Ajker Patrika

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ

জনগণ কি মালিক না প্রজা

এম আর খায়রুল উমাম
ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে সড়ক ও সেতু খাতে ৫১ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে সড়ক ও সেতু খাতে ৫১ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

কয়েক দিন আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে সড়ক ও সেতু খাতে ৫১ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কেউই দেশ ও জাতির স্বার্থের দিকটি মাথায় রেখে এক টাকার কাজকে নিজের মনে করে ৮০ পয়সায় শেষ করার কোনো রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

সবাই ভেবেছে ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা একবার যখন পাওয়া গিয়েছে তখন তা চিরস্থায়ী; এবার আমাদের কোনো দোষত্রুটিই ধরাছোঁয়ার মধ্যে আসবে না! সবাই ভেবেছে দেশের স্বাধীনতা তো আছেই, এখন প্রথমে নিজের স্বাধীনতা নিশ্চিত করি, নিজের ও পরিবারের অভিজাত জীবন নিশ্চিত করি, দলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করি, তারপর যদি সুযোগ থাকে তাহলে না হয় সাধারণ মানুষের কথা ভাবা যাবে! এভাবেই দেশ ও জাতি স্বজাতির শাসনে থেকে স্বাধীনতা উপভোগ করে চলেছে।

দেশের সাধারণ মানুষ জানে এবং বোঝে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে এমন একটা প্রকল্পও হয়নি যা সময়ে আর প্রাক্কলিত ব্যয়ে শেষ হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু স্বাধীনতার অর্থ বুঝে তার মর্যাদা রক্ষার মানসিকতা আমাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। সবাই ভোগের নেশায় ক্ষমতাবান হতে উদ্যোগী হয়েছে এবং নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট তৈরি করে জনগণের অর্থ লোপাটের যত প্রকারের প্রক্রিয়া আছে, তাকে ব্যবহার করেছে। তাই সাধারণ মানুষের জীবন উৎসর্গ আর মা-বোনের সম্মানের মূল্যে অর্জিত স্বাধীনতাকেও তারা নিজেদের অর্জন হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে মহান এ অর্জনের সুফলকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে। সাধারণ মানুষ শুধু উপেক্ষিতই হয়নি, তারা একমাত্র ওপরে ওঠার মই হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে বিগত ৫৩ বছরে। তাই জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৫ বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা লোপাটের শীর্ষ সংবাদও আজ সাধারণ মানুষকে খুব একটা নাড়া দেয় বলে মনে হয় না।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও দেশের ক্ষমতাবানরা এখনো একটা বিষয় হৃদয়ে ধারণ করতে পারেনি। বিষয়টি এই যে এখন আর ব্রিটিশ-পাঠানরা দেশ শাসন করে না, স্বজাতির শাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে। যদিও সাধারণ মানুষের জন্য শুধু স্বজাতির শাসন ছাড়া অন্য কোনো প্রাপ্তি খুঁজে পাওয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার পরও কিছু পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। সবার ওপরে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ লিখে রেখে সাধারণ মানুষকে পুরোপুরি এতিম করে দিয়েছে ক্ষমতাবান মানুষগুলো।

সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সর্বক্ষেত্রে লোপাটের স্বর্গরাজ্য তৈরি করেছে ক্ষমতাবানেরা। টিআইবি শুধু সড়ক ও সেতু বিভাগের অর্থ লোপাটের ইতিহাস তুলে ধরেছে কিন্তু দেশে কি এমন একটা অধিদপ্তর বা বিভাগ পাওয়া যাবে যেখানে লোপাটের ইতিহাস নেই? অর্থ লোপাটের এমন শতসহস্র প্রক্রিয়া দেশে চালু করা হয়েছে, যে প্রক্রিয়াগুলো মাঝেমধ্যে সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে চলে যায়।

দেশের সার কারখানা থেকে শুরু করে আধুনিককালের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র—একটা কলকারখানাও পূর্বনির্ধারিত বাজেটে শেষ করা যায়নি। শুধু তা-ই নয়, যে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, তার ধারেকাছে পৌঁছাতে পারেনি প্রকল্পগুলো। জিকে প্রকল্প, মনু প্রকল্প থেকে শুরু করে আধুনিককালের তিস্তা প্রকল্প—কোনোটাই পূর্বনির্ধারিত বাজেটে শেষ করা যায়নি। তদুপরি এই প্রকল্পগুলোর সব কটিই লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা জনগণের অর্থ লোপাট করে যা উপহার দিয়েছে, তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ করতে না পারার কোনো দায়িত্ব কেউ নেয়নি, জবাবদিহিও করেনি। দেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে জাতির সামনে সব প্রকল্পের তথ্য আনে, তাহলে বিশ্বাস করি সড়ক ও সেতু খাতের চেয়ে অনেক ভয়ংকর তথ্য বের হয়ে আসবে। নিজস্ব অর্থায়নের পদ্মা সেতুও অর্থ লোপাটের এ পরিকল্পনা থেকে বাদ যায়নি। আসলে স্বাধীনতা আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারেনি, তাই আমাদের চরিত্রেরও কোনো পরিবর্তন হয়নি।

দেশের প্রকল্পগুলো থেকে অর্থ লোপাট হয়েছে সেটাই শুধু নয়, সাধারণ মানুষের দুর্ভাগ্য এই যে প্রকল্পগুলো জীবনকালও পায়নি। সাধারণ মানুষ শুধু দেখে ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অথচ আমাদের ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সেতুগুলো নির্মাণের ৩০-৩৫ বছরের মধ্যেই পুনর্নির্মাণ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। বর্তমান সময়ে একটা সড়ক এক মাথা থেকে নির্মাণ শুরু হওয়ার পর কাজ যতই এগিয়েছে, ততই নির্মিত পেছনের সড়ক ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের মহাসড়ক কবে শুরু হয়েছে এবং কবে শেষ হবে, তা কেউ হিসাব-নিকাশ করেই নির্ধারণ করতে পারছে না। প্রকল্প শেষ করার নির্ধারিত সময়ের এক যুগ পরও চলমান আছে অনেক প্রকল্প, কারণ সংশ্লিষ্টরা জানে এই প্রকল্পের সময়সীমা শেষ হওয়ার পরপরই নতুন প্রকল্পের অনুমোদন হয়ে যাবে এবং আবার নির্মাণকাজ শুরু করতে হবে।

সবকিছু জেনে, দেখে, বুঝে সাধারণ মানুষ শুধু বলতে চায়, দেশের প্রকল্প থেকে অর্থ লোপাট হবে তা তারা জানে কিন্তু সেই প্রকল্পের ফলাফল যদি তারা শান্তিমতো ব্যবহার করতে পারে, তাহলেই অর্থের বিষয়ে কোনো ভাবনাই তাদের মনে আসবে না।

দেশের সাধারণ মানুষ খুব ভালো করেই জেনে-বুঝে গিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মালিকরা আজ প্রজারও অধম হয়ে গিয়েছে। আর বৈষম্য হয়েছে আকাশছোঁয়া। জীবনমানের বৈষম্য, শিক্ষায় বৈষম্য এভাবে বলতে গেলে সাধারণ মানুষের প্রতি হওয়া এমন শত শত বৈষম্যের মহাকাব্য সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবে। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে এমন আকাশছোঁয়া বৈষম্য থেকে সাধারণ মানুষকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বের করে আনতে পারবে কি না, জানি না। তবে এখন পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধীদের কর্মকাণ্ড সাধারণ জনগণকে খুব স্বস্তির স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছে, এমন দাবি করার সময় বোধ করি আসেনি।

লেখক: এম আর খায়রুল উমাম

সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পদোন্নতি দিয়ে ৬৫ হাজার সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা: ডিজি

দিনাজপুরে হিন্দু নেতাকে অপহরণ করে হত্যা: ভারত সরকার ও বিরোধী দল কংগ্রেসের উদ্বেগ

সমালোচনার মুখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের নিয়োগ বাতিল

আজ থেকে ৫০০ টাকায় মিলবে ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট

মির্জা ফখরুলের কাছে অভিযোগ, ১৬ দিনের মাথায় ঠাকুরগাঁও থানার ওসি বদলি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত