Ajker Patrika

রুটিরুজির আন্দোলন ও রাজনীতির লেবাস

উপসম্পাদকীয়
রুটিরুজির আন্দোলন ও রাজনীতির লেবাস

৭ নভেম্বর শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান এক সংবাদ সম্মেলনে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের নিম্নতম ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরির ঘোষণা দেন। ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন এই মজুরিকাঠামো কার্যকর হবে এবং জানুয়ারির শুরুতেই শ্রমিকেরা মজুরি পেতে শুরু করবেন।

নতুন মজুরিকাঠামো ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকেরা অসন্তোষ প্রকাশ করে তাৎক্ষণিকভাবে তা প্রত্যাখ্যান করে ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা করার অনুরোধ করেন। নতুন মজুরিকাঠামো ঘোষণার পরদিনই গাজীপুরে শ্রমিকেরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এতে পুলিশের গুলিতে নতুন করে আরও একজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।

কয়েক সপ্তাহ ধরে পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা তাঁদের মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ঢাকার মিরপুর, খিলগাঁও, আশুলিয়া, সাভার ও গাজীপুর এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন। তাঁদের এই আন্দোলনে কারখানা ভাঙচুর থেকে শুরু করে জ্বালাও-পোড়াও, অবরোধের মতো ঘটনাও ঘটেছে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের অস্ত্রধারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায় এযাবৎ তিন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যদিও শ্রমিকনেতারা কারখানা ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনার সঙ্গে কোনো শ্রমিক জড়িত নন বলে দাবি করেছেন।

শ্রমিকদের দাবি, ২০১৮ সালে যখন ৮ হাজার টাকা মজুরি দেওয়া হয়, তখন ডলারের দাম ছিল ৮৩ টাকা ৮৭ পয়সা। ডলারের হিসাবে সে সময় ন্যূনতম মজুরি ছিল ৯৫ দশমিক ৩৮ ডলার। বর্তমানে সরকারি ডলার রেট যদি ১১০ দশমিক ৫০ টাকা হয়, তাহলে ৯৫ দশমিক ৩৮ ডলারের বিনিময়ে এখন একজন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৫৩৯ টাকা হওয়ার কথা।

অথচ তাঁরা এখনো ৮ হাজার টাকাই পাচ্ছেন। অপরদিকে গত পাঁচ বছরে দেশে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিলের সঙ্গে দ্রব্যমূল্য দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে। এ জন্য তাঁদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করলে ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা হওয়া উচিত।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি মূল্যস্ফীতি, দ্রব্যের আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধির কথা বিবেচনায় রেখে একটি জরিপ চালায়। তারা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের ৭৬টি পোশাক কারখানার ওপর জরিপ করে ন্যূনতম মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা করার প্রস্তাব দেয়। সংস্থাটি আরও জানায়, ২৭ শতাংশ কারখানার মালিক মনে করেন তাঁরা শ্রমিকদের ১২ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দিতে পারবেন।

মজুরি পুনর্নির্ধারণের সময় এলেই মালিকেরা বিভিন্ন অজুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। বলা হয়, মজুরি বৃদ্ধি করলে তাঁদের অনেকের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হবে। ফলে হাজার হাজার শ্রমিকের চাকরি চলে যাবে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনেও ধস নামবে। আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক রপ্তানিকারক অন্যান্য দেশ তাদের শ্রমিকদের বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ মজুরি দিয়ে ভালো ব্যবসা করতে পারলে, আমাদের দেশের মালিকেরা কেন পারবেন না? যেখানে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ভিয়েতনামের শ্রমিকেরা মজুরি পান যথাক্রমে ৩০৩ ও ১৭০ ডলার। তা ছাড়া ভারত ১৭১, কম্বোডিয়া ২০০, ইন্দোনেশিয়া ২৪২ ডলার দেয়।

সেখানে বাংলাদেশের শ্রমিকেরা পান মাত্র ৯৫ দশমিক ৩৮ ডলার। বাইরের শ্রমিকের তুলনায় যে এখানকার শ্রমিকেরা শুধু কম মজুরি পান তা নয়, দেশের অভ্যন্তরের অন্যান্য শিল্প খাতের শ্রমিকদের তুলনায়ও কম পান। পোশাকশিল্প শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি যেখানে ৮ হাজার টাকা, সেখানে জাহাজভাঙা শিল্প, রি-রোলিং শিল্প, নির্মাণ ও কাঠশিল্পের শ্রমিকেরা গড়ে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা মজুরি পান। অথচ পোশাকশিল্প মালিকেরা অন্যান্য শিল্পকারখানার তুলনায় সরকারের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন।

অন্য শিল্প খাতকে যেখানে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট কর দিতে হয়, সেখানে পোশাক খাতের জন্য করের হার রাখা হয়েছে ১০ থেকে ১২ শতাংশ। এ ছাড়া বিভিন্ন বাজারে এই খাতে ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়, মূসক অব্যাহতি, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়া ইত্যাদি তো রয়েছেই। বন্ড-সুবিধাও পান এই খাতের মালিকেরা। এই সুবিধার আওতায় পোশাক খাতের কাঁচামাল, যেমন সুতা, কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে শুল্ক-কর দিতে হয় না।

শ্রমিকদের মজুরি বাড়ালে পোশাকশিল্পে ধস নামবে বলে মালিকেরা যত কথাই বলুক না কেন, বাস্তবতা কিন্তু তা বলে না; বরং এক দশকে পোশাকশিল্প ব্যবসারও প্রসার ঘটেছে। ২০১৩-২২ সাল পর্যন্ত তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৩০ শতাংশ। গত কয়েক বছরে ছোট, মাঝারি ও বড় সব ধরনের কারখানারই রপ্তানি বেড়েছে। একই সঙ্গে কারখানার আকারও বেড়েছে। তাতে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। একজন শ্রমিক প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার ৩০ ডলার, অর্থাৎ টাকার মূল্যে ২ লাখ ২৪ হাজার টাকা মূল্যের রপ্তানিযোগ্য পোশাক তৈরি করেন; ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। পরের বছরগুলোতে একই হারে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০১৮ সালে সর্বশেষ মজুরি ঘোষণার পাঁচ বছর পার হয়ে যাওয়ায় এই নভেম্বরের মধ্যেই মজুরি পুনর্নির্ধারণের ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল। সেই মোতাবেক মজুরি বোর্ড, সরকার ও কারখানার মালিকদের মধ্যে সমঝোতার আলোচনাও চলছিল। মজুরি বোর্ডে প্রস্তাব দেওয়ার আগে বিজিএমইএর নেতারা বেশ কয়েকবার বিভিন্ন কারখানার মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

মালিকদের কেউ কেউ ১২ হাজার টাকা মজুরি দেওয়ার সক্ষমতার কথা জানান। কেউ কেউ আবার সাড়ে ১২ হাজার টাকা বলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিকভাবে ১১ হাজার ২০০ টাকা মজুরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি করে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী একটি মহল। তারা ১০ হাজার ৪০০ টাকা দেওয়ার পক্ষে মত দেন; অর্থাৎ শ্রমিকদের দাবি করা ন্যূনতম মজুরির প্রায় অর্ধেক। এই প্রস্তাবের কথা জানার পর, ২৩ অক্টোবর থেকে শ্রমিকদের ভেতর ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয় এবং তা দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

শ্রমিক আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার এবং মালিকপক্ষ প্রথম থেকেই হার্ডলাইনে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শ্রমিকদের এই ন্যায্য আন্দোলনের ভেতর তারা রাজনীতি খোঁজার চেষ্টা করছে। বিজিএমইএর নেতা ও কারখানার একাধিক মালিক ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতাদের মতোই মনে করেন, নির্বাচনের আগে দেশি-বিদেশি একটি চক্র সুযোগ নিতে চাইছে।

তাঁদের ভাষায়, এই আন্দোলনে অনেক ষড়যন্ত্র ভর করেছে। যাঁরা মারামারি করছেন, কারখানা জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা সবাই বহিরাগত। যাঁরা দেশের অগ্রগতি চান না, তাঁরাই এসব কাজ করছেন। তাঁরা বলেছেন, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটে শ্রমিক আন্দোলনকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু শ্রমিক নেতারা অন্য কথা বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, মজুরি বাড়ানোর জন্য এক বছর আগে থেকেই দাবি করে আসছেন তাঁরা। তাঁদের ভাষায়, সবকিছুর পরিবর্তন হলেও শ্রমিকের জীবন ও জীবিকার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ওদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা বিএনপিসহ বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে ভালো চোখে দেখছেন না। তাঁরা মনে করেন, বিএনপি-জামায়াত শ্রমিকদের আন্দোলনকে কাজে লাগাতে সুযোগ নিচ্ছে। বিরোধীরা যাতে সেই সুযোগ না নিতে পারে এ জন্য দলের পক্ষ থেকে সংসদ সদস্যদের এলাকায় গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে বুঝিয়ে শান্ত করতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সতর্ক করা হয়। পোশাক খাত ও এর শ্রমিকেরা বেশ স্পর্শকাতর। কাজেই বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁরা যে আচরণ করেন, একই আচরণ যেন শ্রমিকদের সঙ্গে করা না হয়, তাতে হিতে বিপরীত হবে। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চাপে সরকার ও দল যে পরিস্থিতির মধ্যে আছে তাতে এই মুহূর্তে শ্রমিকদের খেপানো যাবে না।

ফলে তাঁদের সঙ্গে নমনীয় থেকে, বুঝিয়ে শান্ত করতে হবে। কিন্তু এ কথা বললে কী হবে, ঢাকার পল্লবী এলাকায় ৩১ অক্টোবর শ্রমিকেরা বিক্ষোভে নামলে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে মাঠে নামেন স্থানীয় ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আওলাদ হোসেন লাক্কুকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা যায়। তিনি এতই বেপরোয়া ছিলেন যে নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য কোনো মাস্ক বা হেলমেটও পরেননি। সচরাচর অন্যান্য ঘটনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা হাতে যেভাবে হেলমেট পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। লাক্কুকে ওই অস্ত্র দিয়ে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়তেও দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন।

সম্প্রতি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ে বিদেশে এমনিতেই বাংলাদেশের ভাবমূর্তির সংকট চলছে। তারপরও শ্রমিকদের ওপর পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নিপীড়নের ঘটনা যে আরও ক্ষতি করবে—সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ শ্রমিক ইউনিয়ন ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট ‘ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইন’ বা সিসিসি আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিকদের আন্দোলনের এই সময়ে দেশের শ্রম খাতের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল ১২ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করবে।

বর্তমানে পোশাকশিল্পে যে অস্থিরতা চলছে, এর উন্নতি না হলে বিদেশে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শ্রমিকদের ওপর চলমান সহিংসতার জের ধরে, ভবিষ্যতে পোশাক রপ্তানির ওপর যদি কোনো কোটা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, আশ্চর্য হব না। শ্রমিকদের এই রুটিরুজির আন্দোলনকে অনর্থক রাজনীতির লেবাস পরিয়ে পরিস্থিতি আরও ঘোলা করা উচিত হবে না; বরং পোশাকশিল্প খাতের এই অস্থির পরিস্থিতি পরিবর্তনে, শ্রমিকদের দাবির কথা পুনর্বিবেচনা করে, একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান সরকারকেই বের করতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিশ্বে ১৮৬ দেশের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ মাত্র একটি: গবেষণা

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করলেন প্রধান বিচারপতি

শুধু নোটিশে চাকরি হারাবেন সরকারি কর্মচারীরা, আপিলের সুযোগ নেই

সদরপুরে অসহায় পরিবারের ভিটেমাটি দখলের চেষ্টা, যুবক গ্রেপ্তার

ভারতে অর্থ পাচার মামলায় খুলনায় ব্যবসায়ীর ১০ বছরের কারাদণ্ড

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত