Ajker Patrika

মান যাচাই ছাড়াই বাজারে চিকিৎসা সরঞ্জাম

আয়নাল হোসেন, ঢাকা
মান যাচাই ছাড়াই বাজারে চিকিৎসা সরঞ্জাম

পুরান ঢাকার চাল ব্যবসায়ী ইব্রাহিম সরকার প্রতিদিনই রমনা পার্কে হাঁটতে যান। হাঁটাহাঁটি শেষে পার্কের পাশের একটি ভাসমান দোকান থেকে স্বল্প খরচে রক্তের চাপ ও রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ পরীক্ষা করান। তবে মাঝেমধ্যেই মেশিনে সঠিক ফল আসে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তবে ইব্রাহিম সরকারের মতো সবাই এখন আর বাইরে এসব পরীক্ষা করান না। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশনসহ নানা রোগব্যাধি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। অনেকে এখন প্রেশার বা রক্তের চাপ মাপার মেশিন, ডিজিটাল থার্মোমিটার, ওজন মাপার যন্ত্র, ডায়াবেটিস পরিমাপের যন্ত্র ঘরেই রাখেন। কিন্তু আমদানি করা এসব মেডিকেল যন্ত্রপাতির মান যাচাই করা হচ্ছে না। এগুলোর পরীক্ষার ফলাফল নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। অথচ এসব যন্ত্রের রোগের পরিমাপ সঠিক কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমদানির পর জাতীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-এর ন্যাশনাল মেটেরোলজি ল্যাব (এনএমএল) বিভাগ এসব যন্ত্রের ক্যালিব্রেশন (পরিমাপের সূক্ষ্মতা নির্ণয়) ও ভেরিফিকেশন করে। কিন্তু এটি বাধ্যতামূলক নয়। তাই ক্যালিব্রেশনে খরচ আছে বিধায় বেশির ভাগ আমদানিকারক বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। উৎপাদনকারী কোম্পানির দেওয়া ভেরিফিকেশন ও ক্যালিব্রেশনেই এসব যন্ত্রপাতি বাজারজাত হচ্ছে।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজীর আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, মেডিকেল যন্ত্রপাতির ক্যালিব্রেশন ও ভেরিফিকেশন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যন্ত্রপাতি সঠিক না হলে ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। একই সঙ্গে এসব যন্ত্রপাতি কিনে ভোক্তা রীতিমতো প্রতারণার শিকার হওয়ার শঙ্কা থাকে।

উত্তরার বাসিন্দা রাফি হোসেনের কথায় প্রমাণ মেলে প্রতারণার। ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর তিনি একটি ওষুধের দোকান থেকে ডায়াবেটিস পরিমাপক (গ্লুকোমিটার) যন্ত্র কেনেন। কিন্তু তাঁর সেই যন্ত্রে ডায়াবেটিস অবিশ্বাস্য রকম কম রিডিং দেখাচ্ছিল। সন্দেহ হলে তিনি পরে হাসপাতালে গিয়ে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করেন। এতে দেখা যায়, তাঁর কেনা যন্ত্রের চেয়ে হাসপাতালের পরীক্ষায় রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অনেক বেশি দেখাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের প্রধান প্যাথলজিস্ট আলমাস উদ্দিন বলেন, রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি ক্যালিব্রেশন, ভেরিফিকেশন ছাড়াও নিয়মিত কিউসি (মান নিয়ন্ত্রণ) করতে হয়। এটি করা না হলে একই পরীক্ষা ভিন্ন ল্যাবে ভিন্ন ফল দেবে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত বিশ্বের রোগ নির্ণয়ের জন্য আমদানি করা মেডিকেল যন্ত্রপাতি বাজারজাত করার আগে বিভিন্ন সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। যেমন: যুক্তরাষ্ট্রে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ), ইউরোপের ইইউ এবং সিইর মতো প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন লাগে। এসব যন্ত্রপাতি আমদানির পর মান যাচাই বাধ্যতামূলক করা হলে আমদানিকারকেরা তা মানতে বাধ্য হবেন।

মেডিকেল যন্ত্রপাতি শতভাগই আমদানিনির্ভর। চীন, থাইল্যান্ড, জাপান, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব যন্ত্রপাতি আমদানি হয়। তবে টাকা খরচের ভয়ে বিএসটিআইয়ের এনএমএল বিভাগ থেকে আমদানিকারকেরা যন্ত্রপাতি ক্যালিব্রেশন করেন না। এই সুযোগে তাঁরা নিম্নমানের যন্ত্রপাতি আমদানি করে বাজারজাত করেন। এতে ঠকছেন ক্রেতা। শুধু তাই নয়, ভুল রিডিংয়ের কারণে এসব যন্ত্রপাতির ব্যবহারকারীকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে।
বিএসটিআই সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে ন্যাশনাল মেটেরোলজি ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর থেকে বিগত সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখান থেকে প্রায় ২৮ হাজার যন্ত্রের ভেরিফিকেশন ও ক্যালিব্রেশন করেছে।

বিএসটিআইয়ের পরিচালক (প্রশাসন) তাহের জামিল বলেন, প্রেশার মেশিন, থার্মোমিটার ও ওয়েট মিটার—এই তিনটি যন্ত্রের ক্যালিব্রেশন করা উচিত। তবে বাধ্যবাধকতা না থাকায় আমদানিকারকেরা সুযোগ নিচ্ছেন। অর্থ বাঁচাতে তাঁরা ক্যালিব্রেশন করান না।

সূত্র জানায়, দেশে মেডিকেল যন্ত্রপাতির গুণাগুণ পরীক্ষার কোনো কর্তৃপক্ষ ছিল না। ২০১৫ সালে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর মেডিকেল ডিভাইস গাইডলাইন তৈরি করে। কিন্তু আমদানি করা যন্ত্রপাতির মান যাচাইয়ের সক্ষমতা ঔষধ প্রশাসনের নেই। যন্ত্রপাতির সঠিক পরিমাপ জানতে হলে বিএসটিআই থেকে ভেরিফিকেশন ও ক্যালিব্রেশন দরকার।

জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আইয়ূব হোসেন বলেন, আমদানিকারকেরা নিজেরাই যন্ত্রপাতি ক্যালিব্রেশন করে। অনেক সময় তৃতীয় কোনো মাধ্যমেও এটি করা হচ্ছে। তবে বিএসটিআইয়ের মেটেরোলজি ল্যাব থেকে করা হচ্ছে কি না, সেটি তাঁর জানা নেই।

মেডিকেল যন্ত্র আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হেলথওয়ের মালিক নূর হোসেন বলেন, ওজন মাপার যন্ত্র ক্যালিব্রেশন করা হচ্ছে। কিন্তু প্রেশার, থার্মোমিটার, ডায়াবেটিস মেশিন ক্যালিব্রেশন করা হচ্ছে না। সরকার বাধ্যতামূলক করলে সবাই সেটি করবে। তবে এটি বাধ্যতামূলক করা হলে আমদানিকারকদের ভোগান্তি বাড়বে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত