বিভুরঞ্জন সরকার
আজকের পত্রিকায় ৬ জুলাই সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলামে তিনটি রাজনৈতিক দলের তিনজন নেতার বক্তব্য উদ্ধৃত করে যে তিনটি পৃথক খবর ছাপা হয়েছে, তাতে দেশের রাজনীতির প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা নতুন কিছু নয়। তবে গত বছরের জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে যে ধরনের রাজনৈতিক পুনর্গঠন ও শক্তির পুনর্বিন্যাস শুরু হয়েছে, তা এখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দীর্ঘ সময় ধরে একচ্ছত্র ক্ষমতা উপভোগকারী একটি সরকারের পতনের পর নতুন নেতৃত্ব, নতুন পথ এবং নতুন রাজনৈতিক বিন্যাস নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রেক্ষাপটে তিনটি ভিন্ন রাজনৈতিক ধারার তিন নেতা—গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (বিএনপি), ডা. শফিকুর রহমান (জামায়াতে ইসলামি) এবং নাহিদ ইসলাম (জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি)—তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে জনসমাবেশে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গতিপথ বোঝার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘নির্বাচন করতে হবে, নির্বাচন আটকানোর শক্তি কারও হাতে নাই, যদি আমরা (বিএনপি) নামি।‘ কেরানীগঞ্জের এক সমাবেশে এ কথা বলার সময় তিনি আরও বলেন, ‘যারা বলে, ১৬ বছর আমরা কিছু করতে পারি নাই, তাদের বলব, আমরা এখন ১৬ দিনে তা দেখিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমরা দেখাব না।‘ এই বক্তব্যে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস যেমন আছে, তেমনি রয়েছে কৌশলী অপেক্ষার আভাসও। লন্ডন বৈঠকের কথা উল্লেখ করে গয়েশ্বর রায় এ কথাও বলেন, ‘একজন ভদ্রলোক মানুষ ওয়াদা করছে। সে তার ওয়াদা পূরণ করবে, যথাসময়ে নির্বাচন দেবে—এই প্রত্যাশা নিয়ে আমরা ধৈর্য ধরে রাখছি।‘ এই ‘ভদ্রলোক’ যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেটা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। প্রশ্ন হলো, ‘ভদ্রলোক’ যদি কথা রাখতে না পারেন তাহলে কি গয়েশ্বর রায় ও তাঁর দল বিশেষ কিছু ‘দেখিয়ে’ দিতে পারবেন?
জামায়াতে ইসলামির আমির ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্য ছিল অনেক বেশি কাঠামোগত সংস্কারকেন্দ্রিক। কুমিল্লায় এক পথসভায় তিনি বলেন, ‘দেশে ইদানীং কিছু রাজনৈতিক দলের দখল ও লুটপাট জনগণ প্রত্যক্ষ করছে। সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে বলব, নিজেদের সামলান, না হলে জনগণই আপনাদের সামলে দেবে।‘ এরপর তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘আমরা যেনতেন নির্বাচন চাই না। নতুন-পুরনো যেই হোক, সামনে যেকোনো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।‘
সন্ধ্যায় ফেনীর একটি সমাবেশে তিনি বলেন, ‘যারা প্রকৃত গণতন্ত্র চায়, তাদের উচিত সংস্কার কমিশনকে সহযোগিতা করা। মৌলিক সংস্কার শেষ হলে তখন সবাই যার যার রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারবে। কিন্তু অতীতের দুর্গন্ধযুক্ত প্রথা পরিষ্কার না করে আবার যদি নির্বাচন হয়, তা হবে নির্বাচনকে গণহত্যার শামিল।‘ এসব বক্তব্যের মাধ্যমে জামায়াত তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। দলটি নির্বাচন নয়, আগে কাঠামোগত সংস্কার চায়। আবার ‘সামনে যেকোনো ফ্যাসিবাদ’ বলে কী ইংগিত করেছেন, সেটাও রাজনীতি সচেতন কারও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হয় না।
জামায়াত নেতা আরও বলেন, ‘অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত হলো একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। আর সে নির্বাচনের জন্য জরুরি ও মৌলিক কিছু সংস্কার প্রয়োজন, যা আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি। এই সংস্কারের পথে যারা বাধা দেবে, তারা রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিচয় দিচ্ছে না।‘ তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আমরা আগামী নির্বাচনে প্রশাসনের কোনো ধরনের 'টু' শব্দটিও শুনতে চাই না। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।‘
এই বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, জামায়াত পুরনো কাঠামোর ভেতরে নয়, বরং নতুন ভিত্তিতে নির্বাচন চায়। তারা বিএনপির মতো দ্রুত ভোটে যেতে আগ্রহী নয়, বরং আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন—এই ধারা অনুসরণ করছে।
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—একটি নবগঠিত দল—নিজেকে পুরনো রাজনৈতিক শক্তির বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। বগুড়ায় এক পথসভায় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫৪ বছর পর দেশের মানুষের সামনে নতুন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে খুঁজে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজদের দিয়ে আমরা আর পুরনো রাজনৈতিক খেলা খেলতে চাই না। আমরা নতুন রাজনৈতিক খেলা খেলতে এসেছি।‘
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের কথা যারা সংবিধানে লিখতে চায় না, তারা আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে চিহ্নিত হবে।‘ এরপর জয়পুরহাটে আরেক সভায় তিনি বলেন, ‘আমরা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের জন্য আন্দোলন করেছি, গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছি। তবে এবারের আন্দোলন শুধু ক্ষমতা বদলের জন্য নয়, এটি একটি নতুন দেশ গড়ার আন্দোলন।‘ তার ভাষায়, ‘দলের বা নেতৃত্বের পরিবর্তন নয়, আমাদের লক্ষ্য হলো দুর্নীতিবাজ, মাফিয়া কৃষ্টির পরিবর্তন। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জরুরি বিষয় বিচারব্যবস্থার সংস্কার।‘
এনসিপির আরেক নেতা আখতার হোসেন বলেন, ‘আগামীর বাংলাদেশে এনসিপিকে আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না এবং আমরা সংসদের দখল নেব।‘ তিনি মনে করেন, ‘জুলাই সনদের ভিত্তিতে মৌলিক সংস্কার হোক’ এবং ‘পিআর পদ্ধতি চালু হলে দেশে স্বৈরতন্ত্রের মূলোৎপাটন সম্ভব হবে।‘ দলের দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ভারতের প্রতি কটাক্ষ করে বলেন, ‘অন্যদের বাংলাদেশে পুশ ইন না করে, জুলাইয়ের খুনি হাসিনাকে ফেরত পাঠান।‘ তার দাবি, ‘যারা জুলাই বিপ্লবের বিপক্ষে, তারা আসলে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে।‘
এনসিপি নেতাদের বক্তব্য আক্রমণাত্মক, আত্মবিশ্বাসী ও উচ্চকণ্ঠ। তবে এটি বলতে দ্বিধা নেই যে, এ দলটি এখনও সাংগঠনিকভাবে দেশজুড়ে মজবুত ভিত্তি পায়নি, আবার দলটির একাধিক নেতার ব্যক্তিগত আচরণ বা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা হতাশা তৈরি হয়েছে। মুখে তারা নতুন ধারার কথা বললেও অনেক সময় তাদের পথে দেখা যায় পুরনো রাজনৈতিক কৌশলের পুনরাবৃত্তি—অর্থাৎ ভিন্ন ভাষায় বলা হলেও বাস্তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তেমন আলাদা নয়। বিশেষত, ব্যক্তিগত আক্রমণ, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এবং অসহিষ্ণু বক্তৃতা—এসব পুরনো রাজনীতির চিহ্ন তারা এড়াতে পারছে না। কেউ কেউ বলেন, পাত্র নতুন হলেও পানীয় পুরাতন। মানুষ তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এই পানীয় গলায় নেবে কি?
তিনটি দলের নেতাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে যে বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে :
প্রথমত, বিএনপি নিজেকে এখনো প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবেই দেখছে। তারা দ্রুত নির্বাচনের পথে যেতে চায়, তবে আন্তর্জাতিক কূটনীতির পথ ধরে তাদের কৌশল নির্ধারণ করছে। তাদের বক্তব্যে আত্মবিশ্বাস যেমন আছে, তেমনি আছে অপেক্ষার ধৈর্যও।
দ্বিতীয়ত, জামায়াত নিজেকে একটি নৈতিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে বলছে, আমরা শুধু নির্বাচন চাই না, বরং কাঠামো বদলের মাধ্যমে একটি বিশ্বাসযোগ্য পদ্ধতির পথ খুলতে চাই। তারা দীর্ঘ মেয়াদে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার লক্ষ্য নিয়েই এগোচ্ছে এবং সুশৃঙ্খল বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করছে।
তৃতীয়ত, এনসিপি একটি বিকল্প রাজনৈতিক ভাষা তৈরি করতে চায়। তাদের বক্তব্যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আছে, কিন্তু অনেক সময় সেই ভাষা গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি ন, সে প্রশ্নও আছে। তবুও তারা তরুণ প্রজন্মের একটি অংশের মধ্যে আকর্ষণ তৈরি করতে পেরেছে—বিশেষ করে যারা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মধ্যকার দোদুল্যমানতাকে অতিক্রম করতে চায়।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনীতি তিনটি পৃথক ধারায় বিভক্ত হয়ে আছে :
১. একদিকে পুরনো রাজনৈতিক শক্তির ‘পুনরুদ্ধার’ প্রয়াস—যার প্রধান মুখ বিএনপি।
২. দ্বিতীয়ত, কাঠামোগত ‘সংস্কার’ ভিত্তিক ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি—যা জামায়াত উপস্থাপন করছে।
৩. তৃতীয়ত, ‘বিকল্প শক্তি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী একটি নতুন বলয়—যার মূল স্লোগান এনসিপির মতো দলগুলোর মাধ্যমে ধ্বনিত হচ্ছে।
এই তিনটি ধারার মধ্যে আপাত বিরোধ ও প্রতিযোগিতার লক্ষণ স্পষ্ট। ভবিষ্যতে এই তিন ধারার মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যের কোনো সূত্র সামনে আসে কি না, দেখার বিষয় সেটা। যদি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও জনআকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানিয়ে এই ধারাগুলো আলোচনায় বসে, তবে একটি বাস্তব ও নতুন ধারার রাজনীতি সম্ভব হলেও হতে পারে। অন্যথায়, এরা কেউই এককভাবে সেই জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না, যারা একসময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে।
প্রশ্ন হলো, তিন পক্ষের দড়ি টানাটানি নির্বাচনকে বিলম্বিত করবে না তো? জনগণের ভোটে জনগণের সরকার পাওয়ার আশা কী কেবল দূরে সরে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে এই দলগুলোর দায়িত্বশীলতা, কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা এবং সর্বোপরি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল তারা—সেটির ওপর। তবে এক মতে, এক পথে চলা যে যাচ্ছে না, সে বার্তা কী মানুষ পেয়ে যাচ্ছে না?
আজকের পত্রিকায় ৬ জুলাই সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলামে তিনটি রাজনৈতিক দলের তিনজন নেতার বক্তব্য উদ্ধৃত করে যে তিনটি পৃথক খবর ছাপা হয়েছে, তাতে দেশের রাজনীতির প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা নতুন কিছু নয়। তবে গত বছরের জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে যে ধরনের রাজনৈতিক পুনর্গঠন ও শক্তির পুনর্বিন্যাস শুরু হয়েছে, তা এখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দীর্ঘ সময় ধরে একচ্ছত্র ক্ষমতা উপভোগকারী একটি সরকারের পতনের পর নতুন নেতৃত্ব, নতুন পথ এবং নতুন রাজনৈতিক বিন্যাস নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রেক্ষাপটে তিনটি ভিন্ন রাজনৈতিক ধারার তিন নেতা—গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (বিএনপি), ডা. শফিকুর রহমান (জামায়াতে ইসলামি) এবং নাহিদ ইসলাম (জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি)—তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে জনসমাবেশে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য গতিপথ বোঝার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘নির্বাচন করতে হবে, নির্বাচন আটকানোর শক্তি কারও হাতে নাই, যদি আমরা (বিএনপি) নামি।‘ কেরানীগঞ্জের এক সমাবেশে এ কথা বলার সময় তিনি আরও বলেন, ‘যারা বলে, ১৬ বছর আমরা কিছু করতে পারি নাই, তাদের বলব, আমরা এখন ১৬ দিনে তা দেখিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমরা দেখাব না।‘ এই বক্তব্যে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস যেমন আছে, তেমনি রয়েছে কৌশলী অপেক্ষার আভাসও। লন্ডন বৈঠকের কথা উল্লেখ করে গয়েশ্বর রায় এ কথাও বলেন, ‘একজন ভদ্রলোক মানুষ ওয়াদা করছে। সে তার ওয়াদা পূরণ করবে, যথাসময়ে নির্বাচন দেবে—এই প্রত্যাশা নিয়ে আমরা ধৈর্য ধরে রাখছি।‘ এই ‘ভদ্রলোক’ যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেটা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। প্রশ্ন হলো, ‘ভদ্রলোক’ যদি কথা রাখতে না পারেন তাহলে কি গয়েশ্বর রায় ও তাঁর দল বিশেষ কিছু ‘দেখিয়ে’ দিতে পারবেন?
জামায়াতে ইসলামির আমির ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্য ছিল অনেক বেশি কাঠামোগত সংস্কারকেন্দ্রিক। কুমিল্লায় এক পথসভায় তিনি বলেন, ‘দেশে ইদানীং কিছু রাজনৈতিক দলের দখল ও লুটপাট জনগণ প্রত্যক্ষ করছে। সংশ্লিষ্ট দলগুলোকে বলব, নিজেদের সামলান, না হলে জনগণই আপনাদের সামলে দেবে।‘ এরপর তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘আমরা যেনতেন নির্বাচন চাই না। নতুন-পুরনো যেই হোক, সামনে যেকোনো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।‘
সন্ধ্যায় ফেনীর একটি সমাবেশে তিনি বলেন, ‘যারা প্রকৃত গণতন্ত্র চায়, তাদের উচিত সংস্কার কমিশনকে সহযোগিতা করা। মৌলিক সংস্কার শেষ হলে তখন সবাই যার যার রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারবে। কিন্তু অতীতের দুর্গন্ধযুক্ত প্রথা পরিষ্কার না করে আবার যদি নির্বাচন হয়, তা হবে নির্বাচনকে গণহত্যার শামিল।‘ এসব বক্তব্যের মাধ্যমে জামায়াত তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। দলটি নির্বাচন নয়, আগে কাঠামোগত সংস্কার চায়। আবার ‘সামনে যেকোনো ফ্যাসিবাদ’ বলে কী ইংগিত করেছেন, সেটাও রাজনীতি সচেতন কারও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হয় না।
জামায়াত নেতা আরও বলেন, ‘অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম শর্ত হলো একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। আর সে নির্বাচনের জন্য জরুরি ও মৌলিক কিছু সংস্কার প্রয়োজন, যা আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি। এই সংস্কারের পথে যারা বাধা দেবে, তারা রাজনৈতিক সদিচ্ছার পরিচয় দিচ্ছে না।‘ তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আমরা আগামী নির্বাচনে প্রশাসনের কোনো ধরনের 'টু' শব্দটিও শুনতে চাই না। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।‘
এই বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, জামায়াত পুরনো কাঠামোর ভেতরে নয়, বরং নতুন ভিত্তিতে নির্বাচন চায়। তারা বিএনপির মতো দ্রুত ভোটে যেতে আগ্রহী নয়, বরং আগে সংস্কার, তারপর নির্বাচন—এই ধারা অনুসরণ করছে।
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—একটি নবগঠিত দল—নিজেকে পুরনো রাজনৈতিক শক্তির বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। বগুড়ায় এক পথসভায় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫৪ বছর পর দেশের মানুষের সামনে নতুন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে খুঁজে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজদের দিয়ে আমরা আর পুরনো রাজনৈতিক খেলা খেলতে চাই না। আমরা নতুন রাজনৈতিক খেলা খেলতে এসেছি।‘
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের কথা যারা সংবিধানে লিখতে চায় না, তারা আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে চিহ্নিত হবে।‘ এরপর জয়পুরহাটে আরেক সভায় তিনি বলেন, ‘আমরা শেখ হাসিনা সরকারের পতনের জন্য আন্দোলন করেছি, গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছি। তবে এবারের আন্দোলন শুধু ক্ষমতা বদলের জন্য নয়, এটি একটি নতুন দেশ গড়ার আন্দোলন।‘ তার ভাষায়, ‘দলের বা নেতৃত্বের পরিবর্তন নয়, আমাদের লক্ষ্য হলো দুর্নীতিবাজ, মাফিয়া কৃষ্টির পরিবর্তন। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জরুরি বিষয় বিচারব্যবস্থার সংস্কার।‘
এনসিপির আরেক নেতা আখতার হোসেন বলেন, ‘আগামীর বাংলাদেশে এনসিপিকে আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না এবং আমরা সংসদের দখল নেব।‘ তিনি মনে করেন, ‘জুলাই সনদের ভিত্তিতে মৌলিক সংস্কার হোক’ এবং ‘পিআর পদ্ধতি চালু হলে দেশে স্বৈরতন্ত্রের মূলোৎপাটন সম্ভব হবে।‘ দলের দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ভারতের প্রতি কটাক্ষ করে বলেন, ‘অন্যদের বাংলাদেশে পুশ ইন না করে, জুলাইয়ের খুনি হাসিনাকে ফেরত পাঠান।‘ তার দাবি, ‘যারা জুলাই বিপ্লবের বিপক্ষে, তারা আসলে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে।‘
এনসিপি নেতাদের বক্তব্য আক্রমণাত্মক, আত্মবিশ্বাসী ও উচ্চকণ্ঠ। তবে এটি বলতে দ্বিধা নেই যে, এ দলটি এখনও সাংগঠনিকভাবে দেশজুড়ে মজবুত ভিত্তি পায়নি, আবার দলটির একাধিক নেতার ব্যক্তিগত আচরণ বা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়েও সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা হতাশা তৈরি হয়েছে। মুখে তারা নতুন ধারার কথা বললেও অনেক সময় তাদের পথে দেখা যায় পুরনো রাজনৈতিক কৌশলের পুনরাবৃত্তি—অর্থাৎ ভিন্ন ভাষায় বলা হলেও বাস্তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তেমন আলাদা নয়। বিশেষত, ব্যক্তিগত আক্রমণ, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব এবং অসহিষ্ণু বক্তৃতা—এসব পুরনো রাজনীতির চিহ্ন তারা এড়াতে পারছে না। কেউ কেউ বলেন, পাত্র নতুন হলেও পানীয় পুরাতন। মানুষ তৃষ্ণা মেটানোর জন্য এই পানীয় গলায় নেবে কি?
তিনটি দলের নেতাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে যে বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে :
প্রথমত, বিএনপি নিজেকে এখনো প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবেই দেখছে। তারা দ্রুত নির্বাচনের পথে যেতে চায়, তবে আন্তর্জাতিক কূটনীতির পথ ধরে তাদের কৌশল নির্ধারণ করছে। তাদের বক্তব্যে আত্মবিশ্বাস যেমন আছে, তেমনি আছে অপেক্ষার ধৈর্যও।
দ্বিতীয়ত, জামায়াত নিজেকে একটি নৈতিক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে বলছে, আমরা শুধু নির্বাচন চাই না, বরং কাঠামো বদলের মাধ্যমে একটি বিশ্বাসযোগ্য পদ্ধতির পথ খুলতে চাই। তারা দীর্ঘ মেয়াদে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার লক্ষ্য নিয়েই এগোচ্ছে এবং সুশৃঙ্খল বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করছে।
তৃতীয়ত, এনসিপি একটি বিকল্প রাজনৈতিক ভাষা তৈরি করতে চায়। তাদের বক্তব্যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আছে, কিন্তু অনেক সময় সেই ভাষা গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি ন, সে প্রশ্নও আছে। তবুও তারা তরুণ প্রজন্মের একটি অংশের মধ্যে আকর্ষণ তৈরি করতে পেরেছে—বিশেষ করে যারা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মধ্যকার দোদুল্যমানতাকে অতিক্রম করতে চায়।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনীতি তিনটি পৃথক ধারায় বিভক্ত হয়ে আছে :
১. একদিকে পুরনো রাজনৈতিক শক্তির ‘পুনরুদ্ধার’ প্রয়াস—যার প্রধান মুখ বিএনপি।
২. দ্বিতীয়ত, কাঠামোগত ‘সংস্কার’ ভিত্তিক ইসলামী রাজনৈতিক শক্তি—যা জামায়াত উপস্থাপন করছে।
৩. তৃতীয়ত, ‘বিকল্প শক্তি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী একটি নতুন বলয়—যার মূল স্লোগান এনসিপির মতো দলগুলোর মাধ্যমে ধ্বনিত হচ্ছে।
এই তিনটি ধারার মধ্যে আপাত বিরোধ ও প্রতিযোগিতার লক্ষণ স্পষ্ট। ভবিষ্যতে এই তিন ধারার মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যের কোনো সূত্র সামনে আসে কি না, দেখার বিষয় সেটা। যদি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও জনআকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানিয়ে এই ধারাগুলো আলোচনায় বসে, তবে একটি বাস্তব ও নতুন ধারার রাজনীতি সম্ভব হলেও হতে পারে। অন্যথায়, এরা কেউই এককভাবে সেই জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না, যারা একসময় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে।
প্রশ্ন হলো, তিন পক্ষের দড়ি টানাটানি নির্বাচনকে বিলম্বিত করবে না তো? জনগণের ভোটে জনগণের সরকার পাওয়ার আশা কী কেবল দূরে সরে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করবে এই দলগুলোর দায়িত্বশীলতা, কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা এবং সর্বোপরি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল তারা—সেটির ওপর। তবে এক মতে, এক পথে চলা যে যাচ্ছে না, সে বার্তা কী মানুষ পেয়ে যাচ্ছে না?
মিটফোর্ড এলাকায় একজন ব্যবসায়ীকে জনসম্মুখে পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা করা হলো। ঘটনাটি যেমন নির্মম, তেমনই মর্মান্তিক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটি আঘাত করে, তা হলো—ঘটনার সময় আশপাশে থাকা মানুষের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। কেউ বাধা দিল না, কেউ ‘থামো’ বলল না, কেউ ওই বিপন্ন মানুষটার জীবন রক্ষার শেষ
১৫ ঘণ্টা আগেপ্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছিলেন, বিএনপি তখন ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চেয়ে আসছিল। তবে গত ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলে তাতে একমত হওয়ার..
২১ ঘণ্টা আগেআমি তখন ক্লাস টেনের ছাত্র। প্রধান শিক্ষক ডেকে পাঠিয়েছেন শুনে আমি তো রীতিমতো ঘামতে শুরু করে দিয়েছি। এ কে মাহমুদুল হক ছিলেন রাশভারী কিন্তু মজার মানুষ। আবার কড়া বলতে কড়ার গুরু। তিনি ডেকে পাঠাবেন কেন? এই প্রশ্নের জবাব মিলল তাঁর রুমে যাওয়ার পর। হঠাৎ করেই স্কুলে উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা...
১ দিন আগেমানুষের জীবন এক আশ্চর্য দাঁড়িপাল্লার মতো। এক পাশ কানায় কানায় আনন্দ তো অন্য পাশে সমান সমান বিষাদ।
১ দিন আগে