Ajker Patrika

পুতিনের প্রতিপক্ষের পরিণতি হয় ভয়াবহ, শেষ শিকার কি নাভালনি

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২৩: ৫২
Thumbnail image

অ্যালেক্সি নাভালনি নিকট অতীতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিলেন। সেই নাভালনি দেশটির উত্তর মেরুতে অবস্থিত কারাগারে মারা গেছেন আজ শুক্রবার। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। অনেকে ভাবছেন, নাভালনিও হয়তো পুতিনের অন্য শত্রুদের মতোই রহস্যময় পরিণতি বরণ করেছেন। 

বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, রুশ কারা কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘নাভালনি হাঁটাহাঁটির পর অসুস্থতা বোধ করেন এবং একটু পরই জ্ঞান হারান। দ্রুত চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্স দলকে ডাকা হয়। তাঁর জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়। পরে চিকিৎসকেরা তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ জানতে তদন্ত চলছে।’ 

এখন পর্যন্ত নাভালনির মৃত্যুর কারণ নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। রুশ সরকারও সেভাবে মুখ খুলছে না। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক নেতাই নাভালনির মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে মনে করছেন না। রাশিয়ার এক নির্বাসিত লেখক নাভালনির মৃত্যুকে ‘হত্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস বলেছেন, নাভালনি পুতিনের নির্মমতার শিকার। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, নাভালনির মৃত্যুর জন্য রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়া দায়ী। 

এমনকি গতকাল বৃহস্পতিবার যখন নাভালনিকে আদালতে তোলা হয়, তখনো তিনি তাঁর স্বাস্থ্য নিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি। খোদ রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম আরআইএ নভোস্তির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। আর এসব কারণেই এই আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে যে নাভালনি আসলেই স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। নাকি তিনিও পুতিনের অন্যান্য শত্রুর মতোই রহস্যজনকভাবে চিরপ্রস্থান করলেন। 

নাভালনি ছাড়াও আরও অনেকে পুতিনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেননি, এমনকি তাঁদের অনেকেরই রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। নাভালনি সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন। 

অ্যালেক্সি নাভালনি ছাড়াও পুতিনের যেসব প্রতিপক্ষ বিভিন্ন সময় রহস্যজনক করুণ পরিণতি বরণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন, ভ্লাদিমির কারামুরজা, আলেক্সান্ডার লিৎভিনেঙ্কো, আলেক্সান্ডার পেরিপিলিচনি, ভিক্তর ইউশচেঙ্কো এবং আনা পলিৎকোভস্কায়া উল্লেখযোগ্য। তাঁদের পরিণতি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:

অ্যালেক্সি নাভালনি
নাভালনির বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৭ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ইউলিয়া, মেয়ের নাম দারিয়া এবং ছেলের নাম জাহার। নাভালনি ১৯৭৬ সালে মস্কোর নিকটবর্তী শহর বায়তনে জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চশিক্ষা নেন অর্থনীতি ও আইন বিষয়ে। তিনি সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন ২০০৮ সালে এবং ২০১১ সালে দুর্নীতিবিরোধী মঞ্চ এফবিকে গঠন করেন। তাঁর রাজনৈতিক স্লোগান ছিল ‘আগামীর বিস্ময় রাশিয়া’। 

রাজনৈতিক জীবনে নাভালনি পুতিনের কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে রাশিয়ার দুর্নীতি ও কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার কড়া সমালোচক ছিলেন তিনি। রাশিয়ায় তিনি কয়েক যুগ ধরেই বিদ্যমান সরকার ও শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কথা বলে আসছিলেন। দেশজুড়ে এ নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় আন্দোলন সংগঠন করেছেন।

নাভালনি ২০১৭ সালে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভের বিলাসবহুল জীবনযাপনের বিষয়টি উন্মোচন করেন। এমনকি বিষয়টি নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনও গড়ে তোলেন তিনি। পরে ২০১৮ সালে নাভালনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পুতিনের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করা হয় ২০১৪ সালের একটি অভিযোগ সামনে এনে। 

এরপর ২০২০ সালের আগস্টে একটি সফরে নাভালনির খাবারের বিষ মিশিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সে সময় তাঁর খাবারে সামরিক নার্ভ এজেন্ট মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে নাভালনি অভিযোগ করেন, এই বিষয়টির সঙ্গে পুতিন জড়িত। তবে ক্রেমলিন এই অভিযোগ অস্বীকার করে। 

রাশিয়ার এই নেতাকে ২০২১ সালের শুরুর দিকেই গ্রেপ্তার করা হয় ২০১৪ সালে করা একটি অর্থ আত্মসাৎ মামলায়। দ্রুতই বিচারের মাধ্যমে তাঁকে আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে আদালত অবমাননার অভিযোগে তাঁকে আরও ৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০২১ সালের আগস্টে চরমপন্থার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নাভালনিকে আরও ১৯ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। 

ইয়েভজেনি প্রিগোঝিন
রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা সংস্থা ভাগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোঝিনকে বহনকারী বিমান বিধ্বস্ত হয় গত বছরের ২৪ আগস্ট। একসময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বেশ আস্থাভাজন ছিলেন প্রিগোঝিন। কিন্তু গত বছরের ২৩ ও ২৪ জুন রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পুতিনের চক্ষুশূল হন তিনি। তখন পুতিন প্রিগোঝিনকে কিছু না বললেও বিদ্রোহকে ‘গৃহযুদ্ধ’ শুরুর উদ্যোগ’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। 

যাহোক, পুতিন সে সময় প্রিগোঝিনকে ক্ষমা করে দিলেও বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি অনেক জল্পনাকল্পনার জন্ম দেয়। বিশেষ করে অনেকে তখন ভেবেছেন, হয়তো পুতিনের রোষের কারণেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে হলো। বিষয়টি যদিও স্পষ্ট নয়, তবে অমূলকও নয়। কারণ, এর আগেও পুতিনের অনেক ‘প্রতিপক্ষই’ অস্বাভাবিকভাবে প্রাণ হারিয়েছেন, নয়তো অন্য কোনোভাবে মৃত্যুর কাছাকাছি উপনীত হয়েছেন। 

ভ্লাদিমির কারামুরজা
রাশিয়ার বিরোধী রাজনীতিবিদ এবং অধিকারকর্মী ভ্লাদিমির কারামুরজা পুতিনবিরোধী মুখ বলে পরিচিত। তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁকে ২০১৫ ও ২০১৭ সালে বিষ প্রয়োগ করে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। পরে অবশ্য জার্মানির একটি গবেষণাগারে কারামুরজার শরীরের নমুনায় উচ্চ মাত্রার পারদ, তামা, ম্যাঙ্গানিজ এবং জিংকের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে মস্কো এই ঘটনাও নিজেদের সংযোগ অস্বীকার করে। 

সের্গেই স্ক্রিপাল
সের্গেই স্ক্রিপাল রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার ডবল এজেন্ট ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি রাশিয়ার গোয়েন্দা তথ্য ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাচার করা শুরু করেন। পরে ২০১৮ সালের মার্চে ব্রিটেনের স্যালিসবারি শহরে একটি শপিং সেন্টারের বাইরে একটি বেঞ্চে স্ক্রিপাল এবং তাঁর কন্যা ইউলিয়াকে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়।

আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা জানান, ওই দুজনকেই নভিচক বিষ দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক বাহিনীর গবেষকেরা ১৯৭০ থেকে ১৯৮০-এর দশকে এই বিষ আবিষ্কার করেন। পরে এই বিষের প্রভাব কাটিয়ে স্ক্রিপাল ও ইউলিয়া—দুজনেই বেঁচে যান। 

আলেক্সান্ডার লিৎভিনেঙ্কো
একসময় রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি ও দেশটির কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন আলেক্সান্ডার লিৎভিনেঙ্কো। পরে এই বাহিনীগুলোর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ করলে ১৯৯৮ সালে বহিষ্কার করা হয় তাঁকে। রাশিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তখন কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার প্রধান ছিলেন। 

এই অবস্থায় লিৎভিনেঙ্কোকে চিরতরে সরিয়ে দিতে ২০০৬ সালে কেজিবির দুই গোয়েন্দাকে যুক্তরাজ্যে পাঠান পুতিন। তাঁদেরই একজন ছিলেন আন্দ্রেই লুগোভই। লিৎভিনেঙ্কোর সঙ্গে লন্ডনের মিলেনিয়াম হোটেলে সাক্ষাৎ করে তাঁর চায়ের কাপে শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় ধাতু ‘পোলোনিয়াম’ ঢেলে দিয়েছিলেন লুগোভই। মারাত্মক ওই তেজস্ক্রিয়তায় ২৩ দিন ভুগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন লিৎভিনেঙ্কো। তবে মৃত্যুর আগে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই রাসায়নিক হামলার রহস্য উদ্ঘাটন করে গিয়েছিলেন তিনি। 

আলেক্সান্ডার পেরিপিলিচনি
রাশিয়া থেকে অর্থ পাচারের একটি মামলায় ২০০৯ সালে সুইজারল্যান্ডের কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করেছিলেন পেরিপিলিচনি। এরপর প্রাণভয়ে তিনি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। পরে ব্রিটেনেই নিবাস গড়েন। তিন বছর পর ২০১২ সালের নভেম্বরের এক সকালে জগিং করার জন্য বের হওয়ার পর বাড়ির মূল ফটকের সামনে তাঁর মরদেহ পাওয়া যায়। 

পেরিপিলিচনির মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ এমন বিষয় প্রমাণের অভাবে উড়িয়ে দেয়। তবে তাঁর পেটে জেলসেমিয়াম উদ্ভিদ থেকে তৈরি একটি বিরল এবং মারাত্মক বিষের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগের দিন পেরিপিলিচনি বড় এক বাটি ঐতিহ্যবাহী রুশ খাবার এবং স্যুপ খেয়েছিলেন। 

এই মৃত্যুর পর সন্দেহের তির রাশিয়ার দিকে উঠলেও মস্কো অভিযোগ অস্বীকার করেছে। 

ভিক্তর ইউশচেঙ্কো
ভিক্তর ইউশচেঙ্কো ইউক্রেনীয় রাজনীতিবিদ এবং দেশটির তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা। ২০০৪ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণার সময় তাঁর শরীরে বিষ প্রয়োগ করা হয়। তিনি সেই নির্বাচনে মস্কোপন্থী প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের মদতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। 

ইউশচেঙ্কো জানিয়েছিলেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক নৈশভোজের সময় তাঁর খাবারে বিষ মেশানো হয়েছিল। এরপর পরীক্ষায় তাঁর শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে ১ হাজার গুণ বেশি ডাইঅক্সিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই বিষক্রিয়ার ফলে তাঁর মুখমণ্ডল ও শরীর বিকৃত হয়ে গিয়েছিল এবং পরে বেশ কয়েক দফা অস্ত্রোপচার করে স্বাভাবিক হন তিনি। 

ইউক্রেনে সংঘটিত কমলা বিপ্লবের সময় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথমে ভিক্তর ইয়ানুকোভিচকে জয়ী ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পরে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সেই ফলাফল বাতিল ঘোষণা করেন। পরে দ্বিতীয় দফায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইউশচেঙ্কো বিপুল ভোটে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। 

অ্যানা পলিতকোভস্কায়া
মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক অ্যানা পলিতকোভস্কায়াকে ২০০৬ সালের ৭ অক্টোবর তাঁর ফ্ল্যাটের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলি করার ঠিক আগে অ্যানা স্থানীয় সুপারমার্কেট থেকে বাসায় ফিরেছিলেন। অ্যানার মৃত্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব জোর গলায় আওয়াজ তোলে রাশিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত