Ajker Patrika

ডিমে কুসুম জিবে জল

রজত কান্তি রায়, ঢাকা
ডিমে কুসুম জিবে জল

এই স্বাস্থ্যসচেতনতার যুগে চিকিৎসকেরা বলে থাকেন, রিলিজিয়াসলি প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়াবেন আপনার শিশুকে। তাতে শিশুর ত্বক ভালো থাকবে, চুল ভালো থাকবে, বৃদ্ধি ভালো হবে ইত্যাদি। ডান্ডা হাতেই হোক আর কার্টুন সামনে রেখেই হোক, বাবা-মা প্রতিদিন খাবার টেবিলে যুদ্ধ করেন শিশুদের সঙ্গে। উদ্দেশ্য একটাই, রিলিজিয়াসলি একটা ডিম খাওয়ানো। যাতে শিশুর স্বাস্থ্য ভালো থাকে।

যাঁরা এখন শিশুর বাবা-মা, তাঁদের ছেলেবেলায় এ দৃশ্য ছিল অভাবনীয়। একটি ডিম একা! আশ্চর্য আর প্রশ্নবোধক দুটি অভিব্যক্তি একই সঙ্গে খেলে যেত তাঁদের মুখের ওপর। তারও একটু আগে এখনকার মা-বাবার মা-বাবারাও কিছুটা একই রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন, সেটা বলা যায়। তখন একটা ডিম একা পাতে পাওয়া মানে ছিল সাত রাজার ধন হাতে পাওয়া। ১০ জনের পরিবারে দেড় হালি ডিমের গল্প ছিল ঘরে ঘরে। সেদ্ধ ডিমে লবণ আর হলুদ মাখিয়ে তেলে ভেজে আলুর ঝোলে ছেড়ে দেওয়া হতো। পাতি ইঞ্চি দারুচিনির ঘ্রাণ যখন নাকে ছোবল মেরে জেরবার করে তুলতে তুলতে রান্না হয়ে আসত, তখন হলুদ হয়ে যাওয়া সাদাটে ডিম দুই ভাগ হতে দেখা ছিল কষ্টের আর এক নাম। ভালোবাসারও বোধ হয়। কেননা, সেই থেকে মাথায় রোখ চেপে বসত, একদিন একটা ডিম পুরোটাই খাব, দেখিস। অথচ একটা বয়সের পর কারও আর তেমন ডিম খেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু খেয়াল করে দেখেছেন কি, ডিম ভাজার ঘ্রাণ নাকে লাগলে মাথাটা কেমন বিগড়ে যায়। মনে হয়, পৃথিবীর সব স্বাদ ওই ঘ্রাণের মধ্যেই ডুবে আছে।

মুরগি বা হাঁসের নয়, ডিম আসলে মানুষের জীবনেরই অংশ। সকালে, দুপুরে, রাতে, বিকেলে—কখন ডিম খাওয়া হয় না? ছাত্র আর ব্যাচেলরদের জীবনে ডিমের চেয়ে বড় বন্ধু আর দুটি নেই। সকালে হোস্টেলের সামনে কোনো এক মামার দোকানে ঢুকলেই প্লেটভর্তি হয়ে আসে ডিম-রুটি বা ডিম-পরোটা। দুপুরে মাইক্রোস্কোপিক মাছ বা মাংসের পিস খেয়ে মন না ভরলে একটা ডিম ভাজা তো খাওয়াই যায়। রাতে আবশ্যকীয় ডিম-পরোটা বা ডিম-রুটি। আর একটা বিখ্যাত খাবার ছিল, সম্ভবত এখনো আছে ডিম-বান। বান-রুটি বা পাউরুটিতে ফেটানো ডিম মেখে তেলে ভেজে খাওয়া। কখনো ডিমের সঙ্গে কাঁচা মরিচ বা ধনেপাতার কুচি থাকতে পারে আবার না-ও পারে। সেটা নির্ভর করবে দোকানদারের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন, তার ওপর।

ডিম আসলে মানুষের ওপর সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ—এতে হাঁস, মুরগি, কোয়েল প্রভৃতি মনঃক্ষুণ্ণ হলেও বিষয়টি সত্যি। এ জন্য পুরো মানবজাতির উচিত, আমাদের ডিম খাওয়ানো প্রাণীদের ধন্যবাদ জানানোর জন্য একটি দিন বরাদ্দ দেওয়া। সঙ্গে সেদিন পৃথিবীকে ডিমমুক্ত ঘোষণা দেওয়া যেতে পারে। সুকুমার রায় কেন এমন একটি ঘোষণা দিয়ে যাননি, সেটা ভেবে আমার খানিক খটকাই লাগে।

যাহোক, হাতি-ঘোড়া মারা বাঙালি মামলেট না অমলেট, সে নিয়ে বিতর্ক করবে—তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ জাতি এখনো তার মীমাংসা করতে পারেনি আরও অনেক কিছুর মতোই। অমলেটের উৎস ফ্রান্সে বলে শোনা যায়। তবে মামলেট যে বাঙালির মস্তিষ্কপ্রসূত এক জটিল বিষয়, সেটা বলাই বাহুল্য। খাইনি তবে সিনেমায় দেখেছি এবং যাঁরা খেয়েছেন তাঁদের কাছে গল্প শুনেছি, ফরাসিদের হাজারো রেসিপি আছে অমলেট বানানোর। আর মামলেট বানানোর কতগুলো রেসিপি বাঙালির আছে তার হিসাব কেউ রাখেই না।

আগুনের হালকা নীলচে শিখায় পুরু লোহার কড়াই উত্তপ্ত হলে তাতে মাখন ফেলে আলগোছে ডিম ভেঙে দিতে হয়। তারপর আরও আলগোছে উল্টে দিয়ে সোনালি করে ভেজে তুলে নেওয়া হয়। কোথাও পড়েছিলাম, এককালে ফরাসি মেয়েদের বিয়ে হওয়ার অন্যতম মূলমন্ত্র ছিল, না পুড়িয়ে সোনালি করে অমলেট তৈরি করতে পারার রপ্ত করা বিদ্যা। এমনও শোনা যায়, ফরাসি নারীরা ডিমের ওপর সোনালি রঙের বিভিন্ন শেড তৈরি করতে পারতেন। এই যে হালকা হাতে সোনালি রঙের ডিম ভাজা, সেটাই আসলে অমলেট। এর যে বাঙালি সংস্করণ, অর্থাৎ পরিমাণমতো লবণ আর কাঁচা মরিচের কুচি দিয়ে ডিম ভালো করে ফেটিয়ে নিয়ে গরম তাওয়ায় তেল গরম করে ফেটানো ডিম ঢেলে দিয়ে ছড়িয়ে নিলে যা একটা তৈরি হয়, তা-ই মামলেট। এতে মাখনের কারবার নেই। আছে তেলের ছোঁয়া। গরিব বঙ্গবাসী তো, মাখনের কী বুঝবে?

এবার আসা যাক বাঙালির অনন্য উদ্ভাবন ডিম ভাজার কথায়। ডিম ভাজার প্রণালি মামলেটের মতোই। কিন্তু উপকরণে তার ভিন্নতা আছে। ডিম ভেঙে নিয়ে তাতে পরিমাণমতো লবণ, হালকা জিরাগুঁড়ো, কাঁচা মরিচের কুচি, হালকা হলুদ চালে ধনেপাতার কুচি দিয়ে উত্তমরূপে ফেটিয়ে নিয়ে মামলেটের মতো করে ভাজুন। তাহলেই ডিম ভাজা হয়ে যাবে। এই ডিম ভাজা প্রতিদিনের খাবার ছিল না কখনোই। ছিল বিশেষ দিনের সম্মানজনক খাবার। বিশেষত নতুন জামাই এলে ডিম ভাজা হতো। নইলে মামলেট।

ফরাসিরা যেমন মাখন দিয়ে হালকা তাপে অমলেট ভেজে খেত বা খায়, এই খোদ ঢাকা শহরে যে তেমন খাওয়া হতো না, তা নয় কিন্তু। তেমন করে অন্যান্য জায়গায়ও খাওয়া হতো। তারিয়ে তারিয়ে রান্না করে রসিয়ে রসিয়ে খাওয়াটা আসলে অভিজাত বিষয়। মধ্যবিত্তের এত সময় কোথায়? তেমন ডিম ভাজায় মাখনের বদলে ব্যবহার করা হতো গব্য ঘৃত, মানে গরুর দুধ থেকে প্রস্তুতকৃত খাঁটি ঘি। রইস ঢাকার খাবার নিয়ে বলতে গিয়ে সৈয়দ আফজাল হোসেন তাঁর পরিবারের এক সদস্যের ডিমের অমলেট খাওয়ার গল্প বলেছিলেন। সে প্রক্রিয়াটি আপনাদের জানিয়ে দিই।

রান্না শেষ হলে উনুনে থেকে যাওয়া কাঠকয়লার আগুনের ওপর পাতলা টিনের শিট দিয়ে দেওয়া হতো। তার ওপর বসানো হতো একটি ধাতব বাটি। খুব ধীরে দীর্ঘ সময় নিয়ে বাটিটি গরম হলে তার ওপর দেওয়া হতো ঘি। ঘি গরম হলে তাতে ভেঙে দেওয়া হতো ডিম। খুব ধীরে সে ডিম ভাজা হতে থাকত। একে ভাজা না বলে অন্য কিছু বলাই ভালো অবশ্য। এই শহুরে জীবনে অনেক আগেই কাঠকয়লা বিদায় নিয়েছে। তাই বলে খাবেন না এই অসাধারণ ডিম? এক কাজ করুন, গ্যাসের চুলার আগুন একেবারে কমিয়ে দিন। তার ওপর রুটি সেঁকার তাওয়া বসিয়ে দিন। তার ওপর বসান একটি কাঁসার বাটি। গরম হলে বাটিতে দিয়ে দিন ঘি। তারপর ডিম। এবার খেয়ে দেখুন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত