Ajker Patrika

প্যারাবন ধ্বংস

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আয়োজন

ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র 
ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র
ড. বিভূতি ভূষণ মিত্র

উপকূলীয় এলাকায় জেগে ওঠা চরাঞ্চলে ১৯৬৫ সাল থেকে বন সৃষ্টি করা হচ্ছে, যাকে প্যারাবন বলা হয়। বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর এবং কক্সবাজার জেলায় এই প্যারাবন গড়ে উঠেছে। প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর ভূমিতে এই বন তৈরি করা হয়েছে। এটি দেশের আয়তনের ১.৩৬ শতাংশ। বন অধিদপ্তর-নিয়ন্ত্রিত বনের পরিমাণ ১২.৫০ শতাংশ। উপকূলবর্তী অঞ্চলের বন সমুদ্র দ্বারা প্রভাবিত। এর বাস্তুতন্ত্রও ভিন্ন। কেননা সৈকত, মোহনা, জলাভূমি, মাটির প্রকৃতির কারণে এটি একটি স্বতন্ত্র বাস্তুতন্ত্র গঠন করেছে। এর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে। এই প্যারাবনে কেওড়া, ছৈলা, বাইন, গোলপাতা প্রভৃতি উদ্ভিদ প্রজাতি দেখা যায়। বন্য প্রাণীর মধ্যে হরিণ, মেছোবাঘ, শিয়াল ইত্যাদি রয়েছে। পাখির মধ্যে কালালেজ জৌরালি, দেশি গাঙচষা, কালামাথা কাস্তেচরা, খয়রাপাখ মাছরাঙার দেখা মেলে। প্যারাবন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে জানমাল ও দেশকে রক্ষা করে যাচ্ছে।

বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, উপকূলীয় চরাঞ্চলে ২ হাজার ৫২১ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বনায়ন করা হয়েছে। উপকূলের ১ লাখ ১২ হাজার ৬৩ একর জমি শস্য উৎপাদনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে ফেরত দেওয়া হয়েছে। সবুজবেষ্টনীর কারণে বন্য প্রাণীর অভয়াশ্রম ও মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বনজ সম্পদ সৃষ্টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা, জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে কাজ করছে। এর ফলে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার মানুষ নতুন উদ্যমে কাজ করার স্পৃহা পাচ্ছে। বন বিভাগ ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ একর উপকূলীয় বনায়ন করে। বলা হয় এটিই প্রথম বিশ্বের সর্ববৃহৎ উপকূলীয় বনায়ন প্রকল্প। একটি তথ্যমতে, ষাটের দশকে ১ হাজার ১০০ একর জমিতে ম্যানগ্রোভ জাতের গাছ লাগানো হয়। গেওয়া, কেওড়া, ছৈলা এখানে উল্লেখযোগ্য। জলোচ্ছ্বাস ও ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে সবুজবেষ্টনী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এর আগে ১৯৬৬ সালে ম্যানগ্রোভ বনায়ন শুরু হয়। মূলত জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা এবং কৃষিজমি, জানমাল রক্ষায় উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর ফলে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছে উপকূলীয় এলাকা।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী উপকূলীয় অঞ্চলের প্যারাবন প্রতিনিয়ত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বনাঞ্চল যেমন বিলীন হচ্ছে, তেমনি স্থানীয় প্রভাবশালীরাও নির্বিচারে ধ্বংস করছে এসব প্যারাবন। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, অনেকে প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়িঘেরও নির্মাণ করছে। বেশ কিছুদিন আগে মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের তিন সহস্রাধিক একর প্যারাবন কেটে ছোট-বড় অর্ধশত চিংড়িঘের নির্মাণ করেছে প্রভাবশালীরা। পত্রিকায় জানানো হয়েছে, এ রকম কয়েক হাজার একর প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়িঘের বানানো হয়েছে। এ ছাড়া বন কেটে কারখানা তৈরি, বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ, পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন করায় এইসব বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

ভূমিদস্যু ও অতিরিক্ত লোভী মানুষের জন্য বনাঞ্চল বিলীন হওয়ার পথে। ইউনেসকোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সুন্দরবনের ৭৫ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন সময়ে আইলা, আম্পান ও ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বনে লোনাপানি ঢোকে। মিঠাপানির প্রবাহ কমে যায়। এতে করে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সুন্দরী, কেওড়া, গোলপাতাসহ বিভিন্ন গাছ মারা যায়। প্যারাবনগুলোর অবস্থাও তা-ই। পরিবেশবিদেরা শঙ্কা প্রকাশ করলেও এসবের সুরাহা হচ্ছে না।

সম্প্রতি কক্সবাজার শহরের প্রধান নদী বাঁকখালী পরিদর্শন করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। নদী দেখে তাঁরা হতাশা প্রকাশ করেন। কেননা, দখলে-দূষণে এটি এখন মৃতপ্রায়। শুধু নদী নয়, নদীর তীরে যে প্যারাবন ছিল, তা ধ্বংস করে করা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত এক বছরে নদীর ধারের ৬০০ একরের প্যারাবন ধ্বংস করে ১ হাজার ২০০টি অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। ২০২৩ সালে কস্তুরঘাট এলাকায় জেলা প্রশাসন চার শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও ৩০০ একরের বেশি প্যারাবনের জমি উদ্ধার করলেও কিছুদিনের মধ্যে তা আবারও দখল হয়ে যায়। নির্মিত হয় চার শতাধিক ঘরবাড়ি-দোকানপাট। এটি পরিবেশবিদদের কাছে দুর্ভাবনার বিষয়। নদী উদ্ধারের পাশাপাশি প্যারাবন উদ্ধারের কাজেও এগিয়ে আসতে হবে। কেননা, এভাবে প্যারাবন ধ্বংস হতে থাকলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত