Ajker Patrika

শারীরিক-মানসিক চাপে বাড়ছে ব্রণ ও একজিমা, জেনে নিন করণীয়

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২১: ৩০
স্ট্রেস বা শারীরিক—মানসিক চাপ যখন বেড়ে যায়, তখন এর প্রভাব ত্বকেও পড়ে। ছবি: আজকের পত্রিকা
স্ট্রেস বা শারীরিক—মানসিক চাপ যখন বেড়ে যায়, তখন এর প্রভাব ত্বকেও পড়ে। ছবি: আজকের পত্রিকা

অফিসের ইনক্রিমেন্ট হচ্ছে না, বাড়ছে বাড়িভাড়া, সন্তানের স্কুল খরচ। প্রতি রাতে দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে দেরি হয়ে যায় বেসরকারি চাকরিজীবী শারমিন আহমেদের। সকালে সারা দিনের রান্না শেষে স্বামী-সন্তানসহ তৈরি হয়ে বের হওয়ার এক কর্মযজ্ঞ চলে। ঠিকমতো আয়নায় নিজেকে দেখার সুযোগ মেলে না। কাজের স্ট্রেস নিয়েই যখন অফিসের রেস্ট রুমে গেলেন, তখন আয়নায় তাকিয়ে গালে, কপালে ব্রণের উঁকি দেওয়া চোখে পড়ল। আর চোখের নিচের কালি তো পুরোনো সঙ্গী।

স্ট্রেস বা শারীরিক-মানসিক চাপ যখন বেড়ে যায়, তখন এর প্রভাব ত্বকেও পড়ে। ব্রণের উপদ্রব বেড়ে যায়। আবার অনেক সময় একজিমার মতো চর্মরোগেরও আবির্ভাব হয়। সহজভাবে বললে, আপনি যা অনুভব করেন, তা প্রায়ই আপনার ত্বকে প্রকাশ পায়। বলা যায়, আমাদের ত্বক আমাদের অনুভূতির প্রতিফলন ঘটায়।

মানসিক চাপের প্রভাব

ত্বকে ব্রণ বা চর্মরোগ দেখা দিলে সেটি লুকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। আর এগুলো থেকে মানসিক অস্বস্তি, লজ্জা এবং শেষ পর্যন্ত সামাজিক জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয় অনেকে। মেগান ক্লার্কের মতো অনেকে লজ্জিত বা বিব্রত বোধ করেন, ফলে ধীরে ধীরে সামাজিক অনুষ্ঠান বা মানুষের সঙ্গে মেলামেশা এড়িয়ে চলেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্কিন কেয়ার ব্র্যান্ড মিস প্যালেটেবলের স্বত্বাধিকারী মুক্তা তেওয়ানি বলছিলেন, ‘স্ট্রেস আর উদ্বেগ ত্বকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে যদি কারও একজিমা, সোরায়াসিস বা সংবেদনশীল ত্বক থাকে। আমার ত্বক খুব সেনসিটিভ। আমার হাতে কেরাটোসিস পিলারিস (ত্বকে শুকনো, খসখসে দাগ আর ছোট ছোট ফুসকুড়ি) হয়। অনেক সময় যখন আমি মানসিক চাপে থাকি, তখন দেখি আমার কেরাটোসিস বেড়ে যায়।’

একজিমা বা ব্রণের মতো সমস্যাগুলোতে শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি মানসিক অবস্থাও এমন অবস্থানে দাঁড়ায়, যেখানে মানুষ নিজেকে সমাজ থেকে সরিয়ে নেয়। আর যদি এই পরিস্থিতি চলতেই থাকে, তবে তাতে আত্মসম্মানবোধ কমে যাওয়া, হতাশা বা নিজের প্রতি বিকৃত ধারণা তৈরি হওয়ার মতো সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

মার্কিন অধ্যাপক মোহাম্মদ জাফারনি তাঁর বই হ্যান্ডবুক অব সাইকোডার্মাটোলজিতে দেখিয়েছেন, কীভাবে মানসিক চাপ আমাদের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে। ফলে ত্বকের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে যায়। এই দুর্বলতা নতুন জীবাণুর অনুপ্রবেশ এবং আগে থেকে শরীরে থাকা নিষ্ক্রিয় জীবাণুগুলোর আবার সক্রিয় হয়ে ওঠার পথ তৈরি করে।

তিনি লেখেন, কয়েক দশক ধরে মানসিক চাপ ও ত্বকের রোগের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা হয়েছে। ত্বক আমাদের শরীরের ভেতরের ও বাইরের চাপের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে। অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে যখন এসব সিস্টেমের মধ্যে যোগাযোগ ও ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় বা ভেঙে পড়ে, তখনই নানা ধরনের রোগ দেখা দিতে শুরু করে।

স্ট্রেস বা শারীরিক—মানসিক চাপ যখন বেড়ে যায়, তখন এর প্রভাব ত্বকেও পড়ে। ছবি: আজকের পত্রিকা
স্ট্রেস বা শারীরিক—মানসিক চাপ যখন বেড়ে যায়, তখন এর প্রভাব ত্বকেও পড়ে। ছবি: আজকের পত্রিকা

ত্বকের সমস্যাগুলো হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ

দুবাইয়ের এক বিক্রয়কর্মী মেগান ক্লার্ক তাঁর এই সমস্যার কথা বলতে গিয়ে জানান, চাপ আসলেই তাঁর শরীরে চুলকানি শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘এটা ভীষণ অস্বস্তিকর অনুভূতি। হয়তো সামনে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশন কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে কোনো সমস্যা, আর তখনই হাত-পা চুলকাতে শুরু করে। কখনো কখনো একজিমাও বেড়ে যায় আর তখন আঙুলের চামড়া উঠতে থাকে। কখনো কখনো মলম আর ব্যান্ড-এইড নিয়েই আমার দিন কাটে।’

দুবাইয়ের মনোবিজ্ঞানী মায়া গেরা বলেন, দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের রোগগুলো শরীরে এমন একধরনের চাপ সৃষ্টি করে, যা অটোইমিউন (স্ব-রোগপ্রতিরোধী) ও অ্যালার্জি-সংক্রান্ত রোগগুলোর জন্য ট্রিগার বা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করতে পারে।

যখন আপনি উদ্বিগ্ন বা মানসিক চাপে থাকেন, তখন শরীর কর্টিসোল নামক একটি স্ট্রেস হরমোন বেশি পরিমাণে তৈরি করে। কর্টিসোল মস্তিষ্কের এক বিশেষ অংশ হাইপোথ্যালামাসকে উদ্দীপ্ত করে, যা আবার কর্টিকোট্রফিন-রিলিজিং হরমোন (সিআরএইচ) তৈরি করে। এই হরমোন চুলের গোড়ার চারপাশে থাকা সেবেসিয়াস গ্রন্থি থেকে তেল নিঃসরণ বাড়িয়ে তোলে। অতিরিক্ত তেল ত্বকের ছিদ্র বা পোর বন্ধ করে দেয়, ফলে ব্রণ দেখা দেয়।

স্ট্রেস বা শারীরিক—মানসিক চাপ যখন বেড়ে যায়, তখন এর প্রভাব ত্বকেও পড়ে। ছবি: আজকের পত্রিকা
স্ট্রেস বা শারীরিক—মানসিক চাপ যখন বেড়ে যায়, তখন এর প্রভাব ত্বকেও পড়ে। ছবি: আজকের পত্রিকা

দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ শরীরে কর্টিসোলের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে তোলে, যা শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল করে দেয়। দীর্ঘদিন এই ধরনের মানসিক অবসাদে ত্বকের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। কর্টিসোল শ্বেতরক্তকণিকার কার্যক্ষমতাও কমিয়ে দেয়, ফলে শরীর আরও সহজে সংক্রমণ বা ভাইরাসের আক্রমণে আক্রান্ত হতে পারে।

এ ছাড়া স্ট্রেসের কারণে অ্যালোপেশিয়ার (চুল পড়ে যাওয়া) মতো অটোইমিউন রোগও শুরু হতে পারে।

ত্বক রক্ষা করবেন কীভাবে

এ ক্ষেত্রে ত্বকের চিকিৎসার আগে মনের যত্ন নিতে হবে। যাঁরা তীব্র উদ্বেগ বা বিষণ্নতায় ভোগেন, তাঁদের জন্য পেশাদার মানসিক সহায়তা নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনোবিজ্ঞানী মায়া গেরা বলেন, আমরা ধীরে ধীরে আমাদের খাদ্যাভ্যাসের দিকেও মনোযোগ দিতে পারি। কারণ, স্ট্রেস থাকলে অনেক সময় আমরা ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করি না।

তিনি আরও বলেন, জাঙ্ক ফুড তখন সহজে গ্রহণযোগ্য খাবার মনে হলেও এটি ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। জাঙ্ক ফুডে গ্লাইসেমিক লোড (রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ানোর ক্ষমতা) অনেক বেশি থাকে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এতে শরীরে প্রদাহ বেড়ে যায় এবং কিছু নির্দিষ্ট রোগ হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়। সুতরাং ত্বকের সমস্যা কমাতে শুধু মলম বা স্কিন কেয়ার নয়; মানসিক স্বাস্থ্য ও খাদ্যাভ্যাস ঠিক রাখাও সমানভাবে প্রয়োজন।

মায়া গেরা বলেন, যখন আপনি মানসিক সুস্থতার দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করবেন, তখন ধীরে ধীরে আপনার দৈনন্দিন জীবনে মেডিটেশন (ধ্যান) ও রিল্যাক্সেশনের (অবকাশ যাপন) মতো অভ্যাসগুলো যোগ করতে পারেন। আর যদি আপনি নিজেই বুঝতে না পারেন, কোথা থেকে শুরু করবেন বা কীভাবে নিজের রুটিন তৈরি করবেন, তাহলে ডার্মাটোলজিস্ট বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

ত্বক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার সহজ কিছু কৌশল

মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণে আনুন

১. রিল্যাক্সেশন অভ্যাস গড়ে তুলুন: নিয়মিত গভীর শ্বাস নেওয়া, ধ্যান, যোগব্যায়াম (ইয়োগা) বা মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন করুন। এসব অভ্যাস কর্টিসোল হরমোনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। কর্টিসোল হরমোন কম বা নিয়ন্ত্রণে থাকলে স্ট্রেস এবং একজিমা বা ব্রণের মতো ত্বকের সমস্যাগুলো কমে যাবে।

২. নিয়মিত ব্যায়াম করুন: ব্যায়াম শুধু স্ট্রেস কমায় না, ত্বকের রক্তসঞ্চালনও বাড়ায়। যার প্রভাবে ত্বক উজ্জ্বল ও স্বাস্থ্যকর দেখায়।

৩. পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন: ঘুমের ঘাটতি ও স্ট্রেসের প্রভাবে ত্বকের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। প্রতিদিন রাতে ৭-৯ ঘণ্টা ভালোমতো ঘুমানোর চেষ্টা করুন।

ত্বকের যত্ন করতে রুটিন তৈরি করুন

১. ত্বককে হাইড্রেট রাখুন: স্ট্রেসের কারণে শরীর ও ত্বক খুব দ্রুত শুষ্ক বা পানিশূন্য (ডিহাইড্রেটেড) হয়ে পড়ে, ফলে ত্বক নিস্তেজ বা খসখসে লাগে। সারা দিনে পর্যাপ্ত পানি পান করুন। পাশাপাশি ত্বকের উপযোগী একটি ভালো ময়শ্চারাইজার ব্যবহার করুন।

২. কঠিন উপাদানযুক্ত প্রোডাক্ট এড়িয়ে চলুন: স্ট্রেসের সময় ত্বক আরও সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। তাই এমন সময় মাইল্ড প্রোডাক্ট ব্যবহার করুন; যেগুলো ত্বকে জ্বালা সৃষ্টি করে না। বিশেষ করে অ্যালোভেরা বা ক্যামোমাইলের মতো উপকারী উপাদানযুক্ত পণ্য ব্যবহার করতে পারেন।

৩. স্ট্রেসজনিত ত্বকের সমস্যা বুঝে পণ্য নিন: যদি আপনার ব্রণ বা ত্বকে লালচে ভাব হওয়ার প্রবণতা থাকে, তবে স্যালিসাইলিক অ্যাসিড বা নিয়াসিনামাইড-যুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো ত্বকের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।

খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনুন

১. স্ট্রেস কমায় এমন খাবার খান: অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর খাবার; যেমন বেরি, শাকসবজি, বাদাম খেতে পারেন। এগুলো স্ট্রেসের কারণে ত্বকের ক্ষতির বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা স্যামন বা তেলযুক্ত মাছে পাওয়া যায়—প্রদাহ কমাতে এবং ত্বককে সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর রাখতে সাহায্য করে।

২. স্ট্রেস বা ত্বকের প্রদাহ বাড়াতে পারে এমন খাবার শনাক্ত করুন: অনেকের ক্ষেত্রে ক্যাফেইন, চিনি বা দুগ্ধজাত খাবার ত্বকের সমস্যাকে বাড়িয়ে দেয়। কোন খাবার আপনার ত্বকের জন্য খারাপ প্রভাব ফেলছে, তা শনাক্ত করে সেগুলো খাওয়া কমিয়ে দিন।

৩. ত্বকে হাত দেওয়া এড়িয়ে চলুন: মানসিক চাপের সময় অনেকে মুখে বা ত্বকে হওয়া ব্রণ কিংবা চুলকানির স্থানে ঘষতে থাকেন। অনেকে ব্রণ নখ দিয়ে খোঁটেন। যে কারণে যা দাগ, ক্ষত এমনকি ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়তে পারে। যতটা সম্ভব মুখে হাত না দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

সূত্র: গালফ নিউজ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত