বিবিসির প্রতিবেদন
অনলাইন ডেস্ক
চীনের ওপর আরও নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত কয়েক মাসের মধ্যে এটি দ্বিতীয় দফায় শুল্ক বৃদ্ধি; যার ফলে চীনের পণ্য আমদানিতে এখন ২০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে এটি ট্রাম্পের সর্বশেষ পদক্ষেপ। এর আগে থেকেই চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর ১০০ শতাংশ, পোশাক ও জুতার ওপর ১৫ শতাংশসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই শুল্ক চীনের উৎপাদন শিল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত হানবে।
চীনে রয়েছে কারখানা, অ্যাসেম্বলি লাইন এবং সরবরাহ চেইনের বিশাল জাল এক ক্ষেত্র—যেখানে দ্রুত ফ্যাশন ও খেলনা থেকে শুরু করে সৌর প্যানেল ও বৈদ্যুতিক গাড়ি সবকিছুই তৈরি হয় এবং তা বিশ্বজুড়ে সরবরাহ করা হয়।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে চীনের রপ্তানি বাণিজ্যের আয় রেকর্ড ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর মূল কারণ ছিল শক্তিশালী রপ্তানি (৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলার), যা তাদের আমদানি ব্যয়কে (২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার) ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে বৈশ্বিক ব্যবসার জন্য অর্থনীতি উন্মুক্ত করার পর থেকে সস্তা শ্রম এবং অবকাঠামোতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের কারণে চীন বিশ্বের কারখানায় পরিণত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ চীনের উৎপাদনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে? চীন কি উৎপাদনে একচ্ছত্র দখল হারাবে?
শুল্ক হলো অন্য দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ধার্য করা কর। বেশির ভাগ শুল্ক পণ্যের মূল্যের শতাংশ হিসাবে নির্ধারিত হয় এবং সাধারণত আমদানিকারককেই এই শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। যেমন—১০ শতাংশ শুল্কের মানে হলো চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৪ ডলার মূল্যের কোনো পণ্য আমদানি করলে তার ওপর অতিরিক্ত শূন্য দশমিক ৪ ডলার শুল্ক দিতে হবে।
আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেশীয় ভোক্তাদের সস্তা দেশীয় পণ্য কিনতে উৎসাহিত করা এবং এর মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ানোই শুল্ক আরোপের মূল উদ্দেশ্য। ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপের বিষয়টিকে মার্কিন অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, কর্মসংস্থান রক্ষা এবং রাজস্ব বাড়ানোর একটি উপায় হিসাবে দেখেছেন। তবে ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে যে শুল্ক আরোপ করেছিলেন, তার অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে করা বিভিন্ন গবেষণা বলছে, শেষ পর্যন্ত এই পদক্ষেপ মার্কিন ভোক্তাদের জন্য জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
ট্রাম্প বলেছেন, ফেন্টানিল নামক মাদকের চোরাচালান বন্ধে তিনি এই শুল্ক আরোপের পদক্ষেপ নিয়েছেন। উক্ত দেশগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করাই এর মূল উদ্দেশ্য। তিনি একই অভিযোগে মেক্সিকো এবং কানাডার ওপরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
তবে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ কি চীনের কারখানাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে? বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, হ্যাঁ, পারবে।
মুডি’স অ্যানালিটিক্সের অর্থনীতিবিদ হ্যারি মারফি ক্রুজ বিবিসিকে বলেন, রপ্তানি আয় চীনের অর্থনীতির একমাত্র উৎস। তাই এই শুল্ক দীর্ঘস্থায়ী হলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি এক-চতুর্থাংশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। যেহেতু চীনের রপ্তানি আয় দেশটির মোট আয়ের এক পঞ্চমাংশ সেহেতু, ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে তাদের পণ্যের ওপর বিদেশের চাহিদা কমে যেতে পারে এবং এতে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হ্রাস পেতে পারে।
হংকংভিত্তিক বিনিয়োগ পরামর্শদানকারী প্রতিষ্ঠান নেটিক্সিসের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া-হেরেরো বিবিসিকে বলেন, ‘শুল্ক চীনের ক্ষতি করবে। তাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে। সি চিন পিং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর কথা বলেছেন—এখন সেটাই বেশি জরুরি।’ তবে যেখানে নিজেদের বাজার নিম্নমুখী এবং হতাশ যুবকেরা উচ্চ বেতনের চাকরির জন্য লড়াই করছে, সেখানে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো কঠিন কাজ। এদিকে চীনারা অর্থনীতিকে চাঙা করতে নিজেরা যথেষ্ট খরচ করছে না। এ জন্য বেইজিং নাগরিকদের খরচ বাড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে।
তবে বিশ্লেষকেরা এটাও বলছেন, মার্কিন শুল্ক চীনা উৎপাদন খাতের গতি কমিয়ে দিলেও সহজে তাদের কারখানাগুলো বন্ধ করতে পারবে না। গার্সিয়া-হেরেরো বলেন, ‘চীন শুধু বড় রপ্তানিকারক নয়, কিছু ক্ষেত্রে তারা একমাত্র রপ্তানিকারক। যেমন—সৌর প্যানেলের ক্ষেত্রে। আপনি যদি সৌর প্যানেল চান, তবে আপনাকে চীনের কাছেই যেতে হবে।’
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার অনেক আগে থেকেই চীন পোশাক ও জুতা তৈরি থেকে রোবোটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মতো উন্নত প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছিল। এর ফলে চীন ‘আর্লি মুভার’ হিসেবে সুবিধা পেয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির বিশাল উৎপাদন সক্ষমতা তো রয়েছেই।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের প্রধান চীনা অর্থনীতিবিদ শুয়াং ডিং বলেন, ‘চীনা কারখানাগুলো কম খরচে বিপুল পরিমাণে হাই-এন্ড টেক পণ্য উৎপাদন করতে পারে। এর বিকল্প খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন—বাজারের নেতা হিসাবে চীনের মর্যাদাকে টলানো খুব কঠিন।’
চীন মার্কিন কৃষিপণ্য, কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, পিকআপ ট্রাক এবং কিছু স্পোর্টস কারের ওপর ১০-১৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এ ছাড়া, তারা বিমান, প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং গুগলের বিরুদ্ধে একটি অ্যান্টি-মনোপলি তদন্তের ঘোষণা করেছে।
এ ছাড়া চীন ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের শুল্কের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার জন্য গত কয়েক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে। যেমন—কিছু চীনা কিছু প্রতিষ্ঠান দেশ থেকে তাদের কারখানা সরিয়ে নিয়েছে। অনেকে শুল্ক এড়াতে ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। যারা এসব দেশে থেকেই রপ্তানি করছে।
অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া-হেরেরো বলেন, ‘মেক্সিকোর ওপর ট্রাম্পের সাম্প্রতিক শুল্ক চীনের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না, কারণ চীনের পণ্যের জন্য ভিয়েতনাম একটি বড় ব্যাক ডোর।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে ভিয়েতনামই মূল বিষয়। যদি ভিয়েতনামের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়, তবে আমি মনে করি এটি চীনের জন্য খুব কঠিন হবে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের জন্য শুল্কের চেয়েও বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো উন্নত চিপসের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞা দুটি দেশের মধ্যে একটি বড় সমস্যা তৈরি করেছে। তবে এর একটি ভালো দিকও আছে। এই নিষেধাজ্ঞা চীনকে পশ্চিমা বিশ্বের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজস্ব প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেছে।
এ কারণেই চীনা এআই ফার্ম ডিপসিক (DeepSeek) সিলিকন ভ্যালিকে চমকে দিয়ে ওয়াশিংটনকে উদ্বিগ্ন করেছে। কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের উন্নত চিপসের সরবরাহ বন্ধ করার আগে থেকেই এনভিডিয়া চিপসের মজুত গড়ে তুলেছিল।
প্রধান চীনা অর্থনীতিবিদ শুয়াং ডিং মনে করেন, ‘যদিও এটি চীনের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে, তবে আমি মনে করি না যে এটি একটি উৎপাদন শক্তি হিসেবে চীনের মর্যাদাকে প্রভাবিত করবে।’ অন্যদিকে, উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে চীন আরও অগ্রগতি অর্জন করবে, যা তাদের উচ্চমূল্যের রপ্তানিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রীয় সমর্থন, অপ্রতিদ্বন্দ্বী সরবরাহব্যবস্থা এবং সস্তা শ্রমের কারণে উৎপাদনের ক্ষেত্রে চীন একটি পরাশক্তি হয়ে উঠছে। দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিশ্লেষক চিম লি বিবিসিকে বলেন, ‘বৈশ্বিকীকরণ, সেই সঙ্গে চীনের ব্যবসাবান্ধব নীতি এবং বাজারের সম্ভাবনা—এই তিনটি বিষয় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেছে।’
এরপর সরকার কাঁচামাল আনা এবং চীনা পণ্য বিশ্ববাজারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাস্তাঘাট ও বন্দরের বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরিতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করে। চীনা ইউয়ান এবং মার্কিন ডলারের মধ্যে স্থিতিশীল বিনিময় হারও এ ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নত প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ দেওয়ায়, চীন ভবিষ্যতে প্রাসঙ্গিক এবং প্রতিযোগীদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ম্যানুফ্যাকচারিং পাওয়ার হাউস হওয়ার সুবাদে ইতিমধ্যেই চীনের যথেষ্ট অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। তবে ট্রাম্পের শুল্ক বিশ্ব মঞ্চে আমেরিকার সম্পর্কের অবনতি ঘটানোয়, চীনের জন্য একটি রাজনৈতিক সুযোগও তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিবিদ হ্যারি মারফি ক্রুজ বলেন, ‘এর ফলেই চীনের জন্য মুক্তবাণিজ্য এবং একটি স্থিতিশীল বিশ্ব শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।’
তবে বেইজিংও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। যেমন—২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওয়াইনের ওপর ২০০ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপ করার অভিযোগ থাকায়, চীনের জন্য বিষয়টি সহজ হবে না। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও চীনের তাকানো উচিত। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এখনো তাদের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য। কানাডা ও মেক্সিকোর পর যুক্তরাষ্ট্রই চীনের পণ্য রপ্তানির তৃতীয় বৃহত্তম বাজার।
এদিকে ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার সঙ্গেও চীনের বাণিজ্য বাড়ছে। তবে বিশ্বের বৃহত্তম দুটি অর্থনীতির দেশ একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা কীভাবে কমাবে, তা কল্পনা করাই কঠিন।
চীনের ওপর আরও নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত কয়েক মাসের মধ্যে এটি দ্বিতীয় দফায় শুল্ক বৃদ্ধি; যার ফলে চীনের পণ্য আমদানিতে এখন ২০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে এটি ট্রাম্পের সর্বশেষ পদক্ষেপ। এর আগে থেকেই চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর ১০০ শতাংশ, পোশাক ও জুতার ওপর ১৫ শতাংশসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই শুল্ক চীনের উৎপাদন শিল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত হানবে।
চীনে রয়েছে কারখানা, অ্যাসেম্বলি লাইন এবং সরবরাহ চেইনের বিশাল জাল এক ক্ষেত্র—যেখানে দ্রুত ফ্যাশন ও খেলনা থেকে শুরু করে সৌর প্যানেল ও বৈদ্যুতিক গাড়ি সবকিছুই তৈরি হয় এবং তা বিশ্বজুড়ে সরবরাহ করা হয়।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে চীনের রপ্তানি বাণিজ্যের আয় রেকর্ড ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর মূল কারণ ছিল শক্তিশালী রপ্তানি (৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলার), যা তাদের আমদানি ব্যয়কে (২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার) ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে বৈশ্বিক ব্যবসার জন্য অর্থনীতি উন্মুক্ত করার পর থেকে সস্তা শ্রম এবং অবকাঠামোতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের কারণে চীন বিশ্বের কারখানায় পরিণত হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ চীনের উৎপাদনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে? চীন কি উৎপাদনে একচ্ছত্র দখল হারাবে?
শুল্ক হলো অন্য দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ধার্য করা কর। বেশির ভাগ শুল্ক পণ্যের মূল্যের শতাংশ হিসাবে নির্ধারিত হয় এবং সাধারণত আমদানিকারককেই এই শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। যেমন—১০ শতাংশ শুল্কের মানে হলো চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৪ ডলার মূল্যের কোনো পণ্য আমদানি করলে তার ওপর অতিরিক্ত শূন্য দশমিক ৪ ডলার শুল্ক দিতে হবে।
আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেশীয় ভোক্তাদের সস্তা দেশীয় পণ্য কিনতে উৎসাহিত করা এবং এর মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ানোই শুল্ক আরোপের মূল উদ্দেশ্য। ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপের বিষয়টিকে মার্কিন অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, কর্মসংস্থান রক্ষা এবং রাজস্ব বাড়ানোর একটি উপায় হিসাবে দেখেছেন। তবে ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে যে শুল্ক আরোপ করেছিলেন, তার অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে করা বিভিন্ন গবেষণা বলছে, শেষ পর্যন্ত এই পদক্ষেপ মার্কিন ভোক্তাদের জন্য জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
ট্রাম্প বলেছেন, ফেন্টানিল নামক মাদকের চোরাচালান বন্ধে তিনি এই শুল্ক আরোপের পদক্ষেপ নিয়েছেন। উক্ত দেশগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করাই এর মূল উদ্দেশ্য। তিনি একই অভিযোগে মেক্সিকো এবং কানাডার ওপরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
তবে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ কি চীনের কারখানাগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে? বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, হ্যাঁ, পারবে।
মুডি’স অ্যানালিটিক্সের অর্থনীতিবিদ হ্যারি মারফি ক্রুজ বিবিসিকে বলেন, রপ্তানি আয় চীনের অর্থনীতির একমাত্র উৎস। তাই এই শুল্ক দীর্ঘস্থায়ী হলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি এক-চতুর্থাংশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। যেহেতু চীনের রপ্তানি আয় দেশটির মোট আয়ের এক পঞ্চমাংশ সেহেতু, ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে তাদের পণ্যের ওপর বিদেশের চাহিদা কমে যেতে পারে এবং এতে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হ্রাস পেতে পারে।
হংকংভিত্তিক বিনিয়োগ পরামর্শদানকারী প্রতিষ্ঠান নেটিক্সিসের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া-হেরেরো বিবিসিকে বলেন, ‘শুল্ক চীনের ক্ষতি করবে। তাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে। সি চিন পিং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর কথা বলেছেন—এখন সেটাই বেশি জরুরি।’ তবে যেখানে নিজেদের বাজার নিম্নমুখী এবং হতাশ যুবকেরা উচ্চ বেতনের চাকরির জন্য লড়াই করছে, সেখানে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো কঠিন কাজ। এদিকে চীনারা অর্থনীতিকে চাঙা করতে নিজেরা যথেষ্ট খরচ করছে না। এ জন্য বেইজিং নাগরিকদের খরচ বাড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে।
তবে বিশ্লেষকেরা এটাও বলছেন, মার্কিন শুল্ক চীনা উৎপাদন খাতের গতি কমিয়ে দিলেও সহজে তাদের কারখানাগুলো বন্ধ করতে পারবে না। গার্সিয়া-হেরেরো বলেন, ‘চীন শুধু বড় রপ্তানিকারক নয়, কিছু ক্ষেত্রে তারা একমাত্র রপ্তানিকারক। যেমন—সৌর প্যানেলের ক্ষেত্রে। আপনি যদি সৌর প্যানেল চান, তবে আপনাকে চীনের কাছেই যেতে হবে।’
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার অনেক আগে থেকেই চীন পোশাক ও জুতা তৈরি থেকে রোবোটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মতো উন্নত প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছিল। এর ফলে চীন ‘আর্লি মুভার’ হিসেবে সুবিধা পেয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির বিশাল উৎপাদন সক্ষমতা তো রয়েছেই।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের প্রধান চীনা অর্থনীতিবিদ শুয়াং ডিং বলেন, ‘চীনা কারখানাগুলো কম খরচে বিপুল পরিমাণে হাই-এন্ড টেক পণ্য উৎপাদন করতে পারে। এর বিকল্প খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন—বাজারের নেতা হিসাবে চীনের মর্যাদাকে টলানো খুব কঠিন।’
চীন মার্কিন কৃষিপণ্য, কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস, পিকআপ ট্রাক এবং কিছু স্পোর্টস কারের ওপর ১০-১৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এ ছাড়া, তারা বিমান, প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং গুগলের বিরুদ্ধে একটি অ্যান্টি-মনোপলি তদন্তের ঘোষণা করেছে।
এ ছাড়া চীন ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের শুল্কের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার জন্য গত কয়েক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে। যেমন—কিছু চীনা কিছু প্রতিষ্ঠান দেশ থেকে তাদের কারখানা সরিয়ে নিয়েছে। অনেকে শুল্ক এড়াতে ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। যারা এসব দেশে থেকেই রপ্তানি করছে।
অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া-হেরেরো বলেন, ‘মেক্সিকোর ওপর ট্রাম্পের সাম্প্রতিক শুল্ক চীনের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না, কারণ চীনের পণ্যের জন্য ভিয়েতনাম একটি বড় ব্যাক ডোর।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে ভিয়েতনামই মূল বিষয়। যদি ভিয়েতনামের ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়, তবে আমি মনে করি এটি চীনের জন্য খুব কঠিন হবে।’
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের জন্য শুল্কের চেয়েও বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো উন্নত চিপসের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞা দুটি দেশের মধ্যে একটি বড় সমস্যা তৈরি করেছে। তবে এর একটি ভালো দিকও আছে। এই নিষেধাজ্ঞা চীনকে পশ্চিমা বিশ্বের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নিজস্ব প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেছে।
এ কারণেই চীনা এআই ফার্ম ডিপসিক (DeepSeek) সিলিকন ভ্যালিকে চমকে দিয়ে ওয়াশিংটনকে উদ্বিগ্ন করেছে। কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের উন্নত চিপসের সরবরাহ বন্ধ করার আগে থেকেই এনভিডিয়া চিপসের মজুত গড়ে তুলেছিল।
প্রধান চীনা অর্থনীতিবিদ শুয়াং ডিং মনে করেন, ‘যদিও এটি চীনের প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে, তবে আমি মনে করি না যে এটি একটি উৎপাদন শক্তি হিসেবে চীনের মর্যাদাকে প্রভাবিত করবে।’ অন্যদিকে, উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে চীন আরও অগ্রগতি অর্জন করবে, যা তাদের উচ্চমূল্যের রপ্তানিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রীয় সমর্থন, অপ্রতিদ্বন্দ্বী সরবরাহব্যবস্থা এবং সস্তা শ্রমের কারণে উৎপাদনের ক্ষেত্রে চীন একটি পরাশক্তি হয়ে উঠছে। দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিশ্লেষক চিম লি বিবিসিকে বলেন, ‘বৈশ্বিকীকরণ, সেই সঙ্গে চীনের ব্যবসাবান্ধব নীতি এবং বাজারের সম্ভাবনা—এই তিনটি বিষয় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেছে।’
এরপর সরকার কাঁচামাল আনা এবং চীনা পণ্য বিশ্ববাজারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাস্তাঘাট ও বন্দরের বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরিতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করে। চীনা ইউয়ান এবং মার্কিন ডলারের মধ্যে স্থিতিশীল বিনিময় হারও এ ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নত প্রযুক্তির দিকে মনোযোগ দেওয়ায়, চীন ভবিষ্যতে প্রাসঙ্গিক এবং প্রতিযোগীদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
ম্যানুফ্যাকচারিং পাওয়ার হাউস হওয়ার সুবাদে ইতিমধ্যেই চীনের যথেষ্ট অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। তবে ট্রাম্পের শুল্ক বিশ্ব মঞ্চে আমেরিকার সম্পর্কের অবনতি ঘটানোয়, চীনের জন্য একটি রাজনৈতিক সুযোগও তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিবিদ হ্যারি মারফি ক্রুজ বলেন, ‘এর ফলেই চীনের জন্য মুক্তবাণিজ্য এবং একটি স্থিতিশীল বিশ্ব শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।’
তবে বেইজিংও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। যেমন—২০২০ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওয়াইনের ওপর ২০০ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপ করার অভিযোগ থাকায়, চীনের জন্য বিষয়টি সহজ হবে না। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও চীনের তাকানো উচিত। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এখনো তাদের রপ্তানির প্রধান গন্তব্য। কানাডা ও মেক্সিকোর পর যুক্তরাষ্ট্রই চীনের পণ্য রপ্তানির তৃতীয় বৃহত্তম বাজার।
এদিকে ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার সঙ্গেও চীনের বাণিজ্য বাড়ছে। তবে বিশ্বের বৃহত্তম দুটি অর্থনীতির দেশ একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা কীভাবে কমাবে, তা কল্পনা করাই কঠিন।
ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অবস্থান নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে। সর্বশেষ আজ বৃহস্পতিবার বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে এক হয়েছেন ইউরোপের নেতারা। জেলেনস্কিকে তাঁরা বলেছেন—ইউরোপ রাশিয়ার চেয়ে শক্তিশালী। ইউক্রেনকে রক্ষা করতে তাঁরা প্রস্তুত।
৪ মিনিট আগেএপ্রিলের শুরুতেই এই পদক্ষেপ কার্যকর হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিদায়ের আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন অভিবাসীদের সুরক্ষায় এই অস্থায়ী আইনি মর্যাদা অনুমোদন করেন। গত সপ্তাহে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রকাশ্য বিরোধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই...
৩৭ মিনিট আগেযুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যবস্থা ধ্বংস করছে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ভ্যালেরি জালুঝনি। আজ বৃহস্পতিবার লন্ডনের চ্যাথাম হাউসে এক সম্মেলনে বক্তব্য রাখার সময় তিনি বলেন, নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির ধরন পশ্চিমা বিশ্বের ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র,
২ ঘণ্টা আগেইউক্রেনের নিরাপত্তায় যুক্তরাজ্য নেতৃত্ব দেবে বলে বক্তব্য দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার। আজ বৃহস্পতিবার রাতে বিবিসি জানিয়েছে, লিভারপুলের একটি প্রতিরক্ষা কারখানায় শ্রমিক ও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি ওই বক্তব্য দেন।
৩ ঘণ্টা আগে