া ছিল।

আর একটা কথা, জুলাই চেতনাকে আমরা নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শবোধ দ্বারা দেখতে চেয়েছি। এ কারণে কারও সঙ্গে কারওটা মেলেনি। অনেকে হয়তো বলতে পারে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। আসলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সহস্রাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আর মানুষ তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছে।

আর ডানপন্থী ফ্যাসিবাদ আসার যে আশঙ্কার কথা বললেন, সেটা তো সারা বিশ্বে এসেছে। তবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এ কারণে আমি বলতে চাই, যারা এ ধরনের ফ্যাসিবাদ চান না এবং যাঁরা অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি ছিলেন, তাঁদের সবার উচিত একটা প্ল্যাটফর্মে আসা, আমরা যাতে পরের ধাপে অগ্রসর হতে পারি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত