Ajker Patrika

সিআরবি বাঁচাও!

সাঈদ আহসান খালিদ
সিআরবি বাঁচাও!

সরকারি সংস্থা হিসেবে দেশে দখল ও বেদখল মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি ভূমির মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে কোনো স্পেশালাইজড শিশু হাসপাতাল না থাকায় সরকার ২০১৭ সালে একটি শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে রেলওয়ের কাছে ২ একর খালি জমি চেয়ে পায়নি। ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া সত্ত্বেও রেলওয়ের অসম্মতির কারণে সরকারি প্রকল্পটি এখনো আলোর মুখ দেখছে না।

কিন্তু, বিস্ময়করভাবে সরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় জমি বরাদ্দ দিতে অস্বীকার করলেও, এই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষই বর্তমানে ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেড-এর পরিচালনায় বেসরকারি হাসপাতালের জন্য ৬ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে, সেটিও আবার ‘চট্টগ্রামের ফুসফুস’খ্যাত ছায়া সুনিবিড় ঐতিহাসিক সিআরবি এলাকায়!

জানা গেছে, ৫০০ শয্যার একটি বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলা হবে সিআরবি এলাকায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জমিতে। সিআরবি এলাকায় ৬ একর জমিজুড়ে এই হাসপাতাল ও কলেজ গড়ে তোলা হবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় ৪৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। ইতিমধ্যে সাইনবোর্ডও লেগেছে। কিন্তু সরকারি জমিতে হলেও এই হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা হবে সম্পূর্ণ বেসরকারি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। প্রাইভেট মালিকানায় পরিচালিত এই হাসপাতালের চিকিৎসাব্যয় চট্টগ্রামের সাধারণ ও প্রান্তিক জনগণের নাগালের বাইরে থাকবে–এই আশঙ্কার দৃঢ় ভিত্তি রয়েছে।

চিকিৎসা মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা রয়েছে সত্য, বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালও প্রয়োজন; কিন্তু সরকারি চিকিৎসাসুবিধা সম্প্রসারণের প্রকল্পে অসম্মতি দিয়ে, সরকারি জমিতে বেসরকারি হাসপাতাল বানিয়ে চিকিৎসাকে বাণিজ্যিকীকরণ বা ব্যয়বহুল করে তোলার উদ্দেশ্যসংবলিত এই পুঁজিবাদী প্রকল্প চিকিৎসাসেবার নাগরিক অধিকারকে খর্ব করবে এবং এর প্রতিবাদ করা নৈতিক কর্তব্য।

আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বেসরকারি পরিচালনার হাসপাতাল সিআরবি-তে কেন করতে হবে? সিআরবি অর্থ সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং, যেটি বর্তমানে রেলের পূর্বাঞ্চলীয় সদর দপ্তর। তবে এটি একসময় ছিল আসাম-বেঙ্গল রেলের সদর দপ্তর। ১৮৭২ সালে সম্পন্ন হওয়া সিআরবির ভবনটি চট্টগ্রামের প্রাচীনতম ভবন বলে মনে করা হয়। এটি একটি ঐতিহাসিক এলাকা, যা ছায়া সুনিবিড় অজস্র শতবর্ষী বৃক্ষ আচ্ছাদিত জায়গা। এটি নগরীর ফুসফুস, যা আমাদের অক্সিজেন দেয়। এখানের শিরীষগাছের তলায় বছরব্যাপী নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, এখানকার মাঠটিতে শিশু-কিশোরেরা প্রতিদিন খেলাধুলা করে, স্বাস্থ্যসচেতন নাগরিক ও বয়স্করা এই সিআরবি এলাকায় হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়াম করেন, বিকেল ও সন্ধ্যায় চট্টগ্রামবাসী এখানে এসে খোলা আকাশের নিচে খানিক দম নেন, আড্ডা মারেন।

চট্টগ্রাম মহানগরীর ১ হাজার ১৫২ বর্গকিলোমিটার এলাকার স্ট্রাকচার প্ল্যান ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে সিআরবিকে কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণের কথা বলা আছে। এখানে হাসপাতাল তৈরি হলে এই এলাকায় গড়ে উঠবে নতুন দালান অবকাঠামো, দোকানপাট, ফার্মেসি, পার্কিং, আবাসিক ভবন। কাটা পড়বে শতবর্ষ প্রাচীন বৃক্ষ, পরিবেশদূষণ ও আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হবে এই স্থান।

বেসরকারি হাসপাতাল বানানোর জন্য অনেক বিকল্প স্থান চট্টগ্রামে পাওয়া যাবে; কিন্তু চট্টগ্রামবাসীর জন্য এই একটাই সিআরবি। সিলিন্ডার থেকে নয়, আমরা গাছ থেকে অক্সিজেন নিতে চাই। সিআরবিকে এভাবে বাণিজ্যের জন্য ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না।

অবিলম্বে এই প্রকল্প বাতিল করা হোক। চট্টগ্রামের অন্য কোনো স্থানে সরকারি উদ্যোগ ও পরিচালনায় বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হোক, যাতে মানুষ স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা পেতে পারে। দেশের সব নাগরিক বিশেষত, চট্টগ্রামের অধিবাসীদের সচেতনতা ও প্রতিবাদ জরুরি–নিজেদের নিশ্বাসের স্বার্থেই।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক
আইন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে খুন: বোরকা পরে ঢুকে স্কুলড্রেসে বেরিয়ে যান একজন, গৃহকর্মী বলে সন্দেহ

দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে বাংলাদেশ এলডিপির সেলিম, প্রার্থী হবেন ধানের শীষের

হাতকড়া ও শিকল পরিয়ে আরও ৩১ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাদেশ নিয়ে সভা ২৫ ডিসেম্বর, নতুন বছরে প্রথম দিন ক্লাস শুরু

‘নারীশাসিত পুরুষ’: সাহস থাকলে সামনে এসে কথা বল—আসিফকে ওমর সানীর চ্যালেঞ্জ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘আরটিএ’ চুক্তির ভবিষ্যৎ

আবু তাহের খান 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল বিভিন্ন দেশের ওপর বর্ধিত হারে শুল্ক আরোপের যে ঘোষণা দেন, তা পুরো বিশ্ববাণিজ্যব্যবস্থাকেই এক নতুন সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় অর্থাৎ মার্কিন চাপের মুখে বাংলাদেশ সম্প্রতি সে দেশের সঙ্গে এক রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ অ্যাগ্রিমেন্ট (আরটিএ) নামে গোপনীয় একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, সেই চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থকে ব্যাপকভাবে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বস্তুতই এক দীর্ঘমেয়াদি ও বহুমুখী সংকটের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা আছে। চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে বাংলাদেশকে এখন শুধু যে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই বর্ধিত মূল্যে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে এবং তাদেরকে বিপুল হারে শুল্ক ছাড় দিতে হচ্ছে তা-ই নয়। অনুরূপ বর্ধিত মূল্য ও পণ্যছাড় সুবিধা এখন অন্যরাও চাইতে শুরু করেছে, যা পূরণ করতে গেলে বাংলাদেশকে কার্যতই এক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হবে। এ ধরনের দাবি প্রথম উত্থাপন করেছিল জাপান, গত অক্টোবরের শুরুতে। এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) অনুরূপ সুবিধা চাইতে শুরু করেছে (বণিক বার্তা, ৩ নভেম্বর ২০২৫)।

এ অবস্থায় ধারণা করা যায়, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াসহ অন্য যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যচুক্তি রয়েছে, তারাও শিগগিরই অনুরূপ সুবিধা চাইতে শুরু করবে। আর ডব্লিউটিও প্রটোকলে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশও ওই প্রটোকল মেনে অন্য সবার এসব দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ বর্তমানে বেশকিছু অগ্রাধিকার ও সুরক্ষাসুবিধা ভোগ করছে। তবে এসব বাণিজ্যসুবিধা হঠাৎ করেই বাংলাদেশের ভাগ্যে জোটেনি কিংবা এমনি এমনি তা সৃষ্টি হয়নি। এ জন্য বাংলাদেশকে কখনো অনুন্নত দেশ হয়ে আবার কখনোবা উন্নয়নশীল দেশ হয়েও অনুন্নত দেশ সেজে এসব সুবিধা দাবি করতে হয়েছে। কালেভদ্রে হলেও কখনো কখনো আন্তরাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক কিংবা বাণিজ্যকূটনীতিও এ ক্ষেত্রে কাজে এসেছে। ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের কৌশলগত অবস্থান কাজে লাগিয়েও কখনো কখনো এটি অর্জন করা গেছে।

ডব্লিউটিও প্রটোকলের আওতাধীন ন্যায্য বাণিজ্যব্যবস্থার সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিও কখনো কখনো বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। মোটকথা বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমানে যেসব সুবিধা ও সুরক্ষা ভোগ করছে, সেগুলো বস্তুত দীর্ঘদিনের নানামাত্রিক প্রচেষ্টা, সুযোগ, দর-কষাকষি, ভূরাজনীতির কৌশলগত ছাড় এবং অন্য নানাবিধ ঘটনা ও অনুষঙ্গেরই সম্মিলিত ফলাফল।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে দীর্ঘ ৫৫ বছরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের এই যে অবস্থান, সম্প্রতি দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত আরটিএর মাধ্যমে এর একটি বিরাট অংশ বিসর্জিত হতে চলেছে। আর বিসর্জনের এ আয়োজন যদি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পরিধিতে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে তেমন সমস্যা ছিল না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া সুবিধার কারণে এখন অন্যদের কাছেও বিসর্জন দিতে হচ্ছে। আর এর অনিবার্য ফলাফল দাঁড়াচ্ছে, বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে প্রায় সবাইকেই আরও বেশি শুল্ক ছাড় দিতে হবে এবং এতে করে বাংলাদেশের রাজস্ব ঘাটতিই শুধু বাড়বে না, আমাদের বাজার আরও বেশি করে বিদেশি পণ্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে উঠবে এবং বাংলাদেশের স্থানীয় পণ্যকে নতুন করে বর্ধিত প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। ফলে উৎপাদন-শিল্প যেখানে আগে থেকেই বহুলাংশে পিছিয়ে পড়েছিল, সেটি এখন প্রায় পুরোপুরিই স্থবির হয়ে পড়তে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরটিএ স্বাক্ষরের ফলে বাংলাদেশ এখন যেভাবে চতুর্দিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছে, সে অবস্থায় এ থেকে বেরিয়ে আসা কি সম্ভব? জবাব হচ্ছে, সব সমস্যারই সমাধান আছে। কিন্তু সমস্যাটির ক্ষেত্রে পক্ষ যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প, তখন এ থেকে বেরিয়ে আসার কাজটি মোটেও সহজ নয়। তবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে যদি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে নির্বাচিত নতুন সরকারের জন্য এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে। চুক্তিবিরোধী জনমতের উদ্ধৃতি দিয়ে নতুন সরকার তখন যুক্তরাষ্ট্রকে বলতে পারবে যে, অনির্বাচিত সরকার কর্তৃক জনমতের বিপরীতে যেয়ে স্বাক্ষরিত এ চুক্তি নির্বাচিত সরকারের পক্ষে মেনে চলা কঠিন। ফলে বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে তারা যেন এ চুক্তি পর্যালোচনায় সম্মত হয়। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত এ ধরনের চুক্তি পর্যালোচনার দৃষ্টান্ত বহু রয়েছে। ফলে এটিও পর্যালোচনা করা যেতে পারে। তবে বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করবে নির্বাচিত সরকার এ ক্ষেত্রে কতটা কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিতে পারবে তার ওপর।

সরল সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আরটিএ স্বাক্ষরের মূল উদ্দেশ্য শুধু অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া নয়, ভূরাজনীতির জটিল কৌশলগত সম্পর্কের আওতায় বাংলাদেশকে চাপে রাখা, যাতে আমরা তাদের অনুগামী থাকতে বাধ্য থাকি। তবে এশিয়ার এ অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের মতো ছোট দেশগুলোকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বাস্তবতা এখন অনেকখানিই পাল্টে গেছে। পশ্চিম যদি এ অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে পরিবর্তিত বাস্তবতায় সর্বাগ্রে তাদেরকে চীন ও ভারতের সঙ্গে হিসাব-নিকাশ করে আসতে হবে। কিন্তু সেটি না করে আরটিএর মতো হাতিয়ার ব্যবহার করে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগের মানে হচ্ছে দুর্বলের ওপর শক্তিমত্তা জাহির করা। এতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রকারান্তরিক লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো উপকার হবে না। বিষয়টি তারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, সবার জন্য ততই মঙ্গল হবে।

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে নতুন সরকার দায়িত্বে আসতে এখনো আরও প্রায় তিন মাস বাকি। এদিকে জাপান, ইইউ ও অন্যান্য দেশ এরই মধ্যে আরটিএর আওতাধীন শুল্কহ্রাস সুবিধাদি দাবি করে বসে আছে। এ অবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনুরোধ, জাপান-ইইউ প্রমুখের দাবিগুলো নতুন সরকার দায়িত্বে না আসা পর্যন্ত কোনো রকমে ঠেকিয়ে রাখুক। তাদেরকে বুঝিয়ে বলুক, এরূপ শুল্কছাড় দেওয়া বা না দেওয়া আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। ফলে এসব সিদ্ধান্তের জন্য তারা যেন নতুন নির্বাচিত সরকার দায়িত্বে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে।

ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশে রাজনৈতিক সরকারের অবর্তমানে বিচক্ষণ আমলারাই এ-জাতীয় পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করে থাকেন। আমরাও আশা করতে পারি, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েও রাজনৈতিক দলাদলিতে মত্ত ও নানাভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ার পরও বাংলাদেশের আমলারা তা কি পারবেন?

লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে খুন: বোরকা পরে ঢুকে স্কুলড্রেসে বেরিয়ে যান একজন, গৃহকর্মী বলে সন্দেহ

দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে বাংলাদেশ এলডিপির সেলিম, প্রার্থী হবেন ধানের শীষের

হাতকড়া ও শিকল পরিয়ে আরও ৩১ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাদেশ নিয়ে সভা ২৫ ডিসেম্বর, নতুন বছরে প্রথম দিন ক্লাস শুরু

‘নারীশাসিত পুরুষ’: সাহস থাকলে সামনে এসে কথা বল—আসিফকে ওমর সানীর চ্যালেঞ্জ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

রোকেয়া দিবস

রোকেয়ার নারী মুক্তির দর্শন

বেগম ড. এম এ সবুর
বেগম রোকেয়া। ছবি: সংগৃহীত
বেগম রোকেয়া। ছবি: সংগৃহীত

নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন বাঙালি নারীসমাজকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। তাঁর সমকালে সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় অজ্ঞতার কারণে বাঙালি নারীসমাজ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। এ জন্য ধর্মীয় অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার মসিযুদ্ধ চালিয়েছেন তিনি। তাঁর জ্ঞানের অগ্নিশিখায় অজ্ঞতার অন্ধকার দূরীভূত হয়ে আলোর প্রভা উদ্ভাসিত হয় এবং মুসলিম নারীসমাজে জাগরণ সৃষ্টি হয়।

তাঁর সমকালে অনেকে নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার কথা শুনলেই চমকে উঠত। শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও সামাজিক কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার কারণে বাঙালি মুসলিম নারীসমাজ শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে প্রতিবেশী হিন্দু নারীরা পুরুষের সঙ্গে শিক্ষাসহ বিভিন্ন কাজকর্মে অংশগ্রহণ করলেও বাঙালি মুসলিম নারীরা ছিল অনেক পিছিয়ে। জ্ঞান ও প্রতিভা বিকাশের পথ রুদ্ধ করে নারীদের ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হতো। আশঙ্কা করা হতো, নারীরা শিক্ষিত হলে উচ্ছৃঙ্খল হবে, তাদের পতিভক্তি কমে যাবে। লেখাপড়ার পরিবর্তে নারীদের ঘরকুনো করে রাখার দিকে পিতা-মাতার আগ্রহ ছিল বেশি।

নারীর শিক্ষার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল না। মৌলভি রেখে অভিজাত শ্রেণির নারীদের ঘরে আরবি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হলেও, তাদের বাংলা-ইংরেজি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হতো। এতে নারীমনের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ তো হতোই না, অধিকন্তু নানা কুসংস্কার বাসা বাঁধত। বাঙালি মুসলিম নারীসমাজের এহেন করুণ দশা দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। তিনি নারীসমাজকে উদ্ধার ও কুসংস্কারমুক্ত করতে প্রথমেই নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন।

নারী শিক্ষার প্রতি উদাসীনতাকেই তিনি নারীসমাজের দুঃখ-দুর্দশার মূল কারণ উল্লেখ করে বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতির সভায় অভিভাষণে বলেন, ‘মোছলমানদের যাবতীয় দৈন্য-দুর্দশার একমাত্র কারণ স্ত্রীশিক্ষায় ঔদাস্য।’ তিনি যর্থাথই বুঝতে পেরেছিলেন সমাজ ও জাতির উন্নতির জন্য প্রয়োজন নারী শিক্ষা। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য রূপচর্চার পরিবর্তে জ্ঞানচর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। অলংকারকে তিনি নারীর জন্য দাসত্বের শিকল মনে করেছেন। এ জন্য বেগম রোকেয়া ‘বোরকা’ প্রবন্ধে মেয়েদের অলংকার ছেড়ে জ্ঞান শিক্ষার আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, ‘নারীর শোভন-অলংকার ছাড়িয়া জ্ঞানভূষণ লাভের জন্য ললনাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়।’ নারী শিক্ষাবিরোধী কথিত আলেমদের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং নারী শিক্ষায় ধর্মীয় নির্দেশ প্রমাণ করতে তিনি নারী শিক্ষা সমিতি প্রবন্ধে বলেন, ‘পৃথিবীর যিনি সর্বপ্রথম পুরুষ-স্ত্রীলোককে সমভাবে সুশিক্ষা দান করা কর্তব্য বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন তিনি আমাদের রসূল মকবুল (অর্থাৎ পয়গম্বর সাহেব)।’ তিনি নারীসমাজে যেমন শিক্ষার চেতনা জাগ্রত করেছেন, তেমনি নারী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। অনেক বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে বাঙালি মুসলিম সমাজের শিক্ষা বিস্তারে এ প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়া আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম নারীসমাজকে সংঘবদ্ধ করেছেন তিনি।

বেগম রোকেয়ার সমকালে সমাজের প্রায় অর্ধেক অংশ নারীসমাজকে বাদ দিয়ে সমাজ উন্নয়নের চেষ্টা করা হতো। সে সময় নারীদের উন্নয়নের যথার্থ চিন্তাভাবনা ছিল না। নারীর সহযোগিতা ছাড়া পুরুষের একার পক্ষে সমাজ উন্নয়ন যে সম্ভব নয় তৎকালীন মুসলিম সমাজ তা বুঝত না। অফিস-আদালতে নারীদের কাজ করার কথা বাঙালি মুসলিম সমাজ চিন্তা করতেই পারত না। সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণের কথা মানুষ ভাবতেই পারেনি। এক শ্রেণিকে অবনত রেখে অপর শ্রেণি উন্নত হলে সমগ্র সমাজ উন্নয়ন হয় না। এ বিষয়টি যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বেগম রোকেয়া।

সে সময় স্বামী-স্ত্রীর শিক্ষা ও জ্ঞানের পার্থক্যও ছিল ব্যাপক। স্বামী যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা-গবেষণায় নিয়োজিত, স্ত্রী তখন ঘরের মধ্যে গৃহস্থালির ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। বেগম রোকেয়া ব্যথিত হৃদয়ে জ্ঞানের এ বৈষম্য উল্লেখ করে নারীসমাজকে জাগ্রত করার প্রয়াস চালিয়ে ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়ারের দৈর্ঘ্য প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন! স্বামী যখন কল্পনার সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রমালা বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্যমন্ডলের ঘনফল তুলাদন্ডে ওজন করেন এবং ধুমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাল-ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনির গতি নির্ণয় করেন।’

মুসলিম নারীসমাজের বঞ্চনা ও গঞ্জনা দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। বাঙালি নারীসমাজের মুক্তির জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। নারীসমাজকে জাগ্রত করতে তিনি প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেছেন প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে। নির্যাতিত ও অসহায় নারীসমাজকে পুরুষের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রেরণা ও শক্তি জুগিয়েছেন তিনি। পুরুষের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে নারীসমাজকে অধিকার আদায়ের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তিনি পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের জন্য নারীসমাজকে সামাজিক বাধা উপেক্ষা এবং কঠোর পরিশ্রমের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে লেডী কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী-ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী-জজ, লেডী-ব্যারিস্টার সবই হইব। পঞ্চাশ বৎসর পর লেডী ভাইসরয় হইয়া এদেশের সমস্ত নারীকে ‘রাণী’ করিয়া ফেলিব।’ প্রকৃতপক্ষেই বাঙালি নারীকে ‘রাণী’ করার তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। তাঁরা পুরুষসমাজের আধিপত্যের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়েছেন। অধিকন্তু সর্বস্তরে নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিতের চেষ্টা-আন্দোলন অব্যাহত আছে। নারীসমাজের এ উন্নতি-অগ্রগতির জন্য সমগ্র বাঙালি জাতি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার কাছে ঋণী, আমরা তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

লেখক: বেগম ড. এম এ সবুর, আহ্বায়কডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব নন গভর্নমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গট)

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে খুন: বোরকা পরে ঢুকে স্কুলড্রেসে বেরিয়ে যান একজন, গৃহকর্মী বলে সন্দেহ

দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে বাংলাদেশ এলডিপির সেলিম, প্রার্থী হবেন ধানের শীষের

হাতকড়া ও শিকল পরিয়ে আরও ৩১ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাদেশ নিয়ে সভা ২৫ ডিসেম্বর, নতুন বছরে প্রথম দিন ক্লাস শুরু

‘নারীশাসিত পুরুষ’: সাহস থাকলে সামনে এসে কথা বল—আসিফকে ওমর সানীর চ্যালেঞ্জ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

উচ্চমূল্যের ফলের বাণিজ্যিক বাগান, বুঝে-শুনে বিনিয়োগ করতে হবে

শাইখ সিরাজ
জানতে হবে কোন ফল বা কোন জাত আমাদের মাটির জন্য উপযুক্ত। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ
জানতে হবে কোন ফল বা কোন জাত আমাদের মাটির জন্য উপযুক্ত। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ

কৃষিতে বিনিয়োগের ধরন এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ২০২৫ সালে এসে কৃষিতে ঝোঁক বাড়ছে সব পেশার মানুষের: ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিজীবী, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কৃষির সফলতার গল্প ছড়িয়ে পড়ায় একদল নতুন উদ্যোক্তা দ্রুত আগ্রহী হয়ে উঠছে উচ্চমূল্যের ফল-ফসল চাষে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, এদের অনেকেই বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত না নিয়ে শুধু সফলতার ছবি দেখে বিনিয়োগ করে ফেলছেন। কৃষিতে স্বাভাবিকভাবেই ঝুঁকি থাকে; জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, রোগবালাই, বাজার ওঠানামা—সব মিলিয়ে এখনকার কৃষি আগের চেয়ে প্রযুক্তিনির্ভর, কিন্তু একই সঙ্গে জটিলও। তাই আমি বারবার বলি, চারা কিনে বাগান করলেই বা কিছু নতুন জাতের গাছ এনে লাগালেই লাভ নিশ্চিত নয়। কৃষিকে বুঝে বিনিয়োগ করতে হয়, আর তার জন্য মাঠের অভিজ্ঞতা অপরিহার্য।

এই বাস্তবতায় টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার কৃষক আজিজ; যাঁকে স্থানীয় মানুষ ‘আজিজ কোম্পানি’ নামে চেনে। সে এক অনন্য উদাহরণ। কেবল একজন মানুষ হয়েও নিজের বৈচিত্র্যপূর্ণ উদ্ভাবন, কর্মচাঞ্চল্য আর নিষ্ঠার কারণে তিনি যেন একটি ছোট কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তাঁকে আমরা কৃষক বলি, কিন্তু তাঁর চিন্তা, বিশ্লেষণ আর ধারণা অনেক সময় গবেষকদেরও ছাড়িয়ে যায়। তিনি নিজেকে ‘চাষা’ বলতে গর্ববোধ করেন। বাড়ি, পোশাক, জীবনযাত্রা— সবকিছুর সরলতা আজও তাঁর সঙ্গে মিশে আছে। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তাঁর বাড়ি একই রকম; পরিবর্তন আসেনি আঙিনায়, আসেনি বসতঘরেও। তিনি বলেন, ‘মাটির থেকে দূরে গেলে আমি আমার কাজের প্রাণ হারিয়ে ফেলি।’ সেই মাটির টানই তাঁকে আলাদা জায়গায় নিয়ে গেছে। ২০০৮ সালে তিনি পান চ্যানেল আই কৃষি পদক। এর পর থেকে প্রায় প্রতি দুই-তিন বছর অন্তর তিনি নতুন কিছু দেখান, নতুন কোনো ফল-ফসলের বৈচিত্র্য দেশের সামনে তুলে ধরেন।

এই সময়ে এসে কৃষিতে উচ্চমূল্যের ফলের বাণিজ্যিক বাগান করা যেন ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। ড্রাগন ফল, ট্যাং ফল, মাল্টা, বারি উন্নত জাতের কুল, বিদেশি প্রজাতির লেবু; সবকিছুর চাষে যেন হুড়োহুড়ি। আর এই চাহিদার সুযোগ নিয়ে অনেক নার্সারি ব্যবসায়ী নানা নামে-বেনামে অসংখ্য জাতের চারা বাজারজাত করছেন। ফেসবুক লাইভ বা ভিডিওতে দেখানো হচ্ছে দ্রুত ফলন, অস্বাভাবিক রং, উচ্চমূল্যের দাবি। অথচ অধিকাংশ উদ্যোক্তাই জানেন না কোন জাত কোন অঞ্চলের জন্য উপযোগী, কোনটি রোগপ্রবণ, কোনটি দীর্ঘমেয়াদি, কোনটি ঝুঁকিপূর্ণ। এই বাস্তবতার মধ্যেই আজিজ তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে কৃষকের চোখ খুলে দেন।

আজিজের খামারে গিয়ে প্রতিবারই নতুন কিছু দেখতে পাই। বছরখানেক আগে গিয়েও হতাশ হলাম না। তিনি জানালেন, কয়েক বছর ধরে দেশে যেভাবে কমলার বিভিন্ন জাত ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে উদ্যোক্তাদের ভুল করার আশঙ্কা বেশি। নার্সারিগুলো ব্যবসার প্রয়োজনে কমলার ম্যান্ডারিন, দার্জিলিং, বারি মাল্টাসহ অসংখ্য জাত বাজারে তুলছে। অনেকেই সেগুলো কিনে লাগাচ্ছেন, কিন্তু ফল আসার আগে জানা যাচ্ছে জাতটি ওই মাটির জন্য উপযোগী নয়। তাই আজিজ নিজের উদ্যোগে নার্সারিতে পাওয়া যত জাতের কমলা সম্ভব সংগ্রহ করেছেন। তিন একর জমিজুড়ে তিনি পরীক্ষা চালাচ্ছেন কোনটি সত্যিকার অর্থে টিকে থাকতে পারে, কোনটি লাভজনক, আর কোনটি ঝুঁকিপূর্ণ।

তাঁর সঙ্গে বাগান ঘুরতে ঘুরতেই তিনি বললেন, ‘ম্যান্ডারিন আর দার্জিলিং জাতের কমলা আমাদের আবহাওয়া আর মাটিতে বাণিজ্যিকভাবে ভালো লাভ দেবে বলে মনে হয় না।’ তাঁর কথার সঙ্গে মিল পেলাম বাগানে। বেশ কিছু গাছে ফল শুকিয়ে যাচ্ছে। কচি পাতায় দাগ, গাছের শীর্ষভাগে মরা ভাব এসব স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। প্রথমে তিনি বলেছিলেন রুদ্রমৌসুমের তাপে এমন হয়েছে, কিন্তু আমার মনে হলো আরও কোনো কারণ থাকতে পারে। পরে বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম উদ্যানতত্ত্ববিদ ড. মেহেদী মাসুদের সঙ্গে। তিনি বললেন, এই সমস্যা এফিড, হোয়াইট ফ্লাইজ ও স্কেল ইনসেক্টের আক্রমণের কারণে হয়। এরা প্রচুর হানিডিউ নিঃসরণ করে, যা ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বাড়ায়। ফলে কমলার গায়ে কালো দাগ, ফল শুকিয়ে যাওয়া, পাতার রং পরিবর্তন দেখা যায়। তিনি জানালেন, একটি ১৪ ফুট উচ্চতার কমলাগাছে দৈনিক ৫৩ লিটার পানি প্রয়োজন। মাঝারি গাছে লাগে প্রায় ২৫ লিটার। সেচব্যবস্থায় ড্রিপ, জৈব সার, মালচিং এখন বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োজন। আজিজ এখন ড্রিপ সেচ ব্যবহার করছেন, যা তাঁর খরচও কমিয়েছে।

কৃষিতে প্রযুক্তির প্রয়োগ আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। আজিজও পিছিয়ে নেই। করোনার কঠিন দিনের পর তিনি নতুন ফসল নিয়ে গবেষণায় আরও মনোযোগ দিয়েছেন। ২০২২ সালে তিন একর জমিতে বল সুন্দরী কুল চাষ করেছিলেন। সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল সেই কুল। কিন্তু তিনি সেখানে থেমে থাকেননি। দুই বছর পর সেই কুলগাছ কেটে সেখানে শুরু হলো কমলার বাগান। ১০০০ চায়না ম্যান্ডারিন ও ১০০০ দার্জিলিং কমলা। প্রচুর ফলন হয়েছে, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি বড় ক্ষতির অভিজ্ঞতাও বললেন। রংপুর থেকে আনা ২৫০০ পেঁপের চারা ও ৫০০০ মরিচের চারা রোপণ করেছিলেন। পেঁপের মাত্র ২৫ শতাংশ ফল ধরেছে, মরিচের অবস্থাও করুণ। তাঁর মতে, চারা ব্যবসায়ীদের সঠিক দায়িত্বশীলতা নেই। গাছ রোগাক্রান্ত কি না, জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খায় কি না এসব যাচাই না করেই বাজারে তোলা হয়। তিনি মনে করেন নার্সারি ব্যবসায়ীদেরও একটি মাননিয়ন্ত্রণ কাঠামোর মধ্যে আনা প্রয়োজন।

আজিজের কৃষিতে জৈব পদ্ধতির ব্যবহার পুরোনো, কিন্তু এই সময়ে এসে এটি তাঁর কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আমাকে দেখালেন, একই গাছে দুটি ডালের ফল ভিন্নভাবে পাকানো হচ্ছে। একটিতে রাসায়নিক প্রয়োগে রং আনা হচ্ছে, অন্যটিতে প্রাকৃতিকভাবে। তাঁর বক্তব্য, মানুষ রঙিন ফল দেখলেই কিনতে চায়। এতে লাভ হয় ঠিকই, কিন্তু ক্ষতি হয় মানুষের স্বাস্থ্যের।

আজিজ আমাকে আরেকটি নতুন উদ্যোগ দেখালেন, পাহাড়ে জন্মানো আনারসের জাতকে ছাদকৃষিতে আনা। শহরে ছাদে সবজি চাষ এখন সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু আনারস চাষের ব্যাপারটি বহু মানুষের কাছে নতুন। আজিজের উৎসাহে ঢাকার অনেক ছাদকৃষক এখন আনারস লাগাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘টেলিভিশনই কৃষকের স্কুল। আমি দেখাতে চাই, শহরেও ফলন সম্ভব।’

বর্তমানে কৃষির অন্যতম বড় প্রশ্ন, কোন ফল বা কোন জাত আমাদের মাটির জন্য উপযুক্ত? জলবায়ু পরিবর্তন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টির কারণে একই ফসলের সাফল্য এখন অঞ্চলভেদে ভিন্ন। নতুন উদ্যোক্তাদের অনেকেই এসব বৈজ্ঞানিক বিষয় জানেন না। তাই তাঁরা সহজেই প্রতারণার শিকার হন। অসফল হলে শুধু ব্যক্তির ক্ষতি নয়, কৃষির প্রতি আস্থা কমে যায়। আজিজের মতো হাতে-কলমে অভিজ্ঞ, বিজ্ঞানমনস্ক কৃষকের দৃষ্টিভঙ্গি তাই এখন আরও প্রয়োজন।

চাষা আজিজকে কোনো নির্দিষ্ট ফসল বা ফলের কৃষক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। তিনি পরীক্ষা করেন, ভেঙেচুরে দেখেন, ব্যর্থ হন, আবার নতুন করে শুরু করেন। তাঁর মধ্যে সাহস আছে, আছে কৌতূহল, আছে মানবিকতা, যা নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের জন্য শিক্ষণীয়। তিনি বিশ্বাস করেন কৃষি নিশ্চিত লাভের পথ নয়, এটি ওঠানামার মধ্য দিয়েই এগোয়। প্রতিদিনই শেখার, চেষ্টা করার, নতুন কিছু উদ্ভাবনের প্রয়োজন।

কৃষি যে কতটা সম্ভাবনাময়, তা আজিজের মতো একজন কৃষকের কাজেই স্পষ্ট। মাটির সঙ্গে তাঁর যে হৃদ্যতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে সাহস, আর মানবিকতার যে গভীরতা, এসবই তাঁকে ‘আজিজ কোম্পানি’ করে তুলেছে। ভবিষ্যতের কৃষিও এমন মানুষের হাতেই আরও শক্তিশালী হবে, এ বিশ্বাস রাখি।

লেখক: শাইখ সিরাজ,পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে খুন: বোরকা পরে ঢুকে স্কুলড্রেসে বেরিয়ে যান একজন, গৃহকর্মী বলে সন্দেহ

দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে বাংলাদেশ এলডিপির সেলিম, প্রার্থী হবেন ধানের শীষের

হাতকড়া ও শিকল পরিয়ে আরও ৩১ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাদেশ নিয়ে সভা ২৫ ডিসেম্বর, নতুন বছরে প্রথম দিন ক্লাস শুরু

‘নারীশাসিত পুরুষ’: সাহস থাকলে সামনে এসে কথা বল—আসিফকে ওমর সানীর চ্যালেঞ্জ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সরকারি হাসপাতাল বলে কথা

সম্পাদকীয়
সরকারি হাসপাতাল বলে কথা

ফটোথেরাপি মেশিনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিশেষ করে নবজাতকের জন্ডিস হলে ফটোথেরাপি দিতে হয়, যা শিশুর শরীরকে স্বাভাবিক আলোতে রাখতে সহায়তা করে। এ ছাড়া এটি ত্বকের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, বিলিরুবিনের মতো পদার্থের ভাঙন ত্বরান্বিত করে এবং শরীর থেকে তা বের করে দিতে সাহায্য করে। এ কারণে যেকোনো শিশু হাসপাতালে এ যন্ত্র থাকা আবশ্যক। কিন্তু ঝিনাইদহ ২৫ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি শিশু হাসপাতালের চারটি ফটোথেরাপি মেশিনের মধ্যে তিনটি এক বছর ধরে অচল হয়ে পড়ে রয়েছে।

নবজাতকের জন্ডিস হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু জন্ডিসের চিকিৎসা যথাসময়ে না হলে, পরবর্তী সময়ে নানা রকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। সে জন্য নবজাতকের জন্ডিস হলে তাৎক্ষণিকভাবে ফটোথেরাপি দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে যখন এ যন্ত্রের বেশির ভাগ কাজ করে না, তখন শিশুদের বিপদের আশঙ্কা থেকে যায়। এই হাসপাতালে গত বছর কর্মচারী সংকট নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবছর যখন একই হাসপাতালে ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা থাকে, তখন তা নিজেই রুগ্‌ণ হিসেবে বিবেচিত হবে। রুগ্‌ণ হাসপাতাল কখনো কি ভালো চিকিৎসা দিতে পারে?

বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে বলে বিভিন্ন সময় সরকারপ্রধানেরা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করে থাকেন। কিন্তু সমস্যার যে আদৌ সমাধান হয়নি, তা এ ধরনের সংবাদের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। কোনো সরকারপ্রধানের মুখের বুলিকে বন্ধ করার সাধ্য কার আছে! কারণ হাসপাতাল হয়েছে ঠিকই; কিন্তু দেখা গেল ভবন পড়ে আছে। চালু হলেও দেখা যায় চিকিৎসক ও জনবলের মারাত্মক সংকট রয়েছে। আবার এসব ঠিক থাকলেও দেখা যায় যন্ত্রপাতি নেই অথবা তা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এসব হলো দেশের সরকারি হাসপাতালের নিত্যচিত্র। আর এই নানা সমস্যা সৃষ্টি হয় মূলত সিভিল সার্জন কার্যালয় বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অবহেলার কারণেই।

দেশের অনেক সরকারি হাসপাতালেই বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করছে না। অথচ দেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকে কয়েক হাজার কোটি টাকা। সামর্থ্যবানেরা বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে টাকার জোরে ভালো চিকিৎসা পেলেও, হতদরিদ্ররা সরকারি হাসপাতালে যথোপযুক্ত চিকিৎসা পায় না।

স্বাস্থ্যসেবা মানে শুধুই ধনিকশ্রেণির স্বাস্থ্যসেবা নয়, এর মানে দেশের পুরো জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা। দেশের সব সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পয়সাওয়ালারা চিকিৎসার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর, ইউরোপ ও আমেরিকা যেখানেই যান না কেন, সেটা তাঁদের ব্যাপার; কিন্তু সাধারণ খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ নিজ দেশে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাবেন না, এ কেমন কথা! সব শ্রেণির মানুষ ভালো চিকিৎসা তখনই পাবেন, যখন সরকারি হাসপাতালগুলোতে সুচিকিৎসার জন্য সব আয়োজন থাকবে। আমরা ঝিনাইদহ সরকারি শিশু হাসপাতালে যে ফটোথেরাপি মেশিনের নষ্ট হয়ে পড়ে থাকার কথা বলেছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত সেগুলোকে যথাসম্ভব দ্রুত কার্যকর করে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে খুন: বোরকা পরে ঢুকে স্কুলড্রেসে বেরিয়ে যান একজন, গৃহকর্মী বলে সন্দেহ

দল বিলুপ্ত করে বিএনপিতে বাংলাদেশ এলডিপির সেলিম, প্রার্থী হবেন ধানের শীষের

হাতকড়া ও শিকল পরিয়ে আরও ৩১ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র

ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাদেশ নিয়ে সভা ২৫ ডিসেম্বর, নতুন বছরে প্রথম দিন ক্লাস শুরু

‘নারীশাসিত পুরুষ’: সাহস থাকলে সামনে এসে কথা বল—আসিফকে ওমর সানীর চ্যালেঞ্জ

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত