Ajker Patrika

আসনটিই থেকে গেল...

সেলিম জাহান
আসনটিই থেকে গেল...

রেখে চলে যাচ্ছিলাম বছর দুই আগে। যখন রুজভেল্ট দ্বীপ ছাড়ি স্থায়ীভাবে। মনে হলো যেন শুনতে পেলাম: ‘ফেলেই দিলে?’ ব্যথাতুর ফিসফিসানি যেন। চমকে পেছনে তাকালাম। না, কেউ কোথাও নেই। শুধু পড়ে আছে চেয়ারটি। একটু আগেই ফেলে গেছি আমাদের আবাস ভবনের ছয় তলার বর্জ্য ফেলার জায়গায়। না, আহামরি কোনো চেয়ার নয়। সাধারণ একটি বেতের চেয়ার—হাতলবিহীন, বসার জায়গাটি গোল, তার ওপরে সবুজ আচ্ছাদনের কুশন। দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার সময় বুড়ো এ চেয়ারটি বলি হয়েছে ফেলে দেওয়া জঞ্জাল সামগ্রীর মধ্যে।

হঠাৎ কেমন যেন মায়া হলো। কত পুরোনো চেয়ার—২৭ বছরের সাথি। ১৯৯২–তে যখন নিউইয়র্কে আসি, তখন এসেছে আমাদের সঙ্গে। এর সঙ্গী-সাথিদের আর কেউ নেই। শুধু সে-ই একা এবং অদ্বিতীয় হয়ে টিকে ছিল এতকাল। আজ সে–ও বিদায় নিল।

ঢাকা ছেড়ে আসার আগেই বাসার কাঠের আর কিছু বেতের আসবাব আমরা দিয়ে এসেছিলাম নানান জনকে। তখনই আমরা ঠিক করেছিলাম, নিউইয়র্কে সব আসবাবপত্র হবে দেশি বেতের। বেতের আসবাবের দিকে ভীষণ ঝোঁক ছিল আমাদের দুজনেরই। ঢাকাও খোলা যায়, আটকানো যায়, নানান নমুনা করা যায় এমন ভারি সুন্দর একটি বসার ঘরের সোফা বানিয়ে দিয়েছিল আমাদের পূর্বপরিচিত গ্রিন রোডের জালালাবাদ কেইন শপ। এবারও তাদের দুয়ারেই ধরনা দেওয়া গেল।

আসাম থেকে বেত এনে বানিয়ে দিলেন তারা সবকিছু। কী নেই সেই তালিকায়? প্রচলিত আসবাব তো ছিলই, তার সঙ্গে যোগ হলো পুরো বেতের দুলুনি চেয়ার, খাবার টেবিল, স্থান বিভাজনকরণ আড়াল, পড়ার টেবিল—দুই কন্যা এবং আমাদের জন্য। এমনকি নানান ছাদের বেতের ঢাকনাওয়ালা বাতি। আমরা হতভম্ব! দোকানের মালিক জানালেন, বহু অপ্রচলিত জিনিস এই প্রথমবার তারা বানিয়েছেন। কিন্তু কী নিষ্ঠা, কী যত্ন, কী পরিশ্রম এবং কী উদ্ভাবনী কুশলতা নিয়ে যে তাঁরা জিনিসগুলো তৈরি করেছিলেন, তাতে মনে হয়, এ পুরো প্রক্রিয়াটিকে তাঁরা একটি পবিত্র শিল্পসাধনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।

চেয়ারটি এসেছিল আমার বেতের লেখার টেবিলের সঙ্গে। কিন্তু সেই টেবিলটি একটু বেশি উঁচু ছিল বলে প্রথম এক যুগে সে চেয়ার বেশি ব্যবহৃত হয়নি লেখার কাজে। চেয়ারটি নতুন জীবন লাভ করল ২০০৪ সালে বিশেষ একটি কারণে। ও বছরই আবাসন পরিবর্তনের সময় এক যুগের পুরোনো বাড়ির সব বেতের আসবাব ফেলে দিয়ে নতুন আসবাব কেনা হলো। শুধু এই চেয়ারটি রেখে দেওয়া হলো। কারণ, আমাদের কনিষ্ঠা কন্যার রেখে যাওয়া পাইন কাঠের টেবিলটির সঙ্গে এ চেয়ারটিতে বসে বেশ আয়েশে লেখা যায়। সুতরাং বিরানব্বইয়ের বংশলতিকার সবে ধন নীলমণি এ আসনটিই থেকে গেল এবং পরিবারের মধ্যে এর নাম হয়ে গেল ‘বাবার চেয়ার’।

গত ১৫ বছরে কত কাজ করেছি এ চেয়ারে বসে, কত কিছু লিখেছি কম্পিউটারে—ওই চেয়ারে বসেই তো। গত দশকে আমার চারটা বই লেখা হয়েছে ওই চেয়ারে বসেই। তবে জনান্তিকে বলে রাখি, আমার লেখাপড়ার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হচ্ছে বিছানা। বই, খাতাপত্র, পেনসিল-কলম, কম্পিউটার এবং সঙ্গে এক মগ কফি নিয়ে বিছানায় উঠতে পারলেই সবচেয়ে আনন্দ আমার। এর জন্য কত যে বকা খেয়েছি নানান জনের কাছে এ জীবনে, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কিছুই নিরস্ত করতে পারেনি আমাকে। সুযোগ পেলেই পড়ার টেবিল-মেবিল ছেড়ে ওই বিছানার সুখশয্যায়। এ ব্যাপারে শিবরাম চক্কোত্তি আমার গুরু–পড়ানো, গড়ানো সব ওই ছড়ানো শয্যাতেই। আজকাল অবশ্য একটু উন্নতি হয়েছে, শয্যা ছেড়ে দুলুনি চেয়ারে স্থানান্তরিত করেছি নিজেকে। কিন্তু তবু মনে হলেই সেই শয্যা–কোনো লজ্জা ছাড়াই।

কতজন বসেছেন ওই চেয়ারে। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন আমাদের বাড়িতে এলে কোনো কিছু লেখার হলেই ওই চেয়ারে। ড. মাহবুবুল হক ওই চেয়ারে বসেই বহু লেখা পড়েছেন আমার। আমার শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন ওখানে বসেই তাঁর এক বইয়ের মুখবন্ধ লিখে ফেলেন। আর শিল্পের ওপরে পুরো একখানি বই লিখে ফেলেছিলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী—সে–ও ওই চেয়ারেই উপবিষ্ট হয়ে। ভারি প্রিয় ছিল তাঁর জানালার ধারের জায়গাটি। যেখান থেকে পূর্বী নদী দেখা যেত।

গত ক’দিনে এ আবাসন ত্যাগের প্রক্রিয়ায় যখন বাকি সব জিনিসপত্র চলে গেছে, তখন এ বেতের চেয়ারটিই তো ছিল আমার এক বিশাল আশ্রয়। ওটার ওপরে বসে খেয়েছি, কাগজপত্র গুছিয়েছি, রাতে পানির বোতল রেখেছি। তা ছাড়া উঁচু থেকে কিছু পাড়তে হলে ওর ওপরে দাঁড়িয়েছি, কম্পিউটার ওটার ওপরে রেখেই লেখার কাজ করেছি এবং কেউ এলে ওখানেই বসতে দিয়েছি।

এ জীবনে আমাকে অনেক দিয়েছে চেয়ারটি নিঃস্বার্থভাবে। কথিত আছে, শ্মশানে, রাজসভায়, দুর্ভিক্ষে যে সঙ্গে থাকে, সেই হচ্ছে বন্ধু। না, চেয়ারটি এর কোনোটিই করেনি। তবু সে আমার পাশেই ছিল। আমার সঙ্গে আছে সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, হাসি-কান্নায়। গত তিন দশক আগে নানান বেতের আসবাবের মধ্যে সে-ই তো রয়ে গেছে আমার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত। বান্ধব তো সে আমারই। আজ সময়ের দাবি মেটাতে তাকেও ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছি। মনটা কেমন যেন করে উঠল। দুই পা পিছিয়ে গিয়ে খুব আলতো করে চেয়ারটার গায়ে হাত রাখলাম। মনে হলো যেন শুনলাম: ‘ভালো থেকো, বন্ধু।’

লেখক: অর্থনীতিবিদ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত আমদানির ঘোষণা দিতেই ভারতে হু হু করে বাড়ছে চালের দাম

‘আমরা মরে গেলাম ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে’, চিরকুটে লেখা

জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে উচ্চপদস্থ বোর্ড গঠন: আইএসপিআর

ফেসবুকে ছাত্রলীগ নেতার ‘হুমকি’, রাবিতে ১৫ আগস্টের কনসার্টে যাচ্ছে না আর্টসেল

পাবনায় প্রবাসীর স্ত্রীকে নিয়ে এএসআই উধাও, থানায় শ্বশুরের জিডি

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত