চিররঞ্জন সরকার
এককালে চাকা খুলে যাওয়া বলতে বোঝাত ভাঙা ঠেলাগাড়ি, পুরোনো সাইকেল কিংবা ফুচকার ভ্যান। কিন্তু আজকাল সেই সাদামাটা ঘটনা আর মহল্লার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। এখন আকাশেও বিমানের চাকা খুলে যাচ্ছে! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। আমাদের জাতীয় উড়োজাহাজ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসার পথে পেছনের একটি চাকা খুলে পড়ে গেছে!
এই দৃশ্য কোনো মঞ্চনাটকের অংশ নয়, কোনো সিনেমার ভিএফএক্সও নয়, বরং একেবারে বাস্তব, রিয়েল-টাইম এক ‘মিরাকল’। পেছনের চাকা ছাড়াই বিমান আকাশে উড়ছে, অবতরণ করছে এবং অক্ষত থাকছে। পাইলট সাহেব যেভাবে একপাশে ভর দিয়ে বিমানটিকে নামিয়েছেন, তা দেখে মনে হয় যেন তিনি ছোটবেলায় গরুর গাড়ির কাত হয়ে চলার বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
আমরা এত দিন শুনে এসেছি, ‘চাকা না থাকলে গাড়ি চলে কীভাবে?’ এখন বুঝছি, ‘চাকা না থাকলেও দেশ চলে, প্রতিষ্ঠান চলে, এমনকি বিমানও চলে!’ শুধু একটু বেশি ইমান, একচিমটি দক্ষতা আর এক ঢোক ম্যাজিক রিয়ালিজম হলেই যথেষ্ট।
বিখ্যাত সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর লেখায় দাদার ভূতের সঙ্গে নাতির ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প বলতেন, আর আমরা লিখছি উড়োজাহাজের চাকা খুলে পড়ার পরেও নিরাপদে অবতরণের কাহিনি। এ যেন ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব মেইনটেন্যান্স এরর’। একদিকে পেছনের চাকা খসে পড়ছে, অন্যদিকে বলা হচ্ছে—‘পাইলটের উপস্থিত বুদ্ধি আমাদের গর্ব।’ এদিকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীদের চাকরির বয়স বাড়ছে, বেতন বাড়ছে, অথচ তাঁরা কী করছেন? হয়তো নাট-বোল্ট পরীক্ষা না করে চাকার ওপর ফুলের নকশা আঁকছেন। ‘ভাই, বিমানে বেগুনি গোলাপের কাজ আছে, চাকা একটু ঢিলা হলেও চলবে!’
এটা কি নিছক কারিগরি ব্যর্থতা? নাকি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সেই চিরায়ত ‘যেমন পারো চালাও’ নীতির বাস্তব প্রতিফলন? এই যে চাকা ছাড়াই বিমান নিরাপদে অবতরণ করল, এটা কি কেবল পাইলটের সাহস, নাকি জনগণের ভাগ্য?
বিমানবন্দরে যাত্রীদের মুখে হাসি, চোখে জল। তাঁরা নিচে নেমেই বলছেন, ‘আল্লাহ বাঁচাইছে!’ কেউ কেউ তো বলেই ফেলছেন, ‘জানতাম, দেশ যেভাবে চলে, তাতে বিমানের চাকা না থাকলেও চলবে!’ এ একধরনের বিশ্বাস, যা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না—এটা আমাদের জাতীয় ‘সারভাইভাল স্কিল’।
বিমান চলছে। অথচ দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রেল, ব্যাংকিং—সব খাতে চাকা খসে খসে পড়ছে একের পর এক। কিন্তু কেউ যেন তা দেখছে না। কারণ, এখানে চাকার মূল্য নেই, আছে কেবল ‘ন্যারেটিভ’। যেমন ধরুন, যখন ব্যাংকের টাকা উধাও হয়, তখন বলা হয় ‘এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, আর যখন বিমানের চাকা উধাও হয়, তখন বলা হয়, ‘এটা একটা বিরল ঘটনা!’
সবাই বলছে, পাইলট দক্ষ। তা ঠিক, পাইলট সাহেব আরেকটু সাহসী হলে তো হয়তো একেবারে চাকা ছাড়াই সরাসরি বনানী স্টেডিয়ামে নামতেন, সঙ্গে কয়েকটা গোলও দিতেন! কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই চাকা খুলে পড়ার জন্য কে দায়ী হবে? নাকি সবকিছুর মতো এটাও একটা ‘মিরাকল’ বলে চালিয়ে দেওয়া হবে?
প্রকৌশলীরা নিশ্চয়ই বলবেন, ‘চাকা খুলে পড়লেও সেটা তো যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, বরং এটা প্রকৃতির আহ্বান। একধরনের “চাকার মুক্তি আন্দোলন”। এত দিন যা বাঁধা ছিল, এখন তা মুক্ত!’
অবশ্য বাংলাদেশ এখন ‘চাকা ছাড়া এগিয়ে চলার’ ফর্মুলা তৈরি করে ফেলেছে। বিমানের চাকা যায়, মানুষের ন্যায়বিচারের চাকা বন্ধ, রাষ্ট্রযন্ত্রের চাকা জ্যাম, আর সংসদের চাকা তো ঘোরেই না—কেবল হুইলচেয়ারগুলো ঘোরে মাঝে মাঝে।
তবু সবাই বলছে, ‘চলছে তো, সমস্যা কী?’ বিমান চলছে চাকা ছাড়া। দেশও চলছে দায়বদ্ধতা ছাড়া। সবকিছু চলছে, কিছুই ঠিকমতো না চললেও। আমরা বলি—‘বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার দেশ।’ এখন বোঝা যাচ্ছে, সেই সম্ভাবনার অন্যতম দিক হলো ‘উড়োজাহাজ চাকা ছাড়াও উড়তে পারে’—এমন এক অনন্য গৌরব।
বিমান বাংলাদেশের অবস্থা এখন অনেকটা ফটোশপে এডিট করা পাসপোর্ট ছবির মতো—দেখতে ঝকঝকে, কিন্তু ভেতরে জং ধরা চাকা। বাইরে লাল-সবুজ রঙের গাঢ় দেশপ্রেম, ভেতরে পাইলটদের মাথায় হাত। ঠিক যেন বাইরে পতাকা, ভেতরে পলিথিন!
একসময় ছিল, ‘বিমান’ শব্দটা শুনলেই গর্বে বুক ফুলে উঠত—এখন তো বুকের ভেতর ধড়ফড় করে ‘আজ চাকা যাবে, না ব্রেক ফেল?’ চাকা খুলে পড়ার ঘটনায় বোঝা গেল, এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স এখন ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে চলে। মানে, আগে চলাই, পরে দেখি কিছু খুলে পড়ে কি না।
বিমান বাংলাদেশ এখন আকাশে উড়ে বেড়ানো এক ক্লাসিক ব্যর্থতার প্রতীক। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে খাবার নেই, আর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে টয়লেটের পানির ব্যবস্থা নেই। যাত্রীদের বিনোদনের একমাত্র ভরসা—সামনের সিটে বসে থাকা কোনো শিশুর কান্না কিংবা জানালার বাইরের কুয়াশা। যেখানে অন্য দেশে বিমান খারাপ হলে মেইনটেন্যান্স টিম এক ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেয়, সেখানে আমাদের দেশে খারাপ চাকা খুলে ‘জাদুঘরে পাঠানো হয় কি না’—সে নিয়েও সন্দেহ। বোধ হয় তাদের অফিসে লেখা আছে: ‘চাকার গায়ে ফাটল ধরা মানেই এটা পুরাকীর্তি, রক্ষণাবেক্ষণ নয়, সংরক্ষণ!’ আর প্রকৌশলীদের ভূমিকা এমন, যেন তাঁরা বিমানের অংশ নন, বরং বিমানের বিপরীতে এক স্বতন্ত্র শিল্পকলা আন্দোলন চালাচ্ছেন। তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি অনেকটা বাঙালি বাবার গাড়ির মিস্ত্রির কাছে বলা সেই চিরায়ত ডায়ালগের মতো—‘চালায়ে দেখেন ভাই, নিজের থেকেই ঠিক হইয়া যায় কি না।’
বিমান বাংলাদেশ বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে, অথচ একটুও বিমর্ষ নয়। এই প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য এমন, যেন ডায়াবেটিস রোগী প্রতিদিন তিনবার জিলাপি খায়—‘যা হওয়ার হবে, আগে মজা নে!’
একবার বলা হয়েছিল, ‘বিমানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।’ এখন বোঝা যাচ্ছে, সেটা ছিল বিমানের ককপিটে বসে কল্পনার গল্প লেখার চেষ্টা। লাভ তো দূরের কথা, যাত্রীরা সঠিক সময়ে প্লেনে উঠতে পারলেই আমরা বলি–‘এই তো, সব ঠিকঠাক চলছে!’
যাত্রীদের কাছে এখন বিমানের টিকিট মানে লটারি। আপনি হয়তো সিলেট যাচ্ছেন, কিন্তু হঠাৎ জানতে পারলেন—‘এই ফ্লাইট এখন বরিশাল হয়ে যাচ্ছে, কারণ রানওয়ের পাশে জ্যাম!’ কোনো প্ল্যান নেই, কোনো ব্যাকআপ নেই, শুধু ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত এক আকাশযান।
আরও ভয়ংকর সত্য হলো, দুর্নীতি-দুর্বলতা-দায়মুক্তি এতটাই সাধারণ হয়ে গেছে যে আজ চাকা খুলে পড়লেও আমরা তেমন ভয় পাই না। কারণ, আমরা জানি, ‘বিমান বাঁচবে না বাঁচবে না করেও শেষমেশ বাঁচেই। ইনশা আল্লাহ।’ এই জাতীয় আস্থা পৃথিবীর কোথাও নেই।
এত কিছুর পরও যদি কেউ বলে—‘বিমান ভালো চলছে,’ তবে ধরে নিতে হবে তিনি হয় খোলা আকাশে ইমান দিয়ে উড়ছেন, অথবা তিনি বিমানের জেনারেল ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং ম্যানুয়ালের লেখক।
চাকা খুলে পড়ছে, সিস্টেম কাজ করছে না, লোকসান বাড়ছে, যাত্রীরা আতঙ্কে ভুগছে—এ সবকিছুর মধ্যেও একটা কিছুর স্থিতি আছে: ‘আমরা অভিযোগ করি না। কারণ আমরা অভ্যস্ত।’
তাই বলি ভাই, ম্যাজিক রিয়ালিজম আমাদের বাস্তবতা। শুধু একটা অনুরোধ—পরেরবার চাকা খসে পড়লে প্লেনের নিচে একটা বিশাল ব্যানার ঝুলিয়ে দিন—‘আমরা চলি, কারণ থামলে দায় দিতে হয়।’
আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো আর যন্ত্র নয়, ওরা এখন ‘বিশ্বাসনির্ভর’। চোখে কিছু দেখা গেলেও বলার দরকার নেই। আপনি যদি বলেন, ‘বিমানের চাকা পড়েছে’—তখনই আপনি রাষ্ট্রবিরোধী, কারণ আপনি বললেন, রাষ্ট্রের ভারসাম্য কমেছে।
পরিশেষে অনেক বছর আগে শোনা বিমান বাংলাদেশ নিয়ে একটি কৌতুক:
বিমানের সাউন্ড সিস্টেমে বাজছে—
স্বাগতম ফ্লাইট ৪২০-এ, মোগাদিসু টু ঢাকা! সুপ্রভাত, সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ। আমি ক্যাপ্টেন আবদুল কুদ্দুস, সঙ্গে আছেন কো-পাইলট মালেক বিন মজিদ ও আকলিমা পারভীন। ৬ দিনের বিলম্বে যাত্রা শুরু—আবহাওয়া, ইঞ্জিন সমস্যা আর আমার পেটের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ—সব মিলিয়েই এই বিলম্ব। আমাদের গন্তব্য? নিশ্চিত না। উপমহাদেশের যেকোনো জায়গায়, এমনকি কারও গ্রামের পুকুরেও নামতে পারি। সাঁতার জানা থাকলে আপনি বিশেষ সুবিধাভোগী! গর্বের সঙ্গে বলি: গত বছর আমাদের ৩৬ শতাংশ যাত্রী গন্তব্যে পৌঁছেছেন। যাত্রাপথে ইঞ্জিনের শব্দ বিরক্তিকর লাগলে জানাবেন, ইঞ্জিন বন্ধ করে দেব। বিনিময়ে থাকছে ‘ডাইল’ চা আর ‘বেলা’ বিস্কুট। আজ কোনো সিনেমাই নেই। ‘রহিমার নাতি কেন হাজতে’ সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে জানালায় চোখ রাখুন—পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে ক্যাটরিনা কাইফ নাচছেন কি না, দেখে নিতে পারেন। ধোঁয়া? আতঙ্ক নয়। ইঞ্জিন থেকেই বেরোয়। আমাদের প্রকৌশলী ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করতে পারেন। ছাদ থেকে পানি পড়লে সেটাও স্বাভাবিক। তোয়ালে আর হাতপাখা চাইলে বিমানবালার শরণাপন্ন হন। সিটবেল্ট বেঁধে নিন। না পেলে কোমরের বেল্ট দিয়ে কাজ চালান। দাঁড়িয়ে থাকলে নিজেকে স্যুটকেসে বেঁধে ফেলুন। সম্মানিত বিমানবালাদের খুব কাছাকাছি গিয়ে সাহায্য চাইবেন না, আপনারও ঘরে মা-বোন আছেন! এই প্রথম ও শেষ ফ্লাইটে ভ্রমণ করার জন্য ধন্যবাদ। কেয়ামতের দিন পুলসিরাতে আবার দেখা হবে ইনশা আল্লাহ। ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন। ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি...
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
এককালে চাকা খুলে যাওয়া বলতে বোঝাত ভাঙা ঠেলাগাড়ি, পুরোনো সাইকেল কিংবা ফুচকার ভ্যান। কিন্তু আজকাল সেই সাদামাটা ঘটনা আর মহল্লার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। এখন আকাশেও বিমানের চাকা খুলে যাচ্ছে! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। আমাদের জাতীয় উড়োজাহাজ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসার পথে পেছনের একটি চাকা খুলে পড়ে গেছে!
এই দৃশ্য কোনো মঞ্চনাটকের অংশ নয়, কোনো সিনেমার ভিএফএক্সও নয়, বরং একেবারে বাস্তব, রিয়েল-টাইম এক ‘মিরাকল’। পেছনের চাকা ছাড়াই বিমান আকাশে উড়ছে, অবতরণ করছে এবং অক্ষত থাকছে। পাইলট সাহেব যেভাবে একপাশে ভর দিয়ে বিমানটিকে নামিয়েছেন, তা দেখে মনে হয় যেন তিনি ছোটবেলায় গরুর গাড়ির কাত হয়ে চলার বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
আমরা এত দিন শুনে এসেছি, ‘চাকা না থাকলে গাড়ি চলে কীভাবে?’ এখন বুঝছি, ‘চাকা না থাকলেও দেশ চলে, প্রতিষ্ঠান চলে, এমনকি বিমানও চলে!’ শুধু একটু বেশি ইমান, একচিমটি দক্ষতা আর এক ঢোক ম্যাজিক রিয়ালিজম হলেই যথেষ্ট।
বিখ্যাত সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর লেখায় দাদার ভূতের সঙ্গে নাতির ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প বলতেন, আর আমরা লিখছি উড়োজাহাজের চাকা খুলে পড়ার পরেও নিরাপদে অবতরণের কাহিনি। এ যেন ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব মেইনটেন্যান্স এরর’। একদিকে পেছনের চাকা খসে পড়ছে, অন্যদিকে বলা হচ্ছে—‘পাইলটের উপস্থিত বুদ্ধি আমাদের গর্ব।’ এদিকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলীদের চাকরির বয়স বাড়ছে, বেতন বাড়ছে, অথচ তাঁরা কী করছেন? হয়তো নাট-বোল্ট পরীক্ষা না করে চাকার ওপর ফুলের নকশা আঁকছেন। ‘ভাই, বিমানে বেগুনি গোলাপের কাজ আছে, চাকা একটু ঢিলা হলেও চলবে!’
এটা কি নিছক কারিগরি ব্যর্থতা? নাকি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সেই চিরায়ত ‘যেমন পারো চালাও’ নীতির বাস্তব প্রতিফলন? এই যে চাকা ছাড়াই বিমান নিরাপদে অবতরণ করল, এটা কি কেবল পাইলটের সাহস, নাকি জনগণের ভাগ্য?
বিমানবন্দরে যাত্রীদের মুখে হাসি, চোখে জল। তাঁরা নিচে নেমেই বলছেন, ‘আল্লাহ বাঁচাইছে!’ কেউ কেউ তো বলেই ফেলছেন, ‘জানতাম, দেশ যেভাবে চলে, তাতে বিমানের চাকা না থাকলেও চলবে!’ এ একধরনের বিশ্বাস, যা বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না—এটা আমাদের জাতীয় ‘সারভাইভাল স্কিল’।
বিমান চলছে। অথচ দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রেল, ব্যাংকিং—সব খাতে চাকা খসে খসে পড়ছে একের পর এক। কিন্তু কেউ যেন তা দেখছে না। কারণ, এখানে চাকার মূল্য নেই, আছে কেবল ‘ন্যারেটিভ’। যেমন ধরুন, যখন ব্যাংকের টাকা উধাও হয়, তখন বলা হয় ‘এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, আর যখন বিমানের চাকা উধাও হয়, তখন বলা হয়, ‘এটা একটা বিরল ঘটনা!’
সবাই বলছে, পাইলট দক্ষ। তা ঠিক, পাইলট সাহেব আরেকটু সাহসী হলে তো হয়তো একেবারে চাকা ছাড়াই সরাসরি বনানী স্টেডিয়ামে নামতেন, সঙ্গে কয়েকটা গোলও দিতেন! কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই চাকা খুলে পড়ার জন্য কে দায়ী হবে? নাকি সবকিছুর মতো এটাও একটা ‘মিরাকল’ বলে চালিয়ে দেওয়া হবে?
প্রকৌশলীরা নিশ্চয়ই বলবেন, ‘চাকা খুলে পড়লেও সেটা তো যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, বরং এটা প্রকৃতির আহ্বান। একধরনের “চাকার মুক্তি আন্দোলন”। এত দিন যা বাঁধা ছিল, এখন তা মুক্ত!’
অবশ্য বাংলাদেশ এখন ‘চাকা ছাড়া এগিয়ে চলার’ ফর্মুলা তৈরি করে ফেলেছে। বিমানের চাকা যায়, মানুষের ন্যায়বিচারের চাকা বন্ধ, রাষ্ট্রযন্ত্রের চাকা জ্যাম, আর সংসদের চাকা তো ঘোরেই না—কেবল হুইলচেয়ারগুলো ঘোরে মাঝে মাঝে।
তবু সবাই বলছে, ‘চলছে তো, সমস্যা কী?’ বিমান চলছে চাকা ছাড়া। দেশও চলছে দায়বদ্ধতা ছাড়া। সবকিছু চলছে, কিছুই ঠিকমতো না চললেও। আমরা বলি—‘বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার দেশ।’ এখন বোঝা যাচ্ছে, সেই সম্ভাবনার অন্যতম দিক হলো ‘উড়োজাহাজ চাকা ছাড়াও উড়তে পারে’—এমন এক অনন্য গৌরব।
বিমান বাংলাদেশের অবস্থা এখন অনেকটা ফটোশপে এডিট করা পাসপোর্ট ছবির মতো—দেখতে ঝকঝকে, কিন্তু ভেতরে জং ধরা চাকা। বাইরে লাল-সবুজ রঙের গাঢ় দেশপ্রেম, ভেতরে পাইলটদের মাথায় হাত। ঠিক যেন বাইরে পতাকা, ভেতরে পলিথিন!
একসময় ছিল, ‘বিমান’ শব্দটা শুনলেই গর্বে বুক ফুলে উঠত—এখন তো বুকের ভেতর ধড়ফড় করে ‘আজ চাকা যাবে, না ব্রেক ফেল?’ চাকা খুলে পড়ার ঘটনায় বোঝা গেল, এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স এখন ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে চলে। মানে, আগে চলাই, পরে দেখি কিছু খুলে পড়ে কি না।
বিমান বাংলাদেশ এখন আকাশে উড়ে বেড়ানো এক ক্লাসিক ব্যর্থতার প্রতীক। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে খাবার নেই, আর অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে টয়লেটের পানির ব্যবস্থা নেই। যাত্রীদের বিনোদনের একমাত্র ভরসা—সামনের সিটে বসে থাকা কোনো শিশুর কান্না কিংবা জানালার বাইরের কুয়াশা। যেখানে অন্য দেশে বিমান খারাপ হলে মেইনটেন্যান্স টিম এক ঘণ্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেয়, সেখানে আমাদের দেশে খারাপ চাকা খুলে ‘জাদুঘরে পাঠানো হয় কি না’—সে নিয়েও সন্দেহ। বোধ হয় তাদের অফিসে লেখা আছে: ‘চাকার গায়ে ফাটল ধরা মানেই এটা পুরাকীর্তি, রক্ষণাবেক্ষণ নয়, সংরক্ষণ!’ আর প্রকৌশলীদের ভূমিকা এমন, যেন তাঁরা বিমানের অংশ নন, বরং বিমানের বিপরীতে এক স্বতন্ত্র শিল্পকলা আন্দোলন চালাচ্ছেন। তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতি অনেকটা বাঙালি বাবার গাড়ির মিস্ত্রির কাছে বলা সেই চিরায়ত ডায়ালগের মতো—‘চালায়ে দেখেন ভাই, নিজের থেকেই ঠিক হইয়া যায় কি না।’
বিমান বাংলাদেশ বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে, অথচ একটুও বিমর্ষ নয়। এই প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য এমন, যেন ডায়াবেটিস রোগী প্রতিদিন তিনবার জিলাপি খায়—‘যা হওয়ার হবে, আগে মজা নে!’
একবার বলা হয়েছিল, ‘বিমানকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।’ এখন বোঝা যাচ্ছে, সেটা ছিল বিমানের ককপিটে বসে কল্পনার গল্প লেখার চেষ্টা। লাভ তো দূরের কথা, যাত্রীরা সঠিক সময়ে প্লেনে উঠতে পারলেই আমরা বলি–‘এই তো, সব ঠিকঠাক চলছে!’
যাত্রীদের কাছে এখন বিমানের টিকিট মানে লটারি। আপনি হয়তো সিলেট যাচ্ছেন, কিন্তু হঠাৎ জানতে পারলেন—‘এই ফ্লাইট এখন বরিশাল হয়ে যাচ্ছে, কারণ রানওয়ের পাশে জ্যাম!’ কোনো প্ল্যান নেই, কোনো ব্যাকআপ নেই, শুধু ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত এক আকাশযান।
আরও ভয়ংকর সত্য হলো, দুর্নীতি-দুর্বলতা-দায়মুক্তি এতটাই সাধারণ হয়ে গেছে যে আজ চাকা খুলে পড়লেও আমরা তেমন ভয় পাই না। কারণ, আমরা জানি, ‘বিমান বাঁচবে না বাঁচবে না করেও শেষমেশ বাঁচেই। ইনশা আল্লাহ।’ এই জাতীয় আস্থা পৃথিবীর কোথাও নেই।
এত কিছুর পরও যদি কেউ বলে—‘বিমান ভালো চলছে,’ তবে ধরে নিতে হবে তিনি হয় খোলা আকাশে ইমান দিয়ে উড়ছেন, অথবা তিনি বিমানের জেনারেল ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং ম্যানুয়ালের লেখক।
চাকা খুলে পড়ছে, সিস্টেম কাজ করছে না, লোকসান বাড়ছে, যাত্রীরা আতঙ্কে ভুগছে—এ সবকিছুর মধ্যেও একটা কিছুর স্থিতি আছে: ‘আমরা অভিযোগ করি না। কারণ আমরা অভ্যস্ত।’
তাই বলি ভাই, ম্যাজিক রিয়ালিজম আমাদের বাস্তবতা। শুধু একটা অনুরোধ—পরেরবার চাকা খসে পড়লে প্লেনের নিচে একটা বিশাল ব্যানার ঝুলিয়ে দিন—‘আমরা চলি, কারণ থামলে দায় দিতে হয়।’
আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো আর যন্ত্র নয়, ওরা এখন ‘বিশ্বাসনির্ভর’। চোখে কিছু দেখা গেলেও বলার দরকার নেই। আপনি যদি বলেন, ‘বিমানের চাকা পড়েছে’—তখনই আপনি রাষ্ট্রবিরোধী, কারণ আপনি বললেন, রাষ্ট্রের ভারসাম্য কমেছে।
পরিশেষে অনেক বছর আগে শোনা বিমান বাংলাদেশ নিয়ে একটি কৌতুক:
বিমানের সাউন্ড সিস্টেমে বাজছে—
স্বাগতম ফ্লাইট ৪২০-এ, মোগাদিসু টু ঢাকা! সুপ্রভাত, সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ। আমি ক্যাপ্টেন আবদুল কুদ্দুস, সঙ্গে আছেন কো-পাইলট মালেক বিন মজিদ ও আকলিমা পারভীন। ৬ দিনের বিলম্বে যাত্রা শুরু—আবহাওয়া, ইঞ্জিন সমস্যা আর আমার পেটের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ—সব মিলিয়েই এই বিলম্ব। আমাদের গন্তব্য? নিশ্চিত না। উপমহাদেশের যেকোনো জায়গায়, এমনকি কারও গ্রামের পুকুরেও নামতে পারি। সাঁতার জানা থাকলে আপনি বিশেষ সুবিধাভোগী! গর্বের সঙ্গে বলি: গত বছর আমাদের ৩৬ শতাংশ যাত্রী গন্তব্যে পৌঁছেছেন। যাত্রাপথে ইঞ্জিনের শব্দ বিরক্তিকর লাগলে জানাবেন, ইঞ্জিন বন্ধ করে দেব। বিনিময়ে থাকছে ‘ডাইল’ চা আর ‘বেলা’ বিস্কুট। আজ কোনো সিনেমাই নেই। ‘রহিমার নাতি কেন হাজতে’ সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে জানালায় চোখ রাখুন—পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে ক্যাটরিনা কাইফ নাচছেন কি না, দেখে নিতে পারেন। ধোঁয়া? আতঙ্ক নয়। ইঞ্জিন থেকেই বেরোয়। আমাদের প্রকৌশলী ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করতে পারেন। ছাদ থেকে পানি পড়লে সেটাও স্বাভাবিক। তোয়ালে আর হাতপাখা চাইলে বিমানবালার শরণাপন্ন হন। সিটবেল্ট বেঁধে নিন। না পেলে কোমরের বেল্ট দিয়ে কাজ চালান। দাঁড়িয়ে থাকলে নিজেকে স্যুটকেসে বেঁধে ফেলুন। সম্মানিত বিমানবালাদের খুব কাছাকাছি গিয়ে সাহায্য চাইবেন না, আপনারও ঘরে মা-বোন আছেন! এই প্রথম ও শেষ ফ্লাইটে ভ্রমণ করার জন্য ধন্যবাদ। কেয়ামতের দিন পুলসিরাতে আবার দেখা হবে ইনশা আল্লাহ। ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন। ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি...
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
চিড়িয়াখানা হচ্ছে বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের বিনোদনকেন্দ্র। কিন্তু সম্প্রতি একটি ঘটনায় মনে হচ্ছে, এটা আর শুধু বিনোদনকেন্দ্র না হয়ে পশুদের জন্য এক নির্মম নির্যাতনের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৬ ঘণ্টা আগেআমরা সবাই দীর্ঘদিন যাবৎ ‘মেধা পাচার হওয়া’ কথাটির সঙ্গে পরিচিত। আসলেই কি মেধা পাচার হয়? এর একটা কারণ উদ্ঘাটন করা দরকার। আমাদের যে মেধার দরকার, সেই মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে মেধাবী মানুষ রাষ্ট্রীয় জীবনে, সমাজজীবনে—সেটাই সবার কাম্য।
১০ ঘণ্টা আগেসুনামগঞ্জের তাহিরপুরে পাটলাই নদের ওপর ২০১৮ সালে যে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল, তার তিন বছরের নির্ধারিত সময় পার হয়ে সাত বছরে গড়ালেও এখনো কাজ শেষ হয়নি। ১৭ মে আজকের পত্রিকায় এ-সংক্রান্ত একটি খবর ছাপা হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগেমিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য করিডর দেওয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার রেশ কাটতে না কাটতেই সামনে এল চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার তাগিদ।
১ দিন আগে