Ajker Patrika

শান্তিময় শান্তিনিকেতন

সুমন্ত গুপ্ত 
আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫: ৪৯
শান্তিময় শান্তিনিকেতন

ভুবনডাঙ্গার মাঠ সেদিন ছিল জ্যোৎস্নাভরা। ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ আর শালবৃক্ষের মেলা জোড়াসাঁকোর জমিদারকে পাগল করে তুলেছিল। সে অপূর্ব দৃশ্য দেখার পর ১৮৬৩ সালের ৩১ মার্চ জোড়াসাঁকোর জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০ বিঘা জমি পাঁচ টাকায় পাট্টা নিয়ে নেন ভুবন সিংহের কাছ থেকে। ভুবন সিংহের নামে সে মাঠের নাম ছিল ভুবনডাঙ্গা। পরে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন নামে একটি বাড়ি তৈরি করেন। ১৮৮৮ সালের ৮ মার্চ তিনি ট্রাস্টি চুক্তির মাধ্যমে শান্তিনিকেতনকে সবার জন্য উন্মুক্ত করেন।

এরপর সময় যত গড়িয়েছে, সেই মাঠ, বনানী, জনপদ হয়ে উঠেছে বাঙালির একটি বাই ডিফল্ট ভ্রমণ গন্তব্য।

কলকাতা থেকে দিনে দিনে ঘুরে আসা যায় শান্তিনিকেতন থেকে। সকালবেলা শিয়ালদহ কিংবা হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা দিয়ে তিন ঘণ্টার ট্রেন ভ্রমণ করে চলে যাওয়া যায় শান্তিনিকেতনে।

 প্রার্থনা কক্ষসেই ভোরবেলা ৪০ মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম হাওড়া রেলস্টেশনে। হাজার হাজার মানুষের ভিড়, ঠিক আমাদের কমলাপুর রেলস্টেশনের মতো। কারও দিকে কারও তাকানোর সময় নেই। চা খেয়ে নিই কিছুটা সময় পেয়ে। তারপর ট্রেনে চেপে বসি।

কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনের দূরত্ব ১৫৯ কিলোমিটার। জানালার পাশে বসলাম ক্যামেরা নিয়ে। একের পর এক ছবি তোলার চেষ্টা করতে লাগলাম। একটু পরেই ট্রেনে হরেক রকমের খাবার নিয়ে আসতে লাগলেন হকাররা। গরম-গরম কচুরি, ডিম চপ, মুরগির কাটলেটসহ আরও অনেক কিছু। গরম-গরম কচুরি আর মুরগির কাটলেট খেলাম। শালপাতায় প্রথমবার খেলাম।

 বোলপুর রেলস্টেশনপথের দুই পাশে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিলাম, বুঝতেই পারলাম না। স্টেশন থেকে রিকশায় শান্তিনিকেতন ২০ মিনিটের পথ। ভারতের রাস্তাঘাটগুলোতে ছেলে-মেয়ে, যুবক-যুবতী অনেকেই বাইসাইকেলে যাতায়াত করেন। স্টেশন থেকে শান্তিনিকেতন যেতেও সেই চিত্র। রাস্তার ধারের দোকানপাটগুলো আমাদের দেশের মতোই। পথের ধারে হকারদের দোকান। তাতে হরেক রকম পণ্যের সমাহার। শান্তিনিকেতনে ফুটপাতের দোকানগুলোতে দেখলাম মাটির তৈরি রবিঠাকুরের প্রতিকৃতি। দাম ১০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। আরও আছে কারুকার্যময় তৈজসপত্রের ছড়াছড়ি।

কলাভবনের সামনে এসে আমরা রিকশা থেকে নামলাম। চোখে পড়ল শান্তিনিকেতনকে অমর করে রাখা ভাস্কর রামকিঙ্করের বিখ্যাত দুটি ভাস্কর্য। একটি হলো দুই সাঁওতাল রমণী সন্তান নিয়ে কারখানায় কাজ করতে যাচ্ছে। অন্যটি সাঁওতাল শ্রমিক পরিবারের দেশান্তরে যাত্রা। কলাভবনের দরজা দিয়ে বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলাম। লাল কাঁকর বিছানো পথ। দুই পাশে সবুজের সমারোহ।

আমরা এগিয়ে চলছি। গৌতম মামা বলছিলেন শান্তিনিকেতনের শুরুর ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও এর উদ্যোক্তা ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র হিসেবে ছিলেন গৌর গোবিন্দ গুপ্ত, প্রেমকুমার গুপ্ত, অশোককুমার গুপ্ত, সুধীর চন্দ্র,  গিরিন ভট্টাচার্য,  যোগানন্দ মিত্র,  রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীকালে ১৯২১ সালে এখানেই বিখ্যাত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

শান্তিনিকেতনের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভেতরে কড়া নিরাপত্তা। নিয়ম মেনে টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম আমরা। প্রথমে বিচিত্রা ভবনে ঢুকেই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলাম। এটি রবীন্দ্র স্মৃতি-সমৃদ্ধ জাদুঘর। এখানে রবীন্দ্রনাথের ফুলদানি, তাঁর নির্মিত কাঠের বাক্স, জাপানের উপহার,  অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি. লিট নেওয়ার সময় কবির ব্যবহৃত পোশাক, শিশুকাল থেকে প্রৌঢ় পর্যন্ত কবির বিভিন্ন বয়সের ছবি, গুরুত্বপূর্ণ দলিল, চিত্রকর্ম, রাষ্ট্রপ্রধানদের দেওয়া উপহারসামগ্রী, নোবেল পুরস্কারের প্রতিকৃতি আছে।

এরপর চলে এলাম উদয়নে। এটি ছিল রবীন্দ্রনাথের বাসভবন। এই ভবন তৈরিতে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এখানে বসেই রবীন্দ্রনাথ আশ্রমবাসী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কবিতা পাঠ, নাটক ও জলসার আয়োজন করতেন। এরপর চললাম শ্যামলীর দিকে। ১৩৪২ সালের ২৫ বৈশাখ জন্মদিনে কবি এই বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন। এর পাশেই পুনশ্চ। কবি ১৯৩৬ সালে শ্যামলী থেকে পুনশ্চ নামের 
এই বাড়িতে এসে ওঠেন। এ বাড়ির ছাদহীন খোলা জানালা দেওয়া বারান্দা কবির বিশেষ প্রিয় ছিল। এ বাড়িটির কাছেই উদীচী নামে দোতলা মনোরম একটি বাড়ি আছে। ১৯১৯ সালের শেষ দিকে এই বাড়িতেই কবি বসবাস করেছেন।

 পুনশ্চএখান থেকে একটু এগোলেই কোনার্ক। ১৯১৯ সালে নির্মিত এই বাড়ি বিভিন্ন বিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। শান্তিনিকেতনের ঐতিহাসিক এই পাঁচটি বাড়িই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত। দৃষ্টিনন্দন পাঁচটি বাড়ির ছবি তোলার অনুমতি না থাকায় ছবি তোলা হয়নি। বাড়িগুলো মুগ্ধ নয়নে দেখে সামনে এগোতেই উপাসনা গৃহ চোখে পড়ল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে উপাসনা গৃহ ভবন প্রতিষ্ঠা করেন। রঙিন বেলজিয়াম কাচ ও মার্বেল পাথরে এর চারপাশ অলংকৃত। এখানে সাপ্তাহিক ছুটি বুধবার। মঙ্গলবার অর্ধদিবস ছুটি। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম কবির বাড়ির দক্ষিণ পাশে। এদিকটায় অনেক আমগাছ আছে। একটি আমগাছের তলায় বড় বেদি দেখে থমকে দাঁড়ালাম। পরে জানলাম, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এখানে ‘ছাতিমতলায়’ বসে উপাসনা করতেন। মাথার ওপর উন্মুক্ত নীল আকাশ, ঝলমলে রোদ জানান দিচ্ছে দুপুর গড়িয়েছে। আমাদের ফিরতে হবে কলকাতা শহরে।  

কীভাবে যাবেন
শান্তিনিকেতন যেতে হলে প্রথমে কলকাতা যেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অন্তর্গত বোলপুর শহরে এই আশ্রম ও বিশ্ববিদ্যালয়টি। কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনের মধ্যে ১৫৯ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিতে বেশির ভাগ মানুষ ট্রেনকেই বেছে নেন। প্রতিদিন কলকাতার হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন থেকে অনেক ট্রেন শান্তিনিকেতনের উদ্দেশে যাত্রা করে। এগুলোর মধ্যে ‘শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস’ বিখ্যাত। শান্তিনিকেতন স্টেশনে নেমে রিকশায় ২০ মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাবেন শান্তিনিকেতনে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

‘ভারতে ঢুকে’ পাকিস্তানি সেনাদের গুলি, সীমান্তে সংঘাত গড়াল ষষ্ঠ দিনে

বন্ধুকে ছাত্রলীগ সাজিয়ে পুলিশে দিয়ে তাঁর প্রেমিকাকে ধর্ষণ করলেন ছাত্রদল নেতা

মানিকগঞ্জে রাতের আঁধারে স্থানান্তর করা বিদ্যালয় ভবন পরিদর্শনে কর্মকর্তারা

পরিপাকতন্ত্রের ওষুধের পেছনেই মানুষের ব্যয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত