Ajker Patrika

চীনকে ঠেকাতে তিব্বতিদের শিক্ষা ঢেলে সাজাচ্ছে ভারত

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৮: ৩৮
ভারতে প্রায় ৬০০ মঠ রয়েছে। ছবি: ট্রিভোডটকম
ভারতে প্রায় ৬০০ মঠ রয়েছে। ছবি: ট্রিভোডটকম

ভারত-চীনের সঙ্গে বহু পুরোনো বৈরী সম্পর্ক। সীমান্ত-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন দেশ নিয়ে এই প্রতিবেশীদ্বয়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর অংশ হিসেবে চীন সীমান্তের কাছে হিমালয়ের ধর্মীয় কেন্দ্রগুলোর শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে ভারত। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ভারত এই মাসে বৌদ্ধ মঠগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম একীভূত করা এবং ‘দেশপ্রেম জাগ্রত করার’ উদ্যোগ হাতে নিয়েছে।

বৌদ্ধধর্মের জন্মস্থান হিসেবে অনেক প্রাচীন মঠের আবাসস্থল ভারত। ১৯৫০-এর দশকে তিব্বতিদের আগমনে এখানে অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, কিন্তু এখন ভারত ধর্মীয় শিক্ষাকে ‘চীনের প্রভাবমুক্ত’ করার চেষ্টা করছে।

সিকিম, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৬০০ মঠ চার ধরনের তিব্বতি এবং ভারতীয় বৌদ্ধ ঐতিহ্যের প্রশিক্ষণ দেয়। এই মঠগুলোতে আধুনিক বিষয় ও ইংরেজিও শেখানো হয়। তবে যে পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হয়, তা সামগ্রিক ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ভারতে ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতিনির্বিশেষে জাতীয় পরিচয় গড়ে তুলতে যে শিক্ষা কার্যক্রম অনুসরণ করা হচ্ছে, তার সঙ্গে এর মিল পাওয়া যায় না।

ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বৌদ্ধ কর্মী মালিং গোম্বু বলেন, ‘আমরা বৌদ্ধধর্মের শিক্ষার পাশাপাশি ভারতীয় পরিচয়ে শিক্ষিত করার চেষ্টা করছি, যাতে চীন হিমালয়ের মঠগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।’

অরুণাচল প্রদেশে ভারতীয় বৌদ্ধ ঐতিহ্য ও জাতীয় শিক্ষার প্রচারকারী দলের অন্যতম সদস্য গোম্বু আরও বলেন, ‘পৃথক ও বিচ্ছিন্ন এই মঠগুলোতে বসবাসকারী এবং অধ্যয়নরত হাজার হাজার শিশুর ভারত কর্তৃক স্বীকৃত এবং সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত শিক্ষা পাওয়া প্রয়োজন।’

চীন এই সীমান্ত রাজ্য নিজেদের দাবি করে, যদিও নয়াদিল্লি এই দাবি অস্বীকার করে এসেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওপেন স্কুলিংয়ের পরিচালক রাজীব কুমার সিং বলেন, মঠগুলোতে সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীরা যে ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে যা শিক্ষা দিচ্ছেন, সেগুলো বাইরে স্বীকৃত শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

মঠের নতুন পাঠ্যক্রম নিয়ে কাজ করা রাজীব কুমার সিং বলেন, ‘ভারতীয় ও তিব্বতি পড়ুয়াদের ভারতীয় শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করা হবে। তারা (তিব্বতিরা) তিব্বতের ইতিহাস ও ঐতিহ্য শিখছে, তবে যেহেতু তারা এখানে বসবাস করছে, তাদের ভারত সম্পর্কেও জানা উচিত এবং ভবিষ্যতে মঠের বাইরে কর্মক্ষেত্রে নিজ জায়গা করে নেওয়ার জন্য যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ প্রয়োজন।’

মঠগুলোতে ভারতীয় ও তিব্বতিরা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা নিয়ে থাকে। ছবি: ট্রিভোডটকম
মঠগুলোতে ভারতীয় ও তিব্বতিরা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা নিয়ে থাকে। ছবি: ট্রিভোডটকম

একটি সরকারি নথির বরাতে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন সীমান্তের ৩ হাজার কিলোমিটার এলাকার মধ্যে অবস্থিত ২০টি মঠ এই নতুন পাঠ্যক্রম গ্রহণে রাজি হয়েছে এবং বাকিগুলো চলতি বছরের শেষের দিকে পর্যায়ক্রমে চলে আসবে।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই পাঠক্রম তৈরির জন্য মঠগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করলেও নতুন পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ এবং মঠগুলোতে নতুন শিক্ষক নিয়োগে বেশ সময় লাগবে। কারণ, বেশির ভাগ স্কুল জনবিরল এলাকায় অবস্থিত। তবে অরুণাচল প্রদেশের গনৎসে গার্ডেন রবগি লিং মঠের মতো কিছু মঠের সন্ন্যাসীদের দাবি, তাঁদের পাঠ্যক্রম আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি বৌদ্ধ দর্শনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যত্নসহকারে তৈরি করা হয়েছে, যাতে তাঁরা ধর্মপ্রচারক হতে পারেন।

মঠের ধর্মীয় শিক্ষক গেশে ডনডুপ বলেন, ‘আমাদের মঠে সরকার কর্তৃক নির্দেশিত পাঠ্য নির্দেশিকা প্রয়োজন বলে মনে করি না। কারণ, এটি ১৯৭০-এর দশক থেকে তৈরি প্রথাকে ভেঙে দিতে পারে।’

মঠগুলোতে ভারতীয় ও তিব্বতিরা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা নিয়ে থাকে। ছবি: ট্রিভোডটকম
মঠগুলোতে ভারতীয় ও তিব্বতিরা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা নিয়ে থাকে। ছবি: ট্রিভোডটকম

১৯৫৯ সালে চীনা সৈন্যদের হাতে দমনের পর আধ্যাত্মিক নেতা এবং শান্তিতে নোবেলজয়ী দালাই লামাসহ হাজার হাজার তিব্বতি ভারতে পালিয়ে আসেন। বর্তমানে দালাই লামার নির্বাসিত সরকার কেন্দ্রীয় তিব্বত প্রশাসন (সিটিএ) দ্বারা পরিচালিত বসতিতে প্রায় ৭৫ হাজার তিব্বতি বাস করে। সিটিএ কিছু মঠকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে, তবে তিব্বতি ঐতিহ্যের বাইরে থাকা মঠগুলোকে নয়।

মঠগুলোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এবং ভারতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা মিলে যে নতুন পাঠ্যবই তৈরি করেছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে রয়টার্স জানায়, বইগুলোতে ভারতের আধুনিক ও প্রাচীন ইতিহাস এবং তিব্বতের স্বাধীনতাসংগ্রামে তাদের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। বইগুলোতে ইংরেজি, হিন্দি ও স্থানীয় ভোটি ভাষায় বাধ্যতামূলক অধ্যয়নের পাশাপাশি গণিত, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে।

সিটিএর শিক্ষামন্ত্রী থারলাম দোলমা বলেন, ঐতিহাসিকভাবে মঠের স্কুলগুলো তাদের অর্থায়নের ভিত্তিতে সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীদের দ্বারা পরিচালিত হয়।

তবে দালাই লামার কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মঠগুলোতে ভারতীয় ও তিব্বতিরা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা নিয়ে থাকে। ছবি: ট্রিভোডটকম
মঠগুলোতে ভারতীয় ও তিব্বতিরা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা নিয়ে থাকে। ছবি: ট্রিভোডটকম

বৈদেশিক অর্থায়নে এবং বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায় দ্বারা কয়েক দশক ধরে পরিচালিত এই মঠগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ, সন্ন্যাসীদের বৃত্তি প্রদান এবং বার্ষিক পরীক্ষার পথ প্রশস্ত করার জন্য শিগগির তহবিল প্রদান শুরু করবে ভারত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সীমান্তবর্তী কৌশলগত এলাকাগুলোর মঠগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম চীনের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করার বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে রয়টার্সের পক্ষ থেকে মন্তব্য চেয়ে যোগাযোগ করা হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ই-মেইলের জবাব দেননি।

২০২০ সালে সীমান্তে সংঘর্ষে ২০ জনের বেশি সেনা নিহতের পর সৃষ্ট সামরিক অচলাবস্থা দূর করতে কাজ শুরু করেছে এশিয়ার দুই পরাশক্তি। তবে সম্পর্কের উন্নয়ন ধীরগতিতে হলেও সীমান্ত এলাকাগুলোর উন্নয়নে আরও ব্যয়ের লক্ষ্য ভারতের।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত