Ajker Patrika

গাজা যুদ্ধবিরতি

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, নাকি অনন্ত নাকবার পথ

আব্দুর রহমান 
আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ৪৪
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, নাকি অনন্ত নাকবার পথ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নির্দেশনা ধরে গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। নানা অস্পষ্টতা থাকার পরও চুক্তি এখনো টিকে আছে। কিন্তু গত মঙ্গলবার হামাস ইসরায়েলি জিম্মিদের মরদেহ ফিরিয়ে দিতে দেরি করছে, এই অজুহাতে তেল আবিব গাজায় ত্রাণ প্রবেশের হার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। আর এখানেই মূলত পরীক্ষার মুখে পড়ে গেছে যুদ্ধবিরতি চুক্তির ভবিষ্যৎ।

পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অবস্থান এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনিদের বসতি উচ্ছেদ ও ভাঙচুরের গতি আরও বেড়ে যাওয়ায় আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে গাজা এবং পশ্চিম তীরে ট্রাম্প-সমর্থিত এই চুক্তি শান্তি ফেরাতে পারবে, নাকি আবারও ফিলিস্তিনিরা এক অন্তত নাকবা তথা মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে? কারণ, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের চালানো গণ-উচ্ছেদ ও জাতিগত নিধনের করুণ ইতিহাসকে বলা হয় নাকবা তথা মহাবিপর্যয়। একই সঙ্গে এই প্রশ্নও উঠেছে যে ট্রাম্প-সমর্থিত এই চুক্তি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আসলে কতটুকু সহায়ক হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত চুক্তিতে অনেকগুলো অস্পষ্ট বিষয় রয়েছে। বিশেষ করে ইসরায়েলের মূল চাওয়া অনুসারে—হামাসকে কীভাবে নিরস্ত্রীকৃত করা হবে? আদৌ হামাস এই অবস্থান মানবে কি না? যদিও দলটির শীর্ষ নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাঁরা ‘আক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় ভারী অস্ত্র’ পরিত্যাগে প্রস্তুত এবং কেবল নিজেদের ‘আত্মরক্ষা’র জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র রেখে দেবেন। তবে এটি ইসরায়েল মানবে কি না, তা নিয়ে এখনো সন্দেহ রয়ে গেছে।

এ ছাড়া গত মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েল গাজায় ত্রাণ প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। দেশটি বলেছে, গাজায় প্রবেশের অনুমতি পাওয়া ত্রাণবাহী ট্রাকের সংখ্যা দিনে ৬০০ থেকে কমিয়ে ৩০০ করা হবে। পাশাপাশি মিসর সীমান্তের রাফাহ ক্রসিংও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় করা যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন। এই অবস্থায় যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ গুরুতর ঝুঁকির মুখে।

মূলত চুক্তিতে অনেক কিছু অস্পষ্ট থাকার কারণেই এমনটা ঘটার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের মতে, ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার শক্তিটাই আবার তার দুর্বলতা। এই চুক্তির মূল দলিলটিতে অনেক বিষয়ই অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। উভয় পক্ষই বিস্তারিত শর্তে একমত হয়নি। এই অস্পষ্টতাই হয়তো দুই পক্ষকে সই করাতে সাহায্য করেছে, কিন্তু এর অর্থ হলো—সবচেয়ে কঠিন কূটনৈতিক কাজ এখনো বাকি।

এই সাফল্য টেকসই শান্তির পথে কত দূর এগোবে, তা নির্ভর করবে ট্রাম্প কতটা চাপ বজায় রাখতে পারবেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর।

ইসরায়েল ও হামাস এখনো ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা পরিকল্পনার অনেক বিষয়ে একমত হতে পারেনি। আগামী বছর ইসরায়েলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই নেতানিয়াহু তাঁর ডানপন্থী জোট টিকিয়ে রাখতে গেলে নীতি বদলাতেও পারেন। নেতানিয়াহুর জোটের প্রভাবশালী দুই সহযোগী—ইতামার বেন-গভির ও বেজালেল স্মতরিচ—হামাসের সঙ্গে করা যুদ্ধবিরতি চুক্তির সমালোচনা করেছেন। জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী বেন-গভির তো সরকার ছাড়ার হুমকিও দিয়েছেন।

ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিক জন অলটারম্যান বলেন, ‘এটা এমন এক চুক্তি, যেটি সহজেই ভেস্তে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন অস্পষ্ট চুক্তি বিরল—যেখানে এত কিছু পরবর্তী সময়ে ঠিক করতে হবে।’

ইসরায়েলি পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক থিংক ট্যাংক ‘মিতভিম’-এর প্রেসিডেন্ট নিমরোদ গোরেন বলেন, ‘আমরা এখন এমন এক রাজনৈতিক বছরে ঢুকছি, যেখানে সবকিছুই নির্বাচনী প্রচারণার সঙ্গে সম্পর্কিত। নেতানিয়াহুর হিসাব এখন পাল্টে যেতে পারে—চাপের কাছে নতি স্বীকার করার বদলে তিনি হয়তো রাজনৈতিকভাবে টিকে থাকার চেষ্টা করবেন।’

এরই মধ্যে ইসরায়েলের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী ‘রিলিজিয়াস জায়োনিজম’ পার্টির এমপি সিমচা রথম্যান হুমকি দিয়েছেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে হামাস এখনো প্রকাশ্যে বলছে, তারা গাজার ক্ষমতায় থাকবে। আমরা এমন কোনো চুক্তি মেনে নেব না, যা হামাসের পূর্ণ আত্মসমর্পণ নয়। আংশিক বিজয় আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’ আর এমনটা ঘটলে নেতানিয়াহু অতীতের মতো আবারও তাঁর জোটসঙ্গী কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদী নেতাদের কথা শুনে গাজায় পুনরায় যুদ্ধ শুরুর পথে হাঁটতে পারেন।

তবে নেতানিয়াহুকে বাগে রাখার মতো অস্ত্র ট্রাম্পের হাতে আছে। বিভিন্ন জরিপ বলছে, ইসরায়েলে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর চেয়েও অনেক বেশি জনপ্রিয়। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক জন অলটারম্যান বলেন, এখন ট্রাম্পের হাতে বড় সুবিধা রয়েছে—কারণ ইসরায়েলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা নেতানিয়াহুর চেয়েও বেশি।

তিনি বলেন, ট্রাম্প চাইলে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে সমর্থনও দিতে পারেন, আবার চাইলে ধ্বংসও করতে পারেন। ফলে ট্রাম্প নিজে যদি আগ্রহী হন তাহলে হয়তো চুক্তি টিকে যেতে পারে।

তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি ঊহ্য থেকে যায়, তা হলো—ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি। ট্রাম্প প্রস্তাবিত চুক্তিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা আছে। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট রূপরেখা নেই। ফলে হামাস যদি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো রূপরেখা না পেয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং অস্ত্র হাতে তুলে নেয়, তাহলে হয়তো এখন যেসব আরব দেশ হামাসকে অস্ত্র ছাড়ার বিষয়ে চাপ দিচ্ছে, তারা সেটি প্রত্যাহার করে নিতে পারে। কারণ, সৌদি আরবসহ অধিকাংশ দেশই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলোও সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। এ কারণে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া কেবলই পরিস্থিতি জটিল করবে।

এদিকে সবাই যখন গাজা শান্তিচুক্তি নিয়ে ব্যস্ত, তখন ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী কিছুদিন আগে পশ্চিম তীরের মাসাফের ইয়াত্তার ছোট্ট একটি এলাকাকে পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এটি চলতি বছর ইসরায়েলি বাহিনীর পরিচালিত চারটি বৃহৎ ধ্বংস অভিযানের একটি। স্থানীয়দের কাছে এই ধ্বংসযজ্ঞ কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। তাদের চোখে এ এক ‘নতুন নাকবা।’

ইয়াত্তার পাশের গ্রামের প্রধান মোহাম্মদ রাবিয়া বলেন, ইসরায়েলিরা যখন কোনো গ্রামে অভিযান চালায় তখন তারা পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, পানির লাইন, যোগাযোগব্যবস্থাসহ সব ধ্বংস করে দেয়। এই প্রক্রিয়া যুগের পর যুগ ধরে চলছে। ফিলিস্তিনিরা বারবার তাদের বিধ্বস্ত বাড়িঘর ঠিক করে আর ইসরায়েলিরা এসে তা ভেঙে দিয়ে যায়। রাবিয়া আরও বলেন, এ যেন এক ‘অনন্ত নাকবা’।

যখন ইসরায়েলি আগ্রাসন গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, পশ্চিম তীরে অনন্তকাল ধরে দখলদারত্ব চালাচ্ছে, তখন এই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক যে—আদৌ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে, নাকি আবার অন্যান্য শান্তিচুক্তির মতো এটাও ভেস্তে যাবে? আর ভেস্তে গেলে সেটা যে ফিলিস্তিনে চলা ‘অনন্ত নাকবা’কেই দীর্ঘায়িত করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত