Ajker Patrika

ঘর কি তবে নারীর জন্য কারাগার

আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৫, ১৮: ১৪
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

‘বউ পেটানোর শীর্ষে বরিশাল’ শিরোনামে একটি খবর কয়েকটি গণমাধ্যমে ছাপা হওয়ায় এটা ভাইরাল হয়েছে। এটি আসলে একটি জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে তৈরি করা খবর। নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে জরিপের ফল এমনভাবে প্রকাশ করায় কারও এটা মনে হতে পারে যে বরিশাল ছাড়া অন্য কোথাও বোধ হয় স্বামীরা বউকে পেটায় না! ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তেমন নয়। সব জেলায়, সব অঞ্চলেই ঘরে ঘরে নারী নির্যাতনের ঘটনা আগেও ঘটেছে, এখনো ঘটছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ২০২৪ সালের যৌথ জরিপেও নতুন করে উঠে এসেছে নারীর প্রতি সহিংসতার পুরোনো ও ভয়াবহ চিত্র, যা শুধু উদ্বেগ নয়, গভীর মর্মবেদনার এক দলিল হিসেবেও বিবেচিত হওয়া উচিত। গবেষণাটি বলছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে তাঁদের স্বামী বা ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর দ্বারা শারীরিক, মানসিক, যৌন অথবা অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। খোলামেলা ভাষায় বললে, দেশের ঘরে ঘরে নারী নির্যাতনের রূপ, মাত্রা এবং তার দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত আজ এমন এক ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে, যা আর ‘ব্যক্তিগত’ বা ‘পারিবারিক’ বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখা চলে না।

বিশেষত যে পরিসংখ্যান সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে, তা হলো বরিশাল বিভাগে ৮২ শতাংশ নারী এবং খুলনায় ৮১ শতাংশ নারী ঘরোয়া সহিংসতার শিকার হয়েছেন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে। এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রতি পাঁচ নারীর মধ্যে চারজনের বেশি নিজ বাড়িতেই নির্যাতিত হয়েছেন; যেখানে একজন নারীর সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা, যেখানে তাঁকে ভালোবাসা, সম্মান ও সংরক্ষণের আশ্বাস দেওয়া হয়, সেই ঘরই পরিণত হয়েছে এক নীরব কারাগারে। সামাজিক আড়ালে গোপন সেই কারাগারে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চলে নির্যাতন, অপমান ও ক্ষতবিক্ষত মনোবীক্ষণ।

প্রশ্ন জাগে, এই পরিসংখ্যান কি সত্যি। উত্তর হ্যাঁ, যদি আমরা খোলা চোখে সমাজের বাস্তবতা দেখি। আবার প্রশ্ন জাগে, এই পরিসংখ্যান কি গঠনমূলক আলোচনার জন্ম দেয়, নাকি বিভাজন তৈরি করে। দুটিই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং এগুলোর উত্তর পাওয়া জরুরি। কারণ, কোনো জরিপ যখন নির্দিষ্ট অঞ্চলকে ‘সবচেয়ে সহিংস’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তখন সেই অঞ্চলের হাজারো নির্যাতনবিরোধী মানুষও অযথা লজ্জিত হতে পারেন, অপমানিত বা বদনামের শিকার হতে পারেন। অথচ চরম সত্য হলো, নারীর প্রতি সহিংসতা গোটা বাংলাদেশেই ঘটছে, হারে কমবেশি হলেও মূল কাঠামোগত অসাম্য সর্বত্রই বিদ্যমান।

জরিপ বলছে, চট্টগ্রামে এই হার ৭৬ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৭৫, রাজশাহীতে প্রায় ৭৫, রংপুরে ৭৪, সিলেটে ৭৩ এবং ঢাকায়ও ৭৩ শতাংশ নারী এই সহিংসতার শিকার হয়েছেন। অর্থাৎ, কোনো বিভাগেই এই হার ৭০ শতাংশের নিচে নামেনি। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাংলাদেশের নারীদের জীবদ্দশায় সহিংসতার গড় হার ৭০ শতাংশ। শুধু গত এক বছরেই ৪১ শতাংশ নারী এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় এই সংজ্ঞা কিছুটা প্রসারিত করলে দেখা যায়, জীবদ্দশায় ৭৬ শতাংশ নারী এবং গত বছরে ৪৯ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছেন।

এটি এমন এক ভয়াবহ চিত্র, যা শুধু নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর ভাবনার বিষয় নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, পরিবার কাঠামো, এমনকি শিক্ষা ও সংস্কৃতিরও একটি গভীর প্রশ্নচিহ্ন। কীভাবে আমরা এমন একটি সমাজে বাস করছি, যেখানে মা, স্ত্রী, কন্যা বা কর্মজীবী নারীকে ঘরেই সহ্য করতে হয় সবচেয়ে অমানবিক আচরণ? যেখানে তাঁর স্বামী বা সঙ্গী, যে কিনা তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষ, তাঁর কাছেই সে বারবার হার মানে, ভেঙে পড়ে কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারে না?

এই জরিপ আমাদের সামনে শুধু একটি সামাজিক ব্যাধির মাত্রা তুলে ধরে না, বরং আমাদের আত্মপরিচয়ের সংকটও উন্মোচন করে। আমরা কাকে বলি সভ্য সমাজ? যেখানে নারীর কাজ ঘরের কাজে সাহায্য করা নয়, বরং নিজেকে বিসর্জন দেওয়া? যেখানে ছেলেকে শেখানো হয় না যে রাগলে কাউকে আঘাত করা যায় না, অথচ মেয়েকে শেখানো হয় যে সংসার রক্ষা করতে গেলে সব সহ্য করতে হয়? এই শিক্ষা, এই নৈতিকতার ছদ্মবেশই নারীর প্রতি সহিংসতাকে সমাজে টিকিয়ে রেখেছে, কখনো ‘স্বামী স্ত্রীকে একটু গালি দিলে তো দোষের কিছু না’ ধরনের ধারণায়, আবার কখনো ‘মেয়ে একটু সহ্য করলে সংসার টিকে যায়’ এই অবাস্তব উপদেশে।

বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে নারীর মর্যাদা এখনো পুরুষনির্ভর। যদিও আইন বলছে, নারী-পুরুষ সমান, বাস্তবে এর প্রতিফলন খুবই দুর্বল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময় ঘরোয়া সহিংসতাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে না; সমাজও বিষয়টি পারিবারিক সমস্যা বলে এড়িয়ে যায়; এবং নারী নিজেও, নিরাপত্তার অভাব, সামাজিক ভয়ে, কিংবা সন্তানদের কথা ভেবে মুখ বন্ধ রাখে। এই নীরবতা দিন দিন আরও নির্যাতনকে বৈধতা দেয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে নারীদের প্রতি সহিংসতার হার আরও বেশি বলেও জরিপে উঠে এসেছে। ঘরের ছাদ যেমন দুর্যোগে উড়ে যায়, তেমনি নারীর সম্মান ও নিরাপত্তাও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। বাস্তুচ্যুতি, দারিদ্র্য, কর্মহীনতা এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা একত্রে নারীর প্রতি সহিংসতাকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত এখন আর শুধু নদীভাঙন বা বন্যায় সীমাবদ্ধ নেই; এটি নারীর শরীর ও মানসিকতাকেও প্রতিনিয়ত আঘাত করছে।

এত সব বাস্তবতার মধ্যে জরিপ নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন আসে, এভাবে অঞ্চলভিত্তিক সহিংসতার হার তুলে ধরা কি ন্যায্য। বরিশাল, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ—এমন বিভাগগুলো যদি জনগণের মধ্যে অপমানবোধ তৈরি করে, তবে তা সমাজের ভেতরে একধরনের দৃষ্টিভঙ্গিগত বিভাজনও তৈরি করতে পারে। যেন এরা ‘পিছিয়ে পড়া’, ‘সহিংস’, ‘বিকৃত পুরুষতন্ত্রের’ আধার। অথচ বাস্তবতা হলো, উন্নত, আধুনিক, শিক্ষিত অঞ্চলগুলোতেও একই সহিংসতা বিদ্যমান—কেবল হয়তো সে সহিংসতা আরও পরিশীলিত, গোপন ও ভদ্রতার মুখোশে আচ্ছাদিত।

এই কারণে জরিপ উপস্থাপনার ভাষা ও কাঠামো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়: ‘বরিশালে ৮২% নারী নির্যাতিত!’ এটি যেমন একটি ভয়াবহ তথ্য, তেমনি একটি সামাজিক পীড়নের জন্মও দেয়। বরং জরিপ উপস্থাপন করা উচিত এভাবে: ‘বাংলাদেশে ৭০% নারী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে স্বামী বা সঙ্গীর দ্বারা নির্যাতিত’। এতে বোঝা যাবে, এটি একটি সার্বিক সামাজিক ব্যর্থতা। কারণ, অপরাধের ভূগোল আছে বটে, তবে সহিংসতার চর্চা কখনো একা কোনো বিভাগের দায় হতে পারে না।

নারীর প্রতি সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি একটি সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরে প্রোথিত এক দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি। এই কাঠামোতে পুরুষতন্ত্র যেমন দৃঢ়, তেমনি নারীর চুপ করে থাকাও একধরনের বাধ্যতা। একটি মেয়ে যখন ছোটবেলা থেকে দেখে—বাবা মাকে গালাগালি করছে, মা কাঁদছে কিন্তু প্রতিবাদ করছে না, কিংবা মা বলছে ‘বাবার মেজাজ খারাপ, কিছু বলো না’—তখন তার ভেতরে গেঁথে যায় যে সংসারে ভালো থাকতে হলে মেনে নিতে হয়। আবার সেই ছেলেটিও দেখে, তার বাবার হাত থেকে রেহাই পায়নি মা, কিন্তু তবু বাবাকে কেউ কিছু বলেনি। তবু মা সংসার চালিয়ে গেছে। এই নিঃশব্দ নির্যাতনকে পরিবারিক ধৈর্যের চর্চা হিসেবে উপস্থাপন করাই সহিংসতা টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কেবল আইন দিয়ে কিছু হবে না, দরকার শিক্ষাব্যবস্থায় জেন্ডার-সচেতনতা, কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব নীতি এবং গণমাধ্যমে নারীর প্রতি সম্মানজনক উপস্থাপন। একই সঙ্গে দরকার পুরুষদের মধ্যে একটি সহানুভূতিশীল, সমতাভিত্তিক মানসিকতা তৈরি করা। নারী অধিকার মানে পুরুষের অধিকার হ্রাস নয়; এটি একটি মানবিক ভারসাম্য। কিন্তু এই কথা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হলে পরিবারে, বিদ্যালয়ে, ধর্মীয় আলোচনা এবং সাংস্কৃতিক অভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, এই জরিপকে আমরা কীভাবে নিচ্ছি, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। আমরা যদি বলি, ‘এটা বরিশালের সমস্যা’, তাহলে নিজের এলাকার সমস্যাকে ধামাচাপা দিচ্ছি। বরং বলা উচিত, ‘এটি আমাদের সবার সমস্যা।’ একেক জায়গায় হয়তো রূপ ভিন্ন, ভাষা ভিন্ন, উপায় ভিন্ন—কিন্তু নির্যাস একটাই—নারী নিপীড়িত।

জরিপ হোক একটি আয়না, যাতে আমরা সবাই নিজেদের মুখ দেখতে পারি—ভুল, দায় এবং পরিবর্তনের সম্ভাবনাসহকারে। একটি বিভাগে সহিংসতার হার বেশি বললে যদি সেই অঞ্চলটা সচেতন হয়, প্রতিবাদ জোরালো হয়, নারীরা সংঘবদ্ধ হন; তবে সেটিই জরিপের সার্থকতা। কিন্তু যদি সেই তথ্য ঘৃণা, অপমান বা ভ্রান্ত আঞ্চলিক অহংকারের জন্ম দেয়, তবে তা জরিপের উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ করে।

সুতরাং, আমরা চাই এমন একটি আলোচনার ক্ষেত্র, যেখানে জরিপ কোনো অঞ্চলকে দোষারোপের হাতিয়ার হবে না, বরং সমাজে জবাবদিহির শুরুবিন্দু হয়ে উঠবে। যেখানে ঘরের ভেতরের চিৎকার চাপা পড়বে না, বরং তাকে সমাজ শোনার সাহস দেখাবে। যে সমাজের মেয়েরা প্রতিবাদ করতে ভয় পায় না, যে ঘরে পুরুষ নিজেই প্রশ্ন করে—আমি কি আমার স্ত্রীকে সম্মান দিচ্ছি?—সেই ঘরই আসল নিরাপদ আশ্রয়।

আর তত দিন পর্যন্ত, যত দিন ঘরের দেয়াল থেকে নির্যাতিত নারীর নীরব কান্না ভেসে আসবে, তত দিন ঘর তার নিরাপত্তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে। জরিপ তখন শুধু সংখ্যা হবে না, হবে এক এক ফাঁস হয়ে যাওয়া গোপন চিঠি—সমাজের কাছে, আমাদের সবার কাছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত